কোনো এক স্থানে বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে, সংবাদমাধ্যম এখনো ঘটনাস্থলে পৌঁছে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করতে পারেনি। কিন্তু এরইমধ্যে জনৈক ব্যক্তি ফেসবুক মারফত ঘটনাস্থলের খবর ছড়ানো শুরু করেছেন। হয়তোবা ফেসবুকে লাইভ প্রচারও করছেন। সাধারণ একজন নাগরিকের সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারটা বেশ দারুণ বলেই বিবেচিত হবে সবার কাছে। বিকল্প সংবাদমাধ্যম হিসেবে চারপাশের খবর আগের চেয়ে এখন বেশ সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে ব্যাপারটা ভালোই হওয়ার কথা। কিন্তু দুনিয়ার সবটাই যেমন সাদা আর কালো নয়, ভালো-মন্দের পাশাপাশি মিশ্র অবস্থা বা ধূসর কিছু অংশও থেকে যায়। হালের সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার ব্যাপারটাও সেরকমই।
ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কারের এই জমানায় খবর ছড়াতে সময় লাগে না। আশপাশের খবরাখবর এত সহজেই যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমের দরকার কী? এই প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন। কিন্তু বিষয়টিকে এত সরলীকরণ করে সমাধানে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। কারণ আদৌ একজন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে সাংবাদিকতার মতো গুরুদায়িত্ব কোনো প্রশিক্ষণ, দায়বদ্ধতা আর সম্পাদনার কাঁটছাট ছাড়া পালন করা সম্ভব কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের সত্যতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে নানা দিক থেকে বিচার-বিবেচনা আর বিশ্লেষণ করে বিষয়টাকে দেখতে হবে। সবকিছুর আগে সাংবাদিকতার আদ্যোপান্ত জেনে নেয়া প্রয়োজন।
সাংবাদিকতা কী?
সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় আমাদের চারপাশের সবকিছু সম্পর্কে খবর, তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করে তা যথাযথ সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করা, প্রচার করা বা উপস্থাপন করা। এটি একটি পেশা। অর্থাৎ যে পেশাদার ব্যক্তি কোনো সংবাদ সংস্থায় সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ প্রস্তুত বা সম্পাদনার কাজ করেন তখন তাকে সাংবাদিক বলা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম এক অপরিহার্য উপাদান, এতটাই অপরিহার্য যে সংবাদ মাধ্যমকে Fourth Estate বলে অভিহিত করা হয়। একটি রাষ্ট্রের মূল উপাদান কেতাবীভাবে তিনটি ধরা হয়- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ আর বিচার বিভাগ। সংবাদমাধ্যমের অপরিহার্যতার কারণে চতুর্থ উপাদান হিসেবে এই ফোর্থ এস্টেট নামকরণ করা হয়েছে।
সাংবাদিকতার নানারকম মাত্রা বা ধরণ থাকতে পারে। যেমন ফটো সাংবাদিকতা, বিনোদন সাংবাদিকতা, ক্রীড়া সাংবাদিকতা কিংবা টিভি চ্যানেল রিপোর্টিং ইত্যাদি। সাংবাদিকতার যেমন নানা মাত্রা ও ধরণ রয়েছে ঠিক তেমনই সংবাদমাধ্যমেরও নানা ধরণ রয়েছে। যেমন খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেটভিত্তিক নিউজ পোর্টাল, এজেন্সী, ম্যাগাজিন ইত্যাদি। আবার রয়েছে বাসস, এপি, রয়টার্সের মতো সংবাদ সংস্থা।
সাংবাদিকতা পেশার সংবেদনশীলতা
কিছু কিছু পেশা থাকে যেগুলো আর দশটা পেশার থেকে সংবেদনশীল হয়ে থেকে। অর্থাৎ সেসব পেশার মানুষকে বাকিদের থেকে অধিক মাত্রায় দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়, নতুবা মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। যেমন, কোনো ব্যক্তি তার অফিসে ছোটখাট কোনো ভুল করলে যা ক্ষতি হতে পারে, একজন ডাক্তার ছোটখাট ভুল করলে একজনের জীবন-মরণ নিয়ে সমস্যা হতে পারে। সাংবাদিকতাও ঠিক এমন পর্যায়েরই একটা দায়িত্বশীল পেশা।
ছোট্ট একটা ভুল তথ্য দেয়ার কারণে পুরো একটা দেশের ভেতর তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। আবার তথ্যটা যদি ভুল না-ও হয়, শুধুমাত্র সঠিকভাবে উপস্থাপন না করাতেও একই পর্যায়ের সমস্যা হতে পারে। এখানেই একটি পেশাদার সংবাদ মাধ্যম তথা একজন পেশাদার সাংবাদিকের সার্থকতা।
একজন পেশাদার সাংবাদিক খবর ও তথ্য সংগ্রহের জন্য যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। সংগ্রহের পর সেটার সত্য-মিথ্যা তথা নির্ভরশীলতা যাচাই করেন। সবশেষে যথাযথভাবে সম্পাদনা করে সেটা জনগণের সামনে উপস্থাপন যোগ্য করে প্রকাশ করেন। বলাই বাহুল্য, পুরো কাজটা কারো একার কাজ নয়, একটা খবর সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাচাই, সম্পাদনা ইত্যাদি ব্যাপারে অনেকজন সাংবাদিক কাজ করেন।
একটা নির্দিষ্ট প্রকাশিত খবরের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক এবং ঐ সংবাদমাধ্যম দায়বদ্ধ থাকেন। অর্থাৎ পরবর্তীতে খবরটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে বা খবরটি প্রকাশের ফলে কোনো ক্ষতিকর কিছু ঘটলে তাদেকে দায়ী থাকতে হবে। ফলে এখানে একটা দায়িত্বশীলতা রক্ষা করার চেষ্টা সংবাদমাধ্যমগুলো করে থাকে। তথ্য ও খবর ভালোভাবে যাচাই করে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
খবর সংগ্রহে সাংবাদিকদের থাকে ভালো রকমের পারদর্শীতা, সাধারণ যেকোনো মানুষের থেকে বেশি। যেটা তারা অর্জন করেন মাঠে ময়দানে প্রচুর সময় ব্যয় করে এবং ঠেকে শিখে। খবর সংগ্রহের জন্যে তাদেরকে প্রাণ সংশয়ে পড়ার মতো ঝুঁকিও নিতে হয় মাঝে মধ্যে। এটা তাদের পেশাগত জীবনেরই একটা অংশ। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা যেমন সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন, এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা কাছাকাছিই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকগণ মাঝে মধ্যে গোয়েন্দাদেরকেও হার মানান। সে কারণেই বোধহয় সত্যজিৎ রায়ের ‘এবার কান্ড কেদারনাথে’ গল্পে ফেলুদার জবানিতে অকপটে স্বীকারোক্তি এসেছে সাংবাদিকদের নিয়ে- “গোয়েন্দাগিরিতে ওরাও কম যায় না”।
সতাতা নিশ্চিত করতে সংবাদ কর্মীরা Code of Ethics বা পেশাগত নৈতিকতা মেনে চলার চেষ্টা করেন। সাংবাদিকতায় নৈতিকতার মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে বলতে গেলে সত্যের অনুসন্ধান করা, নিরপেক্ষ থাকা, তথ্য সংগ্রহে কারো ক্ষতির কারণ না হওয়া, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহি করা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে রাখা দরকার। অনেকেই হয়তো উপরোক্ত এত গুণকীর্তনের সাথে হলুদ সাংবাদিকতা বা অপসাংবাদিকতার সাংঘর্ষিকতার কথা বলবেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, অন্য আর দশটা পেশার মতো এ পেশাতেও অসৎ লোক রয়েছেন। কিন্তু এতে প্রয়োজনীয়তা আর গুরুত্ব অসার হয়ে যায় না।
নাগরিক সাংবাদিকতা
নাগরিক সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় যখন একজন সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় খবর বা তথ্য সংগ্রহ করে ব্লগ, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ইত্যাদিতে প্রকাশ করে থাকে। এসবে লেখা, ছবি, ভিডিও সবই থাকতে পারে। দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনার খবর আজকাল ব্লগে বা সামাজিক মাধ্যমেই পাওয়া যায়। যেমন- কোনো একটা সম্মেলনের ঘোষণা আগে পত্রিকা মারফত জানতেন, এখন ফেসবুকে কোনো গ্রুপ থেকেই জানতে পারছেন। আবার কোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটলে টিভি চ্যানেল পৌঁছানোর আগেই ফেসবুকে লাইভ দেখাতে পারেন যেকোনো উৎসাহী নাগরিক সাংবাদিক।
বিশেষ করে ব্লগ সাইটগুলোতে যারা নিয়মিত তারা ব্লগগুলো থেকেই অনেক সংবাদ বা বিভিন্ন বিষয় জানতে পারছেন যা আগে তারা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতেন। মূলত ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নতুন এই দিক খুলে দিয়েছে। আবার ইদানীং অনেক প্রথম শ্রেণীর সংবাদমাধ্যম নাগরিকদেরকেও খবর সংগ্রহ করে পাঠানোর ব্যবস্থা রেখেছে। যেমন- পত্রিকায় থাকে পাঠকের কলাম, যেখানে পাঠকরাও রিপোর্টিংয়ের ন্যায় আশপাশের খবরাখবর লিখে পাঠান, কিংবা টিভি চ্যানেলের খবরে কোনো অপরাধ দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে পাঠিয়ে দেন অনেকে।
প্রথাগত সাংবাদিকতা কি তাহলে বাতিলের খাতায় ?
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে সারা বিশ্বেই প্রথাগত সংবাদ মাধ্যম মন্দার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। যদিও মূল কারণটা নাগরিক সাংবাদিকতা নয়, বিজ্ঞাপন। সংবাদমাধ্যম মূলত বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের মাধ্যমে আয় করা লভ্যাংশ দিয়েই চলে। কিন্তু ইন্টারনেটের জমানায় গুগল, ফেসবুকের মতো সাইটগুলো বিজ্ঞাপনের সিংহভাগ নিয়ে চলে যাওয়াতে সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপন সংকটের কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যা-ই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
অভিজ্ঞদের মতে, নাগরিক সাংবাদিকতা কোনোভাবেই প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বিকল্প হতে পারে না। অনেকগুলো কারণ রয়েছে এর পেছনে। নাগরিক সাংবাদিকরা কেউই পেশাদার নন। ফলে সঙ্গত কারণেই তারা কেউই তাদের প্রকাশিত খবরের জন্য দায়বদ্ধ নন। ফলে তথ্যের সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতার কোনো নির্ভরতা থাকে না।
প্রথাগত সাংবাদিকরা যেভাবে সরেজমিনে থেকে খবর সরবরাহ করে থাকেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খবরের সত্যতা যাচাই করেন, সেটা নাগরিক সাংবাদিকতায় একজন ব্যক্তির একার পক্ষে সম্ভব নয়। সংগৃহীত খবর সম্পাদকের কাঁটাছেঁড়ার পর নানাভাবে যাচাই হয়ে তারপর ছাপার হরফে বেরিয়ে আসে। কিন্তু নাগরিক সাংবাদিকতায় প্রায় ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক যা মনে হলো সেটাই দাঁড় করানো হয়। তার উপরে এটা তার পেশা নয়, কাজের ফাঁকে শখের বশে করা। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সঠিক তথ্যের যে বিপুল চাহিদা তা পূরণে পেশাদার সংবাদমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই।
অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, যেকোনো সময়ের চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা এখন সবচেয়ে বেশি। কারণ এখন চারিদিকে বিপুল তথ্যের ছড়াছড়ি, চাইলেই দরকারের থেকেও বেশি তথ্য এসে হাজির হয়। এরকম পরিস্থিতিতে পেশাদার সাংবাদিকতার প্রয়োজন সবথেকে বেশি। একটি পেশাদার, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমই পারে এই হাজারো তথ্যের ভিড়ে সঠিক খবর আর বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে।
নাগরিক সাংবাদিকতা বর্তমান সময়ের এক নতুন শক্তির নাম, এতকাল মানুষ শুধু একতরফাভাবে খবর পড়েই এসেছে। এখন খবর পড়া এবং সরবরাহ করা দু’দিকেই অবস্থান নেয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ মানুষকে আরো শক্ত অবস্থান দিয়েছে। এই সুযোগের সঠিক ব্যবহার ও গঠনমূলক চর্চা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই ‘ফোর্থ এস্টেট’কে আরো শক্তিশালী করবে। তাই নাগরিক সাংবাদিকতা থেকে সত্যিকারে সুফল ভোগ করতে সব পক্ষকেই আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
ফিচার ছবি- The Daily Beast