আল জাহরাউয়ি তখন আন্দালুসিয়ানে খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের রাজচিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। আল হাকামের রাজসভায় তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। আর এখানে থাকাকালীনই তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কিতাব আল তাশরিফ’ রচনার কাজ শেষ করেন। এই গ্রন্থ বদলে দিয়েছিল মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা। সে সময়কার মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জন্য তার ত্রিশ খণ্ডের এই বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা- সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আল তাশরিফের ত্রিশ খণ্ডে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মহাগ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন আল জাহরাউয়ি। সে বছরই খলিফার সহায়তায় বইটি প্রকাশিত হয়।
আল তাশরিফ গ্রন্থের পেছনে জাহরাউয়ি তার পুরো জীবনই ব্যয় করেছেন বলা চলে। এই গ্রন্থে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা মৌলিক দিকের বিস্তারিত তথ্য সংযোজন করতে ৫০ বছর সময় লাগে তার। ৩০ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের প্রথম খণ্ডটি ‘জেনারেল প্রিন্সিপালস অব মেডিসিন’ বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক বিষয়গুলো দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি। একজন চিকিৎসকের প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার কাজ শুরু করতে যতটুকু মৌলিক জ্ঞান প্রয়োজন, তার পুরোটাই (মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের তুলনায়) এই খণ্ডে সংযোজন করেছেন জাহরাউয়ি। আর এর পরের খণ্ডেই তিনি প্যাথলজি বা রোগবিদ্যার সাথে ঔষধ প্রস্তুতির সমস্ত তথ্য-উপাত্ত যোগ করে দিয়েছেন। আল তাশরিফের এই খণ্ডটিকে অনেকেই মধ্যযুগের ফারমাকোলজি বা ঔষধবিজ্ঞানের বাইবেল বলে অভিহিত করেন।
আল তাশরিফের শেষ এবং সবচেয়ে বড় খণ্ডটি শল্যচিকিৎসা নিয়ে রচিত। চিকিৎসক হিসেবে নিজের পুরো ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতাকে ‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস’ নামক এই খণ্ডে একত্র করেছেন আল জাহরাউয়ি। তার আল তাশরিফ গ্রন্থটি মূলত বিশ্বনন্দিত হয়েছিল এই খণ্ডটির জন্যই। এতে তিনি দুই শতাধিক অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দেন, যা সে সময়কার চিকিৎসকদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। অবশ্য, আজকের সময়ে বসেও সেগুলো দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। তিনি নিজেও মূলত একজন শল্যচিকিৎসকই ছিলেন। নিজের প্রিয় অধ্যায়কে সবার শেষ সংযোজন করা নিয়ে তার একটি বিখ্যাত মন্তব্য রয়েছে।
“চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে শল্যচিকিৎসা। একজন চিকিৎসক যতদিন না চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্য সকল শাখার সাথে যথার্থভাবে পরিচিত হয়ে উঠবেন, ততদিন তার শল্যচিকিৎসার দিকে যাওয়া উচিত নয়।”
নিউরোসার্জারি এবং নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসায়ও জাহরাউয়ির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পুরো ইসলামি স্বর্ণযুগে কোনো মুসলিম চিকিৎসককে যদি আলাদা করে নিউরোসার্জন বলতে হয়, সেটা কেবল জাহরাউয়িকেই বলা যায়। তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞান আবর্তিত হত শল্যচিকিৎসা (নিউরোসার্জারি বাদে) এবং ঔষধশাস্ত্রকে কেন্দ্র করে। নিউরোসার্জারির দিকে যাবার সাহস অধিকাংশ চিকিৎসকই দেখাতেন না। সেখানে জাহরাউয়ির নিউরোসার্জারি বিষয়ক কাজগুলো চিকিৎসাশাস্ত্রের এই শাখায় নবদিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। তিনি তার জীবনে অসংখ্যবার মাথার আঘাত, মাথার খুলির অস্থিতে ফাটল, মেরুদণ্ডীয় জখম, হাইড্রোসেফালাসের সমস্যার চিকিৎসা করেছেন। এসব চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রায়োগিক পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন, যেগুলোর একটা বড় অংশ এখনো নিউরোসার্জারিতে ব্যবহৃত হয়!
পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোসেফালিক সমস্যার সমাধান করার কৃতিত্ব দেয়া হয় জাহরাউয়িকে। মানুষের মাথার ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি থেকে ‘সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড’ বা সিএসএফ নামক একপ্রকার তরল নির্গত হয়, যা মস্তিষ্ককে ঘিরে রাখে। হাইড্রোসেফালিক সমস্যা তখন হয়, যখন এই সিএসএফ তরল মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে এটি খুলির মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শিশুদের মাথার আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। কেননা শিশুদের খুলির অস্থিগুলো পরিপক্ক এবং একীভূত নয়। অন্যদিক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার আকৃতি বাড়তে পারে না এবং প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই সমস্যাকে অনেক সময় ‘মাথায় পানি জমা’ও বলা হয়। জাহরাউয়ি তার গ্রন্থে এই সমস্যার অস্ত্রোপচারের কথা সবিস্তারে লিখেছেন।
“নবজাতক শিশুর মাথার খুলি এমনিতেই নানাবিধ তরলে পূর্ণ থাকে। মাথায় পানি জমতে থাকলে প্রতিদিন তার মাথার আয়তন বাড়তে থাকে। ফলে খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধানকল্পে, খুলির মধ্যভাগে তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে কেটে উন্মুক্ত করতে হবে। জমে থাকা তরল নির্গত হয়ে গেলে ক্ষত সেলাই করে শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে, যেন খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে।”- আল তাশরিফ; ৩০তম খণ্ড
‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস’ খণ্ডটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সচিত্র ‘সার্জিক্যাল গাইড’। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আল জাহরাউয়ি এখানে কোন অস্ত্রোপচারে কোন বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, তা সবিস্তারে লিখেছেন, যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী জুড়ে ইউরোপীয়রা আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করেছে। শল্যচিকিৎসায় প্রয়োজন হয় এমন প্রতিটি যন্ত্রের পৃথক পৃথক ডায়াগ্রাম এঁকে সেটিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্ণনাগুলো এতটা প্রাঞ্জল যে, কোনো সাধারণ মানুষও সেগুলো পড়ে শল্যচিকিৎসা শিখে ফেলতে পারবেন! জাহরাউয়ির মূল উদ্দেশ্য ছিল মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য শল্যচিকিৎসা শেখা সহজ করে দেয়া। সে উদ্দেশ্যে তিনি দারুণভাবেই সফল হয়েছিলেন। তার এই গ্রন্থ, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে ইউরোপের সকল বিখ্যাত মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় ৫ শতাধিক বছর প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
“যে ব্যক্তি শল্যচিকিৎসাকে জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করতে চান, তাকে অবশ্যই অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে।”- আল জাহরাউয়ি
ইউরোলজিতে জাহরাউয়ির অবদান লিথোটমি। তিনি মূত্রথলীর পাথর অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ‘মিশাব’ নামক একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যা কিনা অনেকটাই আধুনিক যুগের লিথোট্রাইটের অনুরূপ। এই যন্ত্র দিয়ে তিনি কোনো কাটাছেঁড়া ছাড়া মূত্রথলীর ভেতরেই পাথর ভেঙে ফেলতে পারতেন। ফলে এটিই ছিল ইতিহাসের প্রাথমিককালের লিথোটমি বা কাটাছেঁড়াবিহীন মূত্রথলির পাথর অপসারণ। দন্তচিকিৎসায়ও জাহরাউয়ির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। মুসলিম চিকিৎসকদের মধ্যে একমাত্র জাহরাউয়িই দাঁত অপসারণের অস্ত্রোপচার সঠিকভাবে বর্ণনা করে গেছেন। তিনি ব্রোঞ্জ এবং রূপা দিয়ে দাঁত বাঁধাই করতেন। তাকেই বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সফলভাবে দাঁত ‘ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ করা চিকিৎসক। এসব অস্ত্রোপচারে তিনি ২০০ এর অধিক সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর একটি বড় অংশ আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহরাউয়ি, সংক্ষেপে আল জাহরাউয়ি। ল্যাটিন ভাষায় তিনি ‘আবুলকাসিস’ নামে পরিচিত। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়ার আজহারা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খুব সম্ভবত আল আনসারি গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার শৈশব এবং শিক্ষা সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। যত দূর জানা যায়, জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি স্পেনের কর্ডোভায় কাটিয়েছেন। অধিকাংশের মতে, এ শহরেই তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, ডাক্তারি করেছেন, শল্যচিকিৎসায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। খুব সম্ভবত মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে তিনি এল-জাহরা শহরে স্থানান্তরিত হন এবং বাকি জীবনটা সেখানেই কাটান। ইতিহাসবিদগণের মতে, তিনি তার আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই তাকে নিয়ে আরো অনেক লেখা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্যাস্টিলিয়ান ও আন্দালুসিয়ানদের মধ্যকার যুদ্ধে এল-জাহরা শহর ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে তার ব্যক্তিগত তথ্যাদি পাবার রাস্তাও চিরতরে বন্ধ হয়।
আন্দালুসিয়ার খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের দরবারেই জীবনের একটা বড় অংশ রাজচিকিৎসক হিসেবে কাজ করে কাটিয়ে দেন জাহরাউয়ি। রাজদরবারে কাজ করবার সময়ই তিনি তার অধিকাংশ চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি তৈরি করেন। তার এসব যন্ত্রপাতির জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান তার নিকট যেমনই ঋণী, তেমনি স্মরণে রাখতে হবে খলিফা আল হাকামের নামও। তার পৃষ্ঠপোষকতায়ই এতকিছু করতে পেরেছিলেন জাহরাউয়ি। তার কর্মজীবন সম্পর্কে যতটুকু তথ্যই আমরা পেয়েছি, সেগুলো তার মৃত্যুর অর্ধশতক পর আল হুমায়দি নামক এক ইতিহাসবিদ লিখে গেছেন। খুব সম্ভবত ১০১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কর্ডোভা ছেড়ে এল-জাহরা শহরে গমন করেন এবং সেখানে নিভৃতে বসবাস শুরু করেন। এ শহরেই ১০১৩ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ এই শল্যচিকিৎসক।
“আবুলকাসিসের চিকিৎসাপদ্ধতি এতটাই উন্নত ছিল যে সেগুলোর কাছে গ্যালেনের চিকিৎসাপদ্ধতিও হয়ে যায়! ইউরোপীয়রা অন্ধের মতো অনুকরণ করতে শুরু করে তাকে। তার দেখানো পথে চলেই ইউরোপে শল্যচিকিৎসা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে!” – চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল
মধ্যযুগে আরব বিশ্বে এবং ইউরোপে, শল্যচিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নামটি ছিল আবুলকাসিস তথা আল জাহরাউয়ি। ১৪ শতকে ডাক্তারি করা ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক গাই ডি কলিক অকপটে জাহরাউয়ির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন। রেনেসাঁর সময়ের আরেক বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক পিয়েত্রো আরগালাতা তার সম্বন্ধে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে তিনি সকল শল্যচিকিৎসকদের মাস্টার!” কর্ডোভায় যে গলিতে তিনি বসবাস করতেন, সে গলিটির নামকরণ করা হয়েছে ‘আবুলকাসিস স্ট্রিট’। এমনকি যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করতেন, সে বাড়িও সংরক্ষণ করেছে স্পেন সরকার। আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে একটি ব্রোঞ্জ প্লেট লাগানো আছে, যাতে লেখা, “এটিই সেই বাড়ি, যেখানে আল জাহরাউয়ি বসবাস করতেন।” সর্বোপরি, শল্যচিকিৎসা আলাদা করে না বলে, চিকিৎসাশাস্ত্রই আল জাহরাউয়ির নিকট ঋণী বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না।
ফিচার ছবি: techno.okezone.com