অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল: হিট অ্যান্ড রান অথবা ক্র্যাকপ্লাটুনের গল্প

মুক্তিযোদ্ধারা ততদিনে দেশব্যাপী মুহুর্মুহু গেরিলা হামলা চালাচ্ছে। কখনো সফলতা, কখনো ব্যর্থতা; সব মিলিয়ে জন্মভূমিকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আধুনিক প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে। কিন্তু তৎকালীন এই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা এখনও আওতার বাইরে। কুমিল্লা পর্যন্ত আক্রমণ হলেও ঢাকায় এখনও ঢুকতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা। এই ব্যাপারটি সহজাতভাবেই পোড়াচ্ছিল কোটি বাঙালিকে। অন্যদিকে, জাতিসংঘ থেকে পাক সরকারের উপর চাপ আসছে, যুদ্ধের পাঁয়তারা বন্ধ করতে। আর পাকিস্তান? যুদ্ধ নয়, বরং ছোটখাট ‘গণ্ডগোল’ বলে চুপ করানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

ক্র্যাকপ্লাটুন সদস্যদের একাংশ; Image Source: Daily Star

আসলেই কি শুধু গণ্ডগোল? তা-ই যদি হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের দরজা বন্ধ হবে না পাক সরকারের জন্য। সেটা দেখতেই ঢাকায় আসবে প্রতিনিধি দল। আর সেখানেই প্রমাণ হয়ে গেলো, এই বাংলায় গণ্ডগোল নয়; চলছে সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধ। যাদের মাধ্যমে এই প্রমাণ পেয়েছিল বিশ্বনেতারা, তারা হলো ক্র্যাকপ্লাটুন। ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক ছেলেগুলোকে নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের নিজ হাতে তৈরি কে ফোর্সের বিশেষায়িত কমান্ডো গেরিলা বাহিনী।

১.

মার্চের গণহত্যার পর আরও দুটি মাস কেটে গেছে। পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে নিরীহ বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর জেঁকে বসেছে পাকিস্তানি সেনারা। কখনো গ্রামের পর গ্রাম ধরে ধরে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, কখনো অবলীলায় রাস্তার মাঝখানে গুলি করে মারছে সাধারণ মানুষকে, তুলে নিয়ে যাচ্ছে নারীদের। হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতের শরণার্থী শিবিরে।

যারা পড়ে আছে, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে মৃত্যুভয়ে। এই পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারাও চালিয়ে যাচ্ছে আক্রমণ। মোদ্দাকথা, যুদ্ধের শর্ত পূরণ হয় না; এমন কিছুই বাদ নেই। সবখানে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে, শুধু ঢাকা শহর বাদে। সেখানে এখনও পা রাখা হয়নি তাদের। সেটাও হয়ে গেল জুন মাসের ৯ তারিখে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা; Image Source: dailyasianage.com

দেশের অবস্থা যখন এমন, তখন কাঁটাতারের ওপারে মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলছে কে ফোর্সের ঘাম ঝরানো ট্রেনিং। মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের তত্ত্বাবধানে কমান্ডো ট্রেনিংয়ের অলিগলি চিনে নিচ্ছে ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক পাড়ার আধুনিক কিছু ছেলে। মোদ্দাকথা, সেখানে এসেছে মিশেছে ঢাকার তারুণ্যের সবটুকু শক্তি। প্রত্যেকের বুকে বাজছে একটাই শপথ, ‘মুক্ত করতে হবে এই জনপদকে’। বলে রাখা ভালো, কে ফোর্সের কমান্ডো প্রশিক্ষণের মূলমন্ত্র ছিল দ্রুত আক্রমণ এবং দ্রুত পলায়ন।

সেভাবেই তৈরি হচ্ছিলেন হাবিবুল আলম, রুমি, বদি, বাদল, আজাদ, জুয়েলরা। এর মধ্যে হঠাৎ হাবিবুল আলমকে (বীর প্রতীক) একদিন ডেকে পাঠালেন মেজর খালেদ মোশাররফ। তারপর বললেন,

আমি চাই তুমি তোমার পছন্দমতো ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বেছে নিয়ে সেই নামগুলো বাদলকে দাও। ক্যাপ্টেন হায়দার এ ব্যাপারে তোমাকে সবকিছু জানাবেন। আমি চাই মিশনটা তুমি ভালোমতো বুঝে নাও এবং যেকোনো মূল্যে অপারেশন সফল করো।

অপারেশনটা কেমন হবে, সেটা বুঝিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার এবং বাদল। তারা জানালেন, বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল এবং ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সাদরুদ্দিন আগা খান পাকিস্তান সরকারকে বড় ধরনের একটি আর্থিক সহায়তা দিতে যাচ্ছে। তার আগে বিশ্বব্যাংক এবং ইউএনএইচসিআর নিশ্চিত হতে চায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে আসলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তারা ঢাকা আসবে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকবে।

তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা সামরিক সরকার এটা প্রমাণ করতে চায় যে, ঢাকা স্বাভাবিক আছে। অর্থাৎ তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো রকমে এটা বোঝাতে পারলেই মিলে যাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ, যা দিয়ে আরও অস্ত্র কিনবে সরকার, যা ব্যবহার করা হবে এই বাঙালিদের উপরেই।

মেজর খালেদ মোশাররফ; Image Source: Daily Star

তো কে ফোর্সের এই ১৭ মুক্তিযোদ্ধার উপর দায়িত্ব বর্তেছে একটি সফল অপারেশন করার, যার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া যায়। হায়দার এবং বাদল আরও জানালেন, কোনোভাবেই পরিকল্পনায় ভুলচুক করা যাবে না। যেটা করতে হবে তা হলো, যেদিন প্রতিনিধি দল আসবে সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশেপাশে গ্রেনেড ফাটিয়ে, গোলাগুলি করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করতে হবে। উদ্দেশ্য, বিদেশিদের কাছে প্রমাণ করে দেওয়া, ঢাকা স্থিতিশীল নেই, এখানে যুদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি এই শহর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেও নেই।

কে ফোর্সের প্রথম এই অপারেশনে দলে ছিলেন এফএফ আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মাহমুদ আহমেদ (শহীদ), শ্যামল ভাষণ, আনোয়ার রহমান, মোফাজ্জেল হোসেন মায়া, ফাতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাইদ খান, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গাজী গোলাম দস্তগীর, তারেক এম.আর চৌধুরী, নাজিবুল হক, রেজা, আব্দুস সামাদ, জুয়েল, জাব্বার, ইফতেখার এবং হাবিবুল। অপারেশনের নাম দেওয়া হলো ‘অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল – হিট অ্যান্ড রান’

২.

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম সীমানা দিয়ে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার দলটি এ দেশে ঢোকে। অস্ত্র বলতে প্রত্যেকের কাছে ৫টি করে গ্রেনেড আর একটি করে বেয়নেট। এই দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে সর্বাধুনিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সঙ্গে আছে সব মিলিয়ে ১৬০ পাকিস্তানি রুপী। এই দিয়েই চলতে হবে পুরো দলকে। জুন মাসের ৩ তারিখে রওনা দিয়ে কখনো নৌকা, কখনো ধানের ক্ষেত, কখনো বিরানভূমি পার করে ঢাকায় ঢোকে মুক্তিযোদ্ধারা।

সেদিন বিজয় এসেছিল; Image Source: Daily Star

হোটেল এলাকা রেকি করা, অস্ত্রশস্ত্র ঠিক রাখা, কীভাবে কোথায় পজিশন অ্যামবুশ করতে হবে তা নির্ধারণ করার পর হঠাৎ সবার মনে হলো, একটি গাড়ি লাগবে। একটি গাড়ি আগে থেকেই ছিল, যেটা হাবিবুল আলমের বাবার। কিন্তু আরও একটি লাগবে। ৭ জুন সবাই রাস্তায় নামলো একটি গাড়ি হাইজ্যাক করার জন্য। কিন্তু কীসের কী? যে গাড়িই ছিনতাই করতে যাওয়া হয়, সবাই কোনো না কোনোভাবে তাদের পরিচিতদের গাড়ি! গাড়ি আর ছিনতাই করা হয় না। শেষপর্যন্ত সোভিয়্যেত কনস্যুলেটের কাছ থেকে একটি গাড়ি হাইজ্যাক করা সম্ভব হয়।

সেই হ্যাইজ্যাক করা গাড়ি নিয়েই ৯ জুন অপারেশনে ছোটে গেরিলারা। মনে আছে তো, মেজর খালেদ মোশাররফ কী বলে পাঠিয়েছিলেন? হোটেলের আশেপাশে গ্রেনেড ফাটিয়ে কেবল আতংক সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু এই স্টাইলিশ, সানগ্লাস পরা, স্টেনগান হাতের ছেলেগুলোর ভাবনা ছিল খালেদ মোশাররফের চেয়েও বেশি কিছু। তারা সরাসরি হোটেলের বাইরের লবিতে আর জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের গাড়িতে গ্রেনেড ফাটিয়ে এলো!

অগণিত সৈন্য আর ভারি অস্ত্রের মহড়া আর পাহারায় ঐ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল দুর্গ বানিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। তার মধ্যেই এই আরবান গেরিলার সদস্যরা গ্রেনেড আর গুলি ছুঁড়ে ফিরে এলো নির্বিঘ্নে!

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে; Image Source: Daily Sun

প্রথমে হাবিবুল আলম গ্রেনেড ছোঁড়েন। প্রায় একইসঙ্গে গ্রেনেড ছোঁড়েন জিয়া। একটি সাদা শেভ্রলেট গাড়ি ছিল ভিতরে। গ্রেনেডের শব্দে আতংকে গাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল তারা। ঠিক এমন সময়ে হাবিবুল তার দ্বিতীয় ও মায়া তার প্রথম গ্রেনেড ছোঁড়েন সেই গাড়ি লক্ষ্য করে। শুধু গাড়ি নয়, মায়া আরও একটি গ্রেনেড ছুঁড়েছিলেন হোটেলের ভেতরে। এতে কী হয়েছিল তা জানা যায়নি। বিদেশিরা সেই প্রথম ঢাকায় সরকারী বাহিনীর উপর মুক্তিকামী বাহিনীর আক্রমণ প্রত্যক্ষ করে।

তারপর সেখানে কী হয়েছিল তা দেখার সুযোগ হয়নি গেরিলাদের। ধরা পড়ার ভয় আর প্রথম অপারেশন সফল করার রোমাঞ্চ নিয়ে তারা দ্রুত এলাকা ছেড়েছিল। গেরিলাদের এই খবর অল ইন্ডিয়া বিবিসি রেডিওতে সেই মেলাঘরে বসে শুনেছিলেন কে ফোর্সের কর্তা খালেদ মোশাররফ। অবাক হয়ে বলেছিলেন,

দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! আমি তাদেরকে বললাম হোটেলের আশেপাশে গ্রেনেড ছুঁড়তে, ওরা হোটেলের ভিতরেই ফাটিয়ে আসলো!

সেই থেকে দলটির নাম হয়ে গেল ক্র্যাকপ্লাটুন, যারা ঢাকার সাধারণ মানুষের কাছে বিচ্ছুবাহিনী নামেও পরিচিত ছিলেন। এই ছেলেগুলোর তোপেই দিশেহারা হয়েছিল পাক বাহিনী। তাদের একের পর এক সফল অপারেশনে চোরাগোপ্তা হামলার ভয়ে একপর্যায়ে সন্ধ্যার পর টহল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় পাক হানাদাররা।

This is a Bangla article based on Crack platoon's very first oparetion. Crack platoon was an urban gerilla group during 1971 liberation war of Bangladesh specialised in comando tranning on Dhaka city. Necessary sources have been hyperlinked. 

Feature photo: The Daily Star

Related Articles

Exit mobile version