“বুরা না মানো, হোলি হে”, অর্থাৎ “কিছু মনে করো না, আজ হোলি”- হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়ালের সুবাদে এই স্লোগানটির সাথে বেশ ছোটবেলা থেকেই আমাদের অনেকেরই পরিচয় রয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দারুণ চাঞ্চল্যকর হোলি উৎসবটি বরাবরই সকলের আগ্রহের বিষয়। রঙের খেলায় উৎসাহী না হলেও, অন্যকে রং খেলতে দেখে আনন্দ পায় না- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু নির্মল আনন্দের পাশাপাশি এই উৎসবের বেশ কিছু বদনামও রয়েছে। বিশেষত, মেয়েদের জন্য বিভিন্ন কারণে এই উৎসবটিকে ঠিক ‘নিরাপদ’ মনে করা হয় না।
এরকম বেশ কিছু কারণে হোলি উৎসবে অংশগ্রহণের শত ইচ্ছা থাকলেও বেশিরভাগ মেয়েই এই ইচ্ছেটাকে দমন করে রাখে। এমনকি এখনও আমাদের দেশের অনেকেই জানে না যে এই উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য ভারত বা নেপাল ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা শহরের ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার অঞ্চলেই প্রতি বছর পরিপূর্ণ আমেজে হোলি উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। আর এই উৎসবে যোগদানের জন্য সকলেই সাদরে আমন্ত্রিত। তাই প্রতি বছর শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎসবে যোগদানের জন্য তরুণ-তরুণীরা দলে দলে শাঁখারী বাজারে ভিড় জমায়। দেশি অতিথিদের পাশাপাশি প্রতি বছরই বাংলাদেশের এই উৎসবটিতে বিদেশি পর্যটকেরাও যোগ দিয়ে থাকে। আরও থাকে ডিএসএলআরধারী অসংখ্য ফটোগ্রাফার। তবে এই উৎসবে যোগদানের জন্য কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিদেশি পর্যটক ও বিশ্বায়নের কল্যাণে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও হোলি আজ বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও হোলি উৎসবের তাৎপর্য আমরা অনেকেই জানি না। মূলত বাংলা ফাল্গুন মাসের শেষে বা চৈত্র মাসের শুরুতে, তথা ইংরেজি মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসবটি পালিত হয়। এটি একধরনের বসন্ত উৎসব। এই উৎসবটিকে ‘বসন্ত উৎসব’, ‘রঙের উৎসব’, ‘ভালোবাসার উৎসব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এই উৎসবের মাধ্যমে শীতের বিদায় ও বসন্তের আগমনকে উদযাপন করা হয়ে থাকে। অনেকেই একে বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাতের উপলক্ষ হিসেবেও উদযাপন করে থাকে। তাছাড়া এই উৎসবের মাধ্যমে বসন্তকালে ঘরে তোলা নতুন ফসলের সাফল্যও উদযাপিত হয়ে থাকে।
দুই দিন ব্যাপী এই উৎসবটির তিথি নির্ধারিত হয় পূর্ণিমার সময়ে। এই পূর্ণিমা ‘দোল পূর্ণিমা’ নামে পরিচিত। দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ‘হোলিকা’ নামক অপদেবীর দহনের মাধ্যমে বিদায়ী বছরের যা কিছু খারাপ সেসব বিসর্জন করা হয়। এদিন পূজা হয় এবং হালকাভাবে আবীর খেলা হয়ে থাকে। এই আবীর খেলার সাথে মূল হোলি খেলার পার্থক্য এই যে, আবীর খেলায় খুব অল্প পরিমাণ রং হালকাভাবে ছোঁয়ানো হয়ে থাকে। সাধারণত এতে কোনোরকম পানি ব্যবহার করা হয় না। আর এটি মোটামুটি একটি ধর্মীয় প্রক্রিয়া মাত্র, কোনো উৎসব নয়। এতে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন।
পরেরদিন পালিত হয় মূল দোল উৎসব বা রঙের খেলা। বিভিন্ন রঙের বর্ণিল সমাহারে বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনেরা একে অন্যকে রাঙিয়ে তোলে। নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সকলেই এই খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এই খেলায় বিভিন্ন রঙের অফুরন্ত ব্যবহার হয়। এতে শুকনো রঙের গুঁড়ো ও পানিতে মেশানো রঙ- এই দুই-ই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙ মাখামাখির জন্য হাতের পাশাপাশি ওয়াটার গান, পিচকারী ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এমনকি প্লাস্টিকের বোতলে ভরেও রঙ ছড়াছড়ি করা হয়। আর রঙের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে সাধারণ পানি। তাঁতী বাজার, শাঁখারী বাজার অঞ্চলের আবাসিক এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই উৎসব পালিত হয়। এই সময়ে বাসাবাড়ি থেকে রাস্তায় উৎসব পালনকারীদের ওপর বারংবার অতর্কিতে বর্ষিত হয় বালতি ভর্তি পানি। সৌভাগ্যবশত, পরিষ্কার পানি।
আবাসিক এলাকায় এই উৎসব পালিত হওয়ার সময়ে এলাকার বিভিন্ন দোকানে গুঁড়ো রঙ বিক্রি চলতে থাকে। বিভিন্ন পরিমাণে ও দামে এসকল দোকানে রঙ কিনতে পাওয়া যায়। রঙের সাথে প্রয়োজনীয় পিচকারী ও ওয়াটার গানও বিক্রি হয়ে থাকে। সেই সাথে চলে ডিজে দ্বারা পরিচালিত গানের উৎসব। হোলির আনন্দ যে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের মাঝেই ছড়িয়ে যায় তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন বাবা-মায়েরা শিশু সন্তানদেরকে পথচারীদের গায়ে রঙ ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে। আর নারী-পুরুষ উভয়েরেই সমানভাবে এতে অংশ নেওয়া থেকেও এটি প্রমাণিত হয়। তবে শিশুদের নির্মল আনন্দ আর উদযাপনের বহুরূপী ঢং এই উৎসবকে সত্যিকার অর্থে সার্বজনীন করে তোলে।
কিন্তু আনন্দের পাশাপাশি এই উৎসবের সাথে জড়িয়ে থাকা ‘নিরাপত্তা’ জনিত বিষয়টিও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন- গত বছরে পুরান ঢাকার হোলি উৎসবে একটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এই সংবাদটি গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল। জনৈক মেয়ের শ্লীলতাহানিজনিত ঘটনার জের ধরে দুই ছেলের মধ্যে হাতাহাতির একপর্যায়ে তাদের একজনের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু ধর্মীয় উৎসবকে একটি দুর্ঘটনার অজুহাতে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই যেকোনো ধরনের আপত্তিকর ঘটনা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এই বছরে প্রতিটি রাস্তায় পুরো সময় জুড়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ দলবেধে পাহারায় ছিল। তাছাড়া গণমাধ্যমের কর্মীরাও ছিল। কিন্তু আনন্দ কোনোকিছুতেই বাধা মানেনি। তবে এ বছরের উৎসবে লোকসমাগম অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কম ছিল।
হোলি উৎসবে রঙ দেওয়ার সময়ে শারীরিক সংস্পর্শ খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এই সংস্পর্শ সীমা ছাড়িয়ে যাতে না যায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। এবারের উৎসবে কাউকে জোর করে রঙ দেওয়ার ঘটনা শোনা যায়নি। বরং যার গায়ে রঙের ছোঁয়া ছিল না, তার কাছে অনুমতি নিয়েই তার গায়ে রঙ দেওয়া হচ্ছিল। এমনকি রঙ দেওয়ার সময়ে ক্যামেরা বা ফোনের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেও সকলেরই সতর্ক ও সহযোগি মনোভাব ছিল। তাছাড়া কোন রাস্তায় গেলে রঙের প্রকোপ থেকে বাঁচা যাবে সেই পথও অনেকেই বলে দিচ্ছিল। যদিও রঙ খেলার উদ্দেশ্য যাদের ছিল, তারা নিশ্চয়ই পালানোর পথ খুঁজছিল না। কোনো কোনো সময়ে একসাথে একাধিক মানুষও গায়ে রঙ মিশ্রিত পানি ঢেলে দিতে পারে। সেসময়েই সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
তবে আপনি নিষেধ করলে কেউ জোর করে আপনার গায়ে রঙ দেবে না। এলাকার মানুষ অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। তাই আপনার আপত্তির কথা বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলে, তারা আপনার সাথে কখনই অভদ্রতা করে না। বরং নিজেদের আনন্দে বাধা আসলেও ফটোগ্রাফারদের জন্য নিরলসভাবে ও খুশিমনে পোজ দিতে কেউই আপত্তি করেনি। এমনকি বাচ্চারাও না। তবে উপর্যুপরি পানির অত্যাচার তো ছিলই! সেক্ষেত্রে ক্যামেরাধারীদের বিভিন্ন ধরনের সাবধানতা অবলম্বন যে অত্যাবশ্যক তা বলাই বাহুল্য। সাধারণত একাধিক পলিথিনের ব্যাগ সাথে রাখাটাই উত্তম। আপনার পোশাক ধরে তার ভেতরে রঙ ঢেলে দেওয়ার ঘটনাও স্বাভাবিক। তাই রেইনকোট এখানে আপনাকে রক্ষা করবে না। তবে রঙের খেলায় ছবি তুলতে এসে এতটা অসামাজিক হওয়াও অনুচিত। এবারের উৎসবে ‘ভাঙ’ মিশ্রিত পানীয় চোখে পড়েনি। অন্তত জনসমক্ষে তার ব্যবহার হয়নি। স্থানীয়দের মতে, এই পানীয়টির প্রচলন এখন আগের মতো নেই।
আর হোলিতে ব্যবহৃত রঙ ত্বকের জন্য ক্ষতিকর, সহজে তুলে ফেলা যায় না ইত্যাদি বিভিন্ন কথা প্রচলিত রয়েছে। এর কোনোটাই সত্যি নয়। তবে গুঁড়ো রঙে যদি কারও কোনোরকম অ্যালার্জির প্রবণতা থেকে থাকে তাহলে অংশগ্রহণ না করাই উচিত। সাধারণ নারিকেল তেল ব্যবহার করে অতি সহজেই চুল ও ত্বক থেকে এই রঙ তুলে ফেলা যায়। কিন্তু আপনার পোশাক থেকে রঙ ওঠানো সম্ভব নয়। এমনকি চামড়া বা এই জাতীয় কোনো অনুষঙ্গ থেকেও এই রঙ ওঠানো যায় না। সুতরাং এই উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য খুব সাধারণ পোশাক নির্বাচন করুন। মেয়েদের জন্য পরামর্শ থাকবে সাথে অন্তত একটি বাড়তি শুকনো পোশাক রাখার জন্য, যেন উৎসবে অংশগ্রহণ শেষে সুবিধাজনক স্থানে ভেজা পোশাক বদলে শুকনো পোশাক পরে নিতে পারেন।
পুরান ঢাকার অত্র অঞ্চলে হোলি খেলার পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন নিকটস্থ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান থেকে, যেমন- ভিক্টোরিয়া পার্ক, কবি নজরুল সরকারি কলেজ যার বয়স এ বছরে ১৪৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, রাজা রাম মোহন রায় পাঠাগার (অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কারণে এই পাঠাগারটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে, শুধু বাইরে থেকে দেখা যায়) যেখানে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বই পড়তে আসতেন, বর্তমানে ব্রাক্ষ্ম সমাজের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত রাজা রাম মোহন রায়ের বাসভবন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু পুরনো ও ঐতিহাসিক ভবন। চাইলে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী ‘ঘোড়ায় টানা গাড়ী’তেও চড়তে পারেন।
হোলি আনন্দের উৎসব। মন্দকে বিসর্জন দিয়ে ভালকে স্বাগত জানানোর উৎসব। কিন্তু প্রতিটি উৎসবের মতোই এখানেও নিজের নিরাপত্তা বেশ অনেকটাই নিজের কাছেই। কোথায় থামতে হবে- সেটা জানলে একজন মেয়ের পক্ষে একাও এই ধরনের একটি উৎসবে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষদের সাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া এবং নিজের জীবনেও বেশ কিছু সুন্দর স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা যোগ করা সম্ভব।