এমি নোদারের জন্ম ১৮৮২ সালের ২৩ মার্চ জার্মানির এরলাংএন শহরে। তারা বাবা ছিলেন এরলাংএন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের নামকরা অধ্যাপক। তথাপি এমির শিক্ষাজীবন মসৃণ ছিল না, ছিল না উচ্চাভিলাষী হবার সুযোগ। কারণ, তখনো জার্মানিতে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়নি। অথচ এমি তো শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বাবার মতো স্যুট-টাই পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন গণিত শেখাতে। সে স্বপ্নটা হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত যদি তিনি এমি না হয়ে অন্য কেউ হতেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতে মেধাচর্চার খুব একটা সুযোগ এমি পাননি। প্রথমত, তার মা তাকে সমকালীন সমাজের আর দশটা পরিবারে মেয়েরা যেভাবে গৃহস্থালির কাজ করতে করতে বড় বড় হয়, সেভাবেই বড় করতে পছন্দ করতেন। দ্বিতীয়ত, তার বাবাও তার পড়ালেখা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতেন না এই ভেবে যে, উচ্চশিক্ষার কোনো ভবিষ্যৎ তো নারীদের জন্য নেই। তৃতীয়ত, মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া পর্যন্তও এমির গণিতের চেয়ে অধিক ঝোঁক ছিল নাচের প্রতি। তাই বাড়িতে নিজে থেকে গণিতচর্চা যা করতেন, নাচের চর্চা করতেন তার চেয়ে বেশি।
মাধ্যমিক শেষ করে এমি এরলাংএন শহরের একটি নারী উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হন, যেটি নামে উচ্চশিক্ষা হলেও কার্যত একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। বাচ্চাদের ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি নতুন করে গণিতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই এ আকর্ষণ তার পক্ষে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। তিনি যথেষ্ট ভালো বেতনের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে এরলাংএন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ক্লাসে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন। উল্লেখ্য, তিনি কেবল ক্লাসে যোগ দিয়ে অধ্যাপকদের লেকচার নোট করে আনতে পারতেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হয়নি বিধায় কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন না!
একবছর এরলাংএন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত লেকচার শোনার পর এমি চলে গেলেন গোটিংএন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলে রাখা ভালো, গোটিংএন ছিল তৎকালীন সময়ে গণিতের জন্য ভুবনখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে পড়ালেখা করেছেন আর করিয়েছেন বার্নহার্ড রেইম্যান, ফ্রেডরিখ গস, ডেভিড হিলবার্ট, হারমান মিনকোস্কির (আইনস্টাইনের শিক্ষক) মতো গণিতবিদগণ। এখানে যখন পড়ালেখা করছিলেন, তখনই হঠাৎ পেলেন অমূল্য এক সুখবর। নিজ শহর এরলাংএনের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অনুমোদিত হয় ১৯০৪ সালে। তিনি সুখ্যাত গণিতবিদ পল গর্ডানের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দেন এরলাংএন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২৫ বছর বয়সে পিএইচডি সমাপ্ত করেন এমি নোদার। তৎক্ষণাৎ নিয়োগ পান এরলাংএন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। কিন্তু চাকরিটা খুব একটা সুখকর ছিল না তার জন্য। প্রথম ২ বছর তার চাকরি করতে হয় বিনা বেতনে! অথচ স্কুলে কিংবা নারী শিক্ষা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চাকরি করলেও তিনি অনেক টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু এমির লক্ষ্য তো উপার্জন ছিল না। গণিতের ইতিহাসের সাথে নিজের নাম লিখিয়ে নেয়াই ছিল তার আকাঙ্ক্ষা। আর সে আকাঙ্ক্ষা পূরণে পরিবার ছেড়ে, নিজ শহর ছেড়ে অচেনা শহরে গিয়ে থেকেছেন কোনোরুপ অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়াই। তার বাবা তাকে যথাসাধ্য আর্থিক সহায়তা করলেও এমির জন্য তা ছিল অপ্রতুল। কিন্তু আর্থিক টানাপোড়েনের মাঝেও তিনি নিজের জীবন নিয়ে ছিলেন ভীষণ সন্তুষ্ট। তিনি সর্বদা ভাবতেন, ব্যক্তিইচ্ছার স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কখনোই বড় হতে পারে না।
যা-ই হোক, অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করার পর নিজের প্রতিভার জানান দিতে শুরু করেন এমি। গোটিংএন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড হিলবার্টের ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেবরা’ বা বিমূর্ত বীজগণিত বিষয়ক একটি কাজকে নিজের মতো করে সম্পাদনা করে হিলবার্টের কাছে পাঠিয়ে দেন এমি। হিলবার্ট সেটি দেখে এমির মেধায় মুগ্ধ হন এবং তাকে গোটিংএনের অধ্যাপক হবার আমন্ত্রণ জানান। তবে এমির সম্মতির পূর্বেই অসম্মতি প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও কলা অনুষদ। বিশেষ করে ইতিহাস ও ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ এ প্রতিবাদের সর্বাগ্রে ছিল। তাদের দাবি ছিল, পুরষদের কোনো নারী পড়াতে পারবেন না!
এ পর্যায়ে এসে নিজের দৃঢ়তা আর আত্মপ্রত্যয়ের প্রমাণ আরো একবার প্রতিষ্ঠিত করেন এমি। তিনি জানতেন গোটিংএনে গেলেই কেবল বিমূর্ত বীজগণিত নিয়ে তার গবেষণার স্বপ্নগুলো বাস্তব হতে পারে। তাই গোটিংএনে তার নিয়োগ বিরোধী কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠিতে নিজেকে নিয়োগের জন্য অনুরোধ করেন আর সাথে উল্লেখ করেন বিস্ময় জাগানিয়া কিছু বিষয়। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দেয়ার দরকার নেই, বেতন দেবার প্রয়োজন নেই, তার যাবতীয় গবেষণা এবং লেকচারও হিলবার্টের নামে (একজন পুরুষের নামে!) প্রচার করা হোক, তবু যেন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়! অর্থের প্রতি এমির আকর্ষণ ছিল না তার প্রমাণ তো আগেই দিয়েছেন। এ পর্যায়ে এসে বিস্মিত হতে হয় এটা ভেবে যে, জ্ঞানার্জন আর নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনের জন্য কতটা আন্তরিক হলে একজন মানুষ নিজের গবেষণা ও যাবতীয় চিন্তাভাবনাও অন্যজনের নামে প্রচারের অনুমতি দিয়ে দেন!
এমির এরকম উদাত্ত অনুরোধে আর বাঁধা দিতে পারলো না গোটিংএনের রক্ষণশীল অধ্যাপক শ্রেণী। শুরু হলো এমির জীবনে নতুন এক অধ্যায়, অর্থ আর খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এবং গবেষণার প্রতি আন্তরিক এক অধ্যায়। এ সময় আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের গাণিতিক সমীকরণের দিকটার সমাধানের জন্য গোটিংএনে হিলবার্টের সাথে আলোচনা করতে এসেছিলেন আইনস্টাইন। হিলবার্ট তাকে সমাধান দিয়ে দিলেও কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ে যান। কেননা, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণের নীতি ভাঙতে চলেছিল, যার ব্যাখ্যার জন্য এমির সহায়তা চান তিনি। পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু বিষয় সংরক্ষণের নীতি মেনে চলে, শক্তি যেগুলোর মাঝে একটি। শক্তি কেবল এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপ নিতে পারে, কিন্তু মোট শক্তির পরিমাণ অপরিবর্তনীয়। অথচ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে নতুন এক সম্ভাবনা দেখা দেয়। কোনো বস্তু শক্তি হারালে তা গতি হারানোর পরিবর্তে আরো গতিশীলও হতে পারে! আর তা হতে পারে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিঃসরণের মাধ্যমে। অর্থাৎ, শক্তির সংরক্ষণের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর এ ধাঁধার সমাধানের জন্য এমির বিমূর্ত বীজগণিতে সমাধান চান হিলবার্ট।
একটি নিখুঁত গোলক যতটা প্রতিসম, একটি সিলিন্ডার কি ততটা? না, কারণ একটি গোলককে যেভাবেই ঘোরানো হোক, যে কোণেই দেখা হোক, সেটি একই রকম দেখাবে। কিন্তু একটি সিলিন্ডারকে সব দিক থেকে একই রকম দেখাবে না। পদার্থবিজ্ঞানে এ প্রতিসাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। পদার্থবিজ্ঞানের চূড়ান্ত উৎকর্ষের জন্য এমন সূত্র আর সমীকরণ প্রয়োজন যেগুলো, স্থান, কালভেদে পরিবর্তনশীল নয়। এই দৃশ্যপটে এমির আগমন পদার্থবিজ্ঞানের চেহারাই পাল্টে দিল। ১৯১৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন সেই স্মরণীয় তত্ত্ব যা ‘নোদার্স থিওরি’ নামে পরিচিত।
এমির এ তত্ত্ব বলে যে মহাবিশ্বের প্রতিটি অপরিবর্তনশীল ফাংশনের জন্য একটি করে সংরক্ষণ ফাংশন কাজ করে। এটি মহাবিশ্বের একটি মৌলিক গুণ। উদাহরণস্বরূপ, এমির তত্ত্ব মতে, শক্তির সংরক্ষণ নীতি হচ্ছে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানে সময়ের অপরিবর্তনশীলতার ফলাফল। বিপরীতক্রমে বলা চলে, শক্তির সংরক্ষণ নীতির কারণে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানে সময় অপরিবর্তনীয় থেকেছে। এমির এ তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা দূর করে দেয়। তারা বিভিন্ন বিমূর্ত প্রতিসাম্যের কথা কল্পনা করতে শুরু করেন এ বিশ্বাস থেকে যে, সেগুলোর সাথে নিশ্চিতভাবে কোনো না কোনো সংরক্ষণ নীতি জড়িত আছে। ফলে সেসব গুপ্ত পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো সহজে বেরিয়ে আসতে থাকে। এমির তত্ত্ব আরো দেখায় যে, মহাকর্ষ আর বস্তুকে যদি ভিন্ন মাত্রায় চিন্তা না করে সমন্বিত মাত্রায় দেখা হয়, তাহলে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব শক্তির সংরক্ষণ নীতির কোনোরূপ পরিবর্তন করছে না।
এদিকে ১৯১৮ সালের শেষভাগে এমির কর্মজীবনে অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমত, গোটিংএনে তার অনানুষ্ঠানিক শিক্ষকতা এবং স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন আইনস্টাইন। অন্যদিকে, বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেখা গেল যে, দেশে বিভিন্ন কর্মস্থলের অসংখ্য পদ খালি পড়ে আছে পুরুষের অভাবে। কারণ পুরুষদের একটা বড় অংশ যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ফলে, বিশ্বযুদ্ধ শেষে হঠাৎ করেই জার্মানির বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ দেখা গেল, যেসব ক্ষেত্রে একসময় নারীর নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল। ১২ বছর বিনা বেতনে, বিনা স্বীকৃতিতে, অর্থাভাবে জর্জরিত হয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পান এমি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস। যুদ্ধবিদ্ধস্ত জার্মানিতে পরবর্তী ৩ বছর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই বেতন পাননি। তিনি যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে বেতন পেতে শুরু করেছেন, ততদিনে তার বয়স হয়েছে ৪০।
পূর্ণ নিয়োগ প্রাপ্তির পর এমি নোদার আলোর বেগে ছুটতে থাকেন আর বিমূর্ত বীজগণিতের জগতে নিজেকে অন্য সকলের চেয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রতিষ্ঠা করেন। বিমূর্ত বীজগণের অসংখ্য দিক তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, নোদারিয়ান, নোদারিয়ান গ্রুপ, নোদারিয়ান ইন্ডাকশন, নোদার নর্মালাইজেশন, নোদার প্রবলেম, নোদারিয়ান রিং, নোদারিয়ান মডিউল, নোদারিয়ান স্কিম, নোদারিয়ান স্পেস, আলবার্ট-ব্রাউয়ের-হেসে-নোদার থিওরি, স্কোলেম-নোদার থিওরি ইত্যাদি।
১৯৩০ সালের মাঝে নোদারের নাম, খ্যাতি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কর্মজীবনে তিনি তখন উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে ছুটছেন। কিন্তু সমস্যা বাধালো নাৎসি জার্মানি। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে প্রথমেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ইহুদি বিতারণ শুরু করলেন, যার প্রাথমিক বলি ছিলেন এমি নোদার নিজেও। বাধ্য হয়ে তাকে গোটিংএন ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি জমাতে হয়। ক্যারিয়ারও হঠাৎ বাধাগ্রস্ত হয়। আমেরিকার ব্রিন মাওয়ার কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেও বেশিদিন তা করতে পারেননি। দেশ ছাড়ার মাত্র দু’বছরের মাথায় ১৯৩৫ সালের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এমি নোদার। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। গণিতের প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে কোনোদিন ব্যক্তিজীবনের কথা ভাবারও সময় পাননি তিনি, করেননি বিয়ে। গণিতই যে ছিল তার ভালোবাসা, প্রণয়, জীবনসঙ্গী। আর এ জীবনসঙ্গীকে সাথে নিয়ে এমি পৃথিবীর বুকে আরো কিছুকাল বিচরণ করতে পারলে কতই না লাভবান হতো বিজ্ঞান!