বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ ও করণীয়

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ ছিল দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। স্বাধীনতার পূর্বে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির দরুন এ দেশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। ফলশ্রুতিতে সীমিত সম্পদ দিয়ে সদ্য স্বাধীনতালব্ধ একটি দেশের পুনর্গঠন নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রধানতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে তৈরি পোশাক শিল্প এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক আয়ের উৎস ও লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে যাওয়া এই শিল্প ধীরে ধীরে আমাদের গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে।

অসংখ্য পোশাকের পেছনে সেঁটে দেওয়া “Made in Bangladesh”  ট্যাগটি দেশের জন্য শুধু গর্বই বয়ে আনেনি বরং সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ‘বাংলাদেশ’ যার পরিচয় ছিল একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি, সময়ের সাথে সাথে আজ সেই বাংলাদেশ হাজারও বিস্ময়ের উৎস। ২০১৪ সাল নাগাদ তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জিডিপির গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬%, যেটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৭.২৮%

গর্বের প্রতীক মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ, Image Source: dhakatribune.com

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের অর্থনীতির উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিষয়টি আশ্চর্যজনক। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলাদেশ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং দেশ ধীরে ধীরে সেই অর্জনের পথেই এগোচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও তৈরি পোশাক শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশীয় কর্মসংস্থানের প্রায় ৬৫% ও বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮১% অর্জিত হয় এই শিল্পের মাধ্যমে। তৈরি পোশাক শিল্পের কারণে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক মানুষের, যার মাঝে ৮০% রয়েছেন নারীরা। বাংলাদেশ বিদেশে পোশাক রপ্তানি শুরু করে ১৯৭৮ সালে, যার মাঝে ছিল সুতি কাপড়, বোনা কাপড় এবং শীতবস্ত্র।

পরবর্তী প্রায় দুই দশকে দেশের এই শিল্পখাত বিস্ময়করভাবে উন্নতি লাভ করে। ১৯৮১ সালে এই খাতের আয় ছিল প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেটি ২০০৭ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পোশাক শিল্প বা টেক্সটাইল খাত যখন দেশের একটি বিকাশমান ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে তখনও তৈরি পোশাক শিল্প কিন্তু এতটা লাভজনক ছিল না বা স্বয়ংসম্পূর্ণও ছিল না।   

তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান চিত্র      

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের চলমান অবস্থা বেশ সন্তোষজনক। নিচে একটি সাম্প্রতিক হিসেব তুলে ধরা হলো।

· ইউনিট সংখ্যা- ৫৬০৩

· উৎপাদন ক্ষমতা- ২২.৩২৩ কোটি ডজন

· কর্মী সংখ্যা- ৩৬ লক্ষ, যার ৮০ শতাংশই নারী।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ২৮.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ

দেশের যেকোনো শিল্পের ভবিষ্যৎ অনুধাবনের জন্য জানা দরকার আগামী দিনগুলোতে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

প্রথমত, এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে তৈরি পোশাক শিল্পের কারণে পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশের একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভারী যন্ত্রপাতি এখনও বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে হয়। সেগুলোকে কাজের জন্য সঠিক উপায়ে প্রস্তুত করতে গেলেও দেশীয় প্রকৌশলীদের অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। অর্থাৎ তৈরি পোশাক শিল্প যতটা প্রযুক্তিবান্ধব হওয়ার কথা ছিল এই সুদীর্ঘ সময়ে ততটা বাস্তবে হয়নি। অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অন্যান্য দেশের মুখাপেক্ষী, এটি দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম বড় একটি সীমাবদ্ধতা।

দ্বিতীয়ত, দেশের সুবৃহৎ এই শিল্পটি আক্ষরিক অর্থেই পরিবেশবান্ধব নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বেশিরভাগ বিসিক শিল্প নগরীগুলো স্থাপিত হয়েছে কোনো নদীর তীর ঘেঁষে। কারখানাগুলোতে বিভিন্ন কাজের ফলে প্রতিনিয়ত নানা রকমের বর্জ্য তৈরি হচ্ছে যেগুলো সরাসরি নদীর পানিতে গিয়ে মিশছে। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি কারখানায় Effluent Treatment Plant  থাকার কথা, যদিও দেশের খুব কম সংখ্যক কারখানাতেই এই ধরনের প্ল্যান্ট রয়েছে।

প্রতিটি পোশাক কারখানার থাকা চাই ETP, Image Source: waterintegritynetwork.net

আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক শিল্প, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ যতটা সুগম করেছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৫০ লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া এই খাতের আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে দেশকে। সমাজ ও অর্থনীতি সমৃদ্ধকরণের প্রচেষ্টায় দেশের অন্যান্য শিল্পগুলোর মতো এই শিল্পটিও শামিল হবে নিঃসন্দেহে। দেশে নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় এই শিল্প যে ভূমিকা রেখে চলেছে তা আজ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত এবং পৃথিবীজুড়ে বহু গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ও তৈরি পোশাক শিল্পে নারীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অংশগ্রহণ, এই দুটি বিষয় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের মূল স্রোতধারায় নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গেলে খুব একটা নিরাশ হতে হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে নানাবিধ কারণে চীন খানিকটা লোকসানের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে বিশেষজ্ঞদের মতে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে পরবর্তী হট স্পট হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর থাকায় এসব অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা দেশীয় বাজারকে খতিয়ে দেখতে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য পণ্যের গুণগত মান, চাহিদা মোতাবেক যথাযথ যোগান, সঠিক দাম ইত্যাদির পাশাপাশি দেশে থাকা চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুষ্ঠু অবকাঠামো।

Next Eleven এর দেশগুলো, Image Source: wikimedia.org

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান প্রবৃদ্ধি বিশ্বের প্রসিদ্ধ বিশ্লেষকদের সুনজর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিনিয়োগ ব্যাংক Goldman Sachs, বিকাশমান কিছু দেশের তালিকা নিয়ে প্রকাশ করে, “Next 11” যে তালিকায় বাংলাদেশও স্থান পেয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে BRIC অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সাথে একই তালে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এছাড়া বিনিয়োগের জন্য সুবর্ণ সুযোগের দেশ হিসেবে “Frontier Five” প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বহুজাতিক ব্যাংক JP Morgan, যেটি সম্পদের বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই তালিকাতেও রয়েছে বাংলাদেশের উপস্থিতি।

চাই সুদূর পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প অবশ্যই আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে এর পথচলা যাতে থমকে না যায় সেজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে মূলত প্রযুক্তি। তাই আশা জাগানিয়া এই খাতে উৎপাদন হতে হবে প্রযুক্তিচালিত। পোশাক শিল্প রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের অবশ্যই প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো উচিৎ।

পোশাক শিল্পে চাই উন্নত প্রযুক্তি, Image Source: shopworx.com

পণ্যের সঠিক দাম পেতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে পোশাক সরবরাহ করে ক্রেতার সন্তুষ্টি অর্জনের বিকল্প নেই। বিশেষত স্পোর্টস ওয়্যারের ক্ষেত্রে কাপড়ের ঘাম শোষণ করার ক্ষমতা এবং আরাম দেওয়ার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায় যেগুলো প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া অনেকাংশেই সম্ভব নয়। বিশ্ববাজারে প্রযুক্তি নির্ভর কাপড়ের মূল্যমান প্রায় ১৫০ মিলিয়ন, যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারকে সবার প্রথমে কঠোর হতে হবে। একটি উৎপাদনমুখী শিল্প হিসেবে একে টিকিয়ে রাখতে হলে-

· বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে যেতে হবে এবং অর্থের পরিমাণ ওই শ্রমিকের সমগ্র জীবনের মোট আয়ের চেয়ে কোনোভাবেই কম হতে পারবে না।

· দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তিদান করতে হবে।

· কর্মক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

· কর্মীদের বেতন বাড়াতে হবে এবং অংকটা অবশ্যই জাতীয় দারিদ্র্যসীমার চেয়ে বেশি হতে হবে।

· কর্মীদের বেতন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে।

বিভিন্ন দেশে ঘন্টাপ্রতি কর্মীদের মজুরি, Image Source: lightcastlebd.com

সবকিছুর পরেও আবশ্যিকভাবে দেশে স্বচ্ছতা, মুক্ত চিন্তা ইত্যাদির স্বাধীন চর্চার মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ব্যতিক্রম নেই। ধ্বংস্তূপ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বহু ত্যাগ স্বীকার করে আজ তুলনামূলকভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা, ৬% বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি এবং বৈদেশিক আয়ের উচ্চাবস্থান, শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, গত কয়েক দশকের তুলনায় সন্তোষজনক সামাজিক উন্নয়ন- এসব কিছুই আমাদের ধারাবাহিক পরিশ্রমকে প্রতিফলিত করে। তৈরি পোশাক শিল্পের বদৌলতে স্বাধীন দেশ হিসেবে পুরো বিশ্বে আমাদের যে দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়েছে তাকে সমুন্নত রাখতে হবে। ঐতিহ্যের গর্বে ভেসে না গিয়ে দেশের এই খাতটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হওয়া উচিৎ আমাদের দায়িত্ব।

ফিচার ইমেজ: Textile Analysis

Related Articles

Exit mobile version