বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আগমনের সূচনা ঘটে ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে। মূলত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানি দ্বারা নিযুক্ত হয়ে প্রথম অভিবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে ব্রিটিশ সরকার এর পূর্বের উপনিবেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীকে সেই দেশে স্বাগত জানায়। সেই সময় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন প্রত্যাশীদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ হলেও ধীরে ধীরে শিক্ষা এবং চাকরির সন্ধানে অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। এভাবে একসময় যুক্তরাজ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষদের একটি বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে।
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এসব সংগঠন অভিবাসী বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম, যেমন- ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষের চর্চা পরিচালনা করে আসছিল। ফলে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের উপর সহিংস বর্ণবাদী হামলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনই একটি সহিংস বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের ৪ মে মাত্র ২৪ বছর বয়সে আলতাব আলী নামে এক বাঙালি অভিবাসী নিহত হন।
আলতাব আলী ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈরদরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হাজী আব্দুস সামাদ ও মা সোনাবান বিবির সাত সন্তানের মধ্যে আলতাব আলী ছিলেন সবার বড়। গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করা আলতাব মদনমোহন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার জন্য যুক্তরাজ্যপ্রবাসী চাচা আব্দুল হাসিমের সহায়তায় ১৯৬৯ সালে দেশটিতে পাড়ি জমান।
যুক্তরাজ্যে আলতাব একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। প্রায় ছয় বছর সেখানে অবস্থানের পর তিনি মায়ের সাথে দেখা করতে ১৯৭৫ সালে একবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে তিনি বিয়ে করেন এবং ছয় মাসের মধ্যে আবারও যুক্তরাজ্যে ফিরে যান।
১৯৭৮ সালের ৪ মে যুক্তরাজ্যের বাংলাভাষী অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন এলাকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন উপলক্ষে ভোটগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কারখানায় কাজ করে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে আলতাব সেদিন বাসায় ফিরছিলেন। সন্ধ্যা প্রায় ৭:৪০ এর সময় তিনি লন্ডনের এডলার স্ট্রিটের সেইন্ট মেরি পার্কে পৌঁছামাত্রই তিন কিশোর দুর্বৃত্ত তার উপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।
বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যুক্তরাজ্য অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। পরে পুলিশ এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে রয় আর্নল্ড, কার্ল লাডলো এবং আরেক কিশোরকে গ্রেফতার করে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া এই তিনজনের বয়স ছিল ১৬-১৭ বছরের মধ্যে।
আলতাব আলীর সাথে হত্যাকারীদের পূর্বপরিচয় ছিল না। জাতিবিদ্বেষের সূত্র ধরে তারা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আদালতে সেই তিন কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় এবং পরে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে আদালত তাদের মধ্যে একজনকে ছুরিকাঘাতের অপরাধে সাত বছরের এবং অপর দুজনকে সহায়তার অপরাধে তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
আলতাব আলীর মৃত্যুর ঘটনায় পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন এলাকায় অভিবাসীদের উপর ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন এলাকায় স্থানীয় নির্বাচনে সেইবার ৪৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই দলটি অভিবাসীবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিল এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনে সুবিধা করতে চেয়েছিল।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশি অভিবাসীদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের অভিবাসী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। আলতাব আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর প্রায় ৭ হাজার মানুষ তার কফিন মিছিল নিয়ে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বিক্ষোভকারীরা পূর্ব লন্ডনের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবিলম্বে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী আক্রমণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের সমর্থন দেখে উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো আবারও পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তর পূর্ব লন্ডনের সেইন্ট মেরি পার্কের কাছে স্থানান্তর করা হলে পুরো শহরজুড়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। হ্যাকনি এলাকায় এই রকম আরেকটি বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে ইশহাক আলি নামে আরও একজন নিহত হন।
অব্যাহত বর্ণবাদী হামলা আন্দোলনের মাঠে অভিবাসীদের আরও ঐক্যবদ্ধ করে। তারা পুরো যুক্তরাজ্যে একতার ডাক দিয়ে সব বর্ণ-শ্রেণী-পেশার মানুষকে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে। সেই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে এক বিশাল বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, এবং বিশেষত বাঙালি অভিবাসীদের আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলা কমে আসে। বর্তমানে অনেক ব্রিটিশ-বাংলাদেশী যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যক চারজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশী নারী প্রার্থী- হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন থেকে রুশনারা আলী, পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজ আসন থেকে আফসানা বেগম এবং ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে রূপা হক লেবার পার্টি থেকে জয় লাভ করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
১৯৮৯ সালে বর্ণবাদী হামলার শিকার সব মানুষের স্মরণে সেইন্ট মেরি পার্কে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯৮ সালে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে ‘আলতাব আলী পার্ক’ রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই পার্কের অভ্যন্তরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মত্যাগী শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে।
আলতাব আলীর আত্মত্যাগ এবং বাঙালি অভিবাসীদের বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসকে উপজীব্য করে “ALTAB ALI & THE BATTLE OF BRICK LANE” নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর ৪ মে যুক্তরাজ্যে ‘আলতাব আলী দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদী হামলায় নিহত আলতাব আলীর মর্মান্তিক ঘটনাটি পুরো যুক্তরাজ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
[আলতাব আলীর নিহত হওয়ার আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন এই দুটি বই]