বৈচিত্রময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের গ্রাম

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।

বন্দে আলী মিয়ার কবিতায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এদেশের গ্রামের হৃদয় ভোলানো রুপ। গ্রাম মানেই সবুজ-শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা, মনোরম এক জনপদ। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, টইটুম্বুর খাল-বিলে নয়নাভিরাম শাপলা পদ্ম! গ্রাম মানেই পাখিদের কোলাহল, ঝিঁঝির ডাক আর জোনাকির স্বপ্নীল ওড়াউড়ি।

গ্রামগুলো যেন ছবির মতন সাজানো-গোছানো- ছবি- লেখক
গ্রামগুলো যেন ছবির মতন সাজানো-গোছানো; Image Source: লেখক

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঢাকা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রাম। গ্রামগুলোর অপার সৌন্দর্য একইসঙ্গে নয়নাভিরাম ও বৈচিত্রময়। প্রত্যেকটি ঋতুর পরিবর্তনের সাথে তারা পাল্টে যায় নতুন রুপে, নতুন বৈশিষ্ট্যে। যদিও ক্রমাগত নগরায়নের ফলে গ্রামের সৌন্দর্য এখন হুমকির মুখে, গ্রামের নানা ঐতিহ্য, রুপ আর সৌন্দর্য আর দেখতেই পাওয়া যায় না। তবুও যা টিকে আছে তার কতটুকুই বা উপভোগ করি আমরা? গ্রামের মনোলোভা সৌন্দর্য অবগাহন করতে তাই তো পল্লীকবি জসিমউদ্দীন আকুল কন্ঠে ডেকেছিলেন ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায়-

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।

বন-বাদাড়ে ঢাকা গাজীপুরের একটি গ্রাম- ছবি- লেখক
বন-বাদাড়ে ঘেরা গাজীপুরের একটি গ্রাম; Image Source: লেখক

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের গ্রামের সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজারের মতো। সবচেয়ে বড় গ্রাম সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও সবচেয়ে ছোট গ্রাম তিলইন। তিলইন গ্রামের অবস্থান কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বেলঘর ইউনিয়নে। সবচেয়ে ছোট এই গ্রামে লোকসংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। অপরদিকে ১২০টি পাড়া ও ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় গ্রাম বানিয়াচংয়ে বাস করেন ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। বলা হয়ে থাকে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রাম ও ছোটগ্রামও বানিয়াচং ও তিলইন!

গ্রাম মানেই মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আকাশ - ছবি- লেখক
গ্রাম মানেই মুক্ত হাওয়া, মুক্ত আকাশ ; Image Source- লেখক

নদীপ্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের সাথে নদীর নিবিড় সম্পর্ক। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকার সাথেও নদীর সম্পর্ক রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র সহ দুই শতাধিক নদী বয়ে গেছে অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলের বুক চিরে। নদী ছাড়াও রয়েছে হাজারো খাল, বিল, হাওড় ও বাওড়। প্রত্যেকটি গ্রামেই দেখা মেলে এমন জলাশয়ের। গ্রামগুলোর সৌন্দর্য ও বৈচিত্রের প্রধান অনুসঙ্গ এসব জলাশয়। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর নামগুলো যেমন চমৎকার, মনে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে তেমনি সু্ন্দর অধিকাংশ হাওড়, বাওড়, বিলগুলোর নামও। যেমন হাকালুকি হাওড়, চলন বিল, বিল ডাকাতিয়া, তামাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওড় ইত্যাদি।

বিস্তৃত ফসলের মাঠ গ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট- ছবি- লেখক
সবুজ শ্যামল বিস্তৃত ফসলের মাঠ গ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট; Image Source: লেখক

অধিকাংশ গ্রামগুলোতে শুধুমাত্র প্রকৃতির আচরণের সাথে তাল মিলিয়ে চলে গ্রামের জীবনযাত্রা। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বর্ষা সবকিছুর সাথেই গ্রামের জীবনযাত্রার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ঋতু বদলের সাথে সাথে বদলায় গ্রামের রং, রুপ, লাবণ্য।

তাই তো শরতে দেখা যায় শুভ্র মেঘ, কাশফুল, ঝকঝকে নীলাকাশের অপূর্ব সংমিশ্রণ। নদীর তীরে তীরে শুভ্র কাশফুল, গাছে গাছে হাসনাহেনা কিংবা শিউলী, কামিনী, বেলী, বিলে-ঝিলে শাপলার সমারোহে একেকটি গ্রাম ঢেকে যায় এক আশ্চর্য রূপমাধুরীতে।

কখনো আনন্দের বার্তা নিয়ে  নামে শরতের বৃষ্টি। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টি হৃদয় মনকে করে তোলে প্রফুল্ল। বৃষ্টি শেষে দিগন্তজুড়ে রংধনু মনের মাঝেও যেন আঁকিয়ে দেয় রং। নরম রোদের সকাল, রঙমাখানো সূর্যাস্ত, রাতের স্বচ্ছ আকাশে চাঁদ কিংবা লাখো নক্ষত্র শরতের সৌন্দর্যকে করে তোলে অপার্থিব। শরতের রুপে মুগ্ধ হয়ে নজরুল লিখেছেন,

সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!

গ্রামের জীবনযাত্রা গ্রামের সৌন্দর্যেরই অংশ- ছবি -লেখক
গ্রামের জীবনযাত্রা গ্রামের সৌন্দর্যেরই অংশ; Image Source: লেখক

হেমন্তে আবার গ্রাম পাল্টে যায় অন্যরকম আবহে। নির্মল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পাকা ধানের উপর সূর্যের কিরণে চারপাশে বিচরণ করে সোনালী আভা। কালের বিবর্তনে দিগন্তজোড়া মাঠ হারিয়ে গেলেও গ্রামের পথে প্রান্তরে হেমন্তের সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি আজও। পাতাঝরার এ ঋতুতে ফোটে কামিনী, অপরাজিতা, গন্ধরাজ, মল্লিকা সহ নানা রকম ফুল। নবান্ন উৎসবের সাথে পিঠা পায়েস আর নদী-নালা, খাল-বিলের হাঁটুপানিতে দেখা যায় মাছ ধরার উৎসব। মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী রুপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের।

মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী রুপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের
মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী রুপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের; Image Source: লেখক

শীতে হেমন্তের সাজ খুলে ফেলে গ্রামগুলো ঢেকে যায় কুয়াশার চাঁদরে। সেই কুয়াশা ভেদ করে সকালের সোনালী রোদ যখন গ্রামগুলোতে উঁকি দেয়, তখন দেখা মেলে ভিন্নরকম এক সৌন্দর্যের পশরা। মাঠ জুড়ে হলুদ সরিষাফুল, বিভিন্ন রকম শাক-সবজির বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমারোহ শীতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। পল্লীকবির ভাষায়,

‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’ 

তবে গ্রামের রুপ সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষায়। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে গ্রামগুলো যেন ভেসে থাকে। সে এক অপরুপ দৃশ্য। রিমঝিম বৃষ্টি আর মেঘ বাদলের লুকোচুরিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। ডালে ডালে ফোটে দৃষ্টিনন্দন কদম। বৃষ্টি ও বন্যায় ঝকঝকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে কার?

গ্রামের আনাচে কানাচে সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে আছে প্রকৃতি           ছবি-লেখক
গ্রামের আনাচে কানাচে সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে আছে প্রকৃতি; Image Source: লেখক

তবে গ্রামগুলো সবচেয়ে সুন্দর রুপে সাজে বসন্তে। গাছে গাছে নতুন পাতার আগমনে প্রকৃতি সাজে নবরুপে। ফুলে ফুলে চারপাশ হয়ে ওঠে বর্ণিল। পলাশ, মহুয়া, শিমুল, কনকচাঁপা, কৃঞ্চচূড়া, দোলনচাঁপা, বেলী সহ অধিকাংশ ফুল ফুটে এই সময়ে। গ্রামের ঝোঁপে ঝাড়ে বসন্ত আনে প্রাণের দোলা।

তবে শুধু ঋতু নয়, অঞ্চলভেদেও গ্রামের সৌন্দর্যের বৈচিত্র লক্ষ্য করার মতো। উত্তরাঞ্চল, যেমন- রংপুর, দিনাজপুরের গ্রামগুলোতে দেখা মিলবে সারি সারি পানের বরজ, লিচুর বাগান আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের। আবার সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকার গ্রামগুলোর দৃশ্য পুরোটাই ভিন্নরকম। উচু-নিচু টিলা আর বন এসব এলাকার গ্রামগুলোকে সাধারণ গ্রামের বৈশিষ্ট থেকে একেবারেই আলাদা করে রেখেছে।

হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলোতে জল ও ডাঙার মিশেলে যে অপরুপ সৌন্দর্যের দেখা মেলে, তা এতটাই মনোলোভা যে না দেখলে অনুভব করা শক্ত। জেনে রাখা ভালো, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার অংশবিশেষকে চিহ্নিত করা হয় হাওরাঞ্চল হিসেবে। 

জল ও ডাঙ্গার মিশেলে হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলোর সৌন্দর্য ভিন্নরকম; Image Source: লেখক

তবে সবুজের সমারোহ বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ছবির মতন গ্রামগুলো সৃষ্টিকর্তা যেন এঁকেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। সব গ্রামেই  চালতা, বেলী, নয়নতারা, কলমি, কামিনী, অপরাজিতা, কাঠালচাঁপা, দোলনচাঁপা, শিমুল, ঝুমকো জবা, শাপলা, জারুল, ঘাসফুল সহ হাজারো প্রকৃতির ফুল গ্রামগুলোর আনাচে-কানাচে, ঝোপে-ঝাড়ে শোভাবর্ধন করে আপন মহিমায়। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় শালিক, ময়না, টিয়া, ডাহুক, মাছরাঙ্গা, বক, বউ কথা কও, তিতির, চখাচখি, কাঠঠোকড়া, মোহনচূড়া, মাছরাঙা, পাপিয়া, ফিঙে, তোতা সহ হাজারের কাছাকাছি প্রজাতির পাখি। আম, জাম, কাঠাল, লিচু, জাম, করমচা, নারিকেল, সুপারি তাল সহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ আর লতাপাতার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গ্রামগুলোর মোহনীয়তাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। দেশের যেকোনো গ্রামে বাঁশঝাড় কিংবা বটের ছায়ায় বসে পাখির কিচির-মিচিরের সাথে একটি লগ্ন আপনার হৃদয়কে হাজার বছর বাঁচার জন্য আগ্রহী করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

গ্রাম মানেই উচ্ছল, দুরন্তপনা আর মাটির সুবাস
গ্রাম মানেই উচ্ছল, দুরন্তপনা আর মাটির সুবাস; Image Source: লেখক

বাংলাদেশের গ্রামগুলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ঢাকা থাকলেও বাংলাদেশে গ্রাম পর্যটনের কোনো কার্যকর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। যার ফলে দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জীবন বৈচিত্র। নগরায়নের প্রভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য। তারপরেও সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে টিকে থাকা গ্রামীণ সৌন্দর্যকে আমরা চাইলেই উপভোগ করতে পারি। নিশ্চিন্তে হারিয়ে যেতে পারি প্রকৃতির কোলে। গ্রামগুলো বেঁচে থাকুক তার আপন মহিমায়। অতুলনীয় সৌন্দর্য, বৈচিত্র আর ঐতিহ্যগুলোও টিকে থাকুক প্রজন্মের অহংকার হয়ে।

ফিচার ইমেজ- লেখক

Related Articles

Exit mobile version