১৭৯৬ সালের কথা। বিজ্ঞানজগতে নিজের অস্তিত্ব সে বছরই প্রথম জানান দেন জর্জ কাভিয়ের। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে দাঁড়িয়ে নিজের গবেষণাপত্র সকল জীববিজ্ঞানীর সামনে পড়ে শোনান। চমৎকার পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যাবলী দিয়ে তিনি সকলের সামনে পরিষ্কার করে দেন সাধারণ হাতি এবং ম্যামথের (বিলুপ্ত একপ্রকার অতিকায় বিশালদেহী হাতি) অস্থির মধ্যে পার্থক্য। ভারতীয় এবং আফ্রিকান হাতির সাথে ম্যামথের পার্থক্য, যখন তিনি শ্রোতাদের বোঝাতে সমর্থ হন, তখন তিনি প্রশ্ন তোলেন ম্যামথের অস্তিত্ব নিয়ে। যদি ম্যামথ বেঁচেই থাকে, তাহলে তারা কোথায়? বলতেই হয় ২১ শতকে বসে ম্যামথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলাটা খুব সহজ হলেও কাভিয়েরের সময় তা ছিল না। কেননা মানুষ তখনো ঐশ্বরিক প্রতিসাম্যে বিশ্বাস করতো। ঈশ্বর সকল প্রাণী নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের বিলুপ্তির প্রশ্নই আসে না!
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করতে কিছুদিন সময় লাগলেও, বিজ্ঞানীদের নিকট কাভিয়ের প্রমাণাদি সহ ম্যামথের বিলুপ্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই সাফল্যের পর বিজ্ঞানীমহলে তার ডাকনাম হয়ে যায় ‘দ্য ম্যামথ’! তবে কাভিয়ের কিন্তু ম্যামথেই আটকে ছিলেন না। হাতির সাথে তার সখ্যতা আরো গভীর। তিনি পরে গবেষণা করে হাতি পরিবারের আরো একটি বিলুপ্ত প্রাণী আবিষ্কার করেন, যার নামকরণ (ম্যাস্টোডন) তিনিই করেন। তবে হাতির পাশাপাশি স্লথ নিয়েও বেশ কিছুদিন গবেষণা করেন কাভিয়ের। তিনি একটি বড়সড় স্লথের অস্থি উপস্থাপন করে এর সাথে একটি বিলুপ্ত স্লথের অস্থির পার্থক্য বর্ণনা করেন। কাভিয়ের বিলুপ্ত এই প্রজাতির নাম দেন মেগাথেরিয়াম। কাভিয়েরের এই হাতি এবং স্লথ বিষয়ক গবেষণা বিজ্ঞানের দু’টি নতুন দ্বার খুলে দেয়। প্রথমত, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানবিদ্যা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাণীর বিলুপ্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন।
তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানবিদ্যার ক্ষেত্রে কাভিয়েরের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্গের পারস্পারিক সম্পর্কের নীতি। এই নীতির দ্বারাই পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিলুপ্ত প্রাণীর সামান্য প্রমাণ বা নমুনা থেকেই পুরো প্রাণীদেহ পুননির্মাণ করতে পেরেছেন। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝতে আরো সুবিধা হবে। ধরা যাক, বিজ্ঞানীরা কিছু দাঁত খুঁজে পেয়েছেন যা পরীক্ষা করে দেখা গেছে দাঁতগুলো তৃণভোজী প্রাণীর দাঁতের বৈশিষ্ট্যযুক্ত। কেবলমাত্র দাঁত থেকে বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে প্রাণীটির পরিপাকতন্ত্র সম্বন্ধেও অনুমান করে ফেলতে পারবেন। কারণ তৃণভোজী প্রাণীদের পরিপাকতন্ত্র নিশ্চয়ই কোনো মাংসাশী প্রাণীর পরিপাকতন্ত্রের মতো হবে না। নিজের এই নীতি ব্যবহার করেই কাভিয়ের ১৮০০ সালে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে একটি ফসিল শনাক্ত করেন। সেই ফসিলটিকে তিনি একটি উড়ন্ত সরীসৃপের ফসিল বলে অভিহিত করেন এবং প্রাণীটির নাম দেন ‘টেরোডাকটাইল’।
প্রাণীর বিলুপ্তি সম্বন্ধীয় গবেষণা করতে গিয়ে জর্জ কাভিয়ের ‘ক্যাটাস্ট্রোফিজম’ বা বিপর্যয়বাদকে সমর্থন দেন। ক্যাটাস্ট্রোফিজমের মূল কথা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীতে মাঝে মাঝেই হঠাৎ প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো বিপর্যয় ঘটেছে, যার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। এই তত্ত্বের প্রবক্তা তিনি না হলেও তিনি এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনকারী ছিলেন বটে। অন্যদিকে এসব যুক্তি আবার ভূতত্ত্বের জনক জেমস হাটনের ‘ইউনিফর্মিটারিয়ানিজম’ বা ‘অভিন্নতাবাদ’ এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান উভয় তত্ত্বকেই সমর্থন করছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন যে, যুগযুগান্ত ধরে পলি জমা হওয়া কিংবা ভূমিক্ষয় ইত্যাদি যেসব কারণে ভূমিরূপ পরিবর্তিত হয় কিংবা গঠিত হয়- সেগুলো সঠিক। তবে ইতিহাসের ভয়াবহ বিপর্যয়গুলো, যেমন- বড় বড় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত কিংবা উল্কাপাতও অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলেছে।
জীবাশ্মবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে প্রাণীর জাতিগত উত্তরাধিকার। উইলিয়াম স্মিথের কাজের উপর ভিত্তি করে আলেক্সান্ডার ব্রঙ্গার্ট ও জর্জ কাভিয়ের একত্রে এই নীতি আবিষ্কার করেন। তারা পাথরের স্তরসমূহের মধ্যে ফসিলের উপস্থিতির একটি ক্রম তৈরি করেন। এই ক্রম আস্থাযোগ্য এবং অনুধাবনযোগ্য। এই কথার উপর ভিত্তি করে সহজেই বলে দেয়া যায় যে, বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রাণীর ফসিল পাথরের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে। পাথরের স্তর যত গভীর হবে, ফসিলের বয়সও তত বেশি হবে। এখানে কাভিয়েরের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও এককভাবে তার সবচেয়ে পরিচিত কাজ হচ্ছে ‘লা রেগনে অ্যানিমাল’ বা ‘দ্য অ্যানিম্যাল কিংডম’। ১৮১৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে কাভিয়ের ফসিল বিষয়ক আলোচনা করেছেন এবং জীবিত ও বিলুপ্ত প্রাণী প্রজাতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তাছাড়া বইটিতে আছে কাভিয়েরের হাতে আঁকা ৩০০টির মতো চিত্র।
কাভিয়েরের সময়ে ডারউইন ও ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং বিবর্তন তত্ত্ব সবে পাখা মেলতে শুরু করেছিল। এই তত্ত্বের তৎকালীন প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যে কাভিয়ের অন্যতম। তার মতে, বিবর্তন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা প্রতিটি প্রাণীই নির্দিষ্ট গঠনে সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা অপরিবর্তনীয়। বরং প্রতিটি মহাবিপর্যয়ের সময়েই পৃথিবীতে নতুন কোনো প্রজাতি এসেছে এবং বিলুপ্ত হয়েছে পূর্বের প্রজাতিগুলো। এর পক্ষে তিনি শক্ত যুক্তিও দেখিয়েছেন। প্রাচীন মিশরের মমিতে পরিণত করা প্রাণীগুলো আজকের যুগের প্রাণীগুলোর মতোই। বিবর্তন সত্য হলে এটা ঘটতো না। কিন্তু কাভিয়েরের এই আপত্তিকে পরবর্তীতে ভালোভাবে নেয়া হয়নি। অনেকে কাভিয়েরকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেন। কেউ আবার বলেন যে ফরাসীদের আগে ব্রিটিশরা এই আবিষ্কার করেছে বিধায় কাভিয়ের তা হজম করতে পারেননি! তবে মানবজাতির ক্ষেত্রে কাভিয়েরে সুর কিছুটা হলেও ডারউইনিজমের প্রতি নরম ছিল। তার মতে বিভিন্ন মহাবিপর্যয়ের পর বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো নির্জনে বসবাস করতে শুরু করে। আর এই বিচ্ছিন্নতাই তিনটি শ্রেণী তৈরি করে। সবচেয়ে উন্নত শ্রেণী ককেসিয়ান, তারপর মঙ্গোলিয়ান এবং সবশেষ ইথিওপিয়ান। এই তত্ত্ব আদতে ডারউইনের “গ্যালাপাগোস দ্বীপে বিচ্ছিন্ন প্রাণীরা বিবর্তনের সূচনা করে” কথাটির সমার্থক।
জর্জ কাভিয়েরের কিছু বৈজ্ঞানিক ভুলের প্রধান কারণ হয়ে আছে তার অত্যাধিক আত্মবিশ্বাস। ১৮১২ সালে তিনি দাবি করেছিলেন যে পৃথিবীতে সকল অতিকায় প্রাণীর ফসিল আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। তার এই দাবিটি ছিল ভুল। কেননা ১৮১২ এর পরও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অজস্র বৃহদাকার প্রাণী আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৭ সালের ‘আর্জেন্টিনোসরাস’ একটি উদাহরণ হতে পারে, যা একটি বিশালাকায় ডাইনোসরের প্রজাতি। মজার ব্যাপার হচ্ছে আর্জেন্টিনোসরাসের ব্যাপারে নিশ্চিত হবার মতো খুব বেশি নমুনা পাওয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক জীবাশ্মবিদগণ কাভিয়েরের নীতি ব্যবহার করেই আর্জেন্টিনোসরার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। অর্থাৎ কাভিয়েরের এক তত্ত্ব দ্বারা তার অপর তত্ত্বকে খণ্ডন করা হয়েছে! আরো একটি মজার তথ্য হচ্ছে, জর্জ কাভিয়েরের সাথে নেপোলিয়নের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ঠিক যে বছর বন্ধুর পরাজয় হলো, সে বছরই তার তত্ত্বও ভুল হলো!
জর্জ লিওপোল্ড নিকোলাস ফ্রেডরিখ কাভিয়ের, সংক্ষেপে জর্জ কাভিয়ের। ১৭৬৯ সালের ২৩ আগস্ট উর্টেম্বার্গ রাজ্যের মন্তেবেলিয়ার্ড শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শহরটি বর্তমানে ফ্রান্সের অন্তর্গত। বাবা জিন কাভিয়ের এবং মা ক্লেম্যান্স, উভয়েই ছিলেন লুথেরান চার্চের সদস্য। অন্যদিকে জিন ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট। ফলে জন্মগতভাবে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছেলেকে নিজের মতো শক্ত সমর্থ করতে উদ্যোগী হন জিন। কাভিয়েরের ৫ বছর পর্যন্ত তার পড়ালেখার চেয়ে শারীরিক সক্ষমতার উপরই বেশি জোর দেয়া হয়। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলে কাভিয়ের ল্যাটিন এবং গ্রীক পড়ালেখা করেন। অন্যদিকে গণিত, ভূগোল এবং ইতিহাসে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন।
১০ বছর বয়স থেকে কাভিয়ের এতটাই বই পাগল হয়ে ওঠেন যে তার মা তাকে পড়া থেকে উঠিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতেন খেলাধুলা করার জন্য! এ সময় তিনি ইতিহাসের প্রতি সবচেয়ে বেশি আসক্ত ছিলেন। তবে একবার তার চাচার বাসায় ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ নামক একটি বই পড়ে তিনি প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। এখান থেকেই তার মনে প্রাণপ্রকৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মায়। আর এই আগ্রহ থেকে প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতে ১৪ বছর বয়সে কাভিয়ের চলে আসেন জার্মানিতে। জার্মানির স্টুগার্ট শহরে ক্যারোলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শুরু করেন তার উচ্চশিক্ষা। তবে প্রাণপ্রকৃতি পড়ালেখার জন্য ফ্রান্সেও ভালো প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু কাভিয়েরের চাচা চেয়েছিলেন তিনি যেন জার্মানিতেই পড়ালেখা করেন। কেননা তখনকার সময়ে বিজ্ঞানচর্চায় জার্মানি ফ্রান্সের চেয়ে অনেকটাই অগ্রসর ছিল।
পড়ালেখা শেষ করে কাভিয়ের নিজ শহরে ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন। ১৮০৩ সালে তিনি অ্যানি ম্যারি সোফি নাম্নী একজন বিধবা নারীকে বিয়ে করেন। সোফির প্রাক্তন সংসারে এক ছেলে এবং মেয়ে ছিল। কাভিয়েরের সাথে বিয়ের পর সোফির গর্ভে আরো চার সন্তানের জন্ম হয়, যদিও তিনজনই শৈশবে মারা গিয়েছিল। কাভিয়ের তার সন্তানদের মধ্যে একটিমাত্র মেয়ে ক্লেমেন্টিনাকে হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং মেয়েকেই করেছিলেন নিজের সহকারী গবেষক। ১৮২৫ সালে তিনি ২১ বছর বয়সী ক্লেমেন্টিনার সাথে গবেষণা শুরু করেন। ১৮২৭ সালে মেয়ের জন্য মনে মনে পাত্র ঠিক করেন এবং সুবিধামতো মেয়েকে জানাবার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন কাভিয়েরের সন্তানদের জন্য বিশেষভাবে লেখা ছিল। বিয়ের পরিকল্পনা জানার আগেই টিউবারকুলোসিসে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন ক্লেমেন্টিনা।
মেয়ের মৃত্যুতে কাভিয়েরের পৃথিবীটা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। শোক ভুলতে দ্রুতই কাজে ফিরে গিয়েছিলেন যদিও, কিছুদিনের মধ্যে সব ধরনের গবেষণা থেকে হাত গুটিয়ে নেন তিনি। চলে যান প্যারিসে এবং সেখানেই নিভৃতে শেষ জীবনটা পার করে দেন। ১৮৩২ সালের ১৩ মে, ৬২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কাভিয়ের। তার সময়ে তার কাজ জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছুতে না পারলেও পরবর্তীকালে তিনি জীবাশ্মবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত হন। জীবাশ্মবিজ্ঞান এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনেক উন্নত হয়েছে এবং আরো হবে ভবিষ্যতে, কিন্তু চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে কাভিয়েরের নিকট।
ফিচার ছবি- shiftjournal.com