জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর উপর দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনে প্রভাব রাখে। এই পরিবর্তন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং বাস্তুতন্ত্র উভয়কেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে বহু প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এছাড়া মানবজাতির জন্যও এই পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
যদিও জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সকলের জন্য হুমকিস্বরূপ, তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে এর কারণে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে আছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের ৮০% নারী। দীর্ঘস্থায়ী খরা, স্বল্প খাদ্য উৎপাদন, এবং বৈরী আবহাওয়ার অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব নারীদের উপরই বেশি পড়ে। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেখানে ১৫০ কোটিরও বেশি নারী প্রতিদিন ১ ডলারেরও কম আয় করেন। বিশ্বব্যাপী, ২৫-৩৪ বছর বয়সী নারীদের চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় ২৫% বেশি।
বিশ্বের বেশিরভাগ নারীকে এই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আরও সংবেদনশীল করে তোলে। নারীরা পানি, খাদ্য, এবং জ্বালানির প্রাথমিক সংগ্রাহক। তাদের কেউ কেউ কৃষিকাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক বৈশ্বিক হালে বাসায় বাচ্চাদের যত্ন, এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বও তাদের উপর। এই দায়িত্বগুলোতে পরিবেশগত অবক্ষয় এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রার প্রভাব অনুভব করার প্রবণতা বেশি। কারণ তারা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর খুব বেশি নির্ভর করেন। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নারীরা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়। ভবিষ্যতে, এটি ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, নারী ও মেয়েরা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হলেও, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের উপায় এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বও দিচ্ছেন। এছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নিয়ে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, সেখানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। গবেষণায় দেখা যায়, এই ভূমিকাগুলোর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্যকে পরিবর্তন করতে পারে এবং জলবায়ু সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে পারে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে আমরা নারীদের পদক্ষেপ নেয়ার উদাহরণ দেখতে পাই।
- বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীরা পরিবারের জন্য ঝড় ও বন্যা প্রতিরোধী আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
- হারিকেন মারিয়া পুয়ের্তো রিকোতে আছড়ে পড়ার পর স্থপতি কার্লা গৌটিয়ার (Carla Gautier) তার বন্ধু মারিয়া গ্যাব্রিয়েলা ভেলাসকো (Maria Gabriela Velasco) এক হন। তারা শিপিং কনটেইনারগুলোকে একত্রিত করে দ্বীপ জুড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া তিন লক্ষাধিক বাড়ি পুনর্নির্মাণ করেন।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বকে জানানোর জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশের স্থানীয় নারীরা ফিজিতে মিডিয়া নেটওয়ার্ক এবং মনিটরিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছে।
- গ্রামীণ সুদানের একদল নারী সেখানকার খরা ও দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতির জন্য প্রথম নারী কৃষক ইউনিয়ন গঠন করেছে।
- নিকারাগুয়ায় হারিকেন তীব্রতর আর প্রবল হয়ে ওঠার কারণে সেখানকার আদিবাসী মহিলারা এগিয়ে আসে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বীজ ব্যাংক তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়।
এ থেকে বোঝা যায়- নারীরা দুর্যোগ পরিকল্পনা এবং জরুরি পরিস্থিতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ বা ক্ষমতা পেলে, তারা অসাধারণ জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে।
নারীরা সামাজিক ও পরিবেশগত আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে পদক্ষেপ নিয়েছে। যখন ‘ডাকোটা এক্সেস পাইপলাইন’ কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাকোটা রাজ্যের স্থানীয় জনগণের জমিতে তেলের পাইপলাইন স্থাপন করতে যায়, তখন লাডোনা ব্রেভ বুল অ্যালার্ড এর নির্মাণের বিরোধিতা করেন। তিনি এর বিরুদ্ধে বৈশ্বিক আন্দোলন শুরু করেন। ২০২০ এর জুলাই মাসে, রাজ্যের ফেডারেল বিচারক সিউক্সের উপজাতির (Standing Rock Sioux Tribe) পক্ষে রায় দেন এবং পরিবেশের উপর এই পাইপলাইনের প্রভাব বিশ্লেষণের আদেশ দেন। ফলশ্রুতিতে ২০২১ সালে পাইপলাইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়।
কেনিয়াকে মরুকরণের হাত থাকে বাঁচাতে এবং তার সম্প্রদায়ের নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ওয়াঙ্গারি মাথাই ছয় হাজার গাছের নার্সারি তৈরি করেছেন। তার এই কাজ আফ্রিকান-নেতৃত্বাধীন ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে, যার লক্ষ্য সাহেলজুড়ে ৮,০০০ কি.মি. বৃক্ষের বেষ্টনী তৈরি করা। আশা করা যায়- এটি বিপুল পরিমাণে কার্বন গ্রহণ ও পরিশোধন করার পাশাপাশি জনজীবনকে পরিবর্তন করবে।
যখন ইকুয়েডরের সরকার আমাজনের আদিবাসীদের সাত মিলিয়ন একর জমি তেল কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে যাচ্ছিল, তখন আদিবাসী নারী নেমন্টে নেনকুইমো একটি সম্প্রদায়িক মামলার নেতৃত্ব দেন। আদালত ওয়াওরানি জনগণের পক্ষে রায় দিয়েছে। ফলে তেল উত্তোলন থেকে জমি রক্ষা পেয়েছে এবং পরবর্তী নিলামের আগে তাদের কাছ থেকে সম্মতি নেয়া বাধ্যতামূলক করেছে।
হন্ডুরাসে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ তৈরি প্রতিষ্ঠান আগা জারকা গুয়ালকার্ক নদীতে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। নদীটি ছিল লেনকা জনগণের কাছে পবিত্র, আর বাঁধ নির্মাণের ফলে তাদের পানি, খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে, এবং এটি পরিবেশেরও নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বার্টা ক্যাসেরেস সেখানকার জনগণকে নিয়ে তৃণমূল প্রচারণা চালান, যার ফলে প্রকল্পটি সফলভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া এটি আদিবাসীদের অধিকার নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন ছিল বলেও প্রমাণিত হয়।
কোভিড-১৯ এ নারী নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকা দেশগুলো অন্যান্যদের তুলনায় বেশি সাফল্য দেখিয়েছে। ১৯৪টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, নারীদের নেতৃত্বে দেশগুলোতে মহামারীর বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপগুলো পদ্ধতিগতভাবে ভাল ছিল। এটি আরও দেখায় যে, নারী সরকারপ্রধান দেশগুলোতে কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহারও কম ছিল। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি উদ্ভাবনী এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বিশ্বজুড়ে ১৭টি গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নারীদের উপস্থিতির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণে কঠোর এবং আরও টেকসই নীতি নির্ধারণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সহযোগিতা এবং দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণাটি আরও দেখিয়েছে যে নারীরা এককের চেয়ে সামষ্টিকভাবে চিন্তা করে। নারীদের সেসব সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়, যা জনসাধারণের কল্যাণে সহায়তা করে, ন্যায্য বেতন এবং সুবিধা প্রদান করে এবং সৎ ও নৈতিক আচরণকে উৎসাহিত করে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী যখন নারীরা এগিয়ে যায়, তখন সামগ্রিকভাবে ওই দেশের মানুষ এবং সমাজের জন্য প্রচুর সুবিধা হয়। টেকসই এবং স্থানীয় অর্থনীতি বৃদ্ধি পায়, জনসংখ্যা স্থিতিশীল হয় এবং শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার স্তরের উন্নতি হয়— এগুলো সবই ভবিষ্যতের টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি। গবেষণা দেখায় যে, যেখানে নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা বেশি, তাদের দেশে কার্বন নিঃসরণ ১২% কম। অনেক দেশেই নারীরা ভোট গ্রহণের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেন এবং সরকারি পদে নির্বাচিত হওয়ার সময় তারা পরিবেশগত ও সামাজিক আইন প্রণয়নেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন এবং তার ৪০% নারী নিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভা একটি ‘জলবায়ু জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সরকারি খাতসমূহ কার্বন নিরপেক্ষ করার পরিকল্পনা তৈরি করে।
পরিবেশ আন্দোলন নারীদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল। র্যাচেল কারসনের বই সাইলেন্ট স্প্রিং পৃথিবীকে নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার জন্য একটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এটি শেষপর্যন্ত ধরিত্রী দিবসের প্রতিষ্ঠা এবং মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা তৈরির পথ সুগম করে। সিলভিয়া আর্লে একজন সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, সমুদ্রবিজ্ঞানী এবং অভিযাত্রী। তিনি ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবেশ ও সামুদ্রিক প্রশাসনের প্রথম নারী প্রধান বিজ্ঞানী। মহাসাগরে অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং দূষণের অবসান ঘটানোর জন্য তার নেয়া পদক্ষেপগুলো ছিল কার্যকর এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। এই নারীদের প্রত্যেকেই আমাদের গ্রহকে সংরক্ষণের জন্য প্রভাবশালী সংগঠক হিসেবে কাজ করে চলেছেন, এবং আরও শত শত নারী তাদের দলে যোগদান করছে।
গ্রেটা থুনবার্গের কথা কম-বেশি আমরা সকলেই জানি। সে একজন সুইডিশ পরিবেশকর্মী। ১৯ বছরের এই তরুণী ২০১৮ সাল থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি ও আন্দোলন করে আসছে। প্রথমদিকে তার বিক্ষোভ ছিল সুইডিশ সরকারের জলবায়ু বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার বিপক্ষে। তবে পরে সে বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানায় যেন তারা তাদের নিজ নিজ দেশে একই ধরনের দাবি তুলে ধরে এবং প্রতিবাদ শুরু করে। গ্রেটার মতে, বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সরকাররা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখার জন্য যথেষ্ট দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গ্রেটার এরূপ সাহসী পদক্ষেপের জন্য সে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ও পুরস্কার অর্জন করে। ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্যও আমেরিকা-চীনের মতো বড় বড় দেশের নেতাদের সমালোচনা করে গ্রেটা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে কৃষিকাজের সূচনা নারীদের হাত ধরেই। নারীরাই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, মাটিতে বীজ পুঁতলে তা থেকে নতুনভাবে ফসল তৈরি হয়। শিল্পোন্নত কৃষির আবির্ভাবের অনেক আগেই নারী কৃষকরা মাটিতে পুষ্টির জন্য, রাসায়নিক সার ছাড়াই এবং সময়ের সাথে সাথে উর্বরতা তৈরি করতে কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। আফ্রিকার ৭০% ক্ষুদ্র মালিকের খামার পরিচালনা করে নারীরা। ঐ মহাদেশে বসবাসকারী লোকদের সমস্ত পুষ্টির অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করে তারা। তাদের কৃষিব্যবস্থা প্রাচীন ইতিহাসে নিহিত, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মা থেকে কন্যার কাছে চলে এসেছে। আর তা ভূমি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সহজাতভাবে অভিযোজিত হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, যখন নারীরা পুরুষদের মতো একই সম্পদ ব্যবহার করে, তখন কৃষি উৎপাদন ২০-৩০% বৃদ্ধি হয় এবং ১২-১৭% ক্ষুধা হ্রাস হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারে, নারী এবং মেয়েরা পানি সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে নিয়োজিত । জাতিসংঘ স্বীকার করেছে যে টেকসই পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার সাফল্য মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সকল স্তরে নারীদের সম্পৃক্ত করার উপর নির্ভর করে।
উন্নত দেশে নারীরা রিসাইকেল, অর্গানিক খাবার, এবং ইকো-লেবেলযুক্ত পণ্য কেনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নেয়া শক্তিশালী পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করার সম্ভাবনা বেশি। ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়— নারীরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং তারা পুরুষদের তুলনায় কার্বন নিঃসরণ কমাতে, বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে ইচ্ছুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা জলবায়ু বিজ্ঞানে বিশ্বাস করার হার পুরুষদের তুলনায় ৫% বেশি। উত্তর আমেরিকার নারীদের ৭০% নতুন ব্যবসা শুরু করছে এবং এখন তারা সেখানকার সম্পদের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করছেন। এটাও অনুমান করা হয় যে সমস্ত ভোগ্যপণ্য ক্রয়ের ৭০-৮০% নারী। একটি দেশকে টেকসই, পরিচ্ছন্ন, এবং শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ রাজি হয় যে, শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী যে তাপমাত্রা পৃথিবীর ছিল তার চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি বা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে বাড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে সবাই চেষ্টা করবে।
২০২১ সালের নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত COP26 সম্মেলনেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে দেশগুলোকে আহ্বান করা হয়। এতে নারীদেরকেও এই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সুযোগ সৃষ্টি ও নেতৃত্ব দেয়ার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তবে নারীদেরকে শিক্ষিত করতে না পারলে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে তাদের অবহিত করা যাবে না। এছাড়া তারা এখনও পুরুষদের মতো সমানভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সকল স্তরে যদি নারী-পুরুষের সমতা বজায় রাখা যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নারীরা আরো বেশি ভূমিকা রাখবে।
ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (এমজিআই) প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, যদি জেন্ডার সমতায় দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের হারের সাথে একটি অঞ্চলের সমস্ত দেশ মিলে যায়, তবে তা ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জিডিপিতে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১১% যোগ করতে পারে। যেসব দেশে নারীরা শ্রমবাজারে একক ভূমিকা পালন করে এমন দৃশ্যে দেখা গেছে যে সেখানে তারা পুরুষদের তুলনায়, ২০২৫ সালের মধ্যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জিডিপিতে ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২৬% যোগ করতে পারে। ১৩০টি দেশের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব দেশে তাদের প্রশাসনে নারীদের উচ্চ প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক পরিবেশ চুক্তিগুলো অনুমোদন করার সম্ভাবনা বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে থাকে। এছাড়া এটি নারীদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে এবং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে থাকে। এটি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের টেকসই উন্নয়নে কাজ করে থাকে। কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, ও পানি খাতের ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি জ্ঞান, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্যের (যেমন: প্লাস্টিক) ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবসায় বিনিয়োগের অর্থায়নসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়ে থাকে।
রাজনৈতিক ব্যক্তি, নীতিনির্ধারক, বিনিয়োগকারী এবং সমাজসেবীদের বোঝার সময় এসেছে যে নারীরা তাদের সম্প্রদায় এবং বিশ্বকে আরও টেকসই ও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি বিশাল শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। অসংখ্য গবেষণায় দেখায়, আমরা যদি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, তবে অর্থ, সম্পদ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং শিক্ষায় নারীদের প্রতি বৈষম্যকে দূর করতে হবে। এ কারণেই জলবায়ু আলোচনায় আরও বেশি নারী প্রতিনিধিত্বের দরকার। নারীরা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং তারা অসমভাবে সমাধানও দিচ্ছেন। এভাবে আমাদের অবশ্যই নারীদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে এবং সেই অনুযায়ী অর্থায়নও করতে হবে। আর তাহলেই জলবায়ু সংকট সমাধানের আন্দোলনের সঠিক নেতা হিসেবে নারীদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় হবে।