২০ শতকের শুরুর কথা। তখনো চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রাক-আধুনিক পর্যায়েই রয়েছে। তখনো পৃথিবীতে নিয়মিত ঘটতো নানারূপ মহামারী, যা কেড়ে নিতো লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। এসব মহামারীর মধ্যে একটির নাম ছিল টাইফাস। টাইফাস শব্দটি দিয়ে একাধিক রোগ বোঝালেও মহামারীর ক্ষেত্রে কেবল টাইফাস শব্দটিই ব্যবহৃত হতো। মূলত টাইফাস জ্বর নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত এ রোগ যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল, ঘনবসতি, জেল আর বন্দীখানায় অধিক ছড়াতো। ১৯২০ সালে রাশিয়ান গৃহযুদ্ধের সময় সেখানে টাইফাসের মহামারীতে মৃত্যু হয়েছিল ৩০ লক্ষাধিক মানুষের। এই ভয়াবহ মহামারীর অনেক আগেই টাইফাস রোগের একটা বিহিত করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অখ্যাত এক ডাক্তার, যার নাম চার্লস নিকোল।
১৯০৩ সালে তিউনিসিয়ার মাটিতে পা রাখেন চার্লস নিকোল। উদ্দেশ্য ছিল টাইফাস নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করবেন। তখনকার সময়ে জেলখানাগুলোতে এ রোগ অতিমাত্রায় প্রকট ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জেলে গিয়ে বন্দীদের পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে যেদিন যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন, তার আগেরদিনই ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার স্থলে জেল পরিদর্শনে যান তার দুজন সহযোগী, যারা মরণঘাতি টাইফাস সাথে নিয়ে ফিরেছিলেন। ১ সপ্তাহ পর নিকোল সুস্থ হয়ে ফিরতে ফিরতে তার সহযোগীদ্বয়ের মৃত্যু হয়! এ ঘটনায় নিজেকে ভাগ্যবান ভাবার চেয়ে বরং যেন কিছুটা দোষীই ভাবতে শুরু করেছিলেন নিকোল। আর তাতে টাইফাসের পেছনে আরো মরিয়া হয়ে লেগেছিলেন তিনি।
তবে জেলখানা পরিদর্শনের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন শেষতক। এর বদলে তিউনিস শহরের বিভিন্ন বড় হাসপাতালে ঘুরে বেড়ালেন। সপ্তাহব্যাপী এই ভ্রমণে তার গবেষণার ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্য সহায়ক এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র উদঘাটন করেন তিনি। তিনি লক্ষ্য করেন, হাসপাতালে ভর্তি টাইফাস রোগীদের থেকে এই রোগ অন্যদের মাঝে ছড়াচ্ছে না। কিন্তু, রোগীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ওয়ার্ডে ভর্তি করানোর আগে যেসকল কর্মচারী তাদের তদারকি করেন, তাদের অনেকেই টাইফাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার, বাসা থেকে রোগীর পরে আসা জামাকাপড় ধৌত করার কাজ যারা করেন, তাদের অনেকেও আক্রান্ত হন টাইফাসে। অথচ, রোগীকে হাসপাতালে আনার পর যে ডাক্তাররা তাদের প্রাথমিক চেকআপ করেন, তাদের প্রায় কেউই টাইফাসে আক্রান্ত হচ্ছেন না! এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ধরেই বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে টাইফাসের একটি সাময়িক প্রতিরোধমূলক টিকাও আবিষ্কার করেছিলেন নিকোল।
১৮৬৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের রুয়েন শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে চার্লস নিকোল। তার বাবা এদুয়ার্দ নিকোল ছিলেন একজন পেশাদার ডাক্তার ও পার্ট-টাইম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তার তিন ছেলের তিনজনই ব্যক্তিগত জীবনে সফল্যমণ্ডিত হয়েছেন। তাদের মাঝে মধ্যবয়সী চার্লসের সাফল্য অপর দুজনকে সহজেই ছাড়িয়ে যায়, যিনি ভবিষ্যৎ জীবনে জিতেছিলেন নোবেল পুরস্কারও।
রুয়েন শহরের পিয়েরে কর্নেইল স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় চার্লসের। রুয়েন শহরটি তার কখনো পছন্দের ছিল না। শহরের রাস্তাঘাট, মানুষজন এবং নিজের স্কুলটিকেও তার একঘেয়ে মনে হতো, যে কারণে শৈশবে তার কোনো বন্ধু ছিল না। অবসর সময় তিনি বই পড়েই কাটাতেন। আর পড়ালেখার ক্ষেত্রেও একটি জিনিস তার একঘেয়ে লাগতো। আর সেটি হলো বিজ্ঞান! তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতো সাহিত্য, ইতিহাস আর কল্পকাহিনী। জুলভার্ন ছিলেন তার প্রিয় লেখক।
নিকোলের বাবা এদুয়ার্দ ছেলেদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পছন্দ করতেন না। যা তাদের মনের স্বস্তি যোগাত, তা-ই পড়ার স্বাধীনতা তিনি ছেলেদের দিয়েছিলেন। তবে তাদেরকে শৈশবে বিজ্ঞান পড়ার প্রতি অনুপ্রাণিত করতে ভোলেননি। ফলাফল নিকোলের জন্য ইতিবাচক ছিল। তিনি ধীরে ধীরে কল্পকাহিনীর জগত থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন। একসময় বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে গেলেও শহরটি তার কখনোই মনে ধরেনি। তথাপি অনেকটা বাধ্য হয়েই রুয়েনের মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন, যেহেতু তার বাবা তাকে শহরের বাইরে পাঠাতে চাননি।
ডাক্তারি পড়া শেষ করার আগেই নিকোলের বাবা মারা যান, আর্থিক স্বচ্ছলতাও বিগত হয়। রুয়েনের পড়া শেষ হলে জার্মানি গিয়ে কোনো উন্নত মেডিকেলে পড়বার ইচ্ছা ছিল তার যা আর্থিক কারণে ত্যাগ করতে হয়। দেশের ভেতরেই একটি অপেক্ষাকৃত নতুন গবেষণা ইনস্টিটিউটে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য ভর্তি হন নিকোল। ‘পাস্তুর ইনস্টিটিউট’ নামক এ গবেষণা ইনস্টিটিউট তার ভর্তির মাত্র দু’মাস আগেই উদ্বোধন করা হয়। ফলে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি তখন সহলভ্য হয়নি সেখানে। তথাপি, এখানেই একটি যৌন রোগের উপর নিজের ডক্টোরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন নিকোল।
১৮৯৪ সালে ২৭ বছর বয়সী নিকোল আবারো ফিরে আসেন নিজের একঘেয়ে শহরে এবং ডাক্তারি শুরু করেন নিজের একঘেয়ে মেডিকেল স্কুলেই। এখানে তিনি অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাও করতেন। মাত্র দু’বছরের মাথায় তাকে সেখানকার ব্যাকটেরিওলজিক্যাল গবেষণাগারের প্রধান পরিচালক করা হয়। তখন থেকে তিনি ডাক্তারি কম, গবেষণা বেশি করতে শুরু করেন। তাছাড়া, নতুন শতাব্দীর প্রাক্বালে ছোটখাট এক দুর্ঘটনার পর থেকে তার শ্রবণ শক্তি তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় হ্রাস পায়। ফলে স্টেথোস্কোপ দ্বারা রোগী পরীক্ষা করায় বাঁধার সম্মুখীন হন তিনি।
এদিকে ১৯০২ সালে পাস্তুর ইনস্টিটিউটের নতুন শাখা খোলা হয় তৎকালীন ফরাসি উপনিবেশ তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে। চার্লস নিকোলকে সেখানকার প্রধান করে পাঠানো হয়। ফ্রান্সে যখন টাইফাসের প্রকোপ প্রায় নেই বললেই চলে, তিউনিসে তখন এটি ঘন ঘন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। নিকোলস ঠিক করলেন এ রোগের একটি দফারফা করবেনই। তিউনিসের হাসপাতালগুলো ঘুরে যখন দেখলেন পরিষ্কার রোগীর দেহ থেকে টাইফাস ছড়ায় না, তখন তিনি অনুমান করলেন এটি ছোঁয়াচে রোগ নয়, অন্য কিছু একে ছড়ায়। হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রবেশ করানোর পূর্বে রোগীদের ভালো করে গোসল করিয়ে নেয়া হতো। ফলে তাদের থেকে রোগ ছড়াতো না। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যায় তাদের গোসলের তদারকিতে যে কর্মচারীরা তাদের পুরাতন পোশাক পরিবর্তন করেন কিংবা ধৌত করেন, তাদের অনেকেই রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে তিনি সিদ্ধন্তে এলেন যে, রোগীর দেহের উকুন থেকে সুস্থ মানুষের দেহে টাইফাস ছড়াচ্ছে!
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে তিনি বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। হাসপাতালে রোগীদের পোশাক পরিবর্তনের ব্যাপারটি ছাড়াও, সাধারণত শীতকালে টাইফাস অধিক ছড়াতো, যেসময় মানুষজন কাছাকাছি বসবাস করতো। আর কাছাকাছি গাদাগাদি করে বসবাস করলে উকুনের বিস্তার সহজ হতো। এছাড়াও, টাইফাস সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, জেলখানায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তো। নিকোল অনেক জেলখানায় খোঁজ নিয়ে দেখেন যে, সেখানে বন্দীদের চুল কাটবার খুব ভালো ব্যবস্থা নেই এবং অধিকাংশ বন্দীর মাথার চুলেই উকুন ছিল। তবে, এ ধরনের প্রকল্পিত যুক্তিগুলো তার সিদ্ধান্তকে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি ১৯০৯ সালে কিছু পরীক্ষামূলক প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
- প্রথমে তিনি একজন টাইফাস আক্রান্ত রোগীর রক্ত একটি শিম্পাঞ্জীর দেহে প্রবেশ করান। এতে শিম্পাঞ্জীটিও টাইফাসে আক্রান্ত হলে প্রমাণিত হয় যে, টাইফাস রক্তের আদান-প্রদানে মাধ্যমে ছড়ায়।
- এবার তিনি ঐ আক্রান্ত শিম্পাঞ্জীর রক্ত একটি ম্যাকাওয়ের দেহে দিলেন এবং দেখা গেল যে ম্যাকাওটিও আক্রান্ত হয়েছে।
- সবশেষ তিনি ম্যাকাওটির দেহের কিছু উকুন অন্য কিছু ম্যাকাওয়ের দেহে ছড়িয়ে দেন এবং প্রতিটি ম্যাকাও টাইফাসে আক্রান্ত হয়।
এ পরীক্ষা গিনিপিগের মাধ্যমেও চালিয়েছিলেন নিকোল। দেখা গেল, গিনিপিগ আক্রান্ত হয় ঠিকই তবে টাইফাস এ প্রাণীর জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে না। এই পর্যবেক্ষণের পর তিনি টাইফাস নিয়ে গবেষণায় গিনিপিগ ব্যবহার করা শুরু করেন। কেননা, শিম্পাঞ্জী, ম্যাকাও কিংবা টাইফাস ছড়ানো উকুনও রোগাক্রান্ত হলে শেষতক মারা যেত। তিনি যখন এসকল গবেষণায় নিয়োজিত, তখনও টাইফাসে মারা যাচ্ছে তার হাসপাতালেরই অনেক নার্স এবং কর্মচারী। তিনি তাই টাইফাস নিরাময়ে একটি সাময়িক টিকা তৈরি করলেন। কোনো টাইফাস রোগী, যিনি অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন কিংবা দ্রুত সেরে উঠছেন, তার রক্তের সিরাম অন্য একজন আক্রান্ত রোগীর দেহে প্রবেশ করালে তিনি সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে উঠতেন। এটি ছিল তার সাময়িক টিকা ব্যবস্থা।
এর কিছুকাল পরই চার্লস নিকোলের গবেষণায় উঠে আসে যে উকুন থেকে অত দ্রুত টাইফাস ছড়ানোর কথা নয়, যত দ্রুত এটি আদতে ছড়ায়। তিনি গবেষণা করে প্রমাণ করলেন যে, টাইফাস রোগীর উকুনের মল থেকেও এ রোগ ছড়ায়। উকুন মাথায় যে মল ত্যাগ করে রাখে তা নখের মাধ্যে দেহের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে এবং মুখ বা চোখের মাধ্যমে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন সুস্থ ব্যক্তিও টাইফাসে আক্রান্ত হয়। নিকোলের এ গবেষণার কয়েক মাসের মাথায়ই ইউরোপে টাইফাসের মহামারী বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে, টাইফাস থেকে বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত হলো পরিচ্ছন্নতা। তার এই লাখো মানুষের জীবন রক্ষাকারী গবেষণা তাকে ১৯২৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
টাইফাসের ওষুধ কিংবা এর মূল হোতা ব্যাকটেরিয়া, কোনোটিই নিকোলসের আবিষ্কার নয়। তথাপি, এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পথ সুগম করায় তার অবদান অপরিসীম। আর যে সময়টাতে এর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেই কঠিন সময়ে তার গবেষণাগুলোই লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, যা তার গবেষণাকে আরো মহিমান্বিত করেছে। তার এসকল অবদানের জন্য নোবেল ছাড়াও জিতেছেন আরো অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৩৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিকোল মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পাস্তুর ইনস্টিটিউটের সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি চিরকালই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অবদানের জন্য।