আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা, বাংলা ১৪১৮ সালের চৈত্র সংক্রান্তি, ১৪১৯ শুরু হবার আগের রাত। জাতীয় সংসদ ভবনের বিখ্যাত সড়ক মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ জুড়ে জনারণ্য। কেন? কারণ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সড়কটিতে দেশের দীর্ঘতম আলপনা আঁকার। এই আলপনা দেখতেই সে রাতে ভিড় জমিয়েছিলেন নানান বয়সের মানুষ। এরপর থেকে প্রতি বছরই, নববর্ষের প্রাক্কালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আলপনা আঁকাটা যেন ঢাকা শহরের বর্ষবরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এবারও ১৪২৬ সাল শুরুর আগে প্রায় তিন লাখ বর্গফুটের আলপনা আঁকা হয়েছে ঢাকায় এবং ৪০ থেকে ৬০ হাজার বর্গফুট জুড়ে আঁকা হয়েছে আরও ৪টি শহরে। আলপনাগুলো আঁকতে ২,৫০০ জন আঁকিয়ের সাথে ছিলেন আরও অসংখ্য সাধারণ মানুষ। এশিয়াটিক ইএক্সপির আয়োজনে ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ এর পৃষ্ঠপোষকতায় এবারে সারা দেশের ৫টি শহরে পালিত হয়েছে ‘আলপনায় বৈশাখ’ উৎসব, আঁকা হয়েছে আলপনা। এই যে নববর্ষের উৎসবে আলপনা অংকনের সংস্কৃতি, একটি শিল্পকর্মকে ঘিরে এত মানুষের মিলনমেলা; সেই আলপনা নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে, আলপনার সংজ্ঞা হচ্ছে, “মঙ্গলকার্যে বা উৎসবে, ঘরের দেয়ালে, দরজায় ও মেঝেতে, অঙ্গনে পিটালির বা খড়ি প্রভৃতি রঙের চিত্রাঙ্কন বা অংকিত চিত্র।” বোঝা যাচ্ছে, নানা উৎসবে-পার্বণে বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে, ঘরে-বাইরে-রাজপথে বা দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয় যে রঙিন কারুকাজ বা ছবি; শব্দকোষ অনুসারে তার সবই আলপনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তবে প্রথম কবে থেকে মানবজাতি আলপনা আঁকা শুরু করেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলাটা একটু কষ্টসাধ্য। কারণ, পৃথিবীর বুকে মানুষের আবির্ভাবের পর, তার আদিরূপের বিকাশ শুরু হয়েছে আজ থেকেও প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে। তখন থেকেই মানুষ গুহায়, গাছের বাঁকলে ছবি আঁকতো। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে লিপি এবং নান্দনিক চিত্রাঙ্কন। সেসব চিত্রের চিত্রায়নে ব্যবহার হয়েছে অনন্য সব রেখা বা রেখাচিত্র। আলপনার মূলে কিন্তু এই রেখাচিত্রই। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভ্যতা এবং জীবনধারার উপর ভিত্তি করে এসব চিত্রাঙ্কনেও ভিন্নতা দেখা যায়। স্থানীয় সংস্কৃতি, লোকাচার, ভাষা, ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত লোকজ সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণেই নানান স্থানে নানান রূপ লাভ করেছে আলপনা।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রথম রাস্তায় আলপনা আঁকার চল শুরু হয় বলে জানা যায়। স্ট্রিট পেইন্টিং হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যেভাবে চর্চা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশে এর চর্চা অনেক বেশি শক্তি নিয়ে প্রবাহমান। অন্যান্য জায়গায় যেখানে ছবির প্রাধান্য থাকে বেশি, সেখানে আমাদের আলপনায় থাকে নকশার প্রাধান্য। বার্জার পেইন্টসের পৃষ্ঠপোষকতায় এখন প্রতি বছর আমাদের দেশে যে আলপনা আঁকা হয়, তা থেকে বোঝা যায় আমাদের আলপনায় নকশার প্রাধান্যের বিষয়টি।
প্রাক-আর্য সময়ের লোকজ চিত্রের সাথে আর্যদের চিত্রশৈলীর মিশেলে, বৈদিক যুগে আলপনার সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এরপর পৌরাণিক সময়ে এসে ধর্মীয় চর্চার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে আলপনার বিবর্তন এবং আধুনিকায়ন ঘটেছে। এই ভারত উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং ভারতে, ভাষা এবং অঞ্চলভেদে আলপনাকে ১০ রকম নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় যা আলপনা, ভারতের বিহারেই তার নাম আরিপন। তামিলনাড়ু ও কেরালায় এই আলপনারই নাম হচ্ছে কোলম। আবার রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে আলপনাকে বলা হয় ওসা বা ঝঙ্গতি, হিমাচল আর অন্ধ্রপ্রদেশেই আলপনা নাম বদলে হয়ে গেছে মুঙ্গলি। বাংলাভাষায় যাকে আলপনা বলে, সংস্কৃত ভাষায় বলতে গেলে, তাকে বলতে হবে আলিম্পন!
এবছর চট্টগ্রামের ডিসি হিল, বগুড়ার নবাব বাড়ি রোড, সিলেটের কিন ব্রিজ ও খুলনার শিববাড়ি মোড় এলাকায় হাজারও মানুষের অংশগ্রহণে আঁকা হয় আলপনা, পালিত হয় ‘আলপনায় বৈশাখ’ উৎসব। প্রতি বছরই বাড়ছে এই উৎসবের পরিধি। কারণ, আলপনা কিন্তু শুধুই একটা নান্দনিক শিল্পকর্ম নয়, এর পেছনে বিভিন্নভাবে জড়িত আছে নানান কারণ এবং আচার-অনুষ্ঠানও। লৌকিক শিল্প হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে দেখা যায় মানুষের চাওয়া-পাওয়া-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, বিশেষ করে নারীরা, আদিকাল থেকেই ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, মনস্কামনা পূরণ এবং ব্রতপালনকে কেন্দ্র করে আলপনা আঁকা শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও লক্ষ্মীব্রত উপলক্ষে ঘরের মেঝে, দেয়াল, দরজার চৌকাঠ, কুলা, ডালাতে আলপনা অংকন করে থাকেন যুগ যুগ ধরেই। শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সময়কাল থেকেই সৌন্দর্য বর্ধন এবং উৎসবকে কেন্দ্র করে আলপনা আঁকার চল শুরু হয়েছিল।
তবে আলপনা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝেই আবদ্ধ থাকেনি, এই অঞ্চলের অন্য ধর্মের মানুষও একে বরণ করেছেন সাদরে। প্রাণহীন ছবি বিবেচনায় বাংলাদেশের মুসলিম সমাজেও আলপনা আঁকা বাধাগ্রস্ত হয়নি। জানালার কাঁচে, গ্রিলে, দেয়ালে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রঙিন আলপনা আঁকা তো গ্রাম কিংবা শহরের বহু বাড়িতেই প্রচলিত ছিল। এক দশক আগ পর্যন্তও এদেশে প্রতিটি বিয়েবাড়ির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আলপনা। গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ঘর-বাড়ি বা বিয়ের মঞ্চ সাজানোর প্রধান উপায় ছিল আলপনা। বার্জারের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও শেখ মনিরুজ্জামান লিটনের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের নেতৃত্বে আমাদের দেশের শহরগুলোতে যখন আলপনায় বৈশাখ উৎসবের আয়োজন হয়, তখন বোঝাই যায়, আবারও ফিরে আসছে আমাদের সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রচলন। অবশ্য দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এবং আদিবাসীদের মধ্যে সারা বছরই আলপনা আঁকার প্রচলন রয়েছে এখনও। আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার টিকোইল গ্রামের কথাই বলি। সে গ্রামের মানুষ সারা বছরই তাদের ঘরবাড়ির সাজিয়ে রাখেন অজস্র সুন্দর আলপনা দিয়ে। বাড়ির দেয়ালে, দরজা, মেঝে, চৌকাঠ, উঠোন, জানালার কপাটে আলপনা এঁকে সাজিয়ে রাখা এই গ্রামের মানুষের নিত্যদিনেরই কাজ।
আলপনা আঁকায় কী ধরনের রঙের ব্যবহার হয়? শুরু থেকেই আলপনা আঁকায় মূলত সাদা রংকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। তবে সময়ের আবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তাধারা এবং রুচিতে, পাল্টে গেছে রং তৈরির উপায়ও। ফলে সাদা ছাড়া অন্যান্য রঙিন রংও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আলপনা আঁকার জন্য।
গ্রামে মাটির ঘরে আলপনা দেওয়ার যে প্রচলন রয়েছে, সেখানে সাদা রং তৈরির অন্যতম উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া পানির সাথে গুলিয়ে সাদা রং তৈরি করে আলপনা আঁকার রেওয়াজ এখনও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়।
তবে শহুরে অঞ্চলে আলপনা আঁকার কাজে এখন নানান রঙের সিনথেটিক পেইন্টই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাদার পাশাপাশি লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সবুজসহ অজস্র রঙের সমারোহ দেখা যায় আধুনিক সময়ের আলপনাগুলোতে। এবারের আলপনায় বৈশাখ উৎসবের আলপনা আঁকা হয়েছে বার্জারের দারুণ টেকসই সব রং দিয়েই।
নকশা কিংবা ছবি, যেমনই হোক আলপনা, আমাদের সবারই ভালো লাগে তা দেখতে। বাসা-বাড়ি-রাস্তায় আলপনা আকাঁর মধ্য দিয়েই যেন শৈল্পিক গুণের বহিঃপ্রকাশের একটি পথ তৈরি হয়েছে নানান জাতি-পেশার মানুষের মাঝে। একজন শিক্ষার্থী আলপনা আঁকেন শহীদ মিনারে, একজন রিকশার রংমিস্ত্রিও আলপনা আঁকেন রিকশার হুড বা পেছনের কাঠে, একজন অফিস-ফেরত যুবক আলপনা আঁকেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। উৎসবে, আনন্দে, পালা-পার্বণে ঘরবাড়ির দেয়াল থেকে পিচঢালা সড়ক ক্যানভাস হয়ে উঠে সবার। হবে না-ই বা কেন? বাংলার সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনার গল্প, বাংলার লোকজ ঐতিহ্য- সবই যে লেখা থাকে এই এক আলপনাতেই!