সারমাদ শহীদ: মোগল ভারতের এক রহস্যপুরুষ

বেপরোয়া বলে কুখ্যাতি ছিল। মানতেন না স্বয়ং সম্রাটকেও। একদিন কোথাও যাচ্ছিলেন সম্রাট। যথারীতি তিনিও বসে ছিলেন পথের পাশে। তাকে দেখে সওয়ারি থেকে নেমে এগিয়ে এলেন সম্রাট। কাপড় দিয়ে ঢাকতে বললেন শরীর। কিন্তু নিতান্ত উপেক্ষায় জবাব এলো, “প্রয়োজন মনে হলে তুমিই ঢেকে দাও, পাশেই রাখা আছে কম্বল”।

কম্বলটা টান দিতেই হতভম্ব সম্রাট। কেটে রাখা অনেকগুলো তাজা মাথা। তারই ভাই, ভাইপো এবং আত্মীয়দের; যাদের তিনি নিজেই হত্যা করেছিলেন পূর্বে। বেপরোয়া লোকটি মুখ খুললেন আরেকবারের জন্য, “এবার তাহলে বলো কী ঢাকবো? আমার শরীর নাকি তোমার পাপ?”

আওরঙ্গজেবকে ক্ষমতায় আসতে হাত রক্তাক্ত করতে হয়েছে; Image Source: wikipedia/ painted by Bichitr

আলোচিত সম্রাট মোগল শাসক আওরঙ্গজেব এবং বেপরোয়া রহস্যময় ব্যক্তিটি সারমাদ শহীদ। হয়তো গল্পটা অনেকটাই অতিরঞ্জিত, কিন্তু যুগ যুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত আখ্যানতে উত্থাপিত হয়েছে দুজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সপ্তদশ শতকের মোগল ভারত। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নতুন জোয়ার চলছে চারদিকে। বারানসির গঙ্গাপাড় থেকে দিল্লি পর্যন্ত হচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক। প্রাচীন ভারতীয় ন্যায়জৈন দর্শনের সাথে মুসলিম সুফি ইবনুল আরাবির ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ মতবাদের তুলনা আলোচনা তখন তুঙ্গে। চলছে দার্শনিক ইবনে রুশদ্ থেকে সুফি জালালুদ্দিন রুমিকে নিয়ে ব্যাখ্যা। নব্য প্লেটোবাদীবাদীদের তত্ত্বও বাদ যায়নি।

ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই আধুনিকতা যেন পৌঁছে গেছে ভারতের মাটিতে। আর তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সম্রাট আকবরের প্রপৌত্র দারা শিকোহ। কিন্তু পরিণাম তার ভালো হয়নি। নিজের অধিকার দিল্লির মসনদ থেকে কেবল বঞ্চিতই করা হলো না, নিশ্চিৎ করা হলো মৃত্যু। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাই হয়তো পরিণাম ভালো হলো না দারা শিকোহর অন্যতম প্রিয় ব্যক্তি সারমাদের জন্যও। আওরঙ্গজেব তাকে শিরোচ্ছেদে মৃত্যুদণ্ড দেন। অথচ যে সকল অপরাধের জন্য তাকে দণ্ড ভোগ করতে হলো; তা থেকে তিনি মুক্ত। ক্ষমতার কাণ্ড দেখে কেবল হেসেছেন তিনি। আর কথাগুলো হয়ে উঠেছে কবিতা- 
‘যুম বা দরে মারেফাত গাদায়ে না কুনান’, বা পরম সত্যের দরজা ভিন্ন আমি কারো কাছে ভিক্ষা চাই না।

দারা শিকোহের সাথে তার  মিত্রতা পরবর্তীতে ডেকে এনেছে ভয়াবহ পরিণাম; Image Source: ranasafvi.com

সারমাদের জন্ম ১৫৯০ সালে আর্মেনিয়ার ইহুদি পরিবারে। ইহুদি এবং খ্রিষ্টীয় শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন অল্প বয়সেই। বাদ থাকেনি পারসিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতেও। পরবর্তীতে গ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক মোল্লা সাদরার কাছ থেকে করেন শিক্ষা লাভ। তুলনামূলক ধর্মের আলোচনায় বিশেষ অনুরাগ ছিল তার। মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতে, তাঁর আরবি আর ফারসি ভাষার দখল ছিল ‘দরজায়ে কামেল’ বা সহজ কথায় বিস্ময়কর। তার নিজের জবানে-

সারমাদ! তু হাদিসে কাবা ও দ্যায়ের মা কুন
দর ওয়াদিয়ে শক চু গুমরাহোঁ স্যায়ের মা কুন
হাঁ শেওয়ায়ে বন্দগি যে শ্যায়তান আমুয
য়াক কিবলা গুযি, সিজদায়ে বর গ্যায়ের মা কুন’।

ও সারমাদ, কাবা আর মন্দিরের গল্প বলো না আর,
সন্দেহের অন্ধ গলিতে ঘুরে মরো না আর,
শিখতে হয় তো শয়তানের কাছ থেকে শিখে নাও বন্দেগী,
সিজদা করতে হয় শুধু একজনকেই, অন্য আর কারো সামনে না। 
                                                    (সারমাদ শহীদের রুবাইয়্যাত, পৃষ্ঠা- ৭৪)

১৬৩১ সালে থাট্টায় আগমন করেন সারমাদ শহীদ। ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা শুনে আট দশজনের মতোই আসাটা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই। মোগল ভারতের প্রশাসনিক ভাষা তখন ফারসি এবং পারসিক পণ্যের বাজারও ছিলো বেশ চড়া। বর্তমান করাচির কাছাকাছি শহরটি ছিল তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান বন্দর।

ঐতিহাসিকরা প্রায়ই দাবি করেন, ভারতে প্রবেশ করার অনেক পথ আছে, কিন্তু বের হবার কোনো পথ নেই। সারমাদের জন্য কথাটা আরো বেশি করে সত্য। এখানকার জ্ঞানতাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক এবং ধর্মালোচনা তাকে মুগ্ধ করে দারুণভাবে। তাই যাই যাই করেও ফিরে যাওয়া আর হয়ে উঠলো না। কোনো এক কবিতার জলসায় পরিচয় হয় হিন্দু বালক অভয় চাঁদের সাথে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে সম্পর্ক। অভয় চাঁদ তার কাছে থেকে ইহুদি ধর্মের পাশাপাশি হিব্রু ও ফারসি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। প্রথমবারের মতো তাওরাত অনুবাদ করেন ফারসি ভাষায়।

তিনি ছিলেন বিশিষ্ট্য মুসলিম দার্শনিক মোল্লা সাদরার শিষ্য; tabletmag.com/ walters art musium

এই সময় থেকেই প্রায়শ তিনি একরকম বিবসন হয়ে থাকা শুরু করেন। বড় করতে থাকেন চুল এবং নখ। এজন্য অবশ্য কেউ কেউ সারমাদকে মালামাতিয়া সুফি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করতে চান; যারা নিজেদের গুণাবলিকে গোপন করে লোকসমাজে নিজেকে পরিত্যক্ত হিসাবে উপস্থাপন করেন।

সেই যা-ই হোক, অভয় চাঁদকে নিয়ে সারমাদ বসবাস করতেন লাহোরে। তার রহস্যজনক আচরণ নানা রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে সমাজে। ১৬৪৪ সালে হায়দ্রাবাদে ফিরে আসতে হয়। ততদিনে দাক্ষিণাত্যে সারমাদের অনুসারী দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগ্মীতার কারণে। অধিকাংশই ছিল সরকারি উঁচু পর্যায়ের। সারমাদ অভয় চাঁদকে সাথে নিয়ে মুবিদ শাহকে দাবিস্তান লেখায় সহযোগিতা করলেন। গ্রন্থটি পরবর্তীতে প্রামাণ্য বলে উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয়। এদিকে কবি ও আধ্যাত্মবাদী হিসাবে সারমাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। জন্ম নিল অজস্র শত্রুও। তার লেখাতেই বোঝা যায়,

কতো শত বন্ধু ক্ষণে ক্ষণে পরিণত হলো শত্রুতে,
সেই পরমের অনুরাগ বাঁচিয়ে রেখেছে আমার হৃদয়।
বহুকে দূরে রেখে আমি এককে করেছি আলিঙ্গন,
অবশেষে আমি হয়েছি সে, আর সে হয়েছে আমি।
                                                  (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৬)

হায়দ্রাবাদ থেকে দিল্লি যাবার পথে আগ্রাতে বিরতি দিলেন। সেবারেই বন্ধুত্ব হলো মোগল দরবারের সুফি শেখ খাজা সৈয়দ আবদুল কাসিম শাবজুরির সাথে। এদিকে শাহজাদা দারা শিকোহ ছিলেন অতীন্দ্রিয়বাদ ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরাগী। ধর্মের পাশাপাশি দর্শনের প্রতিও তার আগ্রহ ছিলো তীব্র। পিতা সম্রাট শাহজাহানের কাছে আবদার করেন সারমাদের আধ্যাত্মিকতা পরীক্ষার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করা হলো সারমাদকে। প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তরে শাহজাহান সন্তুষ্ট হলেও নগ্নতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুললেন শেষমেশ। এবার সারমাদের জবাব ছিলো কবিতায়-

‘অলৌকিককে স্বীকার করেও প্রশ্ন তুলছো নগ্ন কেনো,
যা কিছু দৃশ্যমান আছে, তাদের মধ্যে সত্য নেই;
সত্য থাকে খুব গোপনে স্বচ্ছ মনের তলায় জেনো,
ভালোবাসা খুব যত্নে উঠছে বেড়ে সেই বুকেই’।

সারমাদকে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। শাহজাদা দারা শিকোহ সেই থেকেই তার শিষ্য বনে গেলেন। গুরুর নির্দেশনায় মোগল দরবারকে পরিণত করলেন আন্তঃধর্মীয় আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রে। সামনে আসতো প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও ধর্ম, পারসিক চিন্তাধারা, গ্রিক অধিবিদ্যা আর সেই সাথে মুসলিম দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ। যেমনটা পিতামহ আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) সময়ে হয়েছে। মুসলিম শায়খদের পাশাপাশি উপস্থিত হতেন হিন্দু পণ্ডিতগণ। নানা বিশ্বাস ও অঞ্চলের জ্ঞানীরাও আমন্ত্রিত হতে থাকেন। বিষয়টা শাহজাদা আওরঙ্গজেব ঠিক ভালোভাবে নেননি। তাছাড়া উত্তরাধিকার প্রশ্ন তো ছিলোই। এজন্য দারার পাশাপাশি সারমাদও পরিণত হন চক্ষুশূলে।

ধর্ম ও দর্শনে দারা শিকোহর দখল ছিল বিস্ময়কর; ©   Murar/ prints.bl.uk

শাহজাহান দুর্বল হয়ে পড়লে সাম্রাজ্যের ভার বিভক্ত হলো। সুজা ও মুরাদ বাংলায়, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে এবং দারা শিকোহ দিল্লিতে থাকলেন। ক্রমে উত্তরাধিকারের জন্য দারা শিকোহর সমর্থক ও আওরঙ্গজেবের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়লো। বলা ভালো, দারার সমর্থকেরা ছিল শিখ, শিয়া, সুফি এবং সুন্নিসহ প্রায় সব মতের। আওরঙ্গজেব পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন কেবল গোঁড়া সুন্নিপন্থীদের। দিনশেষে জয়ী হলেন আওরঙ্গজেব। আর তাই দারা শিকোহ সমর্থকদের উপর নেমে এলো খড়গ। স্বয়ং দারাকেই হত্যা করা হলো ১৬৫৯ সালে।

নতুন সম্রাটের বিচারক মোল্লা কাওয়ি সামনে আনলেন সারমাদের মামলা। আসলে সারমাদ দারা শিকোহর কাছের মানুষ, এটাই ছিল তার বড় অপরাধ। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য একটা অজুহাত দরকার। রাজনীতিতে ধর্মকে জড়ানোর চিরকালীন প্রথা আরো একবারের জন্য প্রয়োগ করা হলো। প্রথমেই একটা রুবাইয়্যাত দেখিয়ে দাবি করা হলো সারমাদ নবী মুহম্মদ (সা.) এর মি’রাজকে অস্বীকার করেছে। রুবাইয়্যাতটি নিম্নরূপ- 

‘পরম সত্যের রহস্য যে জানে,
সে বিশাল আকাশ থেকেও বিশালতর হয়ে যায়;
মোল্লা বলে মুহম্মদ জান্নাতে আরোহণ করেছিলেন,
সারমাদ বলে জান্নাত নেমে এসেছিল মুহম্মদের সামনে’।  

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতে, তিনি যে স্তরে পৌঁছেছিলেন, মোল্লাদের প্রলাপ সেখানে পৌঁছায় না। (সারমাদ শহীদের রুবাইয়্যাত, পৃষ্ঠা- ৩৬)

সকল অভিযোগের জবাবে কেবল হেসেছিলেন সারমাদ; © sadeqeen/ zoya-thewayofasufi.blogspot.com

সে যা-ই হোক, সারমাদের উপর পরবর্তী অভিযোগ এলো নগ্নতা নিয়ে। মোল্লা কাওয়ি আসলেন কারণ জানতে, ‘তোমার তো এতো জ্ঞান, তবে নগ্ন থাকো কেন’? সারমাদ জবাব দিলেন, কী করি, শয়তান আমার উপর কাওয়ি (আসীন; শাব্দিকভাবে কাওয়ি অর্থ আসীন হওয়া) হয়েছে। তারপর শোনালেন একটা রুবাইয়্যাত-

আমার দীর্ঘাঙ্গি প্রিয় তুচ্ছ করে রেখেছে আমায়,
মদিরায় ছলছল চোখ তার, হুশ কেড়েছে আমার;
নিজের আলিঙ্গনে রেখে নিজেই খুঁজে ফিরি তারে,
এ যে আশ্চর্য তস্কর, কেড়ে নিল বসন আমার।

শুনে কাজি রেগে গেলেও আওরঙ্গজেব আরেকটু শক্ত করতে চাইলেন অভিযোগ। কয়েকজন বৃদ্ধ ডেকে তাদের সামনে হাজির করা হলো সারমাদকে। সম্রাট প্রশ্ন করলেন প্রথমে- ‘লোকে বলে দারা সম্রাট হবে বলে সারমাদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কথাটা কি সত্য’? জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়ে হয়েছে। দারা শিকোহ এখন অনন্তের সম্রাট’

এরপর এলো নতুন অভিযোগ। সারমাদকে কালেমা পাঠ করতে বলা হলো। কারণ বহুল প্রচলিত ছিল সে ‘লা ইলাহা’ বা ‘উপাস্য নেই’ এর বেশি পড়ে না। দেখা গেলো ঘটনা সত্য। উলামারা সারমাদকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সারমাদ সহজ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘আমি এখনো ‘না’ এর স্তরে আছি; হ্যাঁ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। ‘আল্লাহ ছাড়া’ যোগ করতে গেলে তা মিথ্যা বলা হবে। যা ভেতর থেকে আসে না, তা কেমন করে বলি’?

দিল্লির জামা মসজিদে সারমাদের সমাধি প্রায়শ থাকে পূণ্যার্থীর পদচারণা, © engr maqbool/ myishasmehfil.com

উলেমাদের চোখে সারমাদের এই কথা সুস্পষ্ট কুফরি। হয় তওবা করতে হবে, নয়তো মৃত্যুদণ্ড। সারমাদ তওবা করতে অস্বীকার করলেন। ওলেমারাও ফতোয়া দিতে বিলম্ব করলো না। ঠিক পরের দিন তাকে নেয়া হলো বধ্যভূমিতে। সময়টা ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দ। আওরঙ্গজেবের রাজগদিতে বসার তিন বছর পূর্ণ হয়নি তখনো। আসাদুল্লাহ নামের এক দরবেশ সারমাদের ভক্ত ছিলেন। অবস্থার জটিলতা বুঝতে পেরে কাছে গিয়ে বললেন, ‘লোকেরা আপনার সাথে এমন ব্যবহার করছে। আপনি একটু অভ্যাস বদলালেই তো হয়।’ সারমাদ আবৃত্তি করলেন জবাবে,

উম্র য়েস্ত কে আওযাহ মনসর কেহেন শুদ,
মন আয সরে নও জলওয়া দেহেম দার রসন রা;

অর্থাৎ বহুদিন কেটে গেছে মনসুরের আনাল হকের পর,
এবার আমি এলাম বদ্ধভূমিতে লাবণ্য দিতে।

মানসুর হাল্লাজ ছিলেন মুসলিম সুফিবাদের অন্যতম বিখ্যাত চরিত্র। ‘আনাল হক্ব’ বা ‘আমিই সত্য’ দাবি করার জন্য তাকে ‍মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে অনেক সুফি এমনকি ধর্মতাত্ত্বিকেরাও মানসুরকে স্বীকার করেছে সুফিবাদের শহীদ হিসাবে।

হাল্লাজকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়; পরে সুফি বলে স্বীকৃতি পান সর্বমহলে; © Mir abdullah/ the walters art museum 

যাহোক, সারমাদকে টেনে নেয়া হলো বাজারের মধ্য দিয়ে। রায় দেখার জন্য দলে দলে মানুষ এসেছিল। দর্শকের এই কোলাহল তাকে সামান্যও বিচলিত করেনি। বরং উচ্চারণ করলেন-

বা যর্ম ইশক ত আম মিকশান্দ ও গোগায়েস্ত,
ত মিম্বরে বর সরে বাম আ- কে খশ তামাশায়েস্ত।

অর্থাৎ তোমার প্রেমিক হবার অপরাধে বাজারে টেনে আনা হলো আমায়,
কী কোলাহল! ওগো, চৌকাঠে এসে দাঁড়াও, দেখো কী অপূর্ব উৎসব!

সারমাদ আল্লাহর প্রেমে এমন গভীরভাবে অভিন্ন হয়েছিলেন যে তিনি মাত্র একবারই মাথা তুলে চেয়েছিলেন- এমনটাই দাবি করেছেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। যখন ঘাতক ঝকঝকে তলোয়ার হাতে সামনে এগিয়ে এলো, ঘাতকের চোখে চেয়ে ঈষৎ হাসলেন তিনি। হয়তো কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন –

ফিদায়ে তু সাহাবিম,
বায়াঁ বায়াঁ, কে তা হার সুরতে মে আয়ি,
মান তারা খুব মি শানাসাম।

অর্থাৎ আহা! তোমার জন্য মরণে কী সুখ!
এসো! এসো! যে সাজেই সাজো তুমি
আমি তোমাকে চিনি।

সারমাদের শিরচ্ছেদ করা হয় দিল্লির জামা মসজিদের কাছে। কিংবদন্তি আছে, তার কর্তিত মুখ থেকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারিত হয়। তাকে সমাধিস্থ করা হয় সে জায়গাতেই। সমাধিটা এখন তীর্থ ভূমি হিসাবে পরিগণিত। ধনী দরিদ্র সবাই আসে সূরা ফাতিহা ঠোটে ধরে। সারমাদ বোধ হয় আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এই কথা। হয়তো এজন্যই বলা হয়েছিল-

ঊ সরে তরবাত হাফিয চ গুজরে হিম্মত খোয়াহ,
কে যেয়ারত গাহে রিন্দা জাহা খোয়াহাদ বুদ

অর্থাৎ আমার সমাধি পাশে সম্ভ্রম মনে এসো, জেনে রেখো
প্রেমের আঘাতে দীর্ণ সবার জন্য এই সমাধি হবে উপসনালয়।

সারমাদ শহীদ। মুসলিম সুফিচিন্তায় অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলে স্বীকৃত হন পরবর্তীকালে। স্বীকার করা হয় মানসুরে সানী বা দ্বিতীয় মানসুর হাল্লাজ হিসাবে। তার কবিতা আলোচিত হয় রুমি, হাফিজ, গালিব এবং ইকবালের মজলিসে। শুধু দারা শিকোহ না, সারমাদ শহীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যকে এমন এক উচ্চতায় আসীন করলেন, যার ঠিক পরেই ছিল অপ্রতিরোধ্য পতন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি:

১) সারমাদ শহীদের রুবাইয়াত

This Bengali article is about Sarmad Shaheed; the Muslim mystic and sufi during the era of Aurangzeb and the master of Shahzada Dara Shikoh.

References

1) সারমাদ শহীদের রুবাইয়াত: মওলানা আবুল কালাম আজাদ-এর ভূমিকাসহ, জাভেদ হুসেন, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি- ২০১৩, ঢাকা

2) The Rubaiyat of Sarmad, Translated by Syeda Sayidain Hameed, Indian Council for Cultural Relations, New Delhi, 1993

3) Sarmad Kashani

4) Shaheed Sarmad – Mansur e Sani

Featured Image: myishasmehfil.com, Head of Sarmad in front of Aurangzeb,

Related Articles

Exit mobile version