১৯৭১ সাল, নিম্নাঞ্চল হওয়ায় ভূপ্রাকৃতিক কারণে খুলনার গল্লামারী এলাকাটি ছিলো বিস্তৃত ধানক্ষেত আর জলাভূমিতে পূর্ণ। তখনও তৈরি হয়নি খুলনা-সাতক্ষীরা রোড। শহর থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় এই এলাকাটি ছিলো বেশ নির্জন; আশেপাশে ছিলো না তেমন কোনো বসতবাড়ি। যুদ্ধকালীন সময়ে এই ধানক্ষেত আর জলাভূমির মাঝেই ছিলো একটি একতলা অবকাঠামো। বেতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের নামে তৎকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী এই ভবনটি ব্যবহার করতো। শুধু বেতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ নয়; মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে এখানে আটকে রাখা হতো। ভবনটির সামনেই ছিলো একটি দোচালা ঘর আর ফাঁকা জায়গা। এখানেই তাদের উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। বুলেটের আঘাত, বেয়নেটের খোঁচা, অমানুষিক নির্যাতন অথবা জবাই করে হত্যা করা হতো মুক্তিকামী মানুষদের। হত্যা করে নিথর দেহগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হতো গল্লামারীর বিলের স্রোতে। দেশ স্বাধীনের পর এখানে পাওয়া গেছে অজস্র নরকঙ্কাল। বেতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত সেই একতলা ভবনটি আজ দোতলা, যেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবন। ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় আর একাত্তরের নির্মমতার সাক্ষ্য বহনকারী বদ্ধভূমির উপর সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আজকের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
খুলনা মহানগরী থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গল্লামারীতে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা ও দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সরকারী সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদে ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯০’ পাশ হয়।
১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে চারটি ডিসিপ্লিনের ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট প্রথম ওরিয়েন্টেশন এবং ৩১ আগস্ট একাডেমিক ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়। ২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্যপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। সেই থেকেই প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়ে আসছে। আজ ঊনত্রিশ বছর পার করে দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের প্রথম রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন সময়ে ছাত্র-রাজনীতির দরুন অনেক মা-বাবা যখন সন্তানহারা হয়ে পড়ছিলো, ঠিক তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট দাবী জানিয়েছিলো একটি সুস্থ-সুন্দর ছাত্র-রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাসের। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. গোলাম রহমান শিক্ষার্থীদের দাবী মেনে নিলেন; নিষিদ্ধ করা হলো ছাত্র-রাজনীতি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীকে রক্ত ঝরাতে হয়নি, অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে বন্ধ করতে হয়নি একাডেমিক কার্যক্রম। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের মেধা আর প্রয়োজন বিবেচনায় পেয়ে আসছে আবাসন সুবিধা। করতে হচ্ছে না কোনো দলীয় মিটিং মিছিল। ১০৫ একরের এই ক্যাম্পাসে আটটি স্কুলের (অনুষদ) অধীনে মোট ২৯টি ডিসিপ্লিন (বিভাগ) রয়েছে। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাত হাজার; রয়েছেন পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, যাদের মাঝে এক-তৃতীয়াংশ পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
এছাড়া তিন শতাধিক কর্মকর্তা এবং প্রায় তিনশত কর্মচারী রয়েছে। স্কুলগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের আওতায় রয়েছে আর্কিটেকচার, আরবান এন্ড রুরাল প্ল্যানিং, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিন। কলা ও মানবিক স্কুলের আওতায় রয়েছে ইংরেজি, বাংলা এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন। আইন স্কুলের আওতায় রয়েছে আইন ডিসিপ্লিন। জীববিজ্ঞান স্কুলের আওতায় রয়েছে এগ্রোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি, ফার্মেসি ও সয়েল ওয়াটার এন্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিন। ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের আওতায় রয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন এবং হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিন। সমাজ বিজ্ঞান স্কুলের আওতায় আছে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা স্কুলের আওতায় তিনটি ডিসিপ্লিন চালু রয়েছে। এগুলো হলো ড্রইং এন্ড পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং ও ভাষ্কর্য ডিসিপ্লিন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বপ্রথম চালু করা হয় আরবান এন্ড রুরাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) ডিসিপ্লিন। এছাড়াও এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স (ইএস) ডিসিপ্লিন, ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি (এফডব্লিউটি) ডিসিপ্লিন, ব্যবসায় প্রশাসন এবং হিউম্যান রিসোর্স ও ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিন এবং উপমহাদেশর মধ্যে প্রথম বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজি) ডিসিপ্লিন চালু করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের মধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ, যেটি শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অনন্য এক মাত্রা যোগ করে। দেশের প্রথম সয়েল আর্কাইভ চালু করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের ২০ ফুট ভূ-গর্ভে রয়েছে দেশের সমগ্র অঞ্চলের মাটির সংগ্রহশালা। চার বছরের মধ্যেই যাতে স্নাতক শেষ করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কারিকুলাম সাজানো হয়। শিক্ষা কার্যক্রমে বিগত বছরগুলোতে ১১ সহস্রাধিক গ্রাজুয়েট উত্তীর্ণ হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই দেশে-বিদেশে দক্ষতা, সুনাম ও সফলতার সাথে কাজ করে চলেছেন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ৩০টির বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। রয়েছে নৈয়ায়িক (বিতর্ক সংগঠন),বাঁধন (রক্তদান ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন), রোটারেক্ট ক্লাব, পোডিয়াম (স্পিকিং), কৃষ্টি (
বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো এই ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। বসন্ত বরণ, চৈত্র সংক্রান্তি, বাংলা নববর্ষ বরণ, পিঠা উৎসব, দীপাবলি, পূজা, নবীনবরণ ছাড়াও ডিসিপ্লিনকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান র্যাগ ডে (শিক্ষা সামাপনী অনুষ্ঠান)। তিনদিন ব্যাপী এই শিক্ষা সামাপনী অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অন্য মাত্রা দান করেছে। শুধু তা-ই নয়, খেলাধুলায়ও বেশ সক্রিয় এখানকার শিক্ষার্থীরা। বছরের শুরুতে ভলিবল প্রতিযোগিতায় ছেলে-মেয়ে উভয়ের অংশগ্রহণে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, টেবিল টেনিসসহ অন্যান্য ইভেন্টে সবার অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
সবগুলো জাতীয় দিবস পালনের পাশাপাশি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ১৩ মার্চকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালন করে। বলা হচ্ছে কটকা ট্রাজেডির কথা। ২০০৪ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের নয়জন এবং বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের দুজন শিক্ষার্থী সুন্দরবনের কটকা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেয়ে প্রাণ হারান। ২০০৪ সালের ১২ মার্চ রাতের বেলা মোট ৯৮ জন শিক্ষার্থী ও অতিথি মিলে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সারারাত আর সকাল পেরিয়ে বেলা একটার দিকে তারা কটকায় পৌঁছায়। বৈশাখের আম কুড়ানোর মতো ক্ষিপ্রতায় তারা সমুদ্রে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সারারাতের নিদ্রাহীন ক্লান্তি সমুদ্রের বিশালতার কাছে হার মেনে যায়। হঠাৎ চেঁচামেচিতে সবার নজর চলে যায় সমুদ্রের দিকে। ভাটার কবলে পড়ে শিক্ষার্থীদের চিৎকার মুহূর্তের মধ্যে নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। কয়েকটি কালো মাথা, বাঁচার তাগিদে হাতগুলোর ইশারা আর তাদের চিৎকার ধীরে ধীরে সমুদ্রের মাঝে ক্ষীণ হতে থাকে। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয় কটকা মনুমেন্ট। প্রতিবছর ১৩ মার্চ শোককাতর শিক্ষার্থীরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। ঐ সময় কটকা মনুমেন্টে রাতভর জ্বলজ্বল করতে থাকা ১১টি প্রদীপ দূর থেকে রাতের আকাশের তারার মতো মনে হয়। চলে যাওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন তৌহিদুল এনাম (অপু), আব্দুল্লাহ-হেল বাকী, কাজী মুয়ীদ ওয়ালি (কুশল), মো: মাহমুদুর রহমান (রাসেল), মো: আশরাফুজ্জামান (তোহা), আরনাজ রিফাত (রুপা), মাকসুমমুল আজিজ মোস্তাজী (নিপুণ), মো. কাউসার আহমেদ, মুনাদিল রায়হান বিন মাহবুব, শামসুল আরেফিন সাকিল-বুয়েট, এবং সামিউল হাসান খান-বুয়েট। এগুলোর সাথে হাদী চত্বর স্মরণ করিয়ে দেয় আরো একটি মর্মান্তিক ঘটনার কথা। বাস চাপায় নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মুহম্মদ হাদীউল ইসলামের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধটির নাম রাখা হয় হাদী চত্বর।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আড্ডার জন্য চিরচেনা জায়গা হলো তপন দাদা, সাইদুল ভাই অথবা ভাবির চায়ের টং। এখানকার প্রত্যেকটি চায়ের কাপ হাজারো গল্পের স্বাক্ষী। অনিকেত প্রান্তরে বসে প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে পার করা প্রত্যেকটা সন্ধ্যার কথা খুবিয়ানদের স্মৃতির পাতায় হয়তো এখনো জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। শত বছর পরেও চিরযৌবনা থাকুক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বেঁচে থাকুক হাজার বছর ধরে।