‘ঘূর্ণিঝড়’ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক অতি পরিচিত শব্দ। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে থাকা উপমহাদেশের এই ব-দ্বীপটি প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল থাবার শিকার হয়ে থাকে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই উপকূলীয় মানুষগুলো জীবন হারায়, হারায় বহু কষ্টে গড়ে তোলা ভিটেমাটি, অসহায় হয়ে দেখে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসলের জমির পানিতে তলিয়ে যাওয়া। নিয়মিত এই দৃশ্যগুলোয় এই জনপদের মানুষেরা অভ্যস্ত হয়ে যায়, তবু ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলে। বাংলাদেশেই কেন বারবার আঘাত হানে প্রাণঘাতী এসব ঝড়? আমাদের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস পদ্ধতিটাই বা কতটা কার্যকরী? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আলোচনা করা হবে এই লেখায়।
বঙ্গোপসাগরেই কেন সবচেয়ে বেশি মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ ১৬৯৯ সাল থেকে মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে বিশ্বের ৩৫টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা করেছে। এই তালিকার ২৬টি ঘূর্ণিঝড়েরই উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর, যার ১৯টিই বড় ধরনের ক্ষতি ঘটিয়েছে বাংলাদেশে।
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর উপসাগরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি একটি ফানেল হিসেবে কাজ করে এবং যখনই একটি ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে আসে, তখন প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটির অগভীর তল এই ঝড়কে আরও তীব্র করে তোলে। সাগরের ফুঁসে ওঠা পানি এই ফানেল বরাবর ছুটতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পেছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ- সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা। বঙ্গোপসাগরে এই দুটিই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আদর্শ মানদণ্ডে বিরাজ করে। চারদিকের অলস বাতাস যেমন পৃষ্ঠের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে প্রায় ২৮ ডিগ্রিতে বজায় রাখে, অবিরাম বৃষ্টিপাত তেমনই আর্দ্রতাকেও রাখে উচ্চ মানে।
ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি এবং এর শক্তিশালী হওয়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতাকেও দায়ী করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি বঙ্গোপসাগর জুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের গঠন ও তীব্রতায় সহায়ক করে তুলছে। এর বড় উদাহরণ সাম্প্রতিককালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান। গত ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া এই ঘূর্ণিঝড় ১৮ এপ্রিল সকালে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে একটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নজিরবিহীন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ঝড়টির দ্রুততর তীব্রতার পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। চূড়ান্ত সময়ে এসে আম্পানের টানা তিন মিনিটের বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার। একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে এই গতিবেগ সর্বোচ্চ।
ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ হয়ে উঠছে মে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, গত ৬০ বছরে বাংলাদেশে আঘাত হানা ৩৬টি ঘূর্ণিঝড়ের ১৫টিই ছিল মে মাসে। এর মধ্যে গত এক যুগেই ৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে মে-তে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয় নভেম্বর ও এপ্রিল মাসকে। গত ৬০ বছরে এই দুই মাসে ১১টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ধারায় বাংলাদেশে এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রা অন্যান্য মাসের তুলনায় বেড়ে যায়। একইসাথে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে ১-৩ ডিগ্রি বেড়ে যায় মে মাসে। এসব কারণে মে মাস ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ হয়ে উঠেছে। এ মাসের ঝড়গুলো সাধারণত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে। এ অঞ্চল অপেক্ষাকৃত ঢালু বা নিচু হওয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সেখানে ক্ষতিও হয় বেশি।
ভয়াবহতা যখন মৃত্যুর সংখ্যায়
একটা সময় ছিল যখন ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটা নিয়মিত লাখের ঘরে থাকত। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা লাখের ঘর ছুঁয়েছিল আরও একবার। ১৯৯১-এর সেই ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সর্বশেষ তিন অঙ্কের ঘরে ছিল প্রাণহানির সংখ্যা। এরপর গত ১১ বছরে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ ২৪ জন ছিল ২০১৬ সালের ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে। আম্পানে এখন পর্যন্ত ২২ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে মানুষ, সচেতন হতে জেনেছে উপকূলবাসী, বেড়েছে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের সংখ্যা, সরকারি পর্যায়েও নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এতে করে মৃত্যুর সংখ্যা কমলেও একেবারেই নির্মূল করাটা দুরূহই রয়ে গেছে৷ বিবিসির এক তথ্যমতে, বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের একজন থাকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলোতে। আর এই উপকূল জুড়ে থাকা ঘনবসতি মৃত্যুর সংখ্যায় লাগাম ধরাতে ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। এজন্য বিশ্বের সর্বমোট সাগরাঞ্চলের মাত্র ০.৬ শতাংশ জায়গা নিয়েও বঙ্গোপসাগর বিশ্বব্যাপী ঝড়ে প্রাণ হারানো প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধুই কি মৃত্যু?
ঘূর্ণিঝড় শুধু যে মানুষের প্রাণ নেয়, তা নয়; ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা কেড়ে নেয় লাখো মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদটুকুও। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আঘাত হানা সর্বশেষ ছয়টি ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৮ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর ফসলী জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণেই ফসল আর সম্পদের এত ক্ষয়ক্ষতি হয়। উপকূলীয় এলাকাগুলোয় এই জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এসব বেড়িবাঁধ নাজুক আকার ধারণ করায় প্রায়ই ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে গ্রাম থেকে গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর মেলে। ভেসে যায় ফসলী জমি, ভিটেমাটি, মৎস্যের ঘেরসহ উপকূলবাসীর শেষ সম্বলটুকুও।
এ ক্ষতি কমাতে বাঁধের সংস্কার এবং নতুন করে বাঁধ নির্মাণ চলে প্রয়োজন মতো। তবু বাঁধের উচ্চতার চেয়ে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বেশি হয়ে যাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণে লাগাম টানতে একপ্রকার হিমশিমই খেয়ে যায় সরকার। দিনশেষে প্রকৃতির কাছে তাই অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয় উপকূলের মানুষদের। বাঁধ আর জলোচ্ছ্বাসের এই টানাপোড়েন ছাড়াও ক্ষয়ক্ষতির একটা বড় অংশের প্রতিফলন দেখা যায় ঝড়ের গতিবেগে। ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী রূপ লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলীয় গ্রাম। দুমড়ে-মুচড়ে দেয় কাঁচা ঘর, দোকানপাট ও আধপাকা দালান। উপড়ে পড়ে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। প্রকৃতির এমন ধ্বংসলীলায় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে এসব অঞ্চলের মানুষেরা।
সতর্ক সংকেত কতটা পারছে সতর্ক করতে?
বাংলাদেশে মোট চারটি সমুদ্রবন্দরের (মোংলা, পায়রা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) জন্য বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের সময় গতি এবং দিক বিবেচনায় এক থেকে এগারো পর্যন্ত সতর্ক সংকেত জারি করে থাকে। সংকেতগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
১ নং দূরবর্তী সতর্ক সংকেত: জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার (কি.মি.)। ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হবে।
২ নং দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কি.মি.। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে।
৩ নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত: বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগ কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কি.মি. হতে পারে।
৪ নং স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঘূর্ণিঝড় কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কি.মি.। তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেবার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনও আসেনি।
৫ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কি.মি.। ঝড়টি বন্দরকে বাঁদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৬ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কি.মি.। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৭ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কি.মি.। ঝড়টি বন্দরের উপর বা এর নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৮ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কি.মি. বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাঁদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।
৯ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কি.মি. বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডানদিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।
১০ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কি.মি. বা তার বেশি হতে পারে।
১১ নং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত: আবহাওয়ার বিপদসংকেত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা পরিস্থিতি দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।
এছাড়া নদীবন্দরের জন্যও চারটি আলাদা চারটি সংকেত রয়েছে।
১ নম্বর নৌ সতর্কতা সংকেত: বন্দর এলাকা ক্ষণস্থায়ী ঝড়ো আবহাওয়ার কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিবেগের কালবৈশাখীর ক্ষেত্রেও এই সংকেত প্রদর্শিত হয়। এই সংকেত আবহাওয়ার চলতি অবস্থার ওপর সতর্ক নজর রাখারও তাগিদ দেয়।
২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর এলাকায় নিম্নচাপের সমতুল্য তীব্রতার একটি ঝড়, যার গতিবেগ ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ৬১ কিলোমিটার বা একটি কালবৈশাখী, যার বাতাসের গতিবেগ ৬১ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। নৌযান এদের যেকোনোটির কবলে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৬৫ ফুট বা তার কম দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নৌযানকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।
৩ নম্বর নৌ বিপদসংকেত: বন্দর এলাকা ঝড়ে কবলিত। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ৬২-৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিবেগের একটি সামুদ্রিক ঝড় শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানতে পারে। সব নৌযানকে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।
৪ নম্বর নৌ মহা বিপদসংকেত: বন্দর এলাকা একটি প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত এবং শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানবে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।
সনাতনী ব্যবস্থার এসব সংকেত মূলত তৈরি করা হয়েছিল সমুদ্রগামী জাহাজ ও বন্দরের নিরাপত্তার জন্য। জনসাধারণের জন্য সতর্কবার্তার বিষয়টি সেখানে উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।
সমুদ্র বন্দরের জন্য দেওয়া এই সংকেতগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখবেন, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের মাত্রা একই। আবার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতেরও মাত্রা এক। ঝড় কোনদিক দিয়ে যাবে, তার ভিত্তিতে নম্বর আলাদা করা হয়, যদিও বিপদ সবক্ষেত্রেই সমান।
এর ফলে মানুষের মধ্যে অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ থাকে। সাধারণ মানুষ মনে করে, সংকেত বাড়লে বিপদও বাড়বে। ফলে দ্রুততম সময়ে বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা। বর্তমান সংকেতব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত তিন দশকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
বাধার দেয়াল সুন্দরবন
উপকূলীয় বনাঞ্চল থাকলে জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ক্ষতি ও ঝড়ের তীব্রতা হ্রাসের ক্ষেত্রে তা বড় ভূমিকা পালন করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সুন্দরবন।
২০০৭ সালে বাংলাদেশে উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রথম বাধা ছিল সুন্দরবন। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের বাধা পেয়ে সিডর অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কা লাগত রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০০৯ সালে সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আইলার গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪ ফুট কমে যায়। সম্প্রতি আঘাত হানা আরেক ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতিও ৭০ কিলোমিটার কমেছে সুন্দরবনের কারণে। এভাবেই বার বার নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে প্রকৃতি ও জীবনকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে নীরব এই বিস্ময়।
‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ শিরোনামে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪৮৫.২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাঁচায়।
গবেষকরা বলছেন, ৬ লাখ ৩ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো।
সম্প্রতি (২০২০ সালের ২০ মে) আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সুন্দরবনের ১২,৩৫৮টি গাছের ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে গরান গাছের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে স্বস্তির খবর হচ্ছে, ক্ষতি হয়নি কোনো প্রাণীর।
এমন করে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন। নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়, হারায় অসংখ্য উদ্ভিদ আর প্রাণীর জীবন। বাঁচিয়ে দেয় খুব স্বার্থপর এই আমাদের।
প্রতি বছর সুন্দরবনে হেক্টরপ্রতি গড়ে ২৭,৭৫০টি চারা উৎপন্ন হয়। এ কারণেই এত বাধা মোকাবিলা করেও সুন্দরবন বেঁচে আছে প্রকৃতির নিয়মে। মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই এই বনের বেঁচে থাকা জরুরি। কারণ, সুন্দরবন বেঁচে থাকলেই বাঁচবে বাংলাদেশ, বাঁচবে এ দেশের জীববৈচিত্র্য আর এ দেশের মানুষ।