আলেকজান্ডার আইসেভিচ সোলঝিনিৎসিন একজন রাশিয়ান ঔপন্যাসিক, ইতিহাসবিদ ও ছোট গল্প নির্মাতা। সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। তার লেখালেখির অন্যতম উপাদান ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। স্বভাবতই তার কলমে উঠে আসতো বিভিন্ন শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বর্ণনা। একটা সময় তিনি নিজেও সেই শোষণের শিকার হয়েছিলেন। শুধু কারাদন্ড নয় নিজ দেশ থেকে নির্বাসিতও হতে হয়েছিল তাকে।
১৯১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর বর্তমান স্ট্যাভ্রপল ক্রাই তথা তৎকালীন কিসলোভোদস্ক নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইশাকি সোলজাননিসিন তার জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। ইশাকি সোলজাননিসিন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের লেখাপড়া তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডাক আসলে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয় তাকে। আইসেভিচ সোলঝিনিৎসিন পিতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হিসেবে নাম লেখান। পরবর্তীতে তিনি জার্মান আর্টিলারি অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর ৬ মাস পর আমার জন্ম হয়।
আইসেভিচ সোলঝিনিৎসিনের মা তায়সিয়া জাকারোভনা, স্বামী মারা যাওয়ার পর পরিবারের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। সংসার চালানোর জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে টাইপ-রাইটার হিসেবে যোগদান করেন। আইসেভিচ সোলঝিনিৎসিন বলেন:
আমি আমার মায়ের কাছে বেড়ে উঠি। তিনি রোস্টভ শহরের ‘দ্য ডন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে টাইপ-রাইটার হিসেবে কাজ করতেন। সেখানেই আমি আমার বাল্যকাল ও যৌবনকাল অতিবাহিত করেছি। ১৯৩৬ সালে আমি গ্রামার স্কুলের পড়াশোনা শেষ করি।
ছোটবেলা থেকেই সোলঝিনিৎসিন সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার লেখা পত্রিকায় প্রকাশের জন্য চেষ্টাও করেছিলেন। যদিও সে দফায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। শৈশবের সেসব স্মৃতিচারণ করে সোলঝিনিৎসিন বলেন:
এমনকি যখন আমি শিশু, তখনই আমি সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন আমার উৎসাহদাতা বলতে কেউ ছিল না। আমার মধ্যে স্বভাবজাত লেখার আগ্রহ জন্মায়। কৈশোরে আমি পুরোদমে লেখালেখি শুরু করি। ১৯৩০ সালে আমি আমার লেখা ছাপানোর চেষ্টাও করি, কিন্তু তখন আমি এমন কাউকে পাইনি যাকে আমার পাণ্ডুলিপি দিতে পারি। আমি এসময় সাহিত্যের উপর লেখাপড়া করতে আগ্রহী হয়ে উঠি। কিন্তু রোস্টভ শহরে সাহিত্যের উপরে শিক্ষা দানের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। আমি বুঝতে পারি এখানে আমার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই আমি মস্কো শহরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি, কিন্তু তাও সম্ভব হয় না। কেননা আমার মা তখন একা ছিলেন এবং তার স্বাস্থ্যেরও বেশ অবনতি ঘটছিল।
এরপর তিনি নিরুপায় হয়ে রোস্টভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন। প্রথমে তিনি গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হলেও পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেন গণিতের পেছনে তার সারা জীবন ব্যয় করা ঠিক হবে না। তবুও তিনি সেখান থেকে সাফল্যের সহিত স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এই ডিগ্রির ফলে তিনি ছাত্রদের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শেখানোর সুযোগ পান, যা তার সাহিত্য চর্চাকালীন অর্থনৈতিক অভাব দূর করতে সহায়তা করে। এরপর ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪১ সালে যখন তার পড়ালেখা শেষ হয় তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চলছে। দেশের প্রয়োজনে তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেখানে তিনি চার বছর কর্মরত ছিলেন। প্রথমে তিনি ঘোড়ার গাড়ির চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু গণিতে দক্ষতা থকার কারণে তার দ্রুত পদন্নোতি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্যাপ্টেন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৫ সাল। রাশিয়া তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। জোসেফ স্ট্যালিন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক। সোলঝিনিৎসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তিনি শাসক জোসেফ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্যসহ বন্ধুর কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। সেই সূত্রে তাকে সোভিয়েত বিরোধী গুজব-রটনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে আটক করে প্রথমে ৮ বছর শ্রমিক ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়।
পরবর্তীতে আরও ৩ বছর তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বন্দি জীবন ও নির্বাসন শেষে তাকে মধ্য রাশিয়ার রিয়াযান নামক স্থানে পুনর্বাসিত করা হয়। এটি তার সাপে বর হিসেবে কাজে দেয়। সেখানে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কাজে লাগিয়ে একটি শিক্ষকতার চাকরি যোগাড় করে ফেলেন। পাশাপাশি সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। এরপর তার সাহিত্য সাধনায় আর কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি- সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের একজন প্রভাবশালী কথা সাহিত্যিক।
সোলঝিনিৎসিনের প্রথমদিকের উপন্যাসগুলো তার নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই রচনা করা; অর্থাৎ এসব বইয়ে তার যুদ্ধজীবন ও বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অফ ইভান দেনিসোভিচ’ এবং ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফার্স্ট সার্কেল’ গ্রন্থদ্বয় জেল জীবনের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসটি ‘নোভি মির’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ সময় উপন্যাসটি দেশ-বিদেশে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারাগারের নির্মম বর্ণনা থাকায় উপন্যাসটি দ্রুত পাঠকদের মনে সোলঝিনিৎসিনের প্রতি সহানুভূতি জোগাড় করে। এছাড়া তার অন্যান্য গ্রন্থেও বন্দি জীবনের নানা স্মৃতি ফুটে উঠেছে।
১৯৬৩ সালে ‘ম্যাটরোনাস হাউজ এন্ড আদার স্টোরিস’ নামে একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশের পর সোলঝিনিৎসিনের উপর আরেকদফা নির্যাতন নেমে আসে। তার প্রকাশনার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার আর কোনো বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।
কারাগারে থাকাকালে সোলঝিনিৎসিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেসময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও তিনি নানা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পাশাপাশি একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের জীবন যে কতটা কঠিন হয়ে পড়ে, সেসব নিয়ে ১৯৬৮ সালে ‘ক্যান্সার ওয়ার্ড’ নামে আরেকটি উপন্যাস রচনা করেন।
১৯৭০ সালে সুইডিশ একাডেমি তাকে নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত করলে নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি নোবেল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। তার ভয় ছিল যে, নোবেল পুরস্কার আনতে দেশের বাহিরে গেলে সোভিয়েত সরকার তাকে আর দেশে ফিরতে নাও দিতে পারে।
১৯৭১ সালে সোলঝিনিৎসিন‘আগস্ট ২০১৭’ নামে একটি ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস প্রকাশ করেন। উপন্যাসটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও ১৯১৪ সালে জার্মান কর্তৃক রুশ-সেক্টর বিজয়ের পটভূমি বর্ণিত হয়। পরবর্তীতে বইটিকে কয়েকদফা সংস্কার করা হয়। এমনকি নামও পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ ‘দ্য রেড হুইল’ নামে বইটি বাজারে আছে। সর্বশেষ সংস্করণে বইটিতে ‘রুশ বিপ্লব’-এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সংযুক্ত করা হয়।
১৯৭৩ সালে সোলঝিনিৎসিন ‘দ্য গুলাগ আর্কিপিলাগো’ নামের ৩ খণ্ডের একটি ধারাবাহিক গ্রন্থ প্রকাশ করা শুরু করেন। বইটি ছিল ইতিহাসভিত্তিক। সেখানে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন কিভাবে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হলো তার বিশদ বর্ণনা তুলে ধরেন। বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রকাশের সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু হয়। তাকে রাশিয়ার কলঙ্ক আখ্যা দেয়া হয়। পত্র-পত্রিকা ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে লেখা ছাপানো হয়। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। ১৯৭৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাকে উক্ত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পর দিন তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে তিনি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রথমে তিনি সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারপর ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি তার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। ‘দ্য গুলাগ আর্কিপিলাগো’ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর পরই তা সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। যদিও সেই খণ্ডটি রাশিয়ার বাহির থেকেই প্রকাশ করা হয়েছিল; কেননা সোলঝিনিৎসিনের বই-পত্র প্রকাশের বিষয়ে সোভিয়েত সরকার প্রকাশনা সংস্থাগুলোর উপর আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল। ফলে প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল প্যারিস থেকে। দেশ থেকে বহিস্কারের পর বাকী দুই খণ্ড বইও প্যারিস থেকে যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন:
আমি নোবেল কমিটিকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। বিশেষত আপনারা ও আপনাদের রাজা ১৯৭০ সালের অনুষ্ঠানে আমার জন্য নির্ধারিত চেয়ারটি শূন্য রেখে আমার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। আমি সুইডিশ একাডেমিকে আরও অভিনন্দন জানাই, নোবেল পুরুস্কারের জন্য মনোনীত করে আমাকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায়। রাশিয়ার প্রবল বিরোধিতা স্বত্বেও আপনারা এত বড় ঝুঁকি নিয়েছেন, যা কখনো ভোলার মতো ঘটনা নয়। রাশিয়ার এমন আচরণ ছিল লেখক ও পাঠক উভয়ের অধিকার হরণের নামান্তর।
জীবনের এই নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়েও তিনি বই লিখেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক তার উপরে নানাবিধ জেল-জুলুম, নির্যাতন ও নির্বাসনের দুঃসহ স্মৃতি এবং তার বিরুদ্ধে নিজের অদম্য লড়াইয়ের ইতিহাস নিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘দ্য ওয়াক এন্ড দ্য চ্যাফ’ প্রকাশ করেন। সকল বাধা অতিক্রম করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান।
১৯৯০ সালে রুশ সরকার দেশের সকল নির্বাসিত লেখকদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে তার দেশে ফেরার পথ সুগম হয়। অতপর ১৯৯৪ সালে তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তারপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাশিয়াতেই বসবাস করেন। ২০০৮ সালের ৩ আগস্ট হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে তিনি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রীয় সম্মাননা সহকারে তাকে সমাহিত করা হয়। জীবনের শত লড়াই সংগ্রামের যথার্থ মর্যাদা পেয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সুযোগ পান। এই তো সারা জীবন সাহিত্য চর্চা ও লড়াইয়ের সফলতা।
ফিচার ইমেজ- wikimedia.org