Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সারু: এক সিংহের ঘরে ফেরার গল্প

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। ভারতের মধ্য প্রদেশের ছোট্ট শহর খান্দোওয়ার গাণেশতালাই নামের বস্তি, সারু ব্রিয়েরলি নামের এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণ এসেছেন তার হারিয়ে যাওয়া পরিবার খুঁজতে। ছোটবেলায় বাসা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন সারু, এরপর বড় হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু ভুলতে পারেননি মায়ের কথা, তার ভাই-বোনের কথা। ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে বড় হওয়া সারু হিন্দী ভাষা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছেন। অনেক কষ্টে সেদিন বস্তিতে একজনকে পেয়েছিলেন যে ইংরেজি বোঝেন। শেষ পর্যন্ত কি খুঁজে পেয়েছিলেন তার পরিবারকে? তার আগে চলুন জেনে নেই সারুর হারিয়ে যাবার গল্প, সেই সাথে নতুন জীবন পাবার গল্প।

সারুর পরিবার বলতে মা, দুই ভাই আর এক বোন। বাবা আরেকটি বিয়ে করে সারুদের আর খোঁজ নেন না, ফলে দারিদ্রের কষাঘাতে জীবন পার করতে হতো সারুদের। পাঁচ বছর বয়স থেকেই তার দুই ভাই গুড্ডু এবং কাল্লুর সাথে রেলওয়ে স্টেশনে ভিক্ষা করে খাবার যোগাড় করতে হত সারুকে। বড় ভাই গুড্ডু অনেক সময় ট্রেনের কামরা পরিষ্কার করত, সাথে থাকত সারু। ১৯৮৬ সালের এক রাতে খান্দোওয়া থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে বুরহানপুর স্টেশনে গিয়েছিলেন সারু আর বড় ভাই গুড্ডু। গুড্ডু কাজে চলে গেলেও ছোট্ট সারু ঘুমিয়ে পড়েছিল স্টেশনেই। ঘুম থেকে উঠে সারু তার ভাইকে খুঁজে না পেয়ে এক ট্রেনে উঠে বসে, অন্যদিনের মতো ট্রেনেরই কোন কামরা পরিষ্কার করছে ভেবে। সারু নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আবার, সেই ট্রেনেই।

বুরহানপুর স্টেশন; Source: Scoopwoop

ট্রেন চলতে শুরু করলেও সারু বুঝতে পারেননি, যখন ঘুম ভাঙে অনেকদূর চলে এসেছে। ট্রেনের সেই কামরায় ছিল সারু একাই, মাত্র পাঁচ বছরের এক শিশুর জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বেশ কিছু স্টেশনে ট্রেন থামলে সারু ট্রেন থেকে নামতে পারে নি দরজা খুলতে না পারায়। অনেক চেষ্টা করেও না পেরে সারু ঘুমিয়ে পড়েছিল আবারো, প্রায় ১৪ ঘন্টা অপরিচিত পথে ভ্রমণের পর যখন ট্রেন থেকে নামে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যায় চারপাশ দেখে। সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশ, অচেনা এলাকা, এমনকি মানুষগুলোও অচেনা এক ভাষায় কথা বলছে! আর বলবেই না কেন, প্রায় দু’দিনের ভ্রমণে সারু যে পৌঁছে গিয়েছিলেন তার বাসা থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে!

হাওড়া স্টেশন; Source: Wholeplanet

বস্তিতে বড় হওয়া সারু নিজের পুরো নামটা জানত না, এমনকি এলাকার নামও ঠিকভাবে জানত না। সবচেয়ে বড় সমস্যায় সে পড়ে ভাষা নিয়ে। মাত্র পাঁচ বছরের একটি ছেলে হারিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ভাষার একটি এলাকায় এসে নিজেকে আবিষ্কার করে কলকাতার হাজার হাজার পথশিশুদের সাথে। সে খাবারের জন্য ভিক্ষা করত, ডাস্টবিনে খাবারের খোঁজ করত। একদিন রেলের এক কর্মচারী সারুকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে খাবার দেন, তার মাকে খুঁজে বের করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পাঁচ বছরের সারু কোনোভাবে বুঝতে পেরেছিল সেই কর্মচারীর কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। ফলে সে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। আবার তার স্থান হয় কলকাতার রাস্তায় কিংবা স্টেশনের প্লাটফর্মে।

অবশ্য কয়েক সপ্তাহ পরেই সারুর দুর্দিন শেষ হয়। এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পত্তি সারুকে দত্তক নেন। ছোট্ট সারু বুঝে গিয়েছিল তার পক্ষে তার পরিবারকে বের করা সম্ভব হবে না। সারুর স্থান হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন গোলার্ধে; ভিন্ন সংস্কৃতি আর ভাষার দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। নতুন দেশে বাবা জন আর মা সু-এর সাথে শুরু হয় সারুর নতুন জীবন। দত্তক বাবা-মায়ের পারিবারিক নাম ব্রিয়েরলি যোগ হয় তার নামের সাথে। জীবন পাঁচ বছর দারিদ্রতা আর কষ্টের সাথে কাটানো সারু এবার বড় হতে থাকে তাসমানিয়ার হোবার্টে, আগের চেয়ে হাজার গুণ ভাল অবস্থায়। কয়েক বছর পর সারুর দত্তক বাবা-মা আরেকজন ভারতীয় ছেলেকে দত্তক নেন, যার নাম ছিল ম্যানতোস।

অস্ট্রেলিয়ায় ছোটবেলার সারু; Source: Neima foundation

অস্ট্রেলিয়ায় বড় হলেও সারু ভুলে যাননি নিজের অতীতের কথা, ছোটবেলায় হারিয়ে যাবার কথা। হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনার করার জন্য তিনি ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল হোটেল স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু পরিবারকে খুঁজে বের করার কথা ভাবতেন সবসময়। ২০০৮ সালের দিকের কথা, সারু জানতে পারেন গুগল আর্থের কথা। অস্ট্রেলিয়ায় দত্তক বাবা-মাকে নিয়ে সুখে থাকলেও তার সত্যিকারের মায়ের কথা তাকে সবসময় খোঁচা দিত। কী অবস্থায় আছেন, বেঁচে আছেন কী না এসব ভাবতেন। গুগল আর্থ দিয়ে তিনি শুরু করেন এক অসম্ভবকে সম্ভব করার সাধনা।

ছোটবেলার খুব কম স্মৃতিই তার মনে ছিল। ভাসা ভাসা স্মৃতিকে পুঁজি করেই নেমে পড়েন লড়াইয়ে। তবে বিশাল ভারতের কোনো একটি জায়গা শুধু কিছু ভাসা ভাসা স্মৃতি থেকে খুঁজে পাওয়া আর খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজে পাওয়া একই ব্যাপার। কিন্তু সারু হাল ছেড়ে দেননি, চালিয়ে গেছেন চেষ্টা। কিছুদিন পর তিনি কিছুটা উন্নত পদ্ধতিতে খোঁজা শুরু করেন। তার মনে ছিল, তিনি প্রায় ১৪ ঘন্টার মতো ভ্রমণ করেছিলেন। ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করেন সে সময় কলকাতা থেকে কোন কোন ট্রেন ১৪ ঘন্টা বা এরকম সময়ে যাওয়া আসা করত, কেমন ছিল তাদের গতি। সব কিছু খুঁজে বের করে অংক কষে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকেন কলকাতাকে কেন্দ্র করে। আগের চেয়ে খোঁজার জায়গা ছোট হলেও ১,২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তও কম ছিল না।

গুগল আর্থে খান্দোওয়া; Source: Google earth

এভাবে খুঁজতে খুজতেই তিনি পেয়ে যান খান্দোওয়া। স্মৃতি হাতড়ে গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবির সাথে মিলিয়ে ফেলেন খান্দোওয়ার চারপাশ, খুঁজে পান গাণেশতালাই। প্রায় তিন বছর পরিশ্রমের পর তিনি খুঁজে পান তার প্রতীক্ষিত জায়গাটি, যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না এটিই সে জায়গা কী না। এরপর তিনি ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুঁজে পান খান্দোওয়া বিষয়ক। সেই গ্রুপের লোকজনের সাথে কথা বলে তার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় যে খান্দোওয়াই তার জন্মস্থান, যেখানে তিনি কাটিয়েছেন তার ছেলেবেলা।

অনেক আশা নিয়ে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারু ফেরেন ভারতে, প্রায় ২৫ বছর পর, চলে যান খান্দোওয়ায়। খান্দোওয়ায় যাবার পর তার তাকে আর স্মৃতি হাতড়ে মেলাতে হয়নি। এক সময়ের পরিচিত জায়গাগুলো চিনতে একটুও সময় নেননি তিনি। গুগল আর্থের সাহায্যে শহর খুঁজে বের করলেও তার ভয় ছিল তার মা এখনো বেঁচে আছেন কী না কিংবা বেঁচে থাকলেও সেই আগের জায়গাতেই আছেন কী না। সব সংশয় ভুলে তিনি চলে যান গাণেশতালাইতে, তার ছোটবেলার বাসাটি চিনতেও ভুল করেননি। কিন্তু বাসাটি ছিল তালা মারা আর অনেক জায়গায় ভাঙা। তবে কী মা আর এখানে থাকেন না?

সারু কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলেন না ভাষার সমস্যার কারণে। অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়ায় দ্রুতই হিন্দী ভুলে যান তিনি, ইংরেজি হয়ে যায় তার ভাষা। ফলে গাণেশতালাই এর বস্তিতে তিনি কারো সাথে কথা বলতে পারছিলেন না। তার সাথে তার ছোটবেলার একটি ছবি ছিল, যেটি দেখিয়ে তিনি সবাইকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করছিলেন, সেই ছেলেটির পরিবারকে কেউ চিনে কী না। তার ভাই-বোনদের নামও মনে ছিল, সেসব নাম দিয়েও তিনি চেষ্টা চালান। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি তাকে নিয়ে যান এক মহিলার সামনে।

প্রায় ২৫ বছর আগে যখন মাকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন তখন তার মা ছিলেন ৩৪ বছর বয়স্ক। এতোগুলো বছর পর মায়ের বয়স যে বেড়ে যাবে এটাই তার চিন্তায় আসেনি, কিন্তু মাকে চিনতে ক্ষণিকের বেশি সময় লাগেনি সারুর। বড় হয়ে যাওয়া ছেলেকে চিনতেও কষ্ট হয়নি মায়ের। হাত ধরে নিয়ে যান ছেলেকে ঘরে। ছেলে হারানোর পর থেকে তিনি এলাকা ছেড়ে কোথাও যাননি, ছেলে ফিরে আসবে এই বিশ্বাসে।

মায়ের সাথে দেখা হলেও মা ছেলের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ভাষা। মা যেমন ইংরেজি পারেন না, ছেলেও হিন্দী পারেন না। তবুও ইশারায় কিংবা ইংরেজি পারেন এমন কারো সহযোগীতায় কথা বলেন মা-ছেলে। তবে মায়ের সাথে দেখা হবার আনন্দের মাঝেই একটি খারাপ খবর পান সারু। ১৯৮৬ সালের সেই রাতে সারুর সাথে তার ভাই গুড্ডুও হারিয়ে গিয়েছিলেন। দুই ভাইকে পাগলের মতো খোঁজার প্রায় এক মাস পর পুলিশ গুড্ডুর লাশ পায়, পুলিশের ধারণা ছিল গুড্ডু ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল কিংবা কেউ তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। এতো আনন্দের মাঝেও মৃত্যু নামের আরেক বাস্তবতার সাথে পরিচয় হয় সারুর।

মায়ের সাথে সারু; Source: Pinterest

মায়ের সাথে দেখা হবার পর মাকে অস্ট্রেলিয়া নিতে যেতে চেয়েছিলেন সারু। কিন্তু সারাজীবন ভারতের এক ছোট্ট শহরে থাকা, লেখাপড়া না জানা মা অস্ট্রেলিয়া তো দূরের কথা গাণেশতালাই ছেড়েই যেতে চাননি। গাণেশতালাই এর সেই বাসায় সারু কিনে নিয়ে, মেরামত করে মাকে দিয়েছেন থাকার জন্য। প্রতি মাসে মায়ের জন্য ১০০ ডলার পাঠান, যেন মাকে আর মাঠে কাজ করতে না হয়। ২০১২ সালের পর ১৫ বার মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছেন সারু, নিয়ে এসেছিলেন তার অস্ট্রেলিয়ান মাকেও।

দুই মায়ের সাথে সারু; Source: Global citizen

ভারতে মাকে খুঁজে পাবার পরেও সারু কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় তাকে বড় করে তোলা বাবা-মাকে ভুলে যাননি। সবার যত্ন নেন তিনি, আপন বাবা মায়ের মতোই আগলে রেখেছেন। হোটেল ম্যানেজম্যান্টে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি তার। হাল ধরেছেন বাবার কোম্পানির।

সিনেমার মতো ঘটে যাওয়া এ ঘটনা নিয়ে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো ফিচার বের করে। মাকে খুঁজে পাবার এ ঘটনা নিয়ে বই লেখেন সারু, ‘A long way home’ নামের বইটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং অস্ট্রেলিয়ায় বেস্টসেলার হয়। ২০১৬ সালে তার জীবন নিয়ে হলিউডে একটি সিনেমাও হয়েছে ‘Lion’ নামে। সারুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেভ প্যাটেল এবং সারুর অস্ট্রেলিয়ান মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিকোল কিডম্যান। এই সিনেমাটি গতবছর অস্কারে সেরা সিনেমার মনোনয়ন সহ মোট ছয়টি মনোনয়ন পেয়েছিল।

‘A long way home’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Source: Penguin Books Australia

‘Lion’ সিনেমার পোস্টার; Source: IMDb

মায়ের সাথে দেখা হবার পরে সারু জানতে পারে সারা জীবন সে তার নাম ভুল উচ্চারণ করে এসেছে। তার পুরো নাম ছিল শেরু মুন্সি খান। তার নাম মোটেই সারু না, বরং শেরু, স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ সিংহ।

Feature image: KS Pradeley

Related Articles