অনুপা (ছদ্মনাম) জানে না তার বয়স কত। খুব ছোট বয়সে তাকে অপহরণ করে এনে মাত্র ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় দালাল। সেই থেকে তার ঠিকানা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর পুরনো যৌনপল্লী দৌলতদিয়া। অনুপার পেছনে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা উশুল করতেই প্রতিদিন অসংখ্য খদ্দেরের সাথে জোরপূর্বক মিলনে বাধ্য করা হচ্ছে তাকে। হৃষ্টপুষ্ট শারীরিক গঠন আর বয়স বেশি দেখানোর জন্য নিয়মিত গরু মোটা-তাজাকরণের স্টেরয়েড দেয়া হচ্ছে তাকে। ভাইস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অনুপা জানায়, “পিল খাওয়ার পরে যে সৌন্দর্য পেয়েছিলাম, কয়েক বছরের মধ্যে সব চলে গেছে। চামড়া কুঁচকে গেছে, ফিগার আর আগের মতো নেই। প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে। ভুগতে হচ্ছে খুব। আমি আর আগের মতো নেই।”
ব্যস্ত রেলস্টেশন আর ফেরিঘাটের মাঝখানে অবস্থিত এই নিষিদ্ধপল্লীতে প্রতিদিন চলে হাজারো মানুষের আনাগোনা। এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে প্রায় ২ হাজার যৌনকর্মী। তাদের বেশিরভাগই অল্পবয়সী কন্যা, যৌন দাসত্বের জন্য যাদের জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার যুগে নির্মিত এই যৌনপল্লীটির বর্তমান মালিকানা রয়েছে স্থানীয় এক রাজনীতিবিদের পরিবারের অধীনে। অবিশ্বাস্য রকমের লাভজনক এই ব্যবসাটির থেকে কী পরিমাণ মুনাফা হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
ছোট্ট একটি শহরের আকারে গড়ে ওঠা যৌনপল্লীটিতে খদ্দের আর যৌনকর্মীদের যা যা প্রয়োজন তার সব কিছুই পাওয়া যায় হাতের কাছে। বিউটি পার্লার, মার্কেট, জুয়ার আসর- কী নেই সেই পল্লীর ভেতরে? যারা এখানে কাজ করে, তাদের যেন বাইরে বের হওয়ার কোনো প্রয়োজন না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে পল্লীর বাড়িওয়ালিরা। মেয়েদের উপার্জিত অর্থ সরাসরি চলে যায় বাড়িওয়ালিদের কাছে। পল্লীর বাইরে যাওয়ার অনুমতি কখনোই মেলে না মেয়েদের। দালালরা যৌনপল্লীতে ম্যাডামদের কাছে পৌঁছে দেয়ার পর ঐ পল্লীই হয়ে মেয়েদের একমাত্র ঠিকানা। আর এ কারণেই ২৪ ঘণ্টা খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে এখানে।
লাভজনক এই ব্যবসার সাথে জড়িত দালালদের প্রকৃত সংখ্যা জানা এককথায় অসম্ভব। ১৩-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের খোঁজে শহরে-গ্রামে হন্য হয়ে ছুটে বেড়ানো তাদের প্রধান কাজ। “সন্ধ্যার দিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি আমরা। মেয়েদের সাথে কথা বলি কিছুক্ষণ। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি এখন যে জীবন তারা কাটাচ্ছে, তার চেয়ে অনেকটাই ভালো থাকার সুযোগ পাবে পতিতালয়ে গিয়ে। এরপর পতিতালয়ের জীবন দেখানোর জন্য দৌলতদিয়ায় নিয়ে আসি। বাকি কাজটা ম্যাডামরাই করে ফেলে”, দৌলতদিয়ার ভেতরে বসা এক দালাল বলছিল কথাগুলো। পরিচয় গোপন করার জন্য মুখে গামছা পেঁচিয়ে রেখেছিল লোকটা, নাম বলা তো অনেক দূরের কথা।
অনুপার মতো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা ম্যাডাম বা বাড়িওয়ালির চাপে বাধ্য হয় স্টেরয়েড নিতে। মোটা-সোটা না হলে খদ্দর জুটবে না, এই ভয়ে তাদেরকে নানা ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হয়, প্রেস্ক্রিপশনের কোনো রকম বালাই-ই নেই এখানে। দৌলতদিয়ার বেশ নামকরা এক ম্যাডাম, খুশি, অভিযোগ করে তার মেয়েরা ওষুধ খেতে চায় না বলে খদ্দেরও তেমন একটা পায় না। স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য সে তাদের স্টেরয়েড নিতে বলে। তার একটি ১৪ বছর বয়সী মেয়ে, রোজিনা, একেবারেই মোটা হচ্ছে না। ওষুধ তো সে মেয়েদের ভালোর জন্যই খেতে বলে।
স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, স্টেরয়েডগুলো প্রচণ্ড নেশা উদ্দীপক এবং পতিতালয়ের শতকরা ৯০ ভাগ কিশোরীর উপর তা প্রয়োগ করা হয়। কিডনি এবং হাড়ের জন্য ক্ষতিকারক এই ওষুধগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে মৃত্যুর ঝুঁকিও থেকে যায়। কিন্তু এত কিছু জেনেও দৌলতদিয়ায় স্টেরয়েড আমদানি বা তার চাহিদা কমেনি একবিন্দুও। প্রতিদিন প্রায় ১ ডলার অর্থাৎ ৮০ টাকার বিনিময়ে এক বক্স ওষুধ বিক্রি হয় দৌলতদিয়ার আশেপাশের ফার্মেসিগুলোতে। “বেচাকেনা খুব ভালো। মেয়েরা একের পর এক বাক্সভরা ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। অনেকগুলো দোকান থাকলেও সবার বিক্রিই ভালো হয়”, বলছিল পতিতালয়ের আভ্যন্তরীণ এক ফার্মাসিস্ট।
হাতেগোনা কয়েকটি ইসলামিক দেশের মধ্যে বাংলাদেশও একটি, যেখানে পতিতাবৃত্তিকে অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু পতিতালয় বন্ধের ঘটনা এখানে অসংখ্যবার ঘটেছে। ২০১৪ সালেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় টাঙ্গাইলের যৌনপল্লী। তাতে অবশ্য দৌলতদিয়ার খদ্দেরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় হাজারেরও বেশি খদ্দের যৌনকর্মীদের কাছে যায়। অনিয়ন্ত্রিত এই ব্যবসায় ভোক্তাদের জন্য নেই কোনো নিয়ম-কানুন, নেই কোনো নীতিমালা। ২৭ বছর বয়সী করিমের মতো অসংখ্য খদ্দেরের প্রথম পছন্দ ১০-১২ বছরের ছোট মেয়ে। যৌনকর্মীদেরকে খদ্দেররা একসাথে বসে ইয়াবার মতো নেশাজাতীয় ওষুধ খেতেও বাধ্য করে।
অ্যাকশন এইডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষের মতো নারী যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা অবৈধ হলেও হাজারো মেয়ে বাধ্য হয়ে বা পেটের দায়ে একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। আর পুরুষরাও তাদের তথাকথিত পুরুষত্ব প্রমাণ করতে, বিবাহ বহির্ভূত নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়াতে কিংবা জুয়ার মতো অবৈধ খেলায় লিপ্ত হতে চলে আসে পতিতালয়ে। কাজেই দৌলতদিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রমরমা ব্যবসা দিনকে দিন বেড়েই চলছে।
একেকটা দিন যায়, আর মেয়েরা এখান থেকে কোনোদিন বের হতে পারবে সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। “আমি স্বপ্ন দেখি, আপু। আমিও একদিন অন্য সব মেয়ের মতো শক্ত করে কারো হাত ধরতে পারব। ছেলেরা এখানে আসে, টাকা দেয়, মজা করে, চলে যায়। এখানে কেউ আমাদের ভালবাসে না,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মী এভাবেই নিজের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করে।
দৌলতদিয়ার বেশ কিছু যৌনকর্মী দুই বা তিন প্রজন্ম ধরে এখানে কাজ করছে। এমনকি ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখানে রয়েছে, এমন যৌনকর্মীর বংশধরও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু নিজেদের রিক্ত, করুণ পরিণতি দেখে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছে তারা। তারা চায় না বাচ্চারাও এই নির্মম পেশায় জড়িয়ে পড়ুক। নবজাতক শিশুরা পতিতালয়ে ঠাঁই পায় না। তার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সদ্যোজাত শিশুকে যৌনপল্লীর বাইরে পাঠিয়ে দেয়াই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পল্লীর বাইরের পরিবারগুলো অর্থের বিনিময়ে কয়েক বছর বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। খুব কম ক্ষেত্রেই সেসব পরিবার শিশুদের পড়ালেখার দায়ভার নেয় কিংবা দীর্ঘদিন তাদের নিজেদের কাছে রাখার দায়িত্ব নেয়। অর্থের বিনিময়ে অনেক সময় সন্তানদের বিক্রি করে দিতেও বাধ্য হয় পতিতালয়ের মায়েরা। শিশুরা খুব কম ক্ষেত্রেই জানতে পারে পিতৃপরিচয়, আর জানলেও বাবারা কখনো এই বাচ্চাদের দায়িত্ব নেয় না।
এনজিওগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অরক্ষিত শিশুদের শিক্ষাদান করার, কিছুটা হলেও উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করার। পতিতালয়ের খুব কাছের একটি গ্রামে একটি স্কুল চালাচ্ছে ব্র্যাক। অরক্ষিত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশে প্রায় ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যারা কখনো স্কুলে যায়নি বা কোনো কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, এমন শিশুদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই স্কুলগুলো। সরকারি নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের কথা থাকলেও, দৌলতদিয়ার সবচেয়ে কাছের স্কুলটি প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটা পথের দূরত্বে অবস্থিত হওয়ায় বাচ্চারা পড়ার সুযোগ খুব একটা পায় না। ব্র্যাকের এই উদ্যোগের কারণে শিশুরা শুধু যে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে তা না, বরং পড়ালেখার জন্য তাদের এক পয়সাও খরচ করতে হচ্ছে না।
অত্র এলাকায় ব্র্যাকের স্কুলটির দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, স্কুলটিতে সাধারণ বাচ্চাদের সাথে যৌনকর্মীর শিশুরাও নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করছে। শিক্ষকদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তারা যেন এই শিশুদের প্রতি আন্তরিক হয়, সহানুভূতিশীল হয়। ১১ বছর বয়সী শিউলি, শিশুদের জাতীয় পর্যায়ের ট্যালেন্ট শো দীপশিখার ফাইনালে উত্তীর্ণ হওয়া মেয়েটিকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “আচরণের দিক থেকে কিছুটা আক্রমণাত্মক হলেও সাহসের দিক থেকে সে সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে”।
বেশ লম্বা আর আত্মবিশ্বাসী শিউলি দৌলতদিয়ার প্রতিষ্ঠিত এক ম্যাডামের বড় মেয়ে। “ওর বাবা ওকে কখনোই পতিতালয়ে পা রাখতে দেয়নি, আমিও চাই না ও আমার মতো হোক”, শিউলির মা ৩৪ বছর বয়সী তাসলিমা বলছিল কথাগুলো। “ছোট থাকতেই ওর বাবা ওকে এই নোংরা জায়গার বাইরে, সভ্য দুনিয়ায় নিয়ে গেছে। আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রীও আমার বাচ্চাকে বেশ ভালোবাসে। শুরু থেকে ও শিউলিকে মানুষ করেছে”। শিউলি আর তার মতো যৌনকর্মীর সন্তানরা খুব অল্প বয়সেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বলে জানান তাদের শিক্ষিকা সালমা আক্তার। “ছেলে সন্তানদের বয়স ১৪ হলেই কাজের সন্ধানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা ঐ বয়স থেকেই তাদের মতো করে চলতে শেখে। মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন মায়ের পেশায় যোগ দেয়। তবে এই মেয়েদের সংখ্যাটা কমছে। অনেকেই এখন পড়ালেখা করে নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে”। নয় বছর ধরে এখানে শিক্ষকতা করছেন সালমা।
তাসলিমা চান তার মেয়ে পড়ালেখা করে সাধারণ জীবনযাপন করবে, যে পথে তিনি কখনো হাঁটতে পারেননি সেই পথে হেঁটে জয়ী হবে। “আমার জন্মের পরে বাবার অত্যাচারে মা এই পতিতালয়ে এসে কাজ করতে বাধ্য হয়”, এটুকু বলেই থেমে যান তিনি। আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বোধহয়। তিনি জানান, ১৮ বছর বয়সে মাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে এসে নিজেই আটকে পড়েন এই নরকের ফাঁদে। “খুব অর্থ কষ্টে ভুগছিলাম আমরা, টাকা কামানোর জন্য এ পথ বেছে নেই”, নিজেকে তিনি সৌভাগ্যবান মনে করেন। মা ছাড়া পরিবারের আর কেউ জানে না তিনি কোথায় আছেন। সবার ধারণা তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তিনি আলাদা হয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকছেন।
ঘর ভাড়া দিয়ে মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। মেয়েদেরকে পতিতালয়ের বাইরে পাঠান না তাদের জীবনের ঝুঁকি থেকে যায় বলে। এই টাকা দিয়ে চাইলে নিজের বিলাসিতার জন্য নানা ধরনের সামগ্রী কিনতে পারেন তিনি। কিন্তু তা না করে টাকা জমিয়ে রাখেন পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। “আমি চাই শিউলি বড় হয়ে গান করুক, ওর গানের গলা চমৎকার”, কোলে বসিয়ে দ্বিতীয় বাচ্চাটিকে আদর করতে করতে বললেন তিনি। “আমরা ভেবেছিলাম এই বাচ্চাটা হয়তো ছেলে হবে। কিন্তু আল্লাহ আমাদের আরেকটি মেয়ে দিয়েছেন। এই মেয়েটাকে আমি ছেলেদের মতো করেই বড় করব। বাচ্চাটা খুব চটপটে, ওকে আমি ডাক্তার বানাব”।
তাসলিমা বা তার শিশুরা দৌলতদিয়ার করাল গ্রাস থেকে আদৌ মুক্তি পাবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপাতত তাদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করাই তাসলিমার প্রধান লক্ষ্য। যেকোনো মূল্যে মেয়েদেরকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে দূরে রাখতে চান তিনি। স্কুলের পাশে এক পালক মাতা বলেন, “মায়েরা নিষিদ্ধ কাজ করছে তো কী হয়েছে? বাচ্চা তো বাচ্চাই। জাত-পাতের বিচারে বাচ্চাদের তো কখনো আলাদা করা যাবে না, ওরা তো ঈশ্বরের উপহার”।
ফিচার ইমেজ- contentron.net