ঢাকার নারিন্দা সমাধিক্ষেত্রের ব্যাপারে হয়তো অনেকেরই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আবার অনেকেই আছেন যারা এমনকি সরাসরি এই সমাধিক্ষেত্র দেখেছেনও, কিন্তু এটিই যে সেটি, তা জানতেন না। অবস্থান বললে তারা ঠিকই চিনে যাবেন। ওই যে ওয়ারীতে বলধা গার্ডেনের সামনে যে খ্রিস্টান গোরস্তান রয়েছে, ওটার কথাই বলছি। ঢাকার চারশো বছরের ইতিহাসে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে এই সমাধিক্ষেত্রটি। কিন্তু সঠিক জ্ঞানের অভাবে আজ আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের একান্ত নিজস্ব ইতিহাসের এই অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়কে।
কবে এই সমাধিক্ষেত্রের জন্ম?
সমাধিক্ষেত্রের ভেতরে এক সাইনবোর্ডে এর প্রতিষ্ঠার সাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৬০০ সাল। কিন্তু মনে হয় না কেউই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে দাবি করতে পারবেন যে, এই তথ্য ধ্রুব সত্য। তবে আমরা ধারণা করে নিতে পারি, সতেরো শতকের প্রথম দিকেই এই সমাধিক্ষেত্রটি গড়ে ওঠে। কেননা ঐ সময়েই প্রথম পর্তুগিজরা, এরপর একে একে ওলন্দাজ, ফরাসি, আর্মেনীয়, গ্রিক ও ইংরেজরা ঢাকার মাটিতে পা রাখেন ব্যবসায়ের উদ্দেশে। আর তাদের পথ ধরে মিশনারিরা আসেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপীয়দের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকা।
এই ইউরোপীয়দের অনেকেই স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাসের নিয়ত নিয়ে এসেছিলেন। আর তাই নিজেদের প্রয়োজনেই তারা ঢাকায় গড়ে তুলতে শুরু করেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, কুঠি, উপাসনালয়, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ঢাকাই জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন তারা। ঢাকার মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাসও ত্যাগ করতে শুরু করেন অনেকে।
এই ইউরোপীয়দের সমাহিত করা হবে কোথায়? ইউরোপীয় সম্মানীত ব্যক্তিত্বদের তো আর যেখানে সেখানে চিরশায়িত করা যায় না। তাই ঢাকার তিনটি স্থানেই মূলত সমাধিস্থ করা হতে থাকে ইউরোপীয়দের- তেজগাঁও, আরমানিটোলা ও নারিন্দায়। এর মধ্যে নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রটিই ছিল প্রধান ও সর্ববৃহৎ।
সর্বপ্রাচীন এপিটাফ
এই সমাধিক্ষেত্রের সমাধিগুলোতে যেসব এপিটাফ বা সমাধিফলক পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই কলকাতায় তৈরি। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে এই সমাধিক্ষেত্র গড়ে উঠলেও, সবচেয়ে পুরনো যে এপিটাফটির দেখা মেলে, সেটি ১৭২৪ সালের। সমাধিটি কলকাতার কোম্পানি চ্যাপলিন রেভারেন্ড জোসেফ পেজেটের। ১৭২৪ সালের ২৬ মার্চ ঢাকাতেই মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই সমাধিটির সামনেই রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সাইনবোর্ড। তাতে এই সমাধিক্ষেত্রকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ বলে ঘোষণা দেওয়া।
যেহেতু জব চার্নক ১৬৯০ সালের পর কলকাতার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাই আমরা ধরে নিতেই পারি, কেবল এর পরের সময়কালের, অর্থাৎ আঠারো শতকের সমাধিগুলোতেই প্রথম এপিটাফ ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে সম্ভবত ঢাকায় স্থানীয়ভাবে পাথরের এপিটাফ তৈরি সম্ভব ছিল না বলে সমাধিগুলোতে এপিটাফ ব্যবহার করা হয়নি। এবং অনুমানের ভিত্তিতে আমরা আরও বলতে পারি, এর আগের সমাধিগুলো সাধারণ মানের ছিল বলে সময়ের বিবর্তনে সেগুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সমাধিক্ষেত্রটি মূলত চার্চ গ্রেভইয়ার্ড
এই সমাধিক্ষেত্রটির পাশেই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকার প্রথম গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে পাদ্রী সেবাস্তিয়ান মানরিক যখন ১৬২৪ থেকে ১৬২৯ সালের মধ্যে ঢাকায় এসেছিলেন, তিনি সেখানে গির্জা দেখেছিলেন। আরও অনেক যাজক ও পর্যটকের বিবরণীতেই এখানে অবস্থিত একটি গির্জার উল্লেখ পাওয়া যায়। ফরাসি পরিব্রাজক জ্যঁ বাপ্তিস্ত তাভারনিয়ে ১৬৬৬ সালে এবং এর পরপরই নিকোলো মেনুচি ঢাকা সফর করেন। তাঁরা দুজনই এখানকার গির্জার কথা বলেছেন। তাই আমরা ধরে নিতেই পারি, পর্তুগিজ অগাস্টানিয়ানরা গির্জাটি তৈরি করেছিল, এবং বর্তমান সমাধিক্ষেত্রটি ছিল মূলত সেই গির্জা সংলগ্ন সমাধিক্ষেত্র, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় চার্চ গ্রেভইয়ার্ড।
সমাহিত করা হয়েছিল গির্জার খুন হওয়া যাজককেও
গির্জাটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, সে আমলে ঢাকায় পর্তুগিজ ছাড়াও আরও কিছু ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু ১৬৩২ সালে, পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্য ও উদ্ধত আচরণ যখন চরমে পৌঁছে, তখন সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তাদেরকে উৎখাত করে হুগলিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই সময়েই স্থানীয়রা সম্রাটের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গির্জার যাজক, ফাদার বেরনার্দোকে পিটিয়ে হত্যা করে। ধারণা করা হয়, তাঁকেও এখানেই সমাহিত করা হয়েছিল।
গির্জার বিলুপ্তি
১৭৮৯ সালে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত অগাস্টানিয়ানদের গির্জার একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, সেখানে উল্লেখ পাওয়া যায়নি নারিন্দার গির্জার। সে কারণে ধরে নিতে হয় যে, ১৭১৩ থেকে ১৭৮৯ সালের মধ্যেই কোনো এক সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় গির্জাটি। একে আমাদের জন্য একটি চরম ক্ষতিই বলা যায়। যদি এত তাড়াতাড়ি গির্জাটির বিলুপ্তি না ঘটত এবং এটির অস্তিত্বের দালিলিক প্রমাণ মিলত, তাহলে সেই সূত্র ধরে আরও অনেক প্রশ্নেরই হয়তো উত্তর মিলত। ফলে ঢাকায় ইউরোপীয়দের আগমনের প্রথম দিককার ইতিহাসও আরও বেশি স্বচ্ছ ও সমৃদ্ধ হতো।
সমাধিক্ষেত্রটির স্থাপত্যশিল্পের তাৎপর্য
একসময় এই পুরো সমাধিক্ষেত্রটিই ছিল প্রাচীরঘেরা, এবং মুসলিম রীতিতে নির্মিত গেট দিয়ে সাড়ে ছয় একরের উপর অবস্থিত মূল ভূখন্ডে প্রবেশ করতে হতো। এই সমাধিক্ষেত্রে মোট ছয় ধরনের সমাধির দেখা পাওয়া যায়।
টাইপ এ – এই ধরনের সমাধি হয় এতই পুরনো যে সেগুলোর কোনো ধ্বংসাবশেষই আর চোখে পড়ে না, অথবা এতই নতুন যে সেগুলোর মৌলিকত্ব নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এসব ক্ষেত্রে সমাধিটির আসল অবস্থা দর্শনার্থীদের জন্য পাশেই নির্দেশিত থাকে।
টাইপ বি – এ ধরনের সমাধিগুলোতে মুরীয় ঘরানার তোরণ দেখা যায়, যার অধিকাংশই বহু বছর ধরে পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এ ধরণের সমাধির নকশা অনেকটা সমতলভূমির কেন্দ্রের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ তোরণের মত।
টাইপ সি, ডি, ই – এ ধরনের সমাধির স্তৃতিস্তম্ভ আর কফিনের সাথে কলকাতার সমসাময়িক ইংরেজ সমাধিগুলোর সাদৃশ্য দেখা যায়। এ সমাধিগুলো দেখতে অনেকটাই ভারতীয় পিরামিডের মতো, যা একটি পাকা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। পাকা ভিত্তিটি সমাধির উপর তৈরি হয়, আর সেটির স্মৃতিস্তম্ভ কোণাকুণিভাবে উপরে উঠে একটি চূড়ায় গিয়ে শেষ হয়।
টাইপ এফ – এ ধরনের সমাধিগুলো সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ও বিচিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই সমাধিগুলো বৃত্তাকার নয়, বরং ডোরিক ও আয়ন কলামের দ্বারা অষ্টভুজ ও বর্গাকৃতির হয়। পরবর্তী অংশে এ ধরনের সমাধি সম্পর্কে আমরা আরও বিশদে জানব।
বিশপ হেবারের আগমন
রেজিনাল্ড হেবারকে একজন প্রকৃত অলরাউন্ডার বলা যায়। এক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ পরিবারে জন্ম নেয়া এই মানুষটি অক্সফোর্ডে পাঠরত অবস্থায় প্রশস্তি-সংগীত রচনার মাধ্যমে কবি হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তিনি একজন পর্যটক ও অ্যাডভেঞ্চারারে পরিণত হন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে তার পরিচয় ছিল ‘বিশপ অব ক্যালকাটা’ হিসেবে।
১৮২৪ সালের ২২ জুলাই বিশপ হেবার ঢাকায় এসে নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রটির পবিত্রকরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে তার Narrative of a Journey through the Upper Provinces of India, From Calcutta to Bombay, 1824-1825 নামক একটি বই প্রকাশিত হয়, যেখান থেকে আমরা জানতে পারি এই সমাধিক্ষেত্র সম্পর্কে তার অভিমত।
“Some of the tombs are very handsome; one more particularly, resembling the buildings raised over the graves of Mussulman saints, has a high octagon gothic tower, with a cupola in the same style, and eight windows with an elaborate tracery.”
(কিছু সমাধি খুবই সুন্দর। বিশেষ করে একটি, যেটির উপর মুসলমান পীর-ফকিরদের সমাধিতে যেমন আটকোণা গথিক মিনার দেখা যায়, সেই একই রকম কারুকার্যখচিত গম্বুজ ও আটটি জানালা রয়েছে।)
হেবার উল্লেখ করেছিলেন পেজেটের সমাধিটির কথা, যা এই সমাধিক্ষেত্রে টিকে থাকা সবচেয়ে পুরনো সমাধি। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেছিলেন ওয়ান্সি কোঁয়া নামক এক চীনা খ্রিস্টানের সমাধির কথাও। ১৭৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মারা যান এই ভদ্রলোক। পরে তার সমাধি স্থাপনা গড়ে দেন তারই স্বদেশী সুহৃদ ওয়ানা চৌ।
কলম্বো সাহেবের সমাধি
হেবার উল্লিখিত সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক সমাধিটি হলো জনৈক কলম্বো সাহেবের। ইতিপূর্বে এফ টাইপ যে সমাধিগুলোর কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোর একটি এটি। তিনটি সমাধির সমন্বয়ে গঠিত এই সমাধিটি। ঋতু ও জলবায়ু পরিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থান বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, এই সমাধিটির আসল কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন যা দেখতে পাওয়া যায়, তা নিছকই ধ্বংসাবশেষ বাদে আর কিছুই নয়।
এই সমাধির স্তম্ভটি মোঘল আমলের মসজিদসমূহের নকশার আদলে তৈরি। বর্গাকার একটি সমাধি, তার চারপাশে প্রতিদিকে রয়েছে চারটি করে দরজা। সমাধিটির অগ্রমুখে, বাকি তিনদিকের বৃহৎ মধ্যভাগে রয়েছে একটি মুখের ছবি। আর শেষদিকে একটি অষ্টভূজাকৃতির স্তম্ভ, যাতে আবার রয়েছে একটি স্বর্গের পরীর ছবি। এই সমাধির শীর্ষে গম্বুজ আচ্ছাদিত একটি আটকোণা বরুজও আছে। দেয়ালে রয়েছে বেশ কিছু শিলালিপি। প্রতিদিকে একটি করে দরজা। আর একদম সামনের দিকে প্যাঁচানো নকশাবিশিষ্ট থাম।
কে এই কলম্বো সাহেব?
সবমিলিয়ে চোখধাঁধানো একটি সমাধিই বটে। কিন্তু কার সমাধি এটি? প্রশ্ন জেগেছিল হেবারের মনেও। বাকিটা তার নিজের বিবরণীতেই জেনে নিন।
“…the old Durwan of the burial ground said, it was the tomb of a certain ‘Columbo Sahib, Company ka nuokur;’ Mr Columbo, servant to the Company; who he can have been I know not; his name does not sound like an Englishman’s, but as there is no inscription, the beadle’s word is the only accessible authority.” (সমাধিক্ষেত্রের বুড়ো দারোয়ান বললো, এটি নাকি কোনো এক ‘কলম্বো সাহেব, কোম্পানি কা নওকার’ এর কবর। কোম্পানির সেই চাকুরে মি. কলম্বোকে আমি চিনতে পারিনি। তার নামটি শুনতে ইংরেজদের মতোও নয়। কিন্তু যেহেতু সেখানে কোনো লিখিত প্রতিলিপি নেই, তাই বুড়োর কথাই মেনে নিতে হলো।)
বোঝাই যাচ্ছে, বুড়ো দারোয়ানের মুখে কলম্বো সাহেবের পরিচয় কোম্পানির চাকুরে শুনেও হেবারের মনের সংশয় কাটেনি। ফলে কে যে আসলে এই কলম্বো সাহেব, তা আজও একটি অনুদ্ঘাটিত রহস্য হিসেবেই রয়েছে গেছে। রহস্যভেদের চেষ্টাচরিত্র কিন্তু কম করা হয়নি। কিন্তু সবই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
কোথাও নেই কলম্বো সাহেবের উল্লেখ
১৯১৭ সালে Bengal Past and Present নামক সাময়িকীর পঞ্চদশ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেখানে ওয়াল্টার কে ফারমিঙ্গার রচিত Some old graves at Dacca নামক একটি নিবন্ধও ছিল। কিন্তু সেই নিবন্ধেও লেখক নারিন্দা সমাধিক্ষেত্রের সমাধিগুলোর যে তালিকা সংযুক্ত করেছিলেন, সেখানে কোনো পরিচয় ছিল না কলম্বো সাহেবের।
তবে যেহেতু বুড়ো দারোয়ানের মুখে একবার কলম্বো সাহেবের পরিচয় হিসেবে কোম্পানির চাকুরে শব্দদ্বয় উচ্চারিত হয়েছে, তাই আমরা যাচাই করে দেখতে পারি এই সমাধিক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানির আর কোনো চাকুরের সমাধি রয়েছে কি না। আলবৎ রয়েছে। বেশ অনেকগুলো সমাধি বা পরিত্যক্ত এপিটাফই পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি নাথানিয়েল হলের। ১৭২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। অপর একটি নিকোলাস ক্লেরেম বল্টের। তিনি মারা যান ১৭৫৫ সালের ১৬ নভেম্বর। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে, তাদের কেউই আমাদের কলম্বো সাহেব নন। কারণ তাদের এপিটাফ কলম্বো সাহেবের সমাধিগৃহে পাওয়া যায়নি। আর কলম্বো সাহেবের সমাধিগৃহের তিনটি সমাধিই শূন্য, কোনো এপিটাফ নেই সেখানে। এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সম্ভবত কলম্বো সাহেবের সমাধিতে কোনোকালেই এপিটাফ বসানো হয়নি।
চিত্রকর্মে কলম্বো সাহেবের সমাধি
কলম্বো সাহেবের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া না গেলে কী হয়েছে, তাতে তার গ্রহণযোগ্যতা এতটুকুও কমছে না। কারণ ইউরোপীয় কোনো শিল্পীর আঁকা ঢাকার প্রাচীনতম চিত্রকর্মেই রয়েছে দেখা পাওয়া যায় তার সমাধির। ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী জোহান জোফানির ১৭৮৭ সালে তেলরঙে আঁকা ‘নাগাপন ঘাট’ নামে একটি চিত্রকর্ম রয়েছে। সেই চিত্রকর্মে দেখা যায়, ছোট্ট একটি নদীর পাড়ে দুর্গের মতো দেখতে একটি স্থাপনা। বাংলাদেশ ফোরাম ফর হেরিটেজ স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক ওয়াকার এ খানের মতে, ঐ স্থাপনাটিই হলো নারিন্দা সমাধিক্ষেত্রে কলম্বো সাহেবের সমাধি। এ থেকে আরও একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, কলম্বো সাহেবের মৃত্যু অবশ্যই ১৭৮৭ সালের আগে।
সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে আরও যাদের সমাধি
সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিও বহন করছে এই সমাধিক্ষেত্র। সিপাহী বিদ্রোহে নিহত দুই সৈনিকের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে এখানে, সদর দরজার বাঁ দিকে, একদম পথের শুরুতেই। এর মধ্যে একটি এখনও বেশ চেনা যায়। সেটি হেনরি স্মিথের, ২২ নভেম্বর বিদ্রোহের দিন তিনি নিহন হন। এছাড়াও যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত সেনা নেইল ম্যাকমুলেন ও জেমস মুরস ২৩ নভেম্বর এবং উইলিয়াম এসডেন ও রবার্ট ব্রাউন ২৪ নভেম্বর মারা যান।
এই সমাধিক্ষেত্রেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পোগোস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার নিকোলাস পোগোজও। তার আরও বড় পরিচয় তিনি ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ব্যাংকের একজন পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৮৭৪ সালে ঢাকা পৌরসভার কমিশনারও হয়েছিলেন। তার পাশাপাশি এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধিস্থ হয়েছেন তার ছেলে পলও।
আরও আছে বিখ্যাত গ্রিক ব্যবসায়ী মারকার ডেভিডের স্ত্রী এলিজাবেথের সমাধি। তার সমাধিটির উপর রয়েছে পাথরের তৈরি মা মেরীর মূর্তি। আছে ভ্যান তাসেলের সমাধিও, যিনি ঢাকার প্রথম নভোচারী।
শেষ কথা
যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে, এবং জনসাধারণের অবহেলায় ক্রমেই আমরা ভুলতে বসেছি ঢাকার এই নিজস্ব ঐতিহ্যকে। নিজেদের অজান্তেই আমরা হারিয়ে বসছি ঢাকার অনেক গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই সমাধিক্ষেত্রটিকে। অথচ বিশপ হেবার প্রায় দু’শ বছর আগেই এই সমাধিক্ষেত্রের বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, “
…the whole had so wild and characteristic an appearance, that I regretted that I had no time to make a drawing.” (পুরো জায়গাটিকে প্রথম দর্শনেই এতটা বুনো আর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মনে হয়েছিল যে, আমি আফসোস করছিলাম কেন আমার হাতে যথেষ্ট সময় নেই বসে একটা ছবি আঁকার।)
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/