তন্তু বয়ন করা পেশা যার = তন্তুবায়/তাঁতি, বহুব্রীহি সমাস
ব্যাসবাক্যের পূর্বপদ তন্তু থেকে তাঁত শব্দটা এসেছে। আর তাতে চন্দ্রবিন্দু চড়ে তাঁত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস হলো নাসিক্য ন্ ধ্বনির চন্দ্রবিন্দুতে বিবর্তনের ইতিহাস। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেদিকে না যাই। এখন বরং প্রসঙ্গে ঢুকে যাই সরাসরি।
ঢাকা নিউ মার্কেটের ভেতরে এককোণে আলীগড় লাইব্রেরি। রাজশাহীর এক মুরুব্বি। তিনিই সম্ভবত দোকানের স্বত্বাধিকারী। এদেশের যারা আলীগড়ে যাননি, অথচ বইপত্রে আলীগড় আন্দোলন, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়- এসব নাম দেখেছেন, ‘আলীগড়’ শব্দটির প্রতি তাদের এক আলাদা টান আছে। জানি না, হয়তো সেই মনস্তত্ত্ব কাজে লাগিয়েই অমন নামকরণ।
মনস্তত্ত্ব যা-ই হোক, উদ্দেশ্য মহৎ। কারণ অল্প জায়গার মধ্যে তিনি দোকানদারিতে সীমাবদ্ধ থাকেননি। দুয়েকজন বসে বসে পড়তেও পারে পছন্দের বই বেছে নিয়ে। দোকানকে মাইক্রোলাইব্রেরির পর্যায়ে উন্নীত করেছেন ভদ্রলোক। সদালাপী তিনি। যেকোনো বিষয়ে তার সাথে কথা বলা যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও অনেক কিছু তিনি বলেন। এরকমই একদিনের প্রাসঙ্গিক আলাপে আজকের লেখার বিষয়টির ইঙ্গিত ধরিয়ে দিয়েছিলেন আক্ষেপের সুরে,
জানো বাবা… তুমি যখন স্পেনে যাবা, ওরা তোমাকে কী দিবে? মাদ্রিদের ক্যাপ বা টিশার্ট। আবার নিউ ইয়র্কে যাও – বুকের ওপর আই লাভ NYC ছাপানো একটা উন্নতমানের টিশার্ট দেবে। এরকম পৃথিবীর মোটামুটি সব শহরই তাদের ব্র্যান্ডিংটা ভালো বোঝে। কিন্তু বাবা, আমরা বুঝি না। আমরা বুঝি একটা বিদেশি আসছে- তো তারে দাও বোমা মেরে খতরনাক করে। ছিনতাইকারীর পাওয়ার দিখা দো! অথচ দ্যাখো, এই শহরটা ৪০০ বছরেরও বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। কত্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু কোথায় সেই মসলিন?
আমরা কি পারতাম না নিজেদের আদিটাকে অন্তত এই বর্তমানের তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের দেখানোর জন্য সংরক্ষণ করতে? তুমি শাহবাগ জাদুঘরে গেলে রেপ্লিকা পেতে পারো, কিন্তু তোমার আইন তোমাকে বলবে তুমি একটা সম্ভাবনাময় চোর, সুতরাং তোমাকে ধরে দেখতে দেয়া বোকামি। অথচ আমাদের উচিত ছিল, নাও বাবা, নিয়ে যাও, তোমার মা-বোনদের এই শাড়ি পরাও। তারাও ঐতিহ্য চিনুক। …”
সেই ঐতিহ্যের পিতা-মাতারাই এই বাংলার আদি তন্তুবায় বা তাঁতি ।
১৯২০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে দলবেঁধে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন বলে জানা যায়। অবশ্য আরও পুরোনো সূত্রেও তাঁতিদের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ১৫১৮ সালের কথা। তখন ডোয়ার্ট বারবোসা নামের এক পর্তুগিজ ভদ্রলোক তার বাঙলা ভ্রমণের কাহিনীতে মেমোনা, চওলারি, বালিহা, চিনিবাপা- এসব নাম উল্লেখ করেন। এগুলো তাঁত কাপড়েরই নাম। আবার ১৬৭০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রিপোর্টে ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ এবং বাজিতপুরের তাঁতশিল্পের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করে। এ রিপোর্ট অনুসারে সিংহাম, কাস, মলমল, রেশমি, নীলা এবং টফেটা ছিল স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত কাপড়ের প্রধান উদাহরণ। এছাড়াও সারবন্দ, বাদান, তূর্য, চারখানা, মলমল, আদ্দি, তানজেব, এলেবেলে, নয়নসুখ, কুমিশ, তারান্দম ও জামদানি উল্লেখযোগ্য।
জামদানি শাড়ি আমাদের মা-খালারা এখনো পরেন। হয়তো শুধু জামদানিই টিকে আছে ধুঁকে ধুঁকে।
তাঁতিরা মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুধর্মাবলম্বী (যোগী বলা হতো) ছিল। মিথলজি থেকে জানা যায়, তারা শূদ্র পিতা ও ক্ষত্রিয় মাতার সন্তান। মোগল শাসনামলের আগপর্যন্ত এই হিন্দুরাই বেশি ছিল এ পেশায়। এরপর আস্তে আস্তে মুসলমান তাঁতির (জোলা) সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকার তাঁতিরা বারাম, বসাক, প্রামাণিক, সরকার, শীল, নন্দী, পাল, সাধু ইত্যাদি পদবী পান। তবে পরে এদের বসাক নামেই চেনা হয় বেশি।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পটুয়াখালীতে বসাকবাজার নামে একটা জায়গা আছে। ধারণা করা হয়, তারাও তাঁতপেশায় জড়িত। তাছাড়া পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় রাখাইনপল্লী ঘুরলে দেখা যেত প্রত্যেকটা দেড়তলা বাড়ির নিচতলায় তাঁতযন্ত্রে ব্যস্ত রাখাইন তরুণী এবং নারীরা। এভাবে তৈরি কাপড়গুলো স্থানীয় রাখাইন মার্কেটে বিক্রি করে তারা সংসার চালায়। ড. ফজলুর রহমান রচিত ‘পটুয়াখালীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বইটিতে এসব বিস্তারিত লেখা আছে। ওখান থেকে একটি ছড়ার অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি এখানে, “রাঙ্গাবালির রাঙ্গা ভিডা রাঙ্গা তরমুজ/মগের মাইয়া নাদুসনুদুস কাফুর বোনে সবুজ।“
রাঙ্গাবালি পটুয়াখালীর একটি উপজেলা। ওখানে প্রচুর তরমুজ চাষ হয়। আপনি গেলে আস্ত তরমুজ ক্ষেত থেকে তুলে খাইয়ে দেবে বিনা পয়সায়, টাকা সাধলেও নেবে না। যা-ই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ওখানকার মগ তথা রাখাইন নারীদের তাঁত বুননের বর্ণনা আছে ছড়ার এ অংশে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, কুচবিহারের স্থানীয় আদিবাসীরা তাঁতে হাতপাকানো। তাই তাঁতকে এখন মূলত একটা উপমহাদেশীয় সার্বজনীন প্রাচীন পেশা বলা যেতেই পারে।
এখন খুব বেশি তাঁতি টিকে নেই। কারণ, কোনো বাবা-মা এখন আর সন্তানকে ঐতিহ্য বজায় রাখার তাগিদে তাঁতি বানাতে চান না। প্রতিষ্ঠার প্রধান উপায় এখন চাকরি। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-পাবনা-সিরাজগঞ্জসহ যমুনার উপকূল ঘেঁষে অল্প কিছু পরিবার তাঁতপেশায় জড়িত। রাখাইন, মারমারাও কেউ কেউ তাঁতে কাপড় বোনে- সেগুলো আঞ্চলিক বাজার এবং বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হয়।
তাঁতশিল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তাঁতিরা যাযাবর শ্রেণীর। সিন্ধু অববাহিকায় বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী এরা। পরে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে কাজ শুরু করলেও সেখানে শাড়ি তৈরিতে আবহাওয়ার বাধা আসে। ফলে তারা রাজশাহীতে এসে পড়ে। সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যথাক্রমে ঢাকা এবং কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বসতি গেড়ে বসে।
প্রসঙ্গত, পুরান ঢাকায় কথিত কুট্টি ভাষার ভাষীদের মধ্যে তাঁতিরাও রয়েছে। পুরান ঢাকার ‘তাঁতিবাজার’ জায়গাটার নামকরণও তাঁতিদের নামেই। এদিকে রাজশাহী ছেড়ে সব তাঁতি আসেনি। কেউ কেউ সিল্কের কাজের সাথে যুক্ত হয়ে ওখানেই থেকে গেছে। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, মনিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতপেশার কথা। তাদের নিজেদের তাঁতকলে টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারি ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের প্রয়োজনে এসব তৈরি করলেও পরে বাঙালিরা এর কদর করতে থাকে।
ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্য বহন করে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প। এর শিল্পীরা এদেশে এখন বড় অবহেলিত। বংশীয় ঐতিহ্যের পেশা ছেড়ে সেজন্যই চাকরিমুখো হচ্ছে তাদের উত্তরসূরিরা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন তাঁতির সন্তানদের এন্তার দেখা মেলে। যুগে যুগে এরা স্থানীয় জমিদার, জোতদারদের অত্যাচার থেকেও বেঁচে থাকতে পারেনি। ১৯৯৪ সালের দিকে সালমান শাহ অভিনীত একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয় বিটিভিতে ‘ইতিকথা’ নামে। তা ছিল তাঁতশিল্পেরই ইতিকথা। সে নাটকেই প্রমাণ মেলে তাঁতশিল্পের বিস্তার ইংল্যান্ড পর্যন্ত ঘটেছে সেই ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে ।