চায়ের দেশে একদিন

পরিকল্পিত ভ্রমণ থেকে হুটহাট পরিকল্পনাহীন ভ্রমণের স্বাদ কিঞ্চিত ভিন্ন। নাগরীক জীবনের পাঠ চুকিয়ে ব্যস্তময় ক্ষণ অতিবাহিত করছি সবাই। জীবনের পরিকল্পিত সময়গুলোও বেশ যাচ্ছে। কিন্তু যদি হঠাৎ গমনে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় আসে তাহলে নিতান্তই সবকিছু রুবিক্স কিউবের মতো এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা! হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছে আমার সাথে। হুট করেই এক বন্ধু বলে উঠলো- সিলেট যাবে, ঘুরতে। আমিও কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমত, আমাদের দুজনের যাওয়ার কথা চূড়ান্ত হলেও যাওয়ার দিন এবং পরদিন আমাদের সাথে যোগ দেয় আরও চারজন বন্ধু। অতঃপর আমাদের যাত্রা শুরু।

দিনটি ছিল ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩; রোজ বৃহস্পতিবার। আমরা যেহেতু একদিন ঘুরে চলে আসবো, সেহেতু হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকা প্রয়োজন। লক্ষ্য ঠিক করলাম লোকাল বা মেইল ট্রেনে না, যাবো আন্তঃনগর ট্রেনে চড়ে। হুটহাট ভ্রমণে বের হওয়ায় আমাদের আগে থেকে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করা হয়নি। সূর্য অস্ত যাবার পর সকলে রওনা দেই ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে এসে কাউন্টার থেকে আসনবিশিষ্ট টিকিট পাইনি, তাই প্লাটফর্মের কাছে ফিরে আসলাম। সেখানে ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেসের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্যের সাথে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন পাশসহ শর্ত সাপেক্ষে ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ টাকায় বনিবনা করে নিলাম। রাত ৯টায় ট্রেন আসার কথা থাকলেও কিছুক্ষণ বিলম্বে প্লাটফর্মে প্রবেশ করে ট্রেন। সবাই উঠে পড়লাম কামরায়। অল্প কিছুক্ষণ পর ঢাকা ছেড়ে ট্রেন চলছে, গন্তব্য সিলেট।

সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার; ছবি: লেখক

আমাদের ট্রেন আন্তঃনগর হলেও ভেতরে মানুষের এতটাই ভীড় ছিল যে মনে হচ্ছে লোকাল ট্রেনকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ক্যান্টিনের কামরায় দাঁড়িয়ে থাকি। টঙ্গী হয়ে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনটি কিছুক্ষণের জন্য থামলো। আবার ছুটে চলছে। কামরায় যাত্রীদের তুলনামূলক বেশি ভিড় থাকায় মনকে খুশি রাখতে শ্রবণে গুঁজে দিলাম ইয়ারফোন। মেতে উঠলাম ইন্টারনেট জগতে। কু… ঝিক ঝিক… ঝিক ঝিক…; ট্রেন চলছে, ঘড়ির কাটাও তার সঙ্গ দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর আখাউড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশনকে পেছনে ফেলে হরষপুর রেলওয়ে স্টেশনকে অতিক্রমের মধ্য দিয়ে আমাদের ট্রেন সিলেট বিভাগে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ট্রেনের ভিড় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তাই আমি বিভিন্ন কামরায় এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছি, কামরার দুয়ারে হাতল ধরে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে প্রচন্ড গতিতে চলা ট্রেন থেকে আসা বিকট শব্দ অনুভব করতে করতে হুইসেল বাজিয়ে রেলগাড়িটি হবিগঞ্জের নোয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে থামলো।

এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম- এখানে বিশ মিনিটের ক্রসিং আছে। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে ঘুরাঘুরি করে বন্ধুরা মিলে গ্ৰুপ ছবি তুলে উঠে পড়লাম কামরায়। ক্রসিং শেষে স্টেশন থেকে ছেড়ে দিল ট্রেন। এসময় সেই পুলিশ সদস্য এসে আমাদের জানালেন- শ্রীমঙ্গল পৌঁছালে বেশ কয়েকটি আসন ফাঁকা হবে এবং আসন নাম্বারও বুঝিয়ে দিলেন। যা-ই হোক, রাত গাঢ় হচ্ছে। কামরার কপাটের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছি, বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা ভেদ করে হিমশীতল হওয়া গায়ে আঁচড়ে পড়ছে, এবং দু-তিনজন মিলে একের পর এক গান গেয়েই যাচ্ছি; মুহূর্তগুলো বেশ সুন্দর। উপভোগ করতে করতেই আমাদের ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ অতিক্রম করে রাত ২টা নাগাদ হুইসেল বাজিয়ে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে থামলো। আসন ফাঁকা হলো, বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন তার নিয়মে চলতে শুরু করলো।

গভীর রাত, কেউ চোখের পাতা নামিয়ে ভাবছে আবার কারো চোখে ঘুম নামছে; ছবি: লেখক

কামরার সবাই গভীর ঘুমে। আমিও চোখের পাতা নামিয়ে পরিবারের কথা ভাবছি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে ভানুগাছ, শমশেরনগর, কুলাউড়া, মাইজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন পেরিয়ে ঘন্টা তিনেক পর ভোর ৫টা নাগাদ ট্রেনটি পৌঁছে গেলো আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন; ছবি: লেখক

স্টেশন ত্যাগ করে জনপ্রতি ৩০ টাকায় সিএনজিতে চলে গেলাম সিলেটের জনপ্রিয় বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট পানসীতে। ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবার সেরে পায়ে হেঁটে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পৌঁছে যাই আমাদের অদেখা প্রথম দর্শনীয় স্থান হযরত শাহজালাল রহ.-এর মাজার শরীফে।

হযরত শাহজালাল রহ.-এর মাজার শরীফ; ছবি: লেখক

মাজারের চারপাশ দেখে মাজার রোড ধরে পায়ে হেঁটে কিছুদূর পেছনে গিয়ে শর্তসাপেক্ষে একটি সিএনজি ২,২০০ টাকায় রিজার্ভ করি। সিএনজি-তে করে চলে যাই অদেখা দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থান তৎকালীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নামানুসারে নির্মিত ওসমানী জাদুঘরে।

ওসমানী জাদুঘর; ছবি: লেখক

মিনিট পাঁচেক থেকে সিএনজিতে চড়ে সকালের সিলেট শহরকে দেখতে দেখতে মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) এবং জালালাবাদ সেনানিবাস হয়ে পৌঁছে যাই অদেখা তৃতীয় দর্শনীয় স্থান বাংলাদেশের বৃহত্তর চা বাগানগুলোর মধ্যে জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত চিকনাগুল ও খান চা বাগানে।

চিকনাগুল ও খান চা বাগান; ছবি: লেখক

চা বাগানের ভেতরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাগানের একজনের সাথে চা পাতা নিয়ে কথাবার্তা বলে চলে যাই রিজার্ভকৃত সিএনজিতে। বিশাল মাঠ, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকা শস্যভূমি দেখতে দেখতে চলে যাই অদেখা চতুর্থ জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান লালাখালে।

স্বচ্ছ নীল পানির নদী লালাখাল; ছবি: লেখক

স্বচ্ছ এই নীল পানির নদী দেখে মিষ্টি পানের স্বাদ নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে থাকা মেঘালয়ের সবুজে মোড়ানো সুউচ্চ পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সিএনজিতে চলে যাই অদেখা পঞ্চম দর্শনীয় স্থান শ্রীপুর চা বাগানে।

শ্রীপুর চা বাগানের উঁচু টিলা এবং পেছনে মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়; ছবি: লেখক

চা বাগান দেখে এবং উঁচু টিলায় মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়গুলো অবলোকন করে সিএনজি নিয়ে তামাবিল বর্ডারের খুব কাছ দিয়ে চলে যাই গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত সিলেটের অন্যতম জনপ্রিয় অদেখা ষষ্ঠ দর্শনীয় স্থান প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে।

পাথরের ঝাঁকে প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে লেখক; ছবি: হাসিবুল আলম অনিক

সেখানে পোশাক পরিবর্তন করে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাই জিরো পয়েন্টে। তারপর ছোট-বড় পিচ্ছিল পাথরের মেলায় জমে থাকা জলে অবগাহন সেরে চলে যাই পার্কিংয়ে থাকা আমাদের সিএনজিতে। পোশাক পরিবর্তন করে আশেপাশে পাহাড়ি দোকানগুলো ঘুরে দেখি, ভারতীয় কিছু পণ্য কিনে সিএনজি নিয়ে ফিরতি পথে চলে যাই তামাবিল স্থল বন্দরে।

তামাবিল স্থল বন্দর এবং ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার; ছবি: লেখক

এদিকে সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। ভারতীয় নিবন্ধিত গাড়ি, সীমানা বর্ডার এবং ভারত-বাংলাদেশ প্রবেশ পথ দেখে সীমান্তের পাশে হালকা খাবারকার্য সেরে সিএনজি নিয়ে চলে যাই জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরে অবস্থিত অদেখা অষ্টম দর্শনীয় স্থান আগুন পাহাড়ে।

আগুন পাহাড়; ছবি: লেখক

পাহাড়ের পাশে এবং পাদদেশের কোণায় জ্বলন্ত আগুন দেখে সিএনজিতে উঠে পড়ি। এদিকে জাগতিক নিয়মে সূর্য অস্ত যাবার পথে। সিএনজি কিছুদূর যাওয়ার পর পৌঁছে গেলাম অদেখা নবম এবং ভ্রমণের সর্বশেষ দর্শনীয় স্থান হযরত শাহ পরাণ রহ.-এর মাজার শরীফে।

হযরত শাহ পরাণ রহ.-এর মাজার শরীফ; ছবি: লেখক

মাজার শরীফ দর্শন করে দেখি আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। এদিকে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আমাদের ট্রেন ছেড়ে যাবে রাত সাড়ে ১১টার দিকে। হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। যেহেতু দুপুরের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি, সেহেতু মাজার থেকে রিজার্ভকৃত সিএনজি নিয়ে চলে যাই পানসী রেস্টুরেন্টে।

পানসী রেস্টুরেন্ট; ছবি: লেখক

সেখানে সিএনজিকে বিদায় দিয়ে পানসীতে দুপুর এবং রাতের খাবার একসাথে সেরে পায়ে হেঁটে রাতের সিলেট শহর দেখতে দেখতে চলে যাই ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং সিলেট শহরের প্রবেশদ্বার ক্বীন ব্রীজে। ব্রীজ দেখে সিলেট সার্কিট হাউজের পাশে সুরমা নদীর তীরে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেই।

নির্দেশনা

  • মাজারের মূল কক্ষে ছবি তোলা, শিশু এবং নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

This article is in Bangla language. It's about a one-day travel story in Sylhet.
Featured Image: Author

Related Articles

Exit mobile version