অনুবাদকের কথা
এই প্রবন্ধটির মূল রচয়িতা ড. আলি উসমান কাশমি। প্রবন্ধটি প্রথম 1971 war: Witness to history শিরোনামে ছাপা হয়েছিল পাকিস্তানের ডন পত্রিকা হতে প্রকাশিত মাসিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ভিত্তিক ম্যাগাজিন হেরাল্ডে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেরাল্ড ম্যাগাজিনের অনলাইন সংস্করণে প্রবন্ধটিতে কিছু হালনাগাদ তথ্য সংযোজন করা হয়। সেই হালনাগাদ সংস্করণ থেকেই প্রবন্ধটির অনুবাদ করা হয়েছে দুই পর্বে, আজ থাকছে যার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
ড. আলি উসমান কাশমি লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের ইতিহাস বিষয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। ২০০৯ সালের মার্চে তিনি দক্ষিণ এশিয়ান ইতিহাস বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অফ হাইডেলবার্গ, জার্মানি থেকে পিএইচডি লাভ করেন। এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের রয়্যাল হলোওয়ে কলেজে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের একজন নিউটন ফেলোও ছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে লেকচার দিয়েছেন।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এই লেখার অনুবাদ? এই অনুবাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে একজন পাকিস্তানি ইতিহাসবিদের ভাষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা।
আমাদের অনেকেরই জানা আছে, সাধারণ পাকিস্তানিদের মনে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কী ধরনের ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে একে ভারতের ষড়যন্ত্র মনে করা, মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বাসঘাতক কিংবা ভারতের দালাল, ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তানের ভাঙন ইত্যাদি ধারণা এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে দেশটির মানুষের মাঝে।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পাকিস্তানের যে শিক্ষাবিদরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটনেরও চেষ্টা চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের কী মতামত? আমার বিশ্বাস, এই একই কৌতূহলের উদয় হয়েছে আরও অনেকের মনেই। এই প্রবন্ধটি সেই কৌতূহল কিছুটা হলেও মেটাতে পারে।
তবে একটি বিষয়ে শুরুতেই বলে রাখা দরকার: এই প্রবন্ধের সকল বক্তব্যের সাথে আপনারা একমত না-ও হতে পারেন। এমনকি আমি নিজেও এই প্রবন্ধের অনেকাংশের সাথেই একমত নই। প্রবন্ধের কিছু কিছু অংশ আমার মনেও প্রবল বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তারপরও, অনুবাদের সময়ে কোনোকিছুই আমি বাদ দিইনি। কেননা এই অনুবাদের উদ্দেশ্য কেবল আমি বা আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরা, যেসব বক্তব্যের সাথে একমত, সেগুলোই তুলে ধরা নয়; বরং পাকিস্তানের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবেন, সেটি জানার চেষ্টা করা।
পুরো প্রবন্ধটি পড়ার পর নিঃসন্দেহে আপনাদের মনোজগতে ছোটখাট ঝড় উঠবে, অনেক বিষয়ের সাথে আপনারা একমত হবেন, আবার যুক্তি দিয়ে অনেক বিষয়কে উড়িয়ে দিতেও সমর্থ হবেন। সোজা কথায়, স্বাস্থ্যকর আলোচনা-সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকল। আর কথা না বাড়িয়ে, চলুন ঢুকে পড়া যাক মূল প্রবন্ধে। এরপর থেকে যা পড়বেন, সেগুলো সবই মূল রচয়িতা ড. আলি উসমান কাশমি।
(১ম পর্বের পর)
দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে যে পার্থক্যই থাক না কেন, ভাষা-অনুপ্রাণিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং এর ধর্ম-উদ্ভূত বিকল্পধারা, কোনোটিই বাংলাদেশে বাস করা লক্ষ লক্ষ বিহারীকে রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই বিহারীদের পূর্বপুরুষেরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের বিহার রাজ্য থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল, এবং তাদের সাথে সাধারণ বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক ও ভাষাগত পার্থক্য বিদ্যমান। যদিও তারা বাংলাদেশি নাগরিক হতে চায়, তবু তাদেরকে বাস করতে হচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত ক্যাম্পে, ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে। ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৪ থেকে ৫ লক্ষ বিহারী বাস করছে। “আমি আপনাকে পরামর্শ দেব এই ক্যাম্পগুলোতে না যাওয়ার,” এক ক্যাব ড্রাইভার বলেছিলেন আমাকে। “তারা বুঝে যাবে যে আপনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন, ফলে আপনার উপর আক্রমণাত্মকও হয়ে উঠতে পারে। তারা বলবে, তোমরা ওখানে কত মজা করছ, আর তোমাদের কারণে আমরা এখানে দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।”
বস্তুত এই বিহারীরা রাষ্ট্রহীন জনগণ, কারণ পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কেউই তাদেরকে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। এ বছরের শুরুতে (২০১৫ সালে) ইসলামাবাদের ফরেইন অফিস সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল যে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ১,৭০,০০০ বিহারীকে পাকিস্তানি সীমানার মাঝে জায়গা করে দিতে পেরেছে, এবং এখনও যারা বাংলাদেশে বাস করছে, তারা আর পাকিস্তানের দায় নয়। বাংলাদেশে, এই বিহারীরা এমনকি নাগরিকত্ব লাভের যোগ্যও নয়, যদিও দেশটি যখন স্বাধীন হয়, তখন তারা ওই দেশেরই অধিবাসী ছিল। ক্যাম্পগুলোতে বাস করা অধিকাংশ বিহারীই জন্মেছে ১৯৯০’র দশক বা তার পরে – কিংবা অন্তত ১৯৭১ সালের পর – তবু তাদেরকে সমাজে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যারা পাকিস্তানি সেনাদের সাথে হাত মিলিয়ে স্থানীয় মানুষদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। এ ব্যাপারে ঢাকার এক অধ্যাপক আমাকে বলেছেন, “তারা ছিল রাজাকার। তারা গণহত্যার সাথে যুক্ত ছিল। আমরা এ বিষয়টি ভুলে যেতে পারি না।”
আত্মপরিচয়ের কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই, বিহারীরা আটকে রয়েছে মানুষের ভারে ন্যুব্জ ঘেটোগুলোতে, যেখানে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থার কর্মীদের থেকে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা লাভ করছে। তাদের উপস্থিতি আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত সেই সাংঘর্ষিকতা: প্রতিটি রাষ্ট্রই তার জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে সংখ্যালঘু বানিয়ে রাখে। এরকম সম্প্রদায় সবসময় সব জাতি-রাষ্ট্রেই থাকবে, যেমন কেউ হয়তো ‘যথেষ্ট ফরাসি’ নয়, কারণ যে হিজাব ছেড়ে দিচ্ছে না বা হ্যাশট্যাগ ‘আমি চার্লি’ লিখে টুইট করছে না।
আমি এমন একটি সময়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলাম, যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সেখানে গিয়েছিলেন একটি সরকারি ভ্রমণে। যেসব মানুষের সাথে আমি কথা বলেছি – এবং আমি কখনোই দাবি করছি না যে আমি সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্বকারী অনেক মানুষের সাথে দেখা করেছি ও কথা বলেছি – তারা সকলেই সমালোচনায় মুখর ছিল তাদের সরকারের, যদিও কিছুটা সাবধানতার সাথে। কারণ তাদের মনে হচ্ছিল, তাদের সরকার ভারতের স্বার্থোদ্ধারের জন্য নিজেদের অনেক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে ভারতের বাংলাদেশের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া, যাতে তারা বাংলাদেশকে তাদের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই রুটটি ভারতের মূলভূমি ও উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। ওই সাতটি রাজ্যের পশ্চিমে বাংলাদেশ, আর পূর্বে বার্মা। বাংলাদেশিরা খুবই চমকে গিয়েছিল যে, ভারত যা চেয়েছে তা-ই পেয়ে গিয়েছে, বিনিময়ে কিছু না দিয়েও। তারা আশা করছিল, পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে অচলাবস্থা জারি রয়েছে – বিশেষত তিস্তা নদী ব্যবহার নিয়ে – এবং ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ নিয়ে – অবশেষে সেগুলোর সুরাহা হবে।
ভারত অবশেষে একটি সীমান্ত চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে, যেটিতে বাংলাদেশ অনুমোদন দিয়ে রেখেছিল সেই ১৯৭৪ সালেই। এই অনুমোদনের ফলে দুই দেশ বিনিময় করতে পারবে ছোট ছোট সেইসব ছিটমহল, যেগুলো সীমান্তের ভুল দিকে আটকে ছিল। তবে অনেক বাংলাদেশিই যে জিনিসটি আমাকে বলেছে তা হলো, ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার কোনো সমাধান এখানে আসেনি।
এটিকে অনেকের কাছেই অতি-অনুমান মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, বিএসএফ-এর প্রতি বাংলাদেশিদের ঘৃণা আমাকে সাহায্য করেছে পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণাকে ভালো করে বুঝতে। এই ধারণাটি অনেক জিনিসের উদাহরণ হিসেবেই এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মানুষের কাছে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে। যে জনতা কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়, তারা এ কারণে কাজটি করে না যে তারা কাশ্মীরকে দেশভাগের অসমাপ্ত এজেন্ডা বলে মনে করে। বরং তারা কাজটি করে, কারণ তারা একটি নিগৃহীত সম্প্রদায় হিসেবে বাস করছে। তাদের কাছে, পাকিস্তান একটি সংকেত যা বোঝায় এমন একটি সম্প্রদায় গড়ে তোলার ইচ্ছাশক্তি, যেটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসেবে, এবং যা নিজ ধর্মের ধারণা ও আইনের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই কাশ্মিরীদের কাছে পাকিস্তানের ধারণা হলো, নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি, কিংবা মুক্তি সংখ্যালঘুত্ব থেকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, পাকিস্তানের ধারণা লুকায়িত রয়েছে ভারতের সাথে সমতা বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষায়। এই সমতাই দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে মূল কেন্দ্র ছিল মুসলিম রাজনীতির, এমনকি বাংলায় বাসকারীদের ক্ষেত্রেও। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ এবং তার নেতারা – বিশেষ করে জিন্নাহ – সবসময়ই বলতেন যে ভারতে মুসলিমদেরকে বিবেচনা করা উচিৎ ‘বিশেষ সংখ্যালঘু’ হিসেবে, এবং তাই, তাদেরকে অবশ্যই দেয়া উচিৎ অনুপাতহীন প্রতিনিধিত্বের সুযোগ, বিশেষত আইনসভা ও সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে। ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ঠিক এই ধরনের সমতারই সুযোগ দিয়েছিল, এবং সুযোগ দিয়েছিল প্রদেশগুলোকে ভৌগোলিক সন্নিহিত এককে একত্র হওয়ারও। এই এককগুলো পরবর্তীতে যথাযোগ্য বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন সহযোগে সর্বভারতীয় ফেডারেশনে যুক্ত হতে পারত। জিন্নাহ যে দুইটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ একক আশা করেছিলেন, সেগুলো মুসলিমদেরকে সাহায্য করত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দিক থেকে অবশিষ্ট ভারতের সাথে সমতা অর্জনে।
এই সমতার ধারণা কীভাবে প্রাসঙ্গিক আজকের বাংলাদেশের সাথে? এই প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর খুঁজে পেতে, আপনাকে অবশ্যই আগে দেখতে হবে ‘৪৭-এর দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল, এবং ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কেমন রয়েছে। আপাতদৃষ্টির আলোচনায় যদিও বেশিরভাগ বাংলাদেশিই কথা বলে কেবল সামরিক সমতা নিয়ে। “১৯৭১ সালের আগে, যদি বিএসএফ একজনকে (পাকিস্তানি) মারত, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তাহলে মারত দুইজনকে (ভারতীয়),” এভাবেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন একজন বাংলাদেশি। এরপর তিনি অভিযোগ করেছেন যে বাংলাদেশের পক্ষে আর তা করা সম্ভব নয়। “এখনকার অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখুন। প্রতিদিন বিএসএফ কয়েক ডজন নিরীহ বাংলাদেশীকে মারছে, এবং আমরা এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারছি না।“
ক্ষমতা জাহিরের এই ইচ্ছা – কোনো আগ্রাসনের জবাব দিতে পারা – ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের একটি মূল কারণ, এবং এখনো এটি পাকিস্তানি ও অপাকিস্তানি সবার মাঝে পাকিস্তানের ধারণাটিকে গড়ে তুলছে। এমনকি ভারতের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীও এই ধারণা পোষণ করে। হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ১৯৫০ ও ‘৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাসীন নুরুল ইসলাম যখন ১৯৭১ সালে প্রাণ বাঁচাতে কলকাতায় গিয়েছিলেন, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে মুসলিম বাঙালি লোকটির বাসায় তিনি থাকছেন, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করছেন। Making of a Nation, Bangladesh: An Economist’s Tale বইয়ে তিনি লিখেছেন ওই ব্যক্তি নাকি বলেছিলেন, “একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান ছিল ভারতে সাম্যাবস্থা জারি রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভারতে মুসলিমদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ প্রতিরোধেরও হারিয়ার।” তিনি আরো বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার মুসলিমদের উচিৎ ছিল অখণ্ডতা ধ্বংসের পরিবর্তে পাকিস্তানের সাথে বিরোধগুলোর শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করে ফেলা।” ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা, যেমন নেহরু, কিংবা ইতিহাসবিদগণ, যেমন বিপান চন্দ্র ও মুশিরুল হাসান, এই সমতার ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন সাম্যবাদী কিংবা মিথ্যা চেতনা হিসেবে। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে সেটি তখনকার দিনে ছিল, এবং এখনো রয়েছে, একটি জনপ্রিয় ধারণা। এর পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও অবশ্যই রয়েছে।
অবশ্য জনপ্রিয়তাই সমতার ধারণাকে সঠিক করে তোলে না। এটি মজ্জাগতভাবেই বিরোধিতাবাদী, কারণ এটি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুইটি পক্ষের প্রতিক্রিয়াশীল সমতার উপর, যা তারা একে অপরকে দিতে পারবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক দিক থেকে। এর মধ্যে আরো অন্তর্নিহিত রয়েছে আধিপত্যের ফ্যাসিবাদী ধারণা তৈরির প্রবণতা, এবং অপরের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়ার বাসনা। আমরা আমাদের চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি, সমতার এই ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে পাকিস্তানের উদীয়মান শহুরে মধ্যবিত্তের বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে তারা পালন করছে রক্ষণশীল ও গোঁড়া সামাজিকতা, ঘৃণা করছে ভারতকে (এবং হিন্দুদের), এবং মহিমান্বিত করছে সামরিক শক্তিকে। যারা ভারতের সাথে সামরিক দিক দিয়ে সমতা সৃষ্টি করতে চাইছে, তারাও ব্যর্থ হচ্ছে এর প্রভাব অনুধাবনে: যে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো অবাড়ন্ত, এবং অর্থনৈতিক উপাদানও খুবই সীমিত, সেটির ছয়গুণ বড় আকৃতির একটি রাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে অসামঞ্জস্যভাবে সামরিক খাতে ব্যয় করা খুবই অবাস্তবসম্মত একটি চিন্তা, যার ফলে তার সেনাবাহিনী হয়ে উঠবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অতি-উন্নত একটি প্রতিষ্ঠান।
আমি ঢাকায় থাকতে থাকতেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এর কারণ মোদির সেই বক্তব্য, যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে তিনি গরিমান্বিত করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইসলামাবাদের ফরেইন অফিস বলে, তার (মোদির) বক্তব্য হলো নয়া দিল্লীর পক্ষ থেকে তাদের অপরাধের আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি যে তারা জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করে পাকিস্তান বিভাজনে ভূমিকা রেখেছিল। ইসলামাবাদের এই প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র প্রেক্ষাপট বিবর্জিতই নয়, এখানে ইতিহাসের প্রতি চরম অবমাননাও প্রদর্শিত হয়েছিল।
যেখানে বাকি পৃথিবী ইতিমধ্যেই সচেতন, সেখানে পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষেরও এখন জানা জরুরি ঠিক কোন ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পাকিস্তানিদের জানা উচিৎ ১৯৭১ সালের বিরোধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য একটি দীর্ঘ সংগ্রামের শেষাঙ্ক, যেখানে তারা রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জন করে নিয়েছিল। শুধু ১৯৭১ সালের মার্চের সেই সামরিক অভিযানের পর ভিত্তিগত, স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী উপাদানগুলো পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সর্ব-সমর্থন লাভ করেছিল। এবং এখনই সময় পাকিস্তানের স্বীকার করে নেওয়া সেইসব ঘৃণ্য অপরাধের কথা, যেগুলো পাকিস্তানি প্রশাসন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো করেছিল পূর্ব পাকিস্তান। যদি শুধু একটি উদাহরণ দিতে হয়, আমি বলব সেইসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও ছাত্রদের কথা, যাদের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে, এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে। এই হোস্টেলটিকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল, কারণ এখানকার অধিকাংশই বাসিন্দাই ছিলেন হিন্দু।
২৫ মার্চ রাতের অভিযানগুলোর প্রতি অসন্তোষ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যও রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছিল। অচিরেই যেসব পূর্ব পাকিস্তানি কাজ করছিলেন পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও, তারা একে একে ছেড়ে দিতে থাকেন তাদের চাকরি। একটি হিসাব থেকে জানা যায়, তিনটি সামরিক বাহিনীর অন্তত ৩,০০০ প্রশিক্ষিত সদস্য তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে যোগ দিয়েছিলেন বিদ্রোহীদের দলে। নিরাপত্তা বাহিনীর এই দলত্যাগীদের অধিকাংশই পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে, এবং সেখানে তারা যোগ দিয়েছিলেন কর্নেল ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানদের (যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীতে। বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, কূটনৈতিক ও মন্ত্রী (তৎকালীন) আবুল মাল আবদুল মুহিতের বই Bangladesh: Emergence of a Nation থেকে জানা যায় কর্নেল ওসমানী বলেছিলেন, “পাকিস্তানিরা যদি তাদের অভিযান কিছু নির্দিষ্ট রাজনীতিবিদের উপর সীমাবদ্ধ রাখত, তাহলে হয়তো সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালিরা নিরপেক্ষই থাকতেন। কেবলমাত্র ওই তথ্য আসার পরই আমরা বিদ্রোহ শুরু করেছিলাম যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেরিয়ে পড়েছে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবীদের নিধনে।”
এই দলত্যাগের প্রক্রিয়া শুধু নিরাপত্তা বাহিনীতেই সংকীর্ণ ছিল না। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে যখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছিল, কলকাতায় পাকিস্তানি মিশনের পুরো দলটিই তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে প্রবাসী সরকারের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছিল। এটি ছিল পাকিস্তানি সরকারের প্রতি একটি বিশাল লজ্জার বিষয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাঙালি কূটনৈতিকদের ব্যাপারে আরো বেশি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপরও, বাঙালি কূটনৈতিকরা পদত্যাগ অব্যাহত রাখেন। বিদেশে কূটনৈতিকদের যে স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসের জীবন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেগুলো ছেড়ে দিতে থাকেন তাঁরা।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব একটি গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়, যেখানে বিদ্রোহীরা প্রবল জনসমর্থন লাভ করতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এই সময়ে বিদ্রোহীদের দমন করতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছিল, সেগুলো ক্রমশই হয়ে উঠছিল অত্যন্ত নির্মম ও বর্বর। ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঘরদোর ফেলে ভারতে পালিয়ে গিয়ে শরণ নিতে বাধ্য হয়। হাজার হাজার বাঙালি নারী হয় ধর্ষণের শিকার। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আন্তর্জাতিক মেডিকেল এজেন্সিগুলো বাংলাদেশে ছুটে গিয়েছিল গর্ভপাতে সাহায্য করতে। এছাড়া আরো অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল দত্তক নিয়ে সেইসব শিশুদের, যাদের জন্ম হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বদৌলতে। এমনকি সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাবগুলোও বলে সামরিক অভিযান, দেশান্তর ও যুদ্ধের ফলে সব মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকার দাবি করে যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লক্ষের কাছাকাছি। তারা এটিকে একটি গণহত্যা হিসেবেও অভিহিত করে। যদিও অনেক স্বাধীন পর্যবেক্ষকই এটিকে একটি অতিরঞ্জন হিসেবে বিবেচনা করেন, এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে শোধনবাদী ইতিহাসবিদ এবং পাকিস্তানে তাদের সমর্থকেরা এমনভাবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে যে মনে হয় সংখ্যাটিকে ১০ লক্ষের নিচে নামিয়ে আনা গেলেই বুঝি সেটি কহতব্য ও ন্যায়সঙ্গত হয়ে উঠবে। এবং তারা আরো চেষ্টা করে আলোচনার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে কেবল আলোকপাত করতে ১৯৭১ ও পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বিহারীদের উপর চালানো নৃশংসতায়। অস্বীকার করা যাবে না যে বিহারীদের উপর হত্যা, নির্যাতন, লুঠতরাজ ও যৌন অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কখনোই ভারসাম্যের একক হতে পারে না। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের সাথে যা করেছিল, সেই দোষ ঢাকার জন্য আমি বিহারীদের সাথে হওয়া অপরাধকে স্মরণ করতে পারি না।
যারা এখনো এই ধরনের ছলনা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের সাথে যা হয়েছিল তার অবসান দরকার। পাকিস্তানপন্থী সামরিক শক্তি যেমন আল বদর, আল শামসের সদস্যদের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সেই অবসানের পরিবর্তে রাজনৈতিক খেলা খেলছেন। এ কারণেই এইসব বিচার বাংলাদেশি সমাজে আরো বিরোধ ও মেরুকরণের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের (পাকিস্তানের) সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ ওই অবসান লাভ করতে সক্ষম হবে না।
পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ঔদাসীন্যভরা ক্ষমা প্রার্থনা করেছে বটে, কিন্তু এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। সরকারিভাবে পাকিস্তানের নীতি হলো ক্ষমা প্রার্থনার পর থেকে অতীতকে একটি সমাপ্ত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা, এবং সবাইকে সামনে এগিয়ে চলার আহবান জানানো। কিন্তু অতীতকে ভুলে যাওয়া ও সামনে এগিয়ে চলা সবসময় সমাধান হতে পারে না, বিশেষত এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যেহেতু এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু, এবং এখনো যে যাতনা ভোগ করছে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাই এটি কখনোই ভোলা সম্ভব নয়। তবে আবেগিক ও মানসিক ক্ষতগুলো কিছুটা হলেও সারানো সম্ভব, যদি সাধারণ পাকিস্তানিরা উদ্যোগী হয়।
সেটিকে সম্ভবপর করতে, আমাদের (পাকিস্তানিদের) বিস্তারিতভাবে জানা প্রয়োজন আসলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের সাথে কী হয়েছিল — বিশেষত ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাদের সাথে সহানুভূতি বোধ করা এবং তাদের কষ্ট-শোক-যন্ত্রণা অনুধাবন করা খুব একটা কঠিন হবে না। এর শুরুটা করা যায় ভারতীয় সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠির দেয়া পরামর্শ থেকে। সম্প্রতি তিনি যেমনটি তার The Colonel Who Would Not Repent: The Bangladesh War and its Unquiet Legacy বইয়ে লিখেছেন, চলুন আমরা একটি পিটিশন করি যেন পাকিস্তানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় তাদের সম্মানে, যারা মারা গিয়েছেন বা যন্ত্রণা ভোগ করেছেন ১৯৭১ সালে। জার্মানি এমনটি করেছে হলোকাস্টের ভুক্তভোগীদের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রও একই কাজ করেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শহীদদের জন্য। তাহলে আমরা পারব না কেন?
সম্পাদকের বক্তব্য: এই লেখাটি একজন ইতিহাসবিদের একটি প্রবন্ধের অনুবাদ, রোর বাংলা কিংবা অনুবাদকের বক্তব্য নয়।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস
২) বাংলাদেশ অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড
৩) মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম