Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শুভ জন্মদিন গুরু

কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—

জীবনানন্দ দাসের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার লাইন এগুলো। আট বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পপগুরু আজম খান, এই ভাবনা থেকেই কবিতাটা মনে এলো। মৃত্যুর আট বছর পর ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন  আজম খান। আজ তাঁর জন্মদিন। আমরা সবসময় শ্রদ্ধার সাথে সাথে স্মরণ করব এই কিংবদন্তিকে। শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধেয় গুরু।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পপ সম্রাট আজম খানের মরণোত্তর একুশে পদক -২০১৯ গ্রহণ করছেন তার মেয়ে বেগম ইভা খান; ছবি: ফোকাস বাংলা

আজম খান প্রথা গড়া নয়, প্রথা ভাঙাদের দলে ছিলেন। প্রচলিত সঙ্গীতের ধারা থেকে সরে গিয়ে পপ সংস্কৃতি চালু করেছিলেন এদেশে। আর ইতিহাস বলে, যারা প্রথা ভেঙে নতুন কিছু করতে চায় তাঁদের বুকে থাকে হিমালয় সমান সাহস। আজম খান সেই সাহস নিয়েই গলায় নতুন সুরে বেঁধেছিলেন গান। সমালোচকদের সমালোচনা আর অপসংস্কৃতির অপবাদকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তারুণ্যের জোয়ারে।  আর দেশ উদ্ধারেও হাতে তুলে নিয়েছিলেন ‘গান’ (বন্দুক)। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির আগে ‘বীর’ বিশেষণ যোগ করা হয়। আজম খান শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, বীর গায়কও ছিলেন। তিনি আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, পূর্ণতা দিয়েছেন, সুগম করেছেন অন্যদের পথ, যুদ্ধ করেছেন স্বাধীন দেশের জন্যে। তারুণ্যের জয়গান তাঁর জীবনে থেকেছে সবসময়। আজম খানের দেখানো পথ অনুসরণ করেছেন জেমস, আইয়ুব বাচ্চু,  হামিন, শাফিন, মাকসুদ, হাসান, বিপ্লবসহ আরও অনেকে।

পরবর্তী প্রজন্মের ব্যান্ড শিল্পীদের সংগে সদা হাস্যোজ্জ্বল পপ-সম্রাট। ছবি: arkhasan.blogspot.com

মাথায় বাবরি চুল, মুখে দাড়ি। বেলবটম প্যান্ট আর মোটা বেল্ট। কিছুটা হিপ্পি স্টাইল নিয়ে সে সময়ের ফ্যাশন আইকন হয়ে গিয়েছিলেন পপ সম্রাট। স্টাইলিশ আজম খান যেন সে সময় তারুণ্যের  আদর্শ ছিলেন। আর তাঁর সারথী ছিলেন আরো কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র। পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীতে ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজদের সাথে সখ্যতা হয়। স্বাধীনতার পরে হ্যাপি আখন্দ এবং লাকী আখন্দ ভাইদের সাথে গড়ে তুলেছিলেন ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড।

৭০ দশকের তরুণ শিল্পী আজম খান ও তার সঙ্গীরা; ছবি: amradhaka.com

দেশ স্বাধীন করে কী পেয়েছেন? কীসের জন্যে যুদ্ধ করেছেন? সেই সব হতাশা বারুদ হয়ে জন্মেছিল এক গানে।

রেল লাইনের ঐ বস্তিতে
জন্মেছিলো একটি ছেলে
মা তাঁর কাঁদে
ছেলেটি মরে গেছে
হায়রে হায় বাংলাদেশ!

যে দেশকে বাঁচানোর জন্যে জীবন বাজি ধরেছিলেন, সেই দেশকে এভাবে তুলে ধরতে পারাটাও ছিল এক অসাধ্য সাধন। আর সেই বাস্তবতার প্রকাশ ও ধরনকে সবাই গ্রহণ করেছিল ভীষণ উচ্ছ্বাসে। এক নতুন ভাবনা তৈরি করেছিলেন আজম খান। আর সেই ভাবনার জালে বন্দী হয়েছিল এদেশের মানুষ। গুরু বলে স্বীকার করেছিল সবাই।

 ভক্তদের করা দেয়ালচিত্রের সামনে বাংলা রক সঙ্গীতের পথিকৃৎ; ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

বর্ণাঢ্য সঙ্গীতজীবনে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন আজম খান, যার মধ্যে হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে ‘বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড’, ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বটল’ সহ ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম। বিখ্যাত গানগুলো হলো ‘আলাল ও দুলাল’, ‘সারা রাত জেগে জেগে’, ‘আমি যারে চাইরে তারে আমি পেয়েও হারাইরে’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবো না’, ‘নেই কোনো অভিযোগ’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘জীবনে কিছু পাব নারে’, ‘জীবনে মরণ কেন আসে’, ‘অভিমানী তুমি কোথায়’, ‘চাঁদকে ভালোবেসো না’, ‘বধুয়া কি গাইতে জানে গান?’ ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও তার আরো অসংখ্য বিখ্যাত গান রয়েছে।

সব মিলিয়ে প্রায় ১৭টিরও বেশি হিট গানের অ্যালবাম বের করেছিলেন তিনি, যা কয়েক লাখ কপি  বিক্রিও হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে ‘এক যুগ’, ‘দিদি মা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘কেউ নাই আমার’, ‘অনামিকা’, ‘কিছু চাওয়া’, ‘নীল নয়না’  ইত্যাদি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কপিরাইটের কারচুপি ও অসচ্ছতার কারণে আর্থিক সচ্ছলতা পাননি কোনদিন। আর সে কারণেই যোগাড় করা টাকা দিয়েই সিঙ্গাপুরে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে যান তিনি। সেখান থেকেও টাকার অভাবেই থেরাপি সম্পন্ন না করে দেশে ফিরে আসেন। এরপর ২০১১ সালের ৫ জুন সেই চির তরুণের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার আগে সর্বস্তরের জনতার পক্ষ থেকে তাকে একুশে পদক দেওয়ার বিষয়ে দাবি উঠেছিল। কিন্তু সে সময় তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুর পরেও ভক্তদের পক্ষ থেকে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়ার বিষয়ে জোর দাবি ওঠে। অবশেষে এ বছর মিললো সেই সম্মাননা।

ভক্তদের স্মরণে চির অম্লান, পপ-গুরু আজম খান; ছবি: footprint.press

তবে এটা কি আরো আগেই তাঁর প্রাপ্য ছিল না? এমন প্রশ্ন অনেকেরই অন্তরে গুমরে ফিরছে। আজম খানের ভাই সুরকার আলম খান পদকপ্রাপ্তির ঘোষণার পরে এক সাক্ষাতকারে  চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, এ ঘোষণায় তিনি অবশ্যই খুশি হয়েছেন, তবে আক্ষেপও করেছেন যে, “একুশে পদকটি আজম খান জীবিত অবস্থায় পেলে তখন আরো ভালো লাগতো। এখন তিনি সমস্ত পুরস্কারের উর্দ্ধে, দেখে যেতে তো পারলেন না এই সম্মান, এই পুরস্কার।” সাক্ষাতকারে আলম খান আরো বলেছেন, “জীবিত অবস্থায় একুশে পদক পাওয়ার যোগ্য ছিলো আজম খান। সে তো শুধু গায়ক ছিলো না, মুক্তিযোদ্ধাও ছিলো। কমান্ডার ছিলো। সেই হিসেবে আরো আগেই তার পাওয়া উচিত ছিলো।

সবার অন্তরে ঠাই করে নেয়া আজম খান কিন্তু খ্যাতি, তারকার আলোয় ঝলমল করা জগতের মোহ থেকে দূরে থেকেছেন সবসময়। তাঁর জায়গাটাই ছিল সাধারণ মানুষের অন্তরে। আলাল-দুলাল,  সালেকা-মালেকা, পাপড়ির মতো আমাদের চারপাশেরই মানুষের গল্প নিয়ে গান বেঁধেছেন আর যাপন করেছেন অতি সাধারণ জীবন, যা তাকে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের অন্তরের খুব কাছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও করেছিলেন নতুন একটি গান। যেখানে নিজের জীবন তুলে আনতে চেয়েছিলেন বোধহয় তিনি। ‘আমি বাংলাদেশের আজম খান, বাংলাতে গাই পপ গান…’ এই গানটির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের কিছু অংশ চমৎকারভাবে উঠে এসেছে।

সাধারণ জনতার জন্য গাইতেন আজম খান; ছবি: priyo.com

ওপার বাংলার বিখ্যাত গায়ক কবির সুমন আজম খানের সমবয়সী। এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুমন একবার হুট করেই হাজির হয়েছিলেন আজম খানের বাসায়। তখনও অসুস্থ তিনি। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। ইউটিউবে দারুন জনপ্রিয় এই ভিডিওটিতে দেখা যায় সেদিন কী ভীষণ আড্ডায় মেতেছিলেন দুজন। সেই আড্ডাতে খেয়াল করলে দেখা যায়, আজম খান বার বার বলেছেন তিনি দেশের জন্যে যেমন যুদ্ধ করেছেন, তেমনি গানও করেছেন দেশের জন্যেই।

বিখ্যাত কিংবা তারকা হতে নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বিপথগামী তরুণদের মনোযোগ ফেরাতেই গানে নেমেছিলেন। গণশিল্পী ছিলেন তিনি, অর্থাৎ মানুষের জন্যে নিবেদিত ছিল তাঁর গান। বর্তমান সময়ে সঙ্গীতের নামে অস্থির প্রতিযোগিতা, বিখ্যাত হওয়ার তাড়না- এসব নিয়ে দুঃখ করেছেন গুরু। একসময় বাংলাদেশে তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল অনেকের রকস্টার হওয়ার স্বপ্ন। অনেকের কাছে এখনো তিনি আইডল। আজম খানের স্বপ্ন পূরণ হবে, এ দেশের তরুণেরা বিজয় নিশান ওড়াবে সব ক্ষেত্র থেকে। তাহলেই তো পপ সম্রাটের সব চাইতে বড় পুরষ্কার প্রাপ্তি হবে। এই প্রত্যাশা রেখে আমরা তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।  

আজম খান একাডেমির গ্রাফিতির সামনে স্বয়ং কিংবদন্তী; ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

আমি তারে পেয়েও হারাইরে
আমি যারে চাইরে
সে থাকে মোর-ই-অন্তরে
আমি তারে পেয়েও হারাইরে

তাঁর গানের মতোই তিনি বিরাজ করবেন সবার হৃদয়ে সবসময়। আমরা কখনোই তাঁকে হারিয়ে ফেলবো না। চলে যাওয়া মানেই তো প্রস্থান নয়।

"Azam Khan" the first name to start the history of Bengali band or pop songs. A freedom fighter and an unique personality to start the new era of music in Bangladesh. He is honored with the national "Ekushe" award in this year after nearly eight years after his death. People of Bangladesh always remember him with his local title "Pop-Guru". We express our sheer respect from the core of our heart.

Related Articles