সময়টা ১৯৭৮, স্নায়ুযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। এঞ্জেলা ডরোথিয়া মার্কেল পূর্ব জার্মানির লিপজিগে অবস্থিত কার্ল মার্ক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করলেন। ইচ্ছা ছিলো গবেষক হবেন, কিন্তু পূর্ব জার্মানিতে গবেষণার সুযোগ অনেক কম। তবে মার্কেল তার মেধার জোরে বার্লিনের সেন্ট্রাল ইন্সটিউট অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে গবেষণা করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। পূর্ব জার্মানির নামিদামী গবেষকদের সাথে কাজ শুরু করলেন তিনি। কোয়ান্টাম রসায়নবিদ জোয়াকিম সয়্যারের সাথে পরিচয় হয় সেই গবেষণাগারেই। দুজনের রসায়ন গড়ায় বিয়েতে। কৃত্বিত্বের সাথে পিএইচডি শেষ করে পুরোদমে গবেষক হয়ে গেলেন দুজনেই। কিন্তু পূর্ব জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা ততদিনে খারাপ হচ্ছে। গবেষণায় বাজেট কমছে পাশাপাশি নামিদামী গবেষকদের কেউ কেউ লুকিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন আমেরিকা কিংবা ইউরোপে। অলস গবেষণাগারে বসে তখন মার্কেল চিন্তা করছিলেন রাজনীতির কথা। চিন্তা করছিলেন দেশকে কীভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। তখনকার দিনে পূর্ব জার্মানিতে যেকোনো বিষয়ে পিএইচডি পেতে হলে মার্ক্স-লেনিনের তত্ত্বের উপর দখল থাকার পাশাপাশি করতে হতো একটি কোর্সও। সেই সুবাদে রাজনীতির হাতেখড়িটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পেয়ে যান মার্কেল।
মার্কেলের রাজনীতির হাতেখড়ি
পূর্ব জার্মানির ক্ষমাতসীন জার্মানির ‘সোসালিস্ট ইউনিটি পার্টি’র যুব সংগঠন ফ্রি জার্মান ইয়ুথের সাথে যোগ দিলেন। তবে গবেষণাও পুরোদমে চলছিলো, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কোয়ান্টাম ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির মতো কাটখোট্টা সব বিষয় নিয়ে ৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি।
কিন্তু ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন ওয়ালের পতন আর দুই জার্মানির একীভূতকরণের ফলে জার্মানি যেন আগাগোড়া বদলে গেলো। দলে দলে জার্মানির পূর্ব অংশের গবেষকরা যোগ দিচ্ছেন পশ্চিম অংশের গবেষণাগার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মার্কেলের স্বামী সয়্যার বার্লিনের হামবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কিন্তু মার্কেল দুই জার্মানির এই পুর্নমিলনের সময়কেই বেছে নেন তার রাজনীতির মঞ্চ হিসেবে। যোগ দেন ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে। ১৯৯০ সালে সেই দলের হয়ে নির্বাচনে লড়েন এবং পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদদের সাথে পাল্লা দিয়ে জার্মান পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল তার মন্ত্রীসভায় খুঁজছিলেন এমন কাউকেই। দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভায় নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য পূর্ব জার্মানির কাউকেই খুঁজছিলেন তিনি। পুর্ব জার্মানির শেষ প্রধানমন্ত্রী লুথার ডি মেইজার সুপারিশ করলেন মার্কেলের নাম। সুপারিশের সময় কোহলকে তিনি বলেছিলেন,
“She didn’t seem to care about her outward appearance at all, she looked like a typical GDR scientist, wearing a baggy skirt and Jesus sandals and a cropped haircut.”
ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করে চ্যান্সেলরের সুনজরে আসেন মার্কেল। ১৯৯৪ সালে তাকে দেওয়া হয় পরিবেশ আর পারমাণবিক সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। দলে তার অবস্থান আর মতামতও জোরালো হতে থাকে।
চ্যান্সেলর কোহলের মন্ত্রীসভার সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্যকে তিনি ডাকতেন ‘mein Mädchen‘ বলে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘আমার কন্যা’।
মার্কেলের জীবনে নতুন মোড়
১৯৯৮ সালে নির্বাচনে কোহলের নেতৃত্বাধীন ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের ভরাডুবি মার্কেলের জীবনে নতুন মোড় আনে। তাকে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেলের পদ দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে নভেম্বরে কোহলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অর্থনৈতিক কেলেংকারির অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু কোহলের মতো প্রভাবশালীর নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কে? আশ্চর্যজনকভাবে সেই দায়িত্ব কাধে তুলে নিলেন এঞ্জেলা মার্কেল। নিজের রাজনৈতিক পিতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ তিনিই শুরু করেন।
হেলমুট কোহলকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ব্যর্থতার বোঝা কাধে নিয়ে তিনি ও তার সহযোগীদের অনেকেই সরে দাঁড়ান। এঞ্জেলা মার্কেল নির্বাচিত হন পার্টির প্রধান হিসেবে। এই নিয়ে হেলমুট কোহল পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“I put the snake on my arm, she put the knife in my back—and turned it twice”
জার্মানির ইতিহাসে প্রথম নারী চ্যান্সেলর
হেলমুট কোহলের মতো প্রভাবশালী নেতাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারায় ইতোমধ্যে জার্মান জনগণের মাঝে নীতিবান নেত্রী হিসেবে আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন মার্কেল। কিন্তু তখনও অনেক রাস্তা বাকি, নিজ দলের মধ্যেই শুরু হয়ে যাওয়া কোন্দল নিরসনে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০০২ সালের নির্বাচনে তিনি ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের হয়ে চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে নামলেন। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে মোকাবেলা করার জন্য প্রার্থীতা ছেড়ে দিলেন এডমন্ড স্টোবিয়ারের জন্য। নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় দলে গুরুত্ব হারালেন স্টোবিয়ার। মার্কেল হলেন বিরোধীদলীয় নেতা। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আগাম নির্বাচনের ডাক আসলো ২০০৫ সালে।
এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি মার্কেল। জার্মানির ইতিহাসে প্রথম নারী চ্যান্সেলরের উত্থান অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো পুরো বিশ্ব। ২০০৫ সালের নির্বাচনের পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
২০০৫ এর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর জার্মানিকে তিনি উপহার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। প্রতিদানস্বরূপ ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনেও জার্মান মানুষ তার পক্ষেই রায় দিয়েছে।
জার্মানির লৌহমানবী নাকি মমতাময়ী মা?
অনেকেই রাজনীতিবিদ যেন তার মধ্যে ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু ২০০৫ সালে প্রথম মেয়াদে নির্বাচনের পর থেকেই যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মার্কেল বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন, তাতে অনেকের ধারণা থ্যাচারকেও ছাড়িয়ে যাবেন মার্কেল।
তবে ইউরোপজুড়ে শরণার্থী সংকটে বিশ্ব দেখেছে এক মমতাময়ী মার্কেলকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশিরভাগ দেশ যেখানে শরণার্থী নিতে অনাগ্রহী, সেখানে নিজে শুধু শরণার্থীদের জায়গা দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন মার্কেল।
তার এই মমতাময়ী আচরণের কারণে জার্মানিতে তাকে অনেকেই ডাকে ‘Mutti’ বা ‘মমতাময়ী মা’ নামে। তবে রাজনীতিতে আর কূটনীতির ময়দানে তার অসামান্য দক্ষতা তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ রাষ্ট্রনেতাদের কাতারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জার্মানির শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ফ্রান্স, রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুসংহত করেছেন এই নেত্রী। ইউরোপজুড়ে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা আর এর ফলে তৈরী হওয়া ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কালো থাবা জার্মানের নাগরিকদের উপর পড়তেই দেননি মার্কেল। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারীদের তালিকার প্রথম স্থানটি তার দখলে টানা ছয় বছর ধরে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই নারী শুধু নারীদের মধ্যেই নয়, ফোর্বসের হিসাবানুযায়ী বিশ্বের সব ক্ষমতাধর নেতাদের মধ্যেও আছেন তিন নম্বর অবস্থানে। ২০১৫ সালে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে।
শরণার্থী ইস্যুতে বিতর্ক
বিপুল পরিমাণ শরণার্থীকে নিজ দেশ জার্মানিতে জায়গা দিতে গিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছেন মার্কেল।
২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী মার্কেলের বিরোধী শিবিরে আছে পপুলিস্ট পার্টি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)। এএফডি শুরু থেকেই অভিবাসীবিরোধী অবস্থানের কারণে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে সৃষ্ট অভিবাসন সমস্যাই কি ভোটের রাজনীতিতে মার্কেলকে পিছনে ফেলে দিবে? আর অল্প কিছুদিন পরেই এ প্রশ্নের উত্তর পেতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী।