ঘটনাকল্প এক
গত রোজার মাসের ঘটনা। প্রচণ্ড রোদ পড়ছিল প্রায় প্রতিদিনই। এমন একদিন তপ্ত দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে একদমই ইচ্ছে করছিল না নাতাশার, কিন্তু কী আর করার- বিধি বাম; যেতেই হবে জরুরি একটা মিটিংয়ে। দেরি করে বের হওয়াতে একটা সিএনজি ডেকে উঠে যেতে হলো।
যেতে যেতে নাতাশার চোখ পড়ল রাস্তার পাশের একটা কফিশপের জানালার কাচে। সেখানে জমা হওয়া হালকা শিশিরের মতো জলকণা ভেতরের কড়া এসি’র বাতাসের উপস্থিতির জানান দিচ্ছিল। হঠাৎ তার একটা তীব্র ইচ্ছে হলো, সব কাজ বাদ দিয়ে দুপুরের সময়টা সেই কফিশপে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে তো সবসময় মানায় না।
তবে যে কোম্পানিতে মিটিং, সেখানে পৌঁছে দেখা গেল মিটিং শুরু হতে ঢের দেরি, কোনো একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কী যেন কাজ পড়ে গেছে। শুধু শুধুই এত আগে এসে হাজির নাতাশা। লবিতে বসে বসে মোবাইলে কিছুক্ষণ পর পর ফেসবুকে ব্রাউজ করা আর দেয়ালে ঝোলানো বিশাল রেজোল্যুশনের স্ক্রিনে খবর দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। হঠাৎ নাতাশার চোখ আটকে গেল একটি ফিচার সংবাদে, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সেই হামলার পর সেখানকার সব ধর্মের মানুষ কীভাবে এক হয়ে সেই দুঃসময়টা কাটিয়ে উঠেছিল, সেটা নিয়েই ফিচার। বাংলাদেশের অবস্থা কী, সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবনা চলল তার মনে।
এরপর মিটিং শুরু হতে হতে বিকেল, আর শেষ হতে হতে দেখা গেল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন বের হলে একদমই ইফতার ধরা যাবে না বাসায়। মিটিংয়ের মাঝেই বাসা থেকে গোটাকয়েক কল চলে এসেছে। বের হয়েই একটা সিএনজি পেয়ে গেল ভাগ্যবশত। গরমের মাঝে পুরো দিনের ধকলে বেশ ক্লান্ত শ্রান্ত লাগছে। একসময় রাস্তাতেই আজান পড়ে গেল।
নাতাশার সাথে কিছু নেই রোজা ভাঙার মতো। বাসায় গিয়েই একবারে ভাঙতে হবে এটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল হলো, সামনে বসা তরুণ চালক তাকে ডাকছেন। “আপা, রোজা ভাঙবেন? এই লন পানি। আর একটু বিস্কুট আছে এইহানে।”
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি দেখে খুশি না হয়ে পারল না নাতাশা। পানি আর বিস্কুট নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি ভাঙবেন না?”
“আপা, আমি তো রোজা না। হিন্দু। এমনিতেই এই মাসের জন্য গাড়িতে এইগুলা রাইখা দেই, এই সময় প্যাসেঞ্জাররে যেন দিবার পারি।”
সেদিন দুপুরে দেখা সুদূর নিউজিল্যান্ডের মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতির ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেল নাতাশার। সম্প্রীতির তেমনই একটা ছোট্ট গল্পের অংশ হতে পেরে নিজের অজান্তেই চোখের কোণায় এক বিন্দু জল চলে এলো নাতাশার।
ঘটনাকল্প দুই
বাংলাদেশের খেলা চলবে আর রাহাত সেটা বন্ধুদের নিয়ে দেখবে না এটা কি হতে পারে? কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ঠিক সেটাই ঘটছে! দিনকে দিন যে হারে বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে জীবিকার জীবনে ঢুকে, তাতে এখন আর মোটেও খেলা দেখা হয় না আগের মতো। প্রচণ্ড রকমের মিস করে সে দিনগুলোকে রাহাত।
আজকের ম্যাচটা নিয়ে তাই একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছে সে। বিকেলের দিকে এলাকার কয়েকজন ছোট ভাই-বেরাদরকে ডেকে যার যা আছে আর তার সাথে কিছু টাকা দিয়ে, একটা প্রোজেক্টর ভাড়া করে আনা হলো। এরপর ছোট্ট মাঠটার একপাশে সেটা বসিয়ে নানা কায়দাকানুন করে শেষপর্যন্ত তাতে খেলা দেখানো শুরু করে দিল তারা।
শুরুতে ওরা অল্প ক’জনই ছিল। প্রোজেক্টর সেট করতে করতেই তো তিন ওভার শেষ খেলার। কিন্তু ওভার যত বাড়ে, মানুষও তত বাড়তে লাগল। কয়েকজনকে দেখা গেল পানি নিয়ে এসেছে, কেউ আবার চানাচুর-বিস্কুট। কী আশ্চর্য, একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল নাকি! রাহাত অবাক হয়ে দেখল, খেলা দেখতে চলে এসেছে পাড়ার দোকানদার থেকে শুরু করে রিকশা গ্যারেজের মিস্ত্রিরাও। বাংলাদেশের খেলা নিয়ে তো বটেই, এলাকার মাঠে যে এভাবে সবাই মিলে খেলা দেখা যায়- সেটা নিয়েও মাতামাতি করছে সবাই। রাহাতের অবাক হবার পালা কয়েকগুণ বেড়ে গেল যখন সে দেখল, খেলা দেখতে চলে এসেছে তার বন্ধুরা আর ছোট বোনদের গার্লস গ্যাংটাও!
ভীড়ের মাঝে দেখা গেল, একেকটা চারের পর চিৎকার দিয়ে উঠছে পাড়ার মুরুব্বিরা, ছয় মারলে লাফিয়ে উঠছে পিচ্চিদের দল! লিটন দাস আর সাকিব আল হাসানের জুটির ব্যাটিংয়ের সময় কিছুক্ষণ “লিটন, লিটন!” শ্লোগান উঠে তো কিছুক্ষণ উঠে “সাকিব, সাকিব!” চিৎকার! ছয়জনের খেলা দেখার আনন্দ ততক্ষণে পরিণত হয়ে গেছে ছয়শোজনের আনন্দে। মনে হতে লাগল, পুরো বাংলাদেশ যেন একসাথে খেলা দেখছে ঐ ছোট্ট মাঠে বসে!
ঘটনাকল্প ৩
ঢাকায় রাতের বেলা পলাশী মোড়ের মতো আড্ডায় গমগমে এলাকা আর একটিও থাকে না। পুরান ঢাকার রাতের খাবারের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যায় মাঝরাতে। কিন্তু এই পলাশীর মোড়টাতে মোটামুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট আর ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রদের ভীড় লেগে থাকে একদম ভোর পর্যন্ত।
সেই পলাশীর মোড়ের বাজারের বিল্ডিংটাতে সেদিন রাতে আগুন ধরল। এমনি তো রাতে বেলা সেই ভবন বন্ধ থাকে, হঠাৎ আগুন কীভাবে কোত্থেকে ধরে গেল বোঝার উপায় নেই সেমুহূর্তে। তবে অনেকেই জানে, সেখানে রাতের বেলা দোকানের কর্মচারীরা থাকে, তাদের চিৎকারটাই শোনা যাচ্ছিল তখন।
তবে আগুন কোনো ক্ষতি করতে পারল না মানুষগুলোর, কারণ পলাশীর মোড়ের তরুণেরা আগুন লেগেছে সেটা বোঝার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে হাজির হয়ে গেছে। কেউ ফায়ার সার্ভিসে খবর দিল, কেউ দরজা ভাঙল, কেউ পানি আর বালির ব্যবস্থা করল; সবাই যেন একেকজন প্রশিক্ষিত ব্যক্তি এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে।
পলাশীর মোড়ের সেই ভবনের মানুষগুলো জীবন বাঁচল সেদিন ঐ তরুণদের শক্তির জোরেই।
ঘটনাকল্পের এখানেই ইতি নয়।
এরকম গল্প আমাদের প্রতিদিনের জীবনের। নানান ধর্ম, মত, আদর্শের মানুষের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে এমন গল্প প্রতিদিনই তৈরি হয়। সেই গল্পগুলো আমাদের দেখায়, কোনো অন্যায়, সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদের দিকে এই দেশের মানুষ কখনোই পছন্দ করে না। তারা চায় সকলে মিলে একটি শান্তি, সম্প্রীতি আর আনন্দের দেশ। এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরেই নিজেদের মাঝে লালন করছে ধর্মীয় সম্প্রীতি, এদেশে তরুণরাই সবসময় এগিয়ে এসেছে সমাজের প্রতিটি স্তম্ভ নির্মাণে, এদেশের মানুষ চিরকালই জাতপাত, ধনী-দরিদ্র, বংশ-গোত্রের কথা না ভেবে আপন করেছে নিজেদেরকে।
এই গল্পগুলোই আমরা দেখাতে চাই। আপনাদের পাঠানো গল্প থেকে তৈরী স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখবে সারা দুনিয়া। ধর্মীয় সম্প্রীতি, তারুণ্যের শক্তি ও সার্বজনীন বাংলাদেশ- এই তিনটি বিষয় নিয়ে যদি আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা কিংবা কল্পনার কোনো গল্প থাকে এবং আপনার বয়স যদি ১৮ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে হয়, তাহলে সেটি আমাদেরকে লিখে পাঠান এখানে: sveo@outboxbd.com। অথবা পাঠিয়ে দিতে পারেন এই ঠিকানায়ও: পিও বক্স নং- ৬০৯০, গুলশান পোষ্ট অফিস, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২। গল্পের সাথে পাঠাতে ভুলবেন না আপনার নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা, ইমেইল আইডি ও মোবাইল নম্বর।
আপনাদের পাঠানো গল্প থেকে নির্বাচিত সেরা দশটি গল্প নিয়ে নির্মিত হবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সেরা চলচ্চিত্র নিয়ে আয়োজিত হবে টেলিভিশনে গ্র্যান্ড প্রিমিয়ার শো, আর বাকি ৯টি গল্প থেকে বানানো চলচ্চিত্র প্রচারিত হবে ডিজিটাল মিডিয়ায়। প্রথম ধাপে নির্বাচিত ২০০ জনকে দেওয়া হবে সনদপত্র আর সেরা ১০ জনকে সম্মাননা সনদপত্র দেওয়া হবে সরাসরি গ্র্যান্ড প্রিমিয়ারে। এ উদ্যোগটির সাথে জড়িত আছে ইউএসএআইডির ‘Obirodh: Road to tolerance’ প্রকল্পের ‘সবাই ভিন্ন একসাথে অনন্য’ ক্যাম্পেইন। গল্প পাঠানোর খুঁটিনাটি দেখে নিন নিচের ছবি থেকে:
তবে আর দেরি কেন, লিখতে বসে পড়ুন আর দেখুন নিজের গল্প বড় পর্দায়!