“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের এ চরণটি বহুশ্রুত। আবার অনেকেই হয়ত অনুসরণও করি। তবে এবার তা অনুসরণ করলো একটি গ্রামের অধিবাসীরা। ঝাঁপা গ্রামবাসীর ডাক শোনেনি প্রশাসন, বিত্তবান বা ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তি। তাই বলে তারা বসে থাকেনি। তাদের নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছে দীর্ঘ ও অভিনব এক ভাসমান সেতু। ইতোমধ্যে অনেকেই জেনেছেন ভাসমান সেতুটির কথা। গ্রামবাসীর উদ্যোগ ও সেতুটি নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এ লেখায়।
ঝাঁপা
যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় একটি বাঁওড়, ঝাঁপা। বাঁওড়ের এ’পাড়ে রাজগঞ্জ বাজার আর ঐ পাড়ে ঝাঁপা (বাঁওড়ের নামেই এর নাম) গ্রাম। গ্রামটিতে বসবাস করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। প্রতিদিনই নানা দরকারে তাদের এ বাঁওড় পেরিয়ে রাজগঞ্জ আসতে হয়। গ্রামটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে এ বাঁওড়। এটি শুধু একটি মৌসুমের কথা নয়, সারা বছরই তাদের পার হতে হতো এ বাঁওড়। ফলে শত বছর ধরে যোগাযোগ সংকটে ভুগছিল গ্রামটির মানুষ। নৌকা ছিল বাঁওড় পারাপারের একমাত্র উপায়। নৌকা পাওয়া না গেলে মূল লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকত গ্রামটি। যোগাযোগের এই সংকট নিয়ে বেশ কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনার স্মৃতিও রয়েছে গ্রামটির। পারাপারের সময় ২০১৪ সালে স্কুল শিক্ষার্থীসহ নৌকাডুবি, পানিতে পড়ে শিশুর মৃত্যু ও সময়মতো নৌকা না পাওয়ায় মুমূর্ষু অনেক রোগীর মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেছে এখানে।
ভাসমান সেতু ও ঝাঁপার মানুষ
দূর থেকে দেখা যায় সবুজাভ পানির উপরে ভাসমান নীল আর কমলা রঙের সেতুটি। কাছে গেলে দেখা যায় বাঁওড়ের পানিতে নীল আর কমলার প্রতিফলন। বেশ মনোরম এ দৃশ্য, প্রথম দেখায় যে কেউ ভাবতে পারে, বিদেশি কোনো কোম্পানি স্বল্প খরচে তৈরি করে দিয়েছে এ সেতুটি। না, কোনো প্রকৌশল বা কারিগরীজ্ঞান ছাড়াই স্বল্পশিক্ষিত ঝাঁপা গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে সেতুটি। ভাসমান এ সেতু পালটে দিয়েছে এ জনপদের চিত্র। সেতুটি হওয়ার ফলে আশেপাশের নয়টি গ্রামের মানুষের যোগাযোগে এসেছে আমূল পরিবর্তন। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ গ্রামের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এখন সহজেই বাঁওড় পার হতে পারছে। গ্রামবাসী আশা করছে, এ সেতু হওয়ার ফলে দ্রুত উন্নয়ন ঘটবে ঝাঁপার।
হঠাৎ করেই যে সেতুটি তৈরি করা হয়েছে, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। এর জন্য প্রথমে ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। একটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট ফ্রেম তৈরি করে, তা ১৬টি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর স্থাপন করা হয়। এটি সফলভাবে ৩২ জনকে নিয়ে ভাসতে সক্ষম। এ দেখে সাহস পায় গ্রামবাসী এবং বৃহৎ প্রকল্পের দিকে অগ্রসর হয়। আগস্ট মাসের দিকে মূল সেতুটি তৈরির কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজে শ্রমিকদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে গ্রামবাসী। বছরের দ্বিতীয় দিন হাজার ফুট দীর্ঘ ভাসমান এ সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন স্থানীয় জেলা প্রশাসক জনাব আশরাফ উদ্দিন। এরপর থেকে আনন্দের সাথে সেতুটি ব্যবহার করছে গ্রামের মানুষ। ছোটখাট যানবাহনও পার হচ্ছে সেতুটি দিয়ে।
সেতু তো হয়ে গেল, শত বছরের যাতায়াতের জনভোগান্তিরও অবসান ঘটলো, কিন্তু নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতো যেসব মাঝি, তাদের কী হবে? তাদেরও ব্যবস্থা হয়েছে। চারজন মাঝি, যারা আগে এ ঘাটে নৌকা চালাতো, তারাই তুলছে সেতু পারাপারের টাকা। আগে গ্রামবাসী মাঝিদের সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে ও বছরে এক মণ করে ধান দিত নৌকা পারাপারের জন্য। আগের মতো একই খরচে এ সেতু ব্যবহার করতে পারবে তারা। কিন্তু অন্য এলাকার মানুষদের টাকা দিয়ে পার হতে হবে। এ টাকা থেকেই একটা অংশ দেওয়া হবে মাঝিদের।
সেতুর খুঁটিনাটি
লোহার বার দিয়ে তৈরি ফ্রেম বসানো হয়েছে দুই সারি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর। ড্রামগুলো ফ্রেমের সাথে গোলাকার অ্যাঙ্গেল দিয়ে আটকানো আছে। দুই সারি ড্রামের মাঝে রয়েছে সামান্য ফাঁকা স্থান। ফ্রেমের উপর পাটাতন হিসেবে দেয়া হয়েছে লোহার সিট। সেতুর দুই পাশে রয়েছে নিরাপত্তার জন্যে লোহার রেলিং। দৈনিক প্রথম আলো’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ সেতুটি তৈরি করতে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা (মতানৈক্য থাকতে পারে) খরচ হয়েছে। পাঁচ মাস সময় লেগেছে ১ হাজার ফুট লম্বা এবং ৮ ফুট চওড়া সেতুটি তৈরি করতে। ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর ভাসছে এটি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল ও বার। ২৫০টি চার ফুট প্রশস্ত লোহার সিট যুক্ত করা হয়েছে সেতুটিতে। শুষ্ক মৌসুমে বাঁওড়ের পানি কিছুটা শুকিয়ে যায়, তাই সেতুর দুই পাশে যুক্ত করা হয়েছে বাঁশের তৈরি ৩০০ ফুট সংযোগ সেতু। সেতুটি দিয়ে মানুষের পাশাপাশি ছোট যানবাহন যেমন- রিকশা, ভ্যান, নছিমন, মোটর সাইকেল, অটোরিকশা ইত্যাদি যাতায়াত করতে পারে।
পরিকল্পনা
প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা, বাঁওড়ের পাশে বসে স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক আসাদুজ্জামান কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলেন। তখন শ্যালো মেশিন দিয়ে বাঁওড় থেকে বালু তোলা হচ্ছিল, মেশিনটি বসানো হয়েছিল কয়েকটি প্লাস্টিকের ড্রামের উপর যাতে পানিতে ভেসে থাকে এটি। এরকম একটি ভারী মেশিনকে এ পদ্ধতিতে ভাসতে দেখে হঠাৎ তার মাথায় আসে একটি সেতুর কথা। তিনি ভাবলেন, একই পদ্ধতিতে যদি ড্রামের সাহায্যে সেতু তৈরি করা হয় এটিও নিশ্চয়ই ভাসবে।
এরপর তিনি গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনা করেন বিষয়টি নিয়ে। সকলেরই সম্মতি ছিল তার এ পরিকল্পনায়। গ্রামবাসীর সাথে কয়েক দফা আলোচনার পর গঠন করা হয় ‘ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’। যদিও সেতুটি তৈরি করতে লেগেছে কয়েক মাস, এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহু আগে। গ্রামবাসীর সাথে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের ১৯ জানুয়ারি। সরকারি বা রাজনৈতিক কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তা ছাড়াই গ্রামবাসীর অর্থায়নে তৈরি হয় সেতুটি। গ্রামের ৬০ জন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত যুবককে নিয়ে গড়ে তোলা ঐ ফাউন্ডেশনে প্রত্যেকেই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সম্মিলিতভাবে গঠন করে সেতু তৈরির ফান্ড। সেতুটি তৈরি ব্যাপারে শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, “আমাদের কারোরই কারিগরী জ্ঞান নেই। গাইতে গাইতে গায়েন এর মতো নিজেদের মাথা খাটিয়ে কাজটি করেছি। তবে মূল কাজটি করেছে রবিউল।”
যার নির্দেশনায় তৈরি হলো এ সেতু
রাজগঞ্জ বাজারে অবস্থিত বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপটি রবিউল ইসলামের। তেমন স্বচ্ছলতায় কাটেনি রবিউলের শৈশব। অভাব আর অনটনের কারণে মাধ্যমিকের পর আর লেখাপড়া করা হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও মেধার জোর তার বরাবরই ছিল, এর সাথে ছিল ইচ্ছাশক্তি। তার এই ইচ্ছাশক্তি তীব্র ছিল বলেই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এক ক্ষুদ্র প্রকৌশলীতে পরিণত হয়েছেন। ঝাঁপায় ভাসমান সেতুটি তৈরি হয়েছে তারই নির্দেশনায়। নির্দেশনা বললে হয়ত কিছুটা ভুল হবে, সেতুটির কারিগর তিনি, যেমনটি লেখা আছে সেতুর সাথে লাগানো সাইনবোর্ডটিতে।
যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের এক অজপাড়ায় থাকেন রবিউল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না বলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় লেখাপড়া ছেড়ে কাজ নিতে হয় লেদ মেশিনের দোকানে। সেখানে তিনি বিভিন্ন যন্ত্রের ক্ষুদ্রাংশ তৈরির কাজ করতেন। দীর্ঘদিন কাজ শেখার পর তিনি নিজেই ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি লেদ মেশিন কিনে নেন। মেশিনটি কেনার জন্য তাকে টাকা দেন তার বাবা। এরপর নিজেই একটি হালকা প্রকৌশল শিল্পের ওয়ার্কশপ খোলেন। এখন সেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করে। এ ১০ জনকে নিয়ে তিনি সেতুটির কাজ করেছেন। এজন্য সময় একটু বেশি (পাঁচ মাস) লেগেছে। ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা তিনি পেয়েছেন সেতুটি নির্মাণের জন্য। তবে তার মতে তাঁর শ্রমের মূল্য এর চেয়েও বেশি। নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সেতুটি তৈরির জন্য প্রথমে এক মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়েছে। এরপর আমার প্রতিষ্ঠানের ১০ জন শ্রমিক নিয়ে চার মাস ধরে সেতু নির্মাণের কাজ করি। অর্থের জন্য নয়, সুনামের জন্যই কাজটি করেছি। এখানে লাভ-লোকসানের হিসাব নেই।”
ঝাঁপা গ্রামবাসীর এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সারা দেশের মানুষ। প্রতিদিন বহু মানুষ যাচ্ছে অভিনব এ সেতুটি দেখতে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকৃতি পায়নি গ্রামবাসীর এ উদ্যোগ। দুর্নীতি, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, ব্যর্থ আন্দোলনের ভীড়ে যখন হতাশাগ্রস্ত এক অন্ধকারে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন, তখন আশার আলো জ্বালার মতো স্বস্তিদায়ক একটি সংবাদ ছিল গ্রামবাসীর এ পদক্ষেপ। তারা প্রমাণ করে দিয়েছে, ইচ্ছা করলে নিজেদের সমস্যার সমাধান আমরা নিজেরাই করতে পারি। তবে তাদের এ উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান নয়। বর্ষা আসলে বাঁওড়ের পানি বাড়ার সাথে সাথে স্রোতও বাড়বে। তখন সেতুটির অবস্থান ও অবস্থা ঠিক রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আর এ বর্ষা পার করলেও আগামী বর্ষায় কী হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না কাঠামোগত কারণে। গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ যখন নিজ খরচে এমন মহৎ উদ্যোগ নিতে পারে তখন সরকার তো তাদের জন্য একটি স্থায়ী সমাধান দিতেই পারে।
ফিচার ইমেজ- DBC NEWS