সুনামগঞ্জের শিমুলবাগানে একদিন

নদীর পাড়ে সারি সারি শিমুল গাছ, মাঝখানে লেবু বাগান। ফাগুন এলেই সেসব শিমুল গাছে শিমুল ফুল ফোটে, রক্তরাঙা শিমুলের ফুলে বসন্তের বিকিরণ উপচে পড়ে। চারদিকটা সজ্জিত হয় লালে লালে। মনে হয় প্রকৃতি যেন সেজেছে উৎসবের রঙে।

আউল-বাউল, মরমি কবি, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত শিল্পীদের আঁতুড়ঘর হলো হাওর অঞ্চল। সেই হাওর অঞ্চলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেশে অসংখ্য হাওরের মধ্যে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও তার আশপাশের প্রকৃতির একটা আলাদা কদর ছিল বরাবরই। যদিও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় পর্যটক কিংবা সৌন্দর্য প্রেমীরা সেখানে যেতে চাইতেন খুবই কম। কিন্তু সম্প্রতি যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ও আধুনিকায়ন হাওর অঞ্চলকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর সামনে। আজ তাই প্রতিনিয়ত সুনামগঞ্জে ঢল নামে প্রকৃতি প্রেমীদের। দেশের পর্যটনশিল্পের অন্যতম আকর্ষণ এখন শিমুলবাগান, নীলাদ্রী লেক, বারেক্কা টিলা, লাকমাছড়া আর টাঙ্গুয়ার হাওর।

অনেকদিন ধরেই নাম শুনছিলাম শিমুল বাগানের। সময় ও সুযোগের অভাবে যাওয়া হচ্ছিল না। এবার বসন্ত আসার আগেই ভেবে রেখেছিলাম যাবো বলে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন খুব সকালে প্রাইভেটকার যোগে আমরা পাঁচজন রওনা হলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। শিমুলবাগান ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সিলেট থেকে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার দূরে সুনামগঞ্জে গিয়ে পৌঁছলাম সকাল সাড়ে নয়টায়। আমাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ পানসী রেস্টুরেন্টে গিয়ে নাশতা সেরে নিলাম। ভুনা খিচুড়ির সাথে চিকেন ছিল মেন্যু। দারুণ মজাদার ছিল।

শিমুলবাগান যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান রূপ; Image Credit: Author

নাশতা খেয়ে গাড়িতে গ্যাস নেয়ার জন্য সিএনজি স্টেশনে গেলাম। গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। ফলে আমাদের অনেকটা সময় নষ্ট হলো৷ কিন্তু কী আর করা, জ্বালানি ছাড়া তো আর গাড়ি চলে না! যাই হোক, সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুরের পথে রওনা হলাম। যেহেতু আগে কখনও তাহিরপুর যাইনি, আর আমরাও কোনো পেশাদার ড্রাইভার না নিয়ে নিজেরাই ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম সেহেতু লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে এগোতে হচ্ছিল। কারণ বিভিন্ন মোড়ে রাস্তা দু-তিনটা বাঁক নিলে কোনটা মূল রাস্তা সেটা বোঝার উপায় নেই। অবশেষে বেলা ১২টার দিকে তাহিরপুর গিয়ে পৌঁছলাম।

আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল তাহিরপুর গাড়ি রেখে পেশাদার বাইক সার্ভিস নিয়ে ঘুরব। কিন্তু তাহিরপুর যাওয়ার পর লোকজনের কথায় হঠাৎ মত বদলে ফেলি। সবাই বলছিল গাড়ি নিয়ে শিমুলবাগান পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু এখানেই ভুলটা করলাম। গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় বটে। কিন্তু রাস্তার যে অবস্থা, আর ব্রিজগুলো থেকে রাস্তা যেভাবে নেমে এসেছে তাতে বারবার গাড়ির নিচের অংশ সশব্দে মাটি বা রাস্তার ইট-সুরকিতে লেগে যাচ্ছিল। যদি গাড়িটা নষ্ট হয় সেই চিন্তায় সবারই মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ এই হাওর এলাকায় গাড়ির মেকানিক পাওয়া খুব দুরূহ হতো। তাছাড়া রাস্তা না চেনায় জিজ্ঞেস করে করেও যেতে হচ্ছিল। ফলে শিমুলবাগান যেতে যেতে আমাদের প্রায় দুটো বেজে যায়। গাড়ি নিয়ে কীভাবে বেরুব সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই জনপ্রতি ২০টাকা করে টিকেট কেটে প্রবেশ করি শিমুল বাগানে। সব চিন্তা মাথা থেকে হঠাৎ হারিয়ে যায়, সৌন্দর্য ভুলিয়ে দেয় পথের সব কষ্ট। সেই সৌন্দর্যের বর্ণনায় পরে আসছি৷ আগে জানিয়ে দিই শিমুলবাগান সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য।

শিমুল ফুল দিয়ে বাচ্চাদের আঁকা আলপনা; Image Credit: Author

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নে, যাদুকাটা নদীর তীরে অবস্থিত শিমুল বাগানটি প্রায় একশ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। প্রয়াত ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ২০০২ সালের দিকে তার জমিতে প্রায় হাজার তিনেক শিমুল গাছ রোপণ করেন। সেগুলো বড় হয়ে আজকের শিমুল বাগানে পরিণত হয়েছে। শিমুল বাগানের মাঝখানে বেশকিছু জায়গা জুড়ে লাগানো হয়েছে লেবু বাগানও। পর্যটক যাবে সেই উদ্দেশ্যে গাছগুলো না লাগালেও এখন সুনামগঞ্জে জেলার পর্যটনশিল্পের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই শিমুলবাগান। শত শত পর্যটক প্রতিদিন বাগানটিতে গিয়ে থাকেন। অনেকে ঘুরতে যায়, অনেকে বনভোজন করতে। অনেকে আবার নাগরিক কোলাহল থেকে এক-দুটো দিন একটু নদী, হাওর আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতেও যায়। ফাল্গুনে যখন ফুল ফোটে, তখন প্রচুর শিমুল ফুল নিচে পড়ে থাকে। শিমুল ফুল দিয়ে সেখানেই ছোট ছোট বাচ্চারা মেয়েদের মাথার বেণী তৈরি করে, অনেকে আলপনা আঁকে। সেসব বেণী পরে ছবি তোলে অনেকে। কেউ কেউ আলপনার সামনে অথবা মাঝখানে বসেও ছবি তোলে। 

শিমুল বাগানে ঢোকার প্রবেশপথ; Image Credit: Author

আমাদের যাত্রাপথের ক্লান্তি আর গাড়ির চিন্তা দূরে সরিয়ে একটা ঘণ্টা দারুণভাবে কাটল। শিমুল বাগান ও যাদুকাটা নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম অনেক। তারপর ফেরার জন্য পথ ধরলাম৷ অপরিচিত রাস্তার যাওয়ার পথে যতটা সময় ও গাড়ির ক্ষতি হয়েছিল, ফেরার পথে চেনা রাস্তায় এর কিছুই হলো না। মোটামুটি এক ঘণ্টায়ই তাহিরপুর বাজারে পৌঁছে গেলাম। বিকেল চারটা বেজে গেল অবশ্য তাতেও। সন্ধ্যার আগেই ট্যুর শেষ করে সুনামগঞ্জের দিকে রওনা দিতে হবে। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম এবার নীলাদ্রী লেকে যাব। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসতে হলে এই একটা স্পটেই যাওয়া যাবে।

এবার আর কোনো ভুল করলাম না। তিনটা বাইক ভাড়া করলাম নীলাদ্রী লেক ও লাকমাছড়ায় যাওয়ার জন্য। একটু ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে রওনা দিলাম। পঁয়ত্রিশ মিনিটেই বাইকওয়ালারা আমাদের পৌঁছে দিল লেকের পাড়ে। সুনিপুণ দক্ষতায় খুব দ্রুতগতিতে তাদের বাইক চালানো দেখে আরও আফসোস বেড়ে গেল। যদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভুল না করতাম, তাহলে দিনের ভেতরেই বাইক নিয়ে সবগুলো স্পট দেখা হয়ে যেত। 

অপরূপ নীলাদ্রী লেক; ছবিঃ Image Credit: Author

নীলাদ্রী লেক ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের কোলে তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাটে অবস্থিত। এটি মূলত চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইমস্টোন। এটাকে শহিদ সিরাজ লেকও বলা হয়। অনেক গভীর এর পানি। পুরো লেকটি নীল রঙের। লেকের পাড়ে টিলা ও পাশে মেঘালয় পাহাড় আর লেকের স্বচ্ছ জলরাশি এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভ্রমণ প্রেমীদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির সুনামগঞ্জ পর্ব এই লেকের পাড়ের টিলার ওপরে শুটিং করা হয়েছিল। সুনামগঞ্জ গেলে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ থাকে নীলাদ্রী লেক।

আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম ছিল, আমরা পড়ন্ত বিকেলের পুরো সময়টা মুগ্ধ হয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। লেকে গোসল করার ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে করতে পারিনি। লেকটা অনেক গভীর, সাঁতার না জানলে পানিতে না নামাই ভালো। আর নামলেও লাইফ জ্যাকেট পরা জরুরি। যাই হোক, লেকটি ভালো করে ঘুরে আমরা সন্ধ্যার ঠিক আগে চলে গেলাম পাশের লাকমাছড়া। পাহাড়ের বুক চিরে একটি ছড়া আসছে, যার পানি এতই স্বচ্ছ যে- স্থানীয়রা বোতল ভরে ভরে নিয়ে যাচ্ছে খাওয়ার জন্য। ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ফেরার জন্য বাইকে চেপে বসলাম। চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তাহিরপুর ফিরে এলাম। বাইকের ভাড়া মিটিয়ে গাড়িতে ওঠে সুনামগঞ্জ শহরের পথে ফেরার যাত্রাটা শুরু করলাম। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্ষুধার উদ্রেক হলো। কিন্তু রাত হয়ে গেছে তাই তাহিরপুরে না খেয়ে সুনামগঞ্জে গিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত সাড়ে আটটায় সুনামগঞ্জে পৌঁছলেও লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়িতে সিএনজি নিতে আরও আধঘণ্টা চলে গেল। নয়টার দিকে পানসী রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার সের ফেরার পথ ধরলাম। এক অসাধারণ ভ্রমণ শেষে আবারও নাগরিক কোলাহলময় জীবনের যন্ত্রণার জগতে ফিরে এলাম।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে শ্যামলী, মামুন ও এনা পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জ যায়। ভাড়া পড়বে ৫৫০টাকা। ট্রেনও যায় সিলেট পর্যন্ত। সেখান থেকে বাসে কিংবা ভাড়ায় চালিত কার, মাইক্রোতে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ শহর থেকে দু’ভাবে শিমুলবাগান যাওয়ার উপায় আছে। প্রথমটা হলো- কাজী আব্দুজ জহির সেতু থেকে মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে লাউড়েরগড় যাওয়া। ভাড়া মোটামুটি ২০০টাকা পড়বে। সেখান থেকে নৌকায় যাদুকাটা নদী পার হয়ে বারেক্কা টিলা পর্যন্ত গিয়ে, সেখান থেকে আবার বাইক ভাড়া নিয়ে শিমুলবাগান ও অন্যান্য জায়গায় যাওয়া।

দ্বিতীয় উপায় হলো- সুনামগঞ্জ শহর থেকে বাইক অথবা গাড়িতে সোজা তাহিরপুর। সেখান থেকে চার/পাঁচশো টাকায় বাইক ভাড়া নিয়ে শিমুলবাগান ও অন্যান্য স্পটে যাওয়া যায়। মনে রাখবেন, সাথে প্রাইভেট গাড়ি থাকলেও বাইক নিয়েই যাবেন। ভুলেও আমাদের মত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। সময়, শ্রম দুটোই নষ্ট হয় তাতে। আর গাড়িরও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে প্রবলভাবে। বাইকে অনেকক্ষণ চড়তে হবে, পথে অনেক ধুলো। সেগুলো থেকে বাঁচতে অবশ্যই মাস্ক ও সানগ্লাস সাথে নিয়ে যাবেন।

কোথায় থাকবেন?

সুনামগঞ্জ শহরে ভালো অনেকগুলো হোটেল আছে, সাধ্য ও বাজেট অনুযায়ী যেকোনো একটাতে থাকা যাবে। তাহিরপুরেও হোটেল আছে, ডাকবাংলোও আছে। তবে রুম সীমিত। খালি থাকলে থাকা যাবে। এছাড়াও বড়ছড়া বাজার ও নীলাদ্রী লেকের পাশে টেকেরঘাটে গেস্ট হাউজ ও রেস্ট হাউজ আছে। রাত কাটানো যাবে সেসব জায়গাতেও।

কোথায় খাবেন?

সুনামগঞ্জে পানসীসহ অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে। তাহিরপুর, বড়ছড়া বাজার, টেকেরঘাট, বারেক্কা টিলায়ও খাওয়ার জন্য হোটেল আছে। যাত্রাপথে কাজ চালিয়ে নেয়ার মত খাওয়াদাওয়ায় আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

অপরূপ এই প্রকৃতির কাছে মানুষ আজন্ম ঋণী। তাই আমরা যেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়াই, সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

This is the travel story about Sunamganj district. The most popular places are in this district is 'Shimul Bagan', 'Niladri Lake', 'Barekka Tila', 'Tanguar Haor' etc. Sunamganj is a really beautiful place for any traveller.

Featured Image: Pinterest

 

 

Related Articles

Exit mobile version