মনে পড়ে, একদা যেতাম
প্রত্যহ দু’বেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই
বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পরের মুখ দেখার আশায় আমরা কজন।
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবি শামসুর রাহমান এভাবেই নিজের কবিতায় স্মৃতিচারণ করেছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ের।
বাংলা ভাষায় রচিত ও নির্মিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পেছনের অসংখ্য প্রবাদপুরুষ আড্ডা আর শিল্পের কোলাহলে ভরিয়ে রাখতেন যে বিউটি বোর্ডিংকে, তার অন্যতম ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। অসংখ্য কবিতা আর গদ্যের পরতে পরতে যিনি বিউটি বোর্ডিংয়ের স্মৃতিতে পাঠককে আচ্ছন্ন করে গেছেন। বলে গেছেন বাঙালির আত্মশ্লাঘার ভিত নির্মাণের পেছনে বোর্ডিংটির অবদান।
বাঙালি বরাবরই আড্ডাপ্রিয়। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ফাইভ স্টার হোটেল- কোথায় বাঙালির আড্ডাবাজি নেই? বাকি সব কাজে তা-ও সময়ের হিসেব কোনোরকম থাকলেও বাঙালির আড্ডাতে যেন সময়জ্ঞান সবসময়ই ব্রাত্য!
বলা যায়, চব্বিশ ঘন্টাই আড্ডা দিতে পারার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে একেকজন বাঙালি জন্ম নেন! আড্ডাবাজির জন্য ওপার বাংলায় যেমন কলকাতার কফি হাউস কিংবদন্তি হয়ে আছে, তেমনি এপারে বিউটি বোর্ডিং হয়ে আছে ইতিহাসের এক জীবন্ত জাদুঘর।
মান্না দের কফি হাউজ গানটির বদৌলতে আমরা সাতটি চরিত্রের কথা জানি, যারা কফি হাউজের আড্ডায় মেতে থাকতেন। অসংখ্য মানুষ তাই আজও সেই ফ্লেভারটা নিতে কফি হাউজে যান। যতটা না কফি পান করতে, তার চেয়ে বেশি স্মৃতিকাতর হতে। ঠিক একইভাবে আমাদের বিউটি বোর্ডিং আজও কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে বাঙালিকে স্মৃতির বিরানভূমিতে আচ্ছন্ন করতে।
নতুন ঢাকার কারণে পূর্বের জৌলুস ও গুরুত্ব হারালেও, ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অবিস্মরণীয় সূতিকাগার হলো পুরান ঢাকা। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বাংলাবাজার, হাজির বিরিয়ানি থেকে চকবাজার- পুরান ঢাকা মানে বাঙালির শত শত বছরের এক কালীক-আখ্যান।
পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং সেই আখ্যানেরই এক অজর, অক্ষয় কীর্তির নাম। যে বোর্ডিংয়ের আড্ডাগুলো পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশির দশকে আমাদেরকে শিল্পের নিগুঢ় চেতনায় সমৃদ্ধ করে গেছে। যেখানে রচিত হয়েছে অজস্র কালজয়ী কবিতা, উপন্যাস, গল্প, চলচ্চিত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পকর্ম। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আর জাদুশিল্পীদের পদচারণায় মুখরিত থাকত সবসময় যে জায়গাটি, তারই নাম বিউটি বোর্ডিং।
একটু পেছন থেকেই শুরু করা যাক। সাতচল্লিশের দেশভাগের পূর্বে ঢাকার নিঃসন্তান এক জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের জমিদারবাড়ির ভবনে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বের হতো ‘সোনার বাংলা’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা, সাথে গড়ে ওঠেছিল সেটার ছাপাখানাও। মূলত তখন থেকেই ঐ ভবনটি হয়ে ওঠে শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের আনাগোনায় মুখর। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতাটিও ছাপা হয় সেই পত্রিকায়।
দেশভাগের পর ‘সোনার বাংলা’ কার্যালয় স্থানান্তর হয় কলকাতায়, জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসও চলে যান ভারতে। দুই বছর খালি পড়ে থাকে ভবনটি। ১৯৪৯ সালে সেটি ভাড়া নেন মুন্সিগঞ্জের দুই সহোদর নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা।
নলিনী মোহন সাহার বড় মেয়ের নাম ছিল বিউটি। তার নামেই তারা গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। শুরুতে ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করেন, একসময় চাহিদা বাড়তে থাকলে বড় করার চিন্তা থেকে ১১ কাঠা জমিসহ ভবনটি কিনে নেন দুই ভাই। ক্রমেই ব্যবসা হয়ে ওঠে জমজমাট। সেই সাথে আবারও শুরু হয় সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষের বিচরণ।
দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্র হয়ে ওঠে বাংলাবাজার। সে সূত্রে কবি-সাহিত্যিকদেরও প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। বাংলাবাজারের পাশেই শ্রীশ দাস লেনের ১ নাম্বার বাড়িটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সাহিত্যচক্রের সুনিপুণ এক ঠিকানা।
সে সময় কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে আর বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শহিদ কাদরীর আস্তানা ছিলো বিউটি বোর্ডিংয়ের পাশেই একটি ভবনে।
ফলে একসময় বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতে থাকেন সবাই, পরিচিত হন একে অন্যের সাথে। আবাসিক হোটেলটিতে চায়ের আড্ডায় মেতে থাকেন দিন থেকে রাত। কেউ কেউ কখনো বা রাতেও থেকে যান সেখানে, সৃষ্টি করেন অসংখ্য শিল্পকর্মের। শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, আরও নানা পেশাজীবী মানুষও আসতে থাকেন সেখানে। আসেন অনেক রাজনীতিবিদও।
বিউটি বোর্ডিংয়ের একটি তালিকা থেকে দেখা যায়- শামসুর রাহমান, শহিদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ছাড়াও এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, রণেশ দাসগুপ্ত, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, আসাদ চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সাঁতারু ব্রজেন দাস। এসেছিলেন কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ও লেখক জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, নায়করাজ রাজ্জাক, টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, সঙ্গীতজ্ঞ সত্য সাহা, অভিনেতা প্রবীর মিত্র প্রমুখ। ঐতিহাসিক বিউটি বোর্ডিংয়ে কিছুদিন থেকেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, কমরেড আব্দুল মতিন, অলি আহাদদের মতো রাজনীতির তরুণ প্রতিভারাও আড্ডা দিতেন এখানে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে ‘সোনার বাংলা’ কার্যালয়ে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীমউদদীন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এসেছিলেন বলে জানা যায়।
এখান থেকেই ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘কবিকণ্ঠ’, আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘স্বদেশ’। আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকীও নানা সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।
সব্যসাচীখ্যাত লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির জন্য একটা নির্দিষ্ট টেবিল-চেয়ার রাখা ছিল এই বিউটি বোর্ডিংয়ে, যেখানে বসে তিনি কয়েকটি বইও লিখেছেন বলে জানা যায়। যার মধ্যে এক মহিলার ছবি, জনক ও কালো কফিন, আরণ্যক, সীমানা ছাড়িয়ে অন্যতম।
এখানে বসেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলে খ্যাতিমান পরিচালক আব্দুল জব্বার খান। বলা হয়, চিত্রনাট্যের কিছু অংশও এখানে বসে লিখেছিলেন তিনি। সুরকার সমর দাস অনেক বিখ্যাত গানের কথায় সুর বসিয়েছেন এখানেই আড্ডা দেওয়ার ফাঁকেই।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে বাংলার বুকে এক পাশবিক গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। তিনদিনের মাথায় ২৮ মার্চ অভিযান চালায় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক আঁতুড়ঘর বিউটি বোর্ডিংয়েও। ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৭ জনকে।
নিহতদের মধ্যে বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মীর পাশাপাশি ছিলেন মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা স্বয়ং। প্রাণভয়ে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার পরিবার পাড়ি জমায় ভারতে। রাজাকারদের দখলে থাকায় যুদ্ধের সময় খালিই পড়ে থাকে বোর্ডিংটি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই পুত্র সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, আবারও শুরু করেন বোর্ডিং ব্যবসা। কবি শহিদ কাদরী ও বেলাল চৌধুরীর ঐকান্তিক চেষ্টায় আবারও গুণীজনদের পদচারণায় মুখরিত হয় বিউটি বোর্ডিং।
কিন্তু কালের বিবর্তনে একসময় রং হারাতে থাকে পুরান ঢাকা, গড়ে ওঠে আজকের নতুন ঢাকা। সেখানেই বসতি গড়েন বেশিরভাগ মানুষ। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও কলাকুশলীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
ফলে বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা একসময় ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। সবাই ব্যস্ত হয়ে যান, আস্তে আস্তে আড্ডা কমে আসে। আজ তাই বিউটি বোর্ডিং আছে, কিন্তু নেই সেই দিনগুলো।
স্বাধীনতার পর থেকে হাল ধরে আসা প্রহ্লাদ সাহার ছেলে তারক সাহাও গত বছর পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। এখন বোর্ডিংটি সমর সাহা, বিজয় সাহারা দেখাশোনা করেন।
বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবারই। ১৯৯৫ সালে আয়োজন করা হয়েছিলো ‘আড্ডা পুনর্মিলনী’র। সেখানে এসে পুরনোরা স্মৃতিকাতর করে দেন নবীনদের, অতীতের আয়নায় বর্তমানের যোগসূত্র ঘটিয়ে মাতিয়ে তোলেন সবাইকে।
ঐ বছরই ইমরুল চৌধুরী গড়ে তোলেন ‘বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ’। তার উদ্যোগেই ২০০৩ সালে ৬০ সদস্যের এক ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়, নাম ‘বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ ট্রাস্ট’।
ট্রাস্টি বোর্ড আবেদনকৃত বিউটিয়ানরা ছিলেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, ড. আনিসুজ্জামান, বেলাল চৌধুরী, নূরুল হক বাচ্চু, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, জিয়া আনসারী, নির্মল সেন, গোলাম মুস্তাফা, ফারুক আলমগীর, শহীদ সিনহা, এম. সিরাজুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ফিরোজ কবীর মুকুল, সাযযাদ কাদির, জাহিদুল হক, হাজী মো. ইউনুস, মোফাজ্জল হোসেন বিধু, আবদুল রহিম (বাদশা ভাই), পিনাকি দাস, মৃণাল কান্তি রায়, রশিদ হায়দার, জাহাঙ্গীর হাবিবুল্লাহ, মাহমুদ আবু সাঈদ, পান্নালাল রায়, মো. মনসুর হোসেন, আমিরুল হক জিলু, সত্যগোপাল পোদ্দার, আজিজ ইউ আহমেদ, জাকারিয়া সিরাজী, আবদুল হান্নান, আবদুর রহিম, ফখরুল ইসলাম, বিজন সরকার, অগাস্টিন রডরিক্স, ইকবাল হায়াত খান, জর্জ ডি রোজারিও, মোহাম্মদ শাহজাহান, মোহাম্মদ জাকারিয়া, নূরুল করিম নাসিম, মুজিবুল হক, আবু নাহিদ, ফয়জুর রহমান মিন্টু, মোহাম্মদ আব্দুর রহিম, অ্যাডভোকেট সি এন ইউসুফ, ফরিদুর রেজা সাগর, এম. আহসান উল্লাহ, প্রাণেশ সমাদ্দার, সৈয়দ আসাদুজ্জামান বাচ্চু, মাকিদ হায়দার, আমিরুল ইসলাম, বি. এম. আমিনুল ইসলাম, তারক সাহা, জুয়েল আইচ ও ইমরুল চৌধুরী।
বিউটি বোর্ডিং মূলত চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল, যার পূর্ণতা পায় পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরে। প্রগতিশীল ও সমমনা লেখক, কবি, শিল্পীদের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছিল আজকের এই মলিন, জরাজীর্ণ হলুদ ভবনটি। যার প্রমাণ আমরা পাই দেশের কিংবদন্তি সব লেখকদের লেখায়, স্মৃতিচারণায়, আত্মজীবনীতে। যেমন- খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অতলের কথকথা’য় লিখেছেন,
বন্ধু কায়েস আহমেদই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে জড়ো হওয়া কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের সামনে। …বিউটি বোর্ডিংয়ে সমবেত হতে পারার মাধ্যমে দেশের অনেক নবীন প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম।
একবার সৈয়দ শামসুল হক প্রসঙ্গে এক বক্তব্যে কবি আসাদ চৌধুরী বলেছিলেন,
বেশ মনে পড়ে বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংয়ে তার সাথে প্রথম দেখা হয়।
কবি বেলাল চৌধুরী যেমন তার সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে বইয়ে বেশ কয়েক জায়গায় বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে লিখেছেন। এছাড়াও কবি আল মাহমুদ, শহিদ কাদরী, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে আরও অনেকেই বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা তুলে ধরেছেন তাদের গদ্য, পদ্য কিংবা সাক্ষাৎকারে।
আজ আর আড্ডা নেই বিউটি বোর্ডিংয়ে। কিন্তু কালের সাক্ষী আর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আজও ব্যবসাটা ধরে রেখেছেন শহিদ প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী চন্দ্র সাহার উত্তরসূরীরা।
এখনো বিউটি বোর্ডিংয়ে রাত কাটানো যায় অতি সস্তায়, মাত্র ২০০-২৫০ টাকায়, যদিও বেশিরভাগ রুম খালিই থাকে এখন। একইসাথে স্বল্পমূল্যে খাওয়া যায় টাটকা সব খাবারও। বিশেষ করে টাটকা মাছের নানা আইটেম পাওয়া যায়। সারা বছর সেখানে পাওয়া যায় সর্ষে ইলিশ আর বিউটি বোর্ডিংয়ের বিখ্যাত দধি।
মূলত বিউটি বোর্ডিংয়ে খেতেই যান বেশিরভাগ মানুষ। এই সময়ের অনেক কবি, লেখক ও সাহিত্যের পাঠক কিংবা সাংবাদিকগণও সেখানে গিয়ে থাকেন, খাবার খেয়ে আসেন শুধু নিজেদের নস্টালজিক করে তুলতে। পুরান ঢাকার যানজটের যন্ত্রণা মাড়িয়ে গিয়ে আচ্ছন্ন হন কালের গহীন গহ্বরে।
আজ বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রাণ কবি শামসুর রাহমান, শহিদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে নেই; বেঁচে নেই আল মাহমুদ, রফিক আজাদরাও। নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহারাও বার্ধ্যকের যাতনায় বিউটি বোর্ডিংয়ের মত নিভু নিভু প্রদীপ হয়ে জ্বলছেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে মহাদেব সাহা ২০০৩ সালে লিখেছিলেন,
সেই পাখি উড়ে গেছে/ঝরে গেছে ফুল/সারাদিন বৃষ্টিভেজা/ বিউটি বোর্ডিং…’
ফুলেরা ঝরে যাক, আড্ডা থাকুক আর না-ই থাকুক, তবু বিউটি বোর্ডিং নামক ফলবান বৃক্ষটি বেঁচে থাকুক আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক আর কালের সাক্ষী হয়ে।