মেহেরবানু খানম: ঢাকার প্রথম ও আধুনিক নারী চিত্রশিল্পী

‘পাপের নদী উত্তাল তরঙ্গে ছুটিয়া চলিয়াছে। এই নদীতে কাণ্ডারীহীন গোমরাহীন তরণী আত্মরক্ষা করিতে না পারিয়া আরোহীসহ নিমজ্জিত হইতেছে। তাহার হালের দিকটা মাত্র ডুবিতে বাকি আছে। তাহার উদ্ধারের কোন আশা নাই। কিন্তু যাহারা তাওহীদের আশ্রয় লইয়াছে, তাহারা বাঁচিয়াছেন, কারণ এই তরণীর কর্ণধার হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়ালিহি ওসাল্লাম। তাহার চারি প্রধান আসহাব এই তরণীর বাহক। উত্তাল তরঙ্গমালার দিকে বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া তাওহীদের তরণী কেমন অবলীলাক্রমে চলিয়াছে। যাহারা এই তরণীতে আশ্রয় লইয়াছেন, তাহাদের কোন ভয় নাই, কারণ তাদের শাফায়াতের (মুক্তি) পাল প্রস্তুত করিয়া রাখা হইয়াছে। যে দিন বিপ্লব বিশ্ব রেণূ হইতে রেণুতে পরিণত হইয়া যাবে, যে দিন মহাপ্রলয় সংঘটন হইয়া মহাবিচারের দিন সমাদৃত হইবে, সেই দিন এই পাল মুক্ত হইবে। ‘তাওহীদ’ অবলম্বনকারীগণ সেই দিন বিনা আয়াসে ফানাফিল্লায় পৌঁছিবেন, আত্মা সে দিন মহানন্দে পরমাত্মার সহিত মিলিত হইবে।’ 

গদ্যশিল্পী সৈয়দ এমদাদ আলীর বয়ানে একটি চিত্রকর্মের এই বর্ণনাকে যদি আরেকটু সহজ করে বলা যায় তাহলে পুরো বিষয়টা দাঁড়ায় এমন- পাপের নদী উত্তাল তরঙ্গে ছুটে চলছে। মাঝি না থাকায় নদীতে চলমান নৌকা আরোহীসহ ডুবে যাচ্ছে। হালের দিকটাই কেবল এখনও পানির সাথে নিজের দম্ভ প্রকাশ করে টিকে আছে। আরোহীদের চোখে-মুখে উদ্ধারের কোনো আশা নেই। অন্যদিকে তাওহীদের নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের কোনো ভয় নেই। কারণ নৌকার কর্ণধার স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এই নৌকার যাত্রীরা বিনা বাধায় আল্লাহর নিকট পৌঁছাবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। 

এটি কোনো গল্পের সারমর্ম নয়, বরং এটি একটি চিত্রকর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলা চলে। সংক্ষিপ্ত বলার কারণ চিত্রকর্মের বিশালতা শিল্পীর শিল্পকর্মকেও ছাড়িয়ে যায় প্রায় সময়ই। এমনই এক চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’। আর এই চিত্রকর্ম যার সৃষ্টি তিনি ছিলেন ঢাকার নবাব বাড়ির নবাবজাদী মেহেরবানু খানম। ধারণা করা হয়, তিনিই ছিলেন ঢাকার তথা বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম ও আধুনিক নারী চিত্রশিল্পী।   

নবাবজাদী মেহেরবানু খানমের একটি দুর্লভ ফটো; Image Source: facebook.com/nawabsalimullah

বর্তমান ঢাকার আহসানউল্লাহ মঞ্জিল যার নামে নামকরণ করা হয়েছে সেই স্যার নবাব আহসানুল্লাহের কন্যা ছিলেন চিত্রশিল্পী নবাবজাদী মেহেরবানু খানম। আরেক প্রখ্যাত ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর বাহাদুরের বোন ছিলেন তিনি। তার স্বামী ছিলেন খান বাহাদুর খাজা মোহাম্মদ আজম, যিনি নিজেও বঙ্গদেশে তৎকালীন সময়ে ব্যাপক সুনামের অধিকারী ছিলেন। 

ঢাকার নবাব পরিবারের পিতৃপুরুষ ছিলেন খাজা আলীমুল্লাহ। তিনি ছিলেন খাজা আহসানুল্লাহর পুত্র। কিন্তু ছোট বয়সেই তিনি তার পিতাকে হারান এবং তার চাচা খাজা হাফিজুল্লাহ, যে কিনা নিঃসন্তান ছিলেন, তার কাছেই লালিতপালিত হন। চামড়া ও লবণের ব্যবসা করতেন হাফিজুল্লাহ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর, তিনি বেশ কিছু জমিদারী কিনেন এবং নীল ব্যবসায়ও চালু করেন। তার মৃত্যুর পর সব জমিদারী এবং ব্যবসায়ের দায়িত্ব পান খাজা আলীমুল্লাহ। 

উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারী পাওয়ার পর তিনি ঢাকাসহ খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ এবং ত্রিপুরায় ব্যাপক জমিজমা কেনেন। তিনি নিজে অর্থঋণের একটি ব্যবসায় চালু করেন এবং ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা ব্যাংকের অন্যতম প্রধান শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর সকল কিছুর দায়ভার গ্রহণ করে তারই সুযোগ্য পুত্র নবাব আবদুল গণি। 

১৮৪০ সালে নাম না জানা এক শিল্পীর আঁকা খাজা হাফিজুল্লাহর বাসভবন বুড়িগঙ্গার তীরে; Image Source: nawabbari.com

ব্রিটিশদের কাছ থেকে আব্দুল গণি নবাব উপাধি পেয়েছিলেন। নবাব আবদুল গণি তার ছেলে আহসানউল্লাহর নামে আহসান মঞ্জিল নির্মাণ করেন বুড়িগঙ্গার তীরে। আহসানউল্লাহ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। তার ৪ জন সহধর্মিনীর একজনের নাম ছিল কামরুননেসা খানম। তাদের বিয়ে হয় ১৮৮২ সালে। 

কামরুননেসার ঘরে তিন মেয়ে জন্ম নেয়। পরীবাণু, মেহেরবানু এবং আখতার বানু। মায়ের মৃত্যুর পর তিন বোনের উদ্যোগে কামরুননেসা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। নবাব পরিবারের ব্যক্তিগত কবর ছিল বেগমবাজারে। সেখান থেকে প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, পরীবাণুর জন্ম হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। পরীবাণুর পিঠাপিঠি ছোট বোন ছিল মেহেরবানু খানম। সেই হিসেবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত মেহেরবানু খানমের জন্ম খুব সম্ভবত ১৮৮৫-৯০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। 

খাজা পরিবার পরবর্তীতে নবাব পরিবার ঢাকার অন্যতম প্রভাবশালী প্রাচীনতম পরিবার, যারা শিক্ষা খাতে ব্যাপক আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করে থাকতেন। এমনকি খাজা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আব্দুল গণি ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। এছাড়াও, নবাব পরিবারের অনেকেই শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। 

পরীবানু খানম, আখতারবানু খানম এবং মেহেরবানু খানম; Image Source: facebook.com/nawabsalimullah

আর শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, ডাক্তার, শিল্পীসহ সব ধরনের গণ্যমান্য ব্যক্তির আনোগোনা ছিল নবাববাড়িতে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে নবাব পরিবারের পুরুষদের মধ্যে আগ্রহ না থাকলেও পারিবারিক পরিবেশে সবাই কমবেশি পড়ালেখা করতেন। যার কারণে ঘরভর্তি ছিল বইপত্র, প্রবন্ধ সংকলন, রাজনৈতিক ইসতিহার; নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা সাহিত্য। যার ফলে নবাব বাড়ির পরিবেশই ছিল পারিবারিক শিক্ষাময়। আর নবাবজাদী মেহেরবানু খানমও নবাব পরিবারের পারিবারিক পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।  

নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর সৎবোন ছিলেন নবাবজাদী মেহেরবানু খানম। সলিমুল্লাহ ছিলেন তার চেয়ে বয়সে বড়। তাই বড় ভাই হওয়ার কল্যাণে তিনি মেহেরবানু খানমের বিয়ে ঠিক করেন সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক খাজা মোহাম্মদ আজমের সাথে। সম্পর্কে মেহেরবানু খানমের স্বামী ছিলেন তাদেরই নিকটাত্মীয়। খাজা আতিকুল্লাহ শায়দার পুত্র ছিলেন খান বাহাদুর খাজা মোহাম্মদ আজম। মেহেরবানুর শ্বশুর এবং স্বামী দুজনই ছিলেন সেকালের গণ্যামান্য এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বিশেষ।  

১৯০১ মতান্তরে ১৯০২ সালের পৌষ মাসে খাজা মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে মেহেরবানু খানমের বিয়ে হয়। খাজা মোহাম্মদ আজম ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। এছাড়াও, তিনি জমিদার, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বিশিষ্ট উর্দু কবি, প্রাবন্ধিক এবং উর্দু অনুবাদক হিসেবেও তার সুখ্যাতি ছিল। শরৎ বোসের ‘বড় বউ’ নামের জনপ্রিয় উপন্যাসটি ‘বড়ী বহু’ নামে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি।

খান বাহাদ্যর খাজা মোহাম্মদ আজমের একটি দুর্লভ চিত্র; Image Source: nawabbari.com

ঢাকার পঞ্চায়েত প্রধান, ঢাকা পৌরসভার কমিশনার, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম সমিতির সভাপতি, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য, পূর্ব ঢাকা ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য, ঢাকা জেলা মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য, ঢাকা রিক্রুটমেন্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়), রয়্যাল ম্যাটেরিওলজিক্যাল সোসাইটির সদস্য, ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, ভূমি মালিক সমিতির সদস্য এবং রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টের সম্মানীত সদস্য ছিলেন মেহেবানু খানমের স্বামী খাজা আজম।  

ঢাকার পঞ্চায়েত প্রথার উপর রচিত ‘দ্য পঞ্চায়েত সিস্টেম অব ঢাকা’ তারই রচনা, যা প্রামাণ্য দলিল বলে স্বীকৃত। পরবর্তীতে ইংরেজি থেকে নিজেই উর্দুতে অনুবাদ করেন এবং নামকরণ করেন ‘ইসলামি পঞ্চায়েত ঢাকা’। হেকিম হাবিবুর রহমান সম্পাদিত উর্দু ভাষার মাসিক পত্রিকা যাদু-র অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। 

তাই আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মেহেরবানু খানমের পারিবারিক পরিবেশ ছিল কতটা শিক্ষাময় এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পূর্ণ। তাছাড়া, যেহেতু খাজা আজম নিজেই ছিলেন শিল্পমনা। তাই, স্ত্রী মেহেরবানু খানমের শিল্পচর্চায় তার তরফ থেকে ছিল প্রবল উৎসাহ। স্বামী-সন্তান আর নবাব বাড়ি বাদেও যে আলাদা একটা নিজস্ব জগত আছে, এই বিষয়টা মেহেরবানুকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন তার স্বামী। 

সর্বডানে খাজা মোহাম্মদ আজম এবং তারপর মেহেরবানু খানম ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দুর্লভ একটি চিত্র; Image Source: nawabbari.com

তাদের বাসায় ছিল দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত ও খ্যাতনামা সব চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির সংগ্রহ। এছাড়াও, অসংখ্য বইপুস্তক, ফটোগ্রাফ, সচিত্র প্রতিবেদন বা নিবন্ধ এবং পত্র-পত্রিকাসহ আরো অনেক কিছু। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই শিল্পীদেরও দেখা যেত তাদের বসার ঘরে বসে আড্ডা দিতে। তাই, মেহেরবানু খানমের অঙ্কন বিদ্যাচর্চার পুরোটাই হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশে। 

বিবাহিত জীবনে তার দুই পুত্র এবং এক মেয়ে ছিল। পুত্র দুজন হচ্ছেন খাজা মোহাম্মদ আদিল এবং খাজা মোহাম্মদ আজমল। খাজা মোহাম্মদ আদিল ছিলেন ঢাকাস্থ উর্দু সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি। হেকিম হাবিবুর রহমানের যাদু পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ করেন তিনি। এছাড়াও, তিনি ছিলেন ঢাকার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এর অন্যতম অভিনেতা এবং সংগঠক। 

আরেক পুত্র খাজা মোহাম্মদ আজমল ঢাকার বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক এবং বেতার ঘোষক-অভিনেতা ও পাঠক ছিলেন। এছাড়াও, ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস-এর নায়ক, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক এবং সম্পাদকও ছিলেন তিনি। আর মেহেরবানুর মেয়ে হুরবানু খানমের বিবাহ হয় নবাব সলিমুল্লাহর ছোট ভাই নবাবজাদা খাজা আতিকুল্লাহর বড় পুত্র খাজা মোহাম্মদ আজাদের সঙ্গে। যিনি দ্য লাস্ট কিস মুভির চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন। 

পরীবানু, আখতারবানু এবং মেহেরবানু খানম চেয়ারে বসে এবং আশেপাশের তাদের সন্তানাদি এবং আত্মীয়স্বজন; Image Source: facebook.com/nawabsalimullah

খাজা মোহাম্মদ আজম এবং মেহেরবানু খানম দম্পতির বাস ছিল ঢাকার দিলকুশা এলাকাতে। আর উল্লিখিত তথ্য মোতাবেক তাদের বাসা যে, গত শতকের প্রথম তিন দশকে সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মিলনস্থল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  এরকম পরিবেশেই তার অঙ্কন শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছিল। তার এই অসাধ্য সাধন প্রচেষ্টা সম্পর্কে মোসলেম ভারত পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, 

নওয়াবজাদী মেহেরবানু খানম সাহেবা স্বামী পুত্র-কন্যা পরিবৃত বৃহৎ সংসার লইয়াও যে চারুশিল্পীর সেবায় মন দিতে পারিতেছেন ইহা তাহার মতো এক অতি সম্ভ্রান্ত মোসলেম নারীর পক্ষে কম শ্লাঘার বিষয় নয়। অবসর সময় বিনোদনের জন্য তিনি যে পথ বাছিয়া লইয়াছেন, ইহা হইতে উৎকৃষ্ট পথ আর কিছু আছে কিনা জানি না। 

তার অঙ্কন জীবনে কতগুলো ছবি তিনি এঁকেছিলেন বা কত সাল নাগাদ ছবি আঁকা শুরু করেন তার সন্ধান জানা যায় না। তবে তার অঙ্কিত দুটি শিল্প সম্পর্কে জানা যায় যা মোসলেম ভারত পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১৯১৩ মতান্তরে ১৯১৪ সালের একটি আলোকচিত্রতে দেখা যায় যে, মেহেরবানু তার পুত্র-কন্যাকে সাথে নিয়ে একটি চিত্র আঁকছেন। 

তার প্রকাশিত এই দুটি চিত্র তিনি এঁকেছিলেন কেবল তার ছয় মাস শিক্ষার ফলাফলে। পারিবারিক অন্তঃপুরে থেকেও স্বামী, সন্তান, সংসারধর্ম পালনের পাশাপাশি নীরবে নিভৃতে রঙ-তুলি আর ক্যানভাসে তিনি নির্মাণ করেছিলেন নিজস্ব এক সৃজনশীল ভুবন।  

নিজের সন্তানদের সাথে ছবি আঁকছেন মেহেরবানু খানম; Image Source: nawabbari.com

নজরুল সঙ্গী মুজাফফর আহমদ এর কল্যাণে জানা যায় যে, ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তিনি ঢাকা এসে নবাবজাদী মেহেরবানু খানমের দুটো চিত্র সংগ্রহ করেন। তিনি তা সংগ্রহ করে কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামকে দেন পরিচিত লিখে দেওয়ার জন্য। দুটো চিত্রকর্মের মধ্যে একটি ছিল নদী পারাপারকৃত নৌকার ছবি। মূলত এই চিত্র দেখেই নজরুল ইসলাম রচনা করেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’। 

নবাবজাদী মেহেরবানু খানমের আঁকা দুটি চিত্রকর্ম ‘মোসলেম ভারত’-এর ১৯২০ সালের, বাংলা সন ১৩২৭ সালের শ্রাবণ মাস সংখ্যা ছাপা হয়। একই সংখ্যাতে ‘চিত্র পরিচয়’ শিরোনামে সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী বিস্তারিতভাবে চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিত লেখেন। 

সম্ভবত নবাবজাদী মেহেরবানু খানমই ছিলেন মুসলিম বাংলার প্রথম নারী অঙ্কনশিল্পী। শিল্পকর্ম প্রকাশের পাশাপাশি এই সম্পর্কে আলোচনাও প্রকাশ হয়েছিল প্রথমবারের মতো। উপরে মেহেরবানু খানমের প্রথম চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে বিধায় এখানে সৈয়দ এমদাদ আলী কর্তৃক মোসলেম ভারতে লিখিত আর দ্বিতীয় চিত্রকর্মের সম্পর্কে লিখেছেন: 

মোসলেম ভারতে প্রকাশিত মেহেরবানু খানমের চিত্রকর্ম; যা দেখে নজরুল লিখেছিলেন খেয়াপারের তরণী; Image Source: dhakakendro.com

দ্বিতীয় চিত্র পল্লীদৃশ্য। বিক্রমপুরের উত্তর দিকে তালতলা একটি বন্দর। এই বন্দরের পূর্বদিকে যে গ্রামখানি নদী তীরে বিস্তৃতি রহিয়াছে, চিত্রে তাহাই অঙ্কিত হইয়াছে। দক্ষিণে গ্রাম, উত্তরে ধলেশ্বরী নদী ধবল বারিরাশি বুকে করিয়া বহিয়া রহিয়াছে। মৃদুল বায়ু হিল্লোলে নদীবুকে যে তরঙ্গের লীলা আরম্ভ হইয়াছে, চিত্রে তাহা বড়ই সুন্দর করিয়া অঙ্কিত হইয়াছে। আলো ও ছায়ার সু-সমাবেশে উহা কি মনোরমই না দেখাইতেছে। ধলেশ্বরীর অত্যাচারে তালতলা ও তাহার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি আজ বড়ই বিপন্ন। চিত্রে ভাঙ্গন পাড়ের দৃশ্যটিও বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। গ্রামখানি একসময়ে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল, তীরের শ্যাম তরুশ্রেণি তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। 

মেহেরবানু খানমের সম্পর্কে অনুপম হায়াৎ তার বইতে লিখেছেন, তার অঙ্কন চর্চায় কখনো কোনো জীবজন্তুর অস্তিত্ব থাকতো না। তিনি সবসময়ই প্রকৃতি ও ইসলামের ধর্মীয় চেতনাকে তার শিল্পসত্তায় ধরে রাখতেন। শিল্পী মেহেরবানু সাহেবার শিল্পচর্চায় স্বামীর উৎসাহ ছিল ব্যাপক। তাই, স্বামী-সন্তান-সংসারধর্ম পালনের পরেও তিনি অবসরে মেতে থাকতেন রঙ-তুলি নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, শিল্পী মেহেরবানু খানমের আঁকা অন্যান্য ছবি রয়েছে অনুদ্ধারিত। 

নবাবজাদী মেহেরবানু খানম, তার মেয়ে হুরবানু এবং এতিম বলে যাদের তিনি লালনপালন করতেন; Image Source: nawabbari.com

মেহেরবানু খানম ছিলেন স্নেহশীল, দানশালী, শিক্ষানুরাগী ও মহীয়সী এক নারী। বাংলাবাজার এলাকায় তিনি মেয়েদের স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়াও, এতিম শিশুদের লালনপালনের প্রমাণও রয়েছে তার নামে। ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকার নবাব পরিবারের এই বিদুষী চিত্রশিল্পী নবাবজাদী মেহেরবানু খানম মৃত্যুবরণ করেন। তার এমন বিদায়ে নবাব পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সেদিন কেঁদেছিলেন এবং ব্যথিতও হয়েছিলেন বলে জানা যায় খাজা শামসুল হকের ডায়েরিতে। তার দাফন সম্পন্ন হয় দিলকুশা মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে। 

This article is in the Bengali Language. A historical biography of Meherbanu Khanam, a daughter of the Nawab family of Dhaka, the first woman artist in Dhaka.
The necessary references are below.

Feature Image: nawabbari.com
References: 

01. বই-মেহেরবানু খানম। লেখক-অনুপম হায়াৎ। প্রকাশনী-বাংলা একাডেমি। প্রকাশকাল-১৯৯৭। 
02. বই-পুরানো ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ। লেখক-অনুপম হায়াৎ। প্রকাশনী- বাংলা একাডেমি। প্রকাশকাল-২০০১। 
03. যেভাবে সন্ধান মিলেছিল দেশের প্রথম মুসলিম নারী চিত্রশিল্পীর - https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0/news-details-118702
04. Nawabzadis Painting inspires Nazrul Islam - nawabbari.com
05. Meherbanu Khanam - https://en.banglapedia.org/index.php/Khanam,_Meherbanu

Related Articles

Exit mobile version