প্রাচীন পৃথিবীর যে ক’জন ব্যক্তি সম্পর্কে না জানলেই নয় তাদের মধ্যে অ্যারিস্টটল সম্ভবত সবার উপরেই থাকবেন। তাকে আপনি একটি শব্দে তো নয়ই, একটি বিশ্বকোষ লিখেও বর্ণনা করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন, ছিলেন দার্শনিক, এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হিসেবে অ্যারিস্টটলের চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কে-ইবা হতে পারে? এসব পরিচয় ছাড়াও তার আরো একটি পরিচয় আছে। তিনি দ্বিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর শিক্ষক ছিলেন, আবার বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর ছাত্র ছিলেন। বই লিখে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তার লেখার বিষয়ের মধ্যে ছিল পদার্থবিজ্ঞান, অধিবিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনীতি, ভাষা, সঙ্গীত, থিয়েটার, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, রসায়ন, জোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে তিনিই ছিলেন তার সময়ের শেষ ব্যক্তি যিনি জ্ঞানের সকল পরিচিত শাখায় দক্ষ ছিলেন! জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় তার বিস্ময়কর অবদান তাকে করেছে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্বে। নিজের সময়ের চেয়ে তিনি কতটা অগ্রসর ছিলেন তা বোঝাতে তাকে কেবল আইনস্টাইন আর আর্কিমিডিস এর সাথেই তুলনা করা যেতে পারে।
প্রাথমিক জীবন
আনুমানিক ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসের উত্তরাঞ্চলে সমুদ্র উপকূলবর্তী স্টাগিরা নামক এক উপনিবেশে জন্মগ্রহণ করেন অ্যারিস্টটল। বাবা নিকোম্যাকাস ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা ২য় অ্যামিন্টাস-এর গৃহ-চিকিৎসক। তার মা ফায়েস্তিসও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। রাজদরবারে কাজের সুবাদে অ্যারিস্টটলের বাবার আয় ছিল খুব ভাল। ফলে অ্যারিস্টটলের শৈশব কাটে বেশ স্বাচ্ছন্দে। তবে কৈশোরে পা রাখতেই বাবাকে হারান তিনি। কয়েক বছর পর মাকেও হারিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যান কিশোর অ্যারিস্টটল। তবে রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় কখনো অর্থাভাবের মুখ দেখেননি তিনি। তাছাড়া তার দুলাভাই তথা বড় বোনের স্বামী প্রোক্সেনাস তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে।
প্লেটোর শিক্ষার্থী অ্যারিস্টটল
অ্যারিস্টটলের যখন ১৭ বছর পূর্ণ হয় তখন প্রোক্সেনাস তাকে এথেন্সে পাঠান উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য। তখন এথেন্সকে বলা হতো পৃথিবীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেন্দ্র। আর অ্যারিস্টটলের জন্মের বছর প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘প্লেটোর একাডেমি’ ততদিনে প্রসিদ্ধ। প্লেটোর স্কুলে কোনো বেতন বা শিক্ষা বিষয়ক খরচ ছিল না। তবে প্লেটো তার শিক্ষার্থীদের নিজে বেছে নিতেন। মেধাবী অ্যারিস্টটল সহজেই প্লেটোর একাডেমিতে সুযোগ পেয়ে যান। সেখানে তিনি ২০ বছর কাটান এবং বিজ্ঞান ও দর্শনের উপর পড়াশোনা করেন।
প্লেটোর সাথে অ্যারিস্টটলের সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল, যদিও অ্যারিস্টটল তার গুরুর সকল তত্ত্বের সাথে একমত ছিলেন না। প্লেটোর মৃত্যুর পর মাইসিয়ার রাজা এবং অ্যারিস্টটলের বন্ধু হারমিয়াস অ্যারিস্টটলকে তার রাজসভায় সভাসদ হবার আমন্ত্রণ জানান। অ্যারিস্টটল সানন্দে রাজি হন এবং মাইসিয়ার রাজদরবারে প্রায় ৩ বছর কাটান। এ সময় তিনি হারমিয়াস এর ভাইয়ের কন্যা পিথিয়াসকে বিয়ে করেন।
আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসেবে অ্যারিস্টটল
৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যারিস্টটল তার স্বদেশ মেসিডোনিয়ায় ফিরে যান এবং রাজা ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। আলেকজান্ডারের বয়স তখন ১৩ বছর মাত্র। খুব দ্রুতই তিনি আলেকজান্ডারের নিকট খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন এবং রাজা ফিলিপের নিকট হয়ে ওঠেন অত্যন্ত সম্মানীয় এক ব্যক্তি। তিনি আলেকজান্ডারকে চিকিৎসা, নৈতিকতা এবং অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। মজার ব্যাপার হলো, আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে ততদিনে বিখ্যাত বনে যাওয়া অ্যারিস্টটল রাজা ফিলিপের নিকট তিনটি শর্ত পেশ করেন।
- মেসিডোনিয়া জয় করার সময় ফিলিপের সৈন্যরা স্টাগিরা শহরে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে
- স্টাগিরার নির্বাসিত জনগণকে নিজ শহরে ফেরার সুযোগ দিতে হবে
- স্টাগিরার যে সকল মানুষকে বন্দী এবং দাস করে রাখা হয়েছে তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে
শিক্ষক হিসেবে অ্যারিস্টটলের প্রভাব এতোটাই বেশি ছিলো যে ফিলিপ কোনো আপত্তি ছাড়াই শর্তগুলো মেনে নেন!
তিন বছর পরই রাজা ফিলিপের মৃত্যু হলে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মেসিডোনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন আলেকজান্ডার। রাজা হবার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এথেন্স জয় করেন এবং সেখানে অ্যারিস্টটলকে নিজের স্কুল খোলার অনুমতি দেন। অ্যারিস্টটল সেখানে ‘লাইসিয়াম’ নামের একটি স্কুল পরিচালনা শুরু করেন এবং আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেখানেই শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এথেন্সের কোর্ট তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহীতা এবং আলেকজান্ডারের সাথে সংযুক্ত থাকার অভিযোগ আনে। প্রাণে বাঁচতে তিনি ইউবোয়া দ্বীপে পালিয়ে যান এবং পরের বছর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
রসায়ন এবং আলকেমিতে অ্যারিস্টটলের অবদান
অ্যারিস্টটলের রসায়ন বিষয়ক গবেষণা শুরু হয় আরেক প্রাচীন রসায়নবিদ এম্পেডোক্লিস এর তত্ত্ব থেকে। এম্পেডোক্লিস মনে করতেন পৃথিবীর সকল বস্তু তৈরি হয়েছে চারটি মৌলিক উপাদান মাটি, পানি, বায়ু এবং আগুন থেকে। এই উপাদানগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণেই তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন বস্তু। এ তত্ত্বে অ্যারিস্টটল সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি এ চারটি মূল উপাদানের সাথে আরো একটি উপাদান যোগ করেন। তিনি সেই উপাদানটির নাম দেন ‘ফার্স্ট এলিমেন্ট’ বা ‘প্রথম উপাদান’, যা পরে কুইন্টেসেন্স নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন চারটি পার্থিব উপাদান সমান্তরালে চলে। কিন্তু প্রথম উপাদানটি, যা কিনা বিশুদ্ধ ও নিখুঁত, বৃত্তাকারে চলে। এ উপাদানটি কখনোই বাকি উপাদানগুলোর সাথে মেশেনি এবং চাঁদ, সূর্য, গ্রহগুলোতে এ উপাদান থাকায় সেগুলো বৃত্তাকারে চলে! অ্যারিস্টটলের এই তত্ত্বের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে তা হাজার বছর যাবত রসায়ন শাস্ত্রের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। তার এই তত্ত্বে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসী ছিলেন প্রাথমিক যুগের আলকেমিস্টরা। তারা বিশ্বাস করতেন যে, যদি তারা প্রথম উপাদানের প্রকৃতি শনাক্ত করতে পারেন, তাহলে তা দিয়ে মানুষের রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এমনকি মানুষকে চিরজীবী করাও সম্ভব!
জীববিজ্ঞান
জীববিজ্ঞানী হিসেবে অ্যারিস্টটল ছিলেন অধিক নির্ভুল। রসায়নের তুলনায় জীববিজ্ঞানে তার অবদানও অনেক বেশি। তার লেখা কিছু জীববিজ্ঞানের বই এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। তিনি জীবের শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন এবং বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রাণীকে বিভিন্ন গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি ১১টি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন এবং প্রতিটি গ্রুপের নাম দেন জেনাস। তিনিই প্রথম জীববিজ্ঞানী যিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে ডলফিন তার নবজাতককে দুধ পান করায়। তিনি ঘোষণা দেন ডলফিন কোনো মাছ নয়। তিনিই প্রথম প্রাণীদের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেনীবিন্যাস করেন যা ক্যারোলাস লিনিয়াসও করেন। পুরো জীবনে তিনি প্রায় ৬০০ প্রাজাতি শনাক্ত করেন।
ভূতত্ত্ব
বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ লায়েল অ্যারিস্টটলের পৃথিবীর ভূতল নিয়ে গবেষণায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অ্যারিস্টটল দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে পৃথিবীর পৃষ্ঠতল কখনোই অপরিবর্তনীয় ছিল না। কারণ নদী শীতকালে শুকিয়ে যায়, আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে একটি দ্বীপ তৈরি হয়ে যায়, বিস্তৃত সমতল ভূমি কখনো বা পানিতে প্লাবিত হয়, আবার কখনো যে স্থান পানির নীচে ছিল তা চর আকারে জেগে ওঠে। তার মতে এসব পরিবর্তন অনেক ধীরে ধীরে ঘটতো বলে মানুষ সহজে পর্যবেক্ষণ করতে পারতো না। কেননা মানুষের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত।
জোতির্বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান
অ্যারিস্টটল পদ্ধতিগতভাবে বিজ্ঞানী ছিলেন না বলা চলে। কেননা তিনি পরীক্ষণ বা পরিমাপ না করে কেবল পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাই তার পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা একরকম দর্শনই ছিল বলা চলে। ফলে অধিকাংশই ছিল ভুলে ভরপুর। তার তত্ত্বের প্রভাব ছিল অপরিসীম, যা সুদীর্ঘকাল বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাকে পিছিয়ে দেয়। চলুন দেখা যাক তার পদার্থবিজ্ঞান এবং জোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু ভুল।
- তিনি বিশ্বাস করতেন সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তার এই বিশ্বাস কোপারনিকাস আর গ্যালিলিওর আগপর্যন্ত বিজ্ঞানীদেরকে অন্ধ করে রাখে।
- তিনি বলেছিলেন স্বর্গের (মহাকাশের) সবকিছুই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
- অ্যারিস্টটল মনে করতেন স্বর্গ (চাঁদকে নির্দেশ করে) একেবারে নিখুঁত। পরে গ্যালিলিও চাঁদের কলঙ্ক আবিষ্কার করলে অ্যারিস্টটলপন্থীরা তার শত্রু বনে যান।
- অ্যারিস্টটল সাধারণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলেছিলেন যে ভারী বস্তু হালকা বস্তুর চেয়ে দ্রুততর সময়ে মাটিতে পতিত হয় যা গ্যালিলিও ভুল প্রমাণ করেন।
অ্যারিস্টটলের অনেক ভুলই পরবর্তীতে সংশোধিত হয়েছিল কিন্তু মানুষ সেগুলোকে বর্জন করে। তার মৃত্যুর মাত্র ১০০ বছর পরই অ্যারিস্টার্কাস বলেন যে সূর্য নয় বরং পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলোই সূর্যের পাশে ঘুরছে। তবে অ্যারিস্টটলের ব্যাপক প্রভাবের কাছে বৈজ্ঞানিক এই সত্যটি হার মানতে বাধ্য হয় এবং দীর্ঘ দু’হাজার বছর তার তত্ত্বই মানুষের মনে বদ্ধমূল ছিল।
দর্শন
অ্যারিস্টটলের দর্শনের মূল বিষয় ছিল পদ্ধতিগতভাবে যুক্তি প্রদান। তিনি আলোচনা করতেন কিভাবে ব্যবকলন এবং অনুমানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তার এই ব্যবকলনীয় তত্ত্বকে আধুনিক দার্শনিকগণ নাম দিয়েছেন ‘সিলোগিজম’। এছাড়া তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তি প্রতিষ্ঠায়ও অ্যারিস্টটল গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দর্শন শাস্ত্রের উপর রচিত তার দুটি বই হলো ‘নিকোম্যাসিয়ান এথিকস’ এবং ‘প্রায়র অ্যানালিটিকস’।
বিখ্যাত লেখাসমূহ
অ্যারিস্টটল প্রায় ২০০-এর মতো নোট/গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার ছাত্র থিওফ্রাস্টাস তার মৃত্যুর পর কাজগুলো সংরক্ষণ করেন এবং তার ছাত্র নিলিয়াস সেগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অ্যারিস্টটলের সেই ২০০ কাজের মধ্যে এখন মাত্র ৩১টিই টিকে আছে, যার অধিকাংশই হাতে লেখা। যুক্তিতর্কের উপর তার লেখা ক্যাটাগরিস, অন ইন্টারপ্রিটেশন, প্রায়র অ্যানালিটিকস ও পোস্টেরিয়র অ্যানালিটিকস উল্লেখযোগ্য।
বস্তুর ধরন ও গঠন নিয়ে তিনি ‘মেটাফিজিক্স’ নামে একটি বই লেখেন। তাছাড়া মানুষের আচরণ ও বিচার বিশ্লেষণ নিয়ে তার দুটি বিখ্যাত কাজ হচ্ছে ‘নিকোমেসিয়ান এথিকস’ এবং ‘ইউডেমিয়ান এথিকস’। ‘অন দ্য হেভেনস’, ‘অন দ্য সোল’ এবং ‘রেটরিক’ হচ্ছে তার আরো কিছু বিখ্যাত কাজ। মনোবিজ্ঞান নিয়েও রয়েছে তার কিছু জ্ঞানগর্ভ লেখা।