মার্শাল গিওর্গি ঝুকভ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক || পর্ব ৭

(পর্ব ৬ এর পর থেকে)

স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ: বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্যনির্ধারণী লড়াইয়ে ঝুকভ

১৯৪২ সালের ১৭ জুলাই চির নদীর তীরে জার্মান ৬ষ্ঠ আর্মির অগ্রবর্তী ইউনিটগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত ৬২তম ও ৬৪তম আর্মির সংঘর্ষ হয় এবং এটিকে বিবেচনা করা হয় দুনিয়া কাঁপানো স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের প্রথম সংঘর্ষ হিসেবে। কয়েক দিনের মধ্যেই বিপুল সংখ্যক জার্মান সৈন্য দক্ষিণ দন অঞ্চল অতিক্রম করে ক্ষিপ্রগতিতে স্তালিনগ্রাদ ও ককেশাসের দিকে ধাবমান হয়। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ জার্মান সৈন্যরা রোস্তভ দখল করে নেয়। রোস্তভকে ককেশাসের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এই শহরটি দখলের ফলে দন নদী ও ট্রান্সককেশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যবর্তী উর্বর কুবান অঞ্চলের রাস্তা জার্মানদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালের নভেম্বরে জার্মানরা রোস্তভ দখল করে নিয়েছিল, কিন্তু এর কয়েক দিন পরেই সোভিয়েতরা শহরটি পুনর্দখল করে নেয়। সোভিয়েতরা রোস্তভ পুনর্দখলের ঘটনাকে ব্যাপকভাবে উদযাপন করেছিল, কারণ রোস্তভ ছিল জার্মানদের কাছ থেকে সোভিয়েতদের পুনর্দখল করা প্রথম বড় শহর। এই কারণে পুনরায় জার্মানদের নিকট রোস্তভের পতন ছিল সোভিয়েতদের জন্য বিরাট এক মনস্তাত্ত্বিক আঘাত।

স্তালিনগ্রাদের কাছেই লাল ফৌজ জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণ চালায়, কিন্তু তাদের এই আক্রমণ ব্যর্থ হয় এবং ২৩ আগস্টের মধ্যে জার্মানরা স্তালিনগ্রাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। তারা শহরটি অবরোধ করে এবং শহরটির ওপরে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে, যার ফলে অন্তত ২৫,০০০ বেসামরিক সোভিয়েত নাগরিক নিহত হয়। ২৫ আগস্ট স্তালিনগ্রাদ শহর কর্তৃপক্ষ শহরে সামরিক আইন জারি করে।

এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত নেতা স্তালিন লাল ফৌজের পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার জেনারেল গিওর্গি ঝুকভকে রঝেভ–ভিয়াজমা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মস্কোয় ডেকে পাঠান। ইতিপূর্বে খালখিন গোল, ইয়েলনিয়া ও মস্কোর লড়াইয়ে ঝুকভের অর্জিত সাফল্যের কারণে স্তালিন ঝুকভের ওপর আস্থাশীল ছিলেন এবং স্তালিনগ্রাদের ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধে ঝুকভকে সংযুক্ত করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এজন্য ঝুকভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ও লাল ফৌজের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ নিযুক্ত করা হয় এবং আগস্টের শেষদিকে স্তাভকার (লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফ) প্রতিনিধি হিসেবে স্তালিনগ্রাদে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ঝুকভের মূল দায়িত্ব ছিল যুধ্যমান স্তালিনগ্রাদ ফ্রন্ট ও দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি স্তালিনকে অবহিত করা।

স্তালিনগ্রাদ দখলের জন্য জার্মান সৈন্যদের ভোলগা নদীর পশ্চিম তীর দখল করা আবশ্যক ছিল, কারণ কেবল এর মধ্য দিয়েই নদীটির পূর্ব তীর থেকে লাল ফৌজের জন্য অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদপত্র যাতে স্তালিনগ্রাদে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা যেত। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিল জেনারেল ফ্রিডরিখ পাউলুসের নেতৃত্বাধীন জার্মান ৬ষ্ঠ আর্মি এবং জেনারেল ভাসিলি চুইকভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ৬২তম আর্মি। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ ছিল খুবই তীব্র ও প্রলম্বিত। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানরা শহরটি প্রায় ৯০% অংশ দখল করে নেয়, কিন্তু ভোলগা নদীর পশ্চিম তীরে ১৬ মাইল বিস্তৃত একটি অঞ্চল থেকে সোভিয়েত সৈন্যদের অপসারণ করতে জার্মানরা ব্যর্থ হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জার্মানরা ঐ অংশটুকু দখল করতে না পারছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত লাল ফৌজের প্রতিআক্রমণের আশঙ্কা দূরীভূত হচ্ছিল না।

মানচিত্রে ১৯৪২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্তালিনগ্রাদে জার্মান সৈন্যদের অগ্রগতি; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ৬২তম আর্মির ৭৫% সৈন্য হতাহত হয়, কিন্তু তারা জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে এবং স্তালিনগ্রাদের প্রতি ইঞ্চি ভূমির জন্য লড়াই করে। স্তালিনগ্রাদের প্রান্তে সোভিয়েত ৬৩তম, ৬৪তম ও ৬৬তম আর্মি জার্মানদের শহরটিতে অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। স্তালিনগ্রাদের আকাশে কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য জার্মান ও সোভিয়েত বিমানবাহিনী এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তদুপরি, ভোলগা নদীর পূর্ব তীর থেকে সোভিয়েত আর্টিলারি জার্মানদের ওপর ব্যাপক হারে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে।

অপারেশন ইউরেনাস এবং অপারেশন মার্স: ঝুকভের সাফল্য এবং ব্যর্থতা

অবশ্য স্তাভকার দৃষ্টিকোণ থেকে স্তালিনগ্রাদে লাল ফৌজের অবস্থান ধরে রাখা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জার্মানরা দক্ষিণ সোভিয়েত ইউনিয়নে যে আক্রমণাভিযান (অপারেশন ব্লাউ) চালিয়েছে, সেটিকে প্রতিহত করা। এই উদ্দেশ্যে স্তাভকা ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জার্মানদের বিরুদ্ধে একটি নতুন বিস্তৃত অভিযান পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে শুরু করে। ৪ অক্টোবর ঝুকভ ফ্রন্ট কমান্ডারদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন এবং সেখানে তাদেরকে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। এই বৈঠকের পর দন, স্তালিনগ্রাদ ও দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডাররা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রণীত প্রস্তাবনাগুলো ঝুকভ ও স্তাভকার প্রধান জেনারেল আলেক্সান্দর ভাসিলেভস্কির কাছে পেশ করেন।

এই পরিকল্পনাটির সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ইউরেনাস’ এবং এটি পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণে ঝুকভের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। একই সময়ে ঝুকভ রঝেভ–ভিয়াজমা অঞ্চলে জার্মানদের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় মাত্রার আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এটির সাঙ্কেতিক নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন মার্স’। এই অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল উক্ত অঞ্চলে অবস্থানরত জার্মান ৯ম আর্মিকে ধ্বংস করে দেয়া। স্তালিন, ঝুকভ ও ভাসিলেভস্কির মূল পরিকল্পনার মাত্রা ছিল আরো বৃহৎ। তাদের লক্ষ্য ছিল, অপারেশন ইউরেনাস সফল হলে লাল ফৌজ জার্মান আর্মি গ্রুপ সাউথের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন স্যাটার্ন’ পরিচালনা করবে এবং রোস্তভ দখল করে ককেশাসে জার্মান আর্মি গ্রুপ এ-কে ধ্বংস করে ফেলবে। অন্যদিকে, অপারেশন মার্স সফল হলে লাল ফৌজ জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টারের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন জুপিটার’ পরিচালনা করবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।

কিন্তু তাদের মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি সফল হয়নি। বস্তুত স্তালিন, ঝুকভ ও ভাসিলেভস্কি চাচ্ছিলেন ১৯৪২ সালের মধ্যেই জার্মানদের পরাজিত করে এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে। কিন্তু লাল ফৌজের তখনো এত বড় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সামর্থ্য ছিল না। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে প্রায় একই সময়ে লাল ফৌজ অপারেশন মার্স ও ইউরেনাস শুরু করে। কিন্তু ডিসেম্বর নাগাদ অপারেশন মার্স ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এই অভিযানে সোভিয়েতরা প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ সৈন্য হারায়। এর ফলে ‘অপারেশন জুপিটার’ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু অপারেশন মার্স ব্যর্থ হলেও এটি ঐ রণাঙ্গনে জার্মানদের মনোযোগ দিতে বাধ্য করে এবং এর ফলে জার্মানরা স্তালিনগ্রাদে তাদের পূর্ণ শক্তি মোতায়েন করতে পারেনি। তদুপরি, অপারেশন মার্সে জার্মানদেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং এজন্য ১৯৪৩ সালে তারা নিজেরাই ঐ অঞ্চল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

মানচিত্রে ১৯৪২ সালের নভেম্বরে স্তালিনগ্রাদে অক্ষবাহিনীর ও সোভিয়েত ইউনিটগুলোর অবস্থান; Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে, ১৯ নভেম্বর লাল ফৌজের অপারেশন ইউরেনাস শুরু হয়। সোভিয়েতরা অত্যন্ত গোপনে এই অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল এবং বেশকিছু ‘মাস্কিরোভকা’ বাস্তবায়ন করেছিল। উল্লেখ্য, মাস্কিরোভকা ছিল সোভিয়েতদের রণকৌশলের একটি বিশেষ উপাদান, যেটির মাধ্যমে তারা শত্রুপক্ষকে ধোঁকা দিত এবং ভুয়া তথ্য সরবরাহ করত। এর ফলে অপারেশন ইউরেনাস শুরু হলে জার্মানরা সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে পড়ে। ২৩ নভেম্বরের মধ্যে তারা স্তালিনগ্রাদে অবস্থানরত জার্মান ৬ষ্ঠ আর্মিকে ঘিরে ফেলে। সোভিয়েত আক্রমণের ফলে জার্মান সৈন্যরা এবং ৬ষ্ঠ আর্মির পার্শ্বরক্ষী ইতালীয়, রুমানীয় ও হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

জার্মানরা আকাশপথে অবরুদ্ধ ৬ষ্ঠ আর্মিকে রসদপত্র সরবরাহ করতে থাকে। তারা ৬ষ্ঠ আর্মিকে উদ্ধারের জন্য একটি আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে, কিন্তু স্তালিনগ্রাদের বাইরে সোভিয়েতরা তাদের গতিরোধ করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, স্তাকভার পরিকল্পনা ছিল, স্তালিনগ্রাদে তারা প্রায় ১ লক্ষ জার্মান সৈন্যকে ঘেরাও করবে, কিন্তু কার্যত সেখানে তারা এরচেয়ে কয়েক গুণ বেশি জার্মান সৈন্যকে ঘেরাও করে ফেলে। যখন সোভিয়েতরা বুঝতে পারে যে, তারা বিরাট এক জার্মান সৈন্যদলকে ঘেরাও করতে পেরেছে, তখন তারা তাদের ঘেরাও আরো জোরদার করে। ১৯৪৩ সালের ১০ জানুয়ারি জেনারেল কনস্তান্তিন রোকোসোভস্কির নেতৃত্বে লাল ফৌজের ৭টি আর্মি জার্মানদের আক্রমণ করে। জানুয়ারির শেষদিকে জার্মান ৬ষ্ঠ আর্মি সোভিয়েতদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েতরা প্রায় ২৫ লক্ষ সৈন্য হারায়, কিন্তু তাদের অর্জিত বিজয় ছিল এক বিরাট বিজয়। এই যুদ্ধে অক্ষশক্তি প্রায় ১৫ লক্ষ সৈন্য হারায় এবং প্রথমবারের মতো কোনো জার্মান আর্মি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে। তখন পর্যন্ত এটি ছিল নাৎসি জার্মানির সবচেয়ে বড় পরাজয়। স্তালিনগ্রাদে সোভিয়েতদের কঠোর প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। উল্লেখ্য, স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে ঝুকভ সেখানে ছিলেন না। স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল চুইকভ এবং অপারেশন ইউরেনাস পরিচালনায় মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল রোকোসোভস্কি। কিন্তু অপারেশন ইউরেনাসের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রস্তুতি গ্রহণে ঝুকভের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এজন্য স্তালিনগ্রাদে সোভিয়েতদের বিরাট বিজয়ে ঝুকভের যে বিশেষ অবদান ছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৯৪২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঝুকভের সামরিক জীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তিনি অপরাজিত ছিলেন না। অপারেশন বার্বারোসার প্রারম্ভে সোভিয়েতদের বিরাট বিপর্যয়ের জন্য তদানীন্তন জেনারেল স্টাফের প্রধান হিসেবে ঝুকভ আংশিকভাবে দায়ী ছিলেন। একইভাবে, ঝুকভ কর্তৃক ১৯৪২ সালে পরিচালিত রঝেভ–ভিয়াজমা অপারেশনদ্বয় এবং অপারেশন মার্স ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু অন্যদিকে, ১৯৩৯ সালের খালখিন গোল যুদ্ধে, ১৯৪১ সালে ইয়েলনিয়া, লেনিনগ্রাদ ও মস্কোর লড়াইয়ে এবং ১৯৪২ সালে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। 

স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পর জার্মান ৬ষ্ঠ আর্মির অধিনায়ক জেনারেল ফ্রিডরিখ পাউলুসকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; Source: Wikimedia Commons

এজন্য বেশ কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি স্তালিনের আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হন। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ঝুকভের ছবি ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘স্তালিন্স ল্যুবিমেৎস’ বা ‘স্তালিনের প্রিয়’। বস্তুত এসময় ঝুকভ ক্রমশ স্তালিনের শীর্ষ সমরনায়কে পরিণত হচ্ছিলেন।

অপারেশন ইস্ক্রা: লেনিনগ্রাদে ঝুকভের বিজয় এবং মার্শাল পদ লাভ

১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে লাল ফৌজ যখন দক্ষিণ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনগ্রাদে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, তখন ঝুকভকে উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদে প্রেরণ করা হয়। ১৯৪১ সালে তার নেতৃত্বে লাল ফৌজ লেনিনগ্রাদকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। ১৯৪৩ সালে তাকে আবার লেনিনগ্রাদে প্রেরণ করা হয়। তখনো জার্মানরা লেনিনগ্রাদ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এবার ঝুকভের দায়িত্ব ছিল লাল ফৌজের ভলখভ ও লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টদ্বয় কর্তৃক লেনিনগ্রাদকে অবরোধমুক্ত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত অভিযান তত্ত্বাবধান করা। অভিযানটির সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ইস্ক্রা’।

ঝুকভের তত্ত্বাবধানে ১২ জানুয়ারি এই অভিযান শুরু হয় এবং ১৮ জানুয়ারি নাগাদ সোভিয়েতরা লেনিনগ্রাদের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হয়। অবশ্য লেনিনগ্রাদের সঙ্গে স্থাপিত এই স্থল সংযোগপথটি ছিল অল্প কয়েক মাইল প্রশস্ত এবং জার্মানরা এটির ওপর নিয়মিত গোলাবর্ষণ করত। এজন্য অপারেশন ইস্ক্রায় জার্মানদের লেনিনগ্রাদ অবরোধ ভেঙে যায় নি, বরং তাতে কেবল ফাটল ধরেছিল। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত কেবল লাদোগা হ্রদের ওপর দিয়ে একটি অতি বিপজ্জনক পথে সোভিয়েতরা লেনিনগ্রাদে রসদপত্র সরবরাহ করতে পারত। এই অভিযানের ফলে লেনিনগ্রাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্টাংশের স্থল সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে শহরের অধিবাসীদের রসদপত্র সরবরাহ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে ওঠে।

মানচিত্রে ‘অপারেশন ইস্ক্রা’; Source: Wikimedia Commons

এই অভিযানে সাফল্য অর্জনের ফলে সোভিয়েত সরকার ১৯৪৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ঝুকভকে ‘মার্শাল অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদমর্যাদায় ভূষিত করে। সরকারি সংবাদপত্র ‘ইজভেস্তিয়া’য় ঝুকভকে একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ও সাহসী নেতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যিনি মস্কো, লেনিনগ্রাদ ও স্তালিনগ্রাদে জার্মানদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছেন। ২৮ জানুয়ারি স্তালিনগ্রাদে জার্মানবিরোধী প্রতিআক্রমণ পরিচালনায় তার অবদানের জন্য তাকে ‘অর্ডার অফ সুভোরভ, ১ম শ্রেণি’ প্রদান করা হয়।

অপারেশন পোলার স্টার: ঝুকভের ব্যর্থ মহাপরিকল্পনা

জানুয়ারির শেষদিকে ঝুকভ মস্কোয় ফিরে আসেন এবং সেখানে জার্মানদের বিরুদ্ধে নতুন একটি পরিকল্পনা প্রণয়নে মনোনিবেশ করেন। এই পরিকল্পনাটির সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন পোলার স্টার’। এই বৃহৎ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল লাল ফৌজের ভলখভ, লেনিনগ্রাদ ও উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টত্রয় কর্তৃক লেনিনগ্রাদ অঞ্চলে অবস্থানরত জার্মান আর্মি গ্রুপ নর্থকে ঘিরে ফেলা। এই অভিযানের তত্ত্বাবধানের জন্য ঝুকভ পুনরায় লেনিনগ্রাদে যান। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এই অভিযান আরম্ভ হয়।

এই অভিযানে সাফল্য অর্জনের মূল শর্ত ছিল দেমিয়ানস্ক অঞ্চলে অবস্থানরত জার্মান ১৬তম আর্মিকে ধ্বংস করে দেয়া। লাল ফৌজের ১ম শক আর্মিকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু অপারেশন পোলার স্টার শুরুর প্রাক্কালে জার্মানরা দেমিয়ানস্ক থেকে পশ্চাৎপসরণ করে এবং লোভাৎ নদীর তীরে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক স্থানে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ঝুকভ ২৮ ফেব্রুয়ারি স্তালিনকে জানান যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপারেশন পোলার স্টারের পরিধি স্তারায়া রুসা অঞ্চল দখলের মধ্যেই সীমিত রাখা উচিত এবং বসন্তকালে নতুন একটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে তাদের আগেকার উদ্দেশ্য (আর্মি গ্রুপ নর্থকে ধ্বংস করা) বাস্তবায়ন করা উচিত।

স্তালিন ঝুকভের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহ ধরে সোভিয়েত সৈন্যরা স্তারায়া রুসা পুনর্দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর মধ্য দিয়ে অপারেশন পোলার স্টার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এই অভিযানে সোভিয়েতরা প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্য হারায়। এর ফলে অপারেশন পোলার স্টার ঝুকভের জন্য একটি বড় পরাজয় হিসেবে দেখা দেয়। মার্চের মাঝামাঝি স্তালিন ঝুকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠান।

ভরোনেঝ ফ্রন্টে ঝুকভ: স্তালিনগ্রাদ–পরবর্তী জার্মান রণপরিকল্পনা শনাক্তকরণ

ঝুকভ মস্কোয় পৌঁছানোর পর তাকে ভরোনেঝ ফ্রন্টে প্রেরণ করা হয়। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মানদের কাছ থেকে খারকভ শহর পুনর্দখল করেছিল, কিন্তু জার্মানরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পুনরায় খারকভ দখল করে নেয়। এই পরিস্থিতির তদন্ত করার জন্যই ঝুকভকে ভরোনেঝ ফ্রন্টে প্রেরণ করা হয়েছিল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ঝুকভ ৮ এপ্রিল স্তালিনের কাছে একটি লম্বা বার্তা প্রেরণ করেন। এই বার্তায় তিনি মন্তব্য করেন যে, জার্মানদের আর দক্ষিণ সোভিয়েত ইউনিয়নে তাদের আক্রমণাভিযান পুনরায় শুরু করা কিংবা অন্য কোনো বড় মাত্রার অভিযান পরিচালনার সামর্থ্য নেই। বরং তারা এখন যে অঞ্চলে তাদের সৈন্য মজুদ রয়েছে এবং যেখানে আক্রমণ চালালে তাদের মস্কো দখলের উদ্দেশ্য সফল হবে, এরকম কোনো জায়গায় আক্রমণ চালাবে।

মানচিত্রে ‘অপারেশন পোলার স্টার’; Source: Wikimedia Commons

প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঝুকভ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, জার্মানরা কুরস্কের দিকে আক্রমণ চালাবে এবং এই আক্রমণের জন্য তারা আড়াই হাজারের মতো ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে পারে। ঝুকভ পরামর্শ দেন, সোভিয়েতদের উচিত তাদের ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং যত বেশি সম্ভব যুদ্ধবিমান এতদঞ্চলে মোতায়েন করা। তিনি আরো মন্তব্য করেন, সোভিয়েতদের নিজে থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা উচিত হবে না। বরং তাদের উচিত প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানদের শক্তিক্ষয় করা এবং এরপর পাল্টা আক্রমণ চালানো। পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে প্রমাণ হয় যে, ঝুকভের হিসেব ছিল সম্পূর্ণভাবে সঠিক।

উল্লেখ্য, ১৯৪৩ সালের এপ্রিল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয় শরৎকাল। রুশ ভাষায় এই সময়কে বলা হয় ‘রাস্পুতিৎসা’ বা ‘খারাপ রাস্তার ঋতু’। কারণ, এই সময়ে একদিকে শীতকালীন বরফ গলতে শুরু করে, অন্যদিকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে রাস্তাগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এজন্য এই সময়ে লাল ফৌজকে তাদের অগ্রাভিযান স্থগিত রাখতে হয় এবং প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকাল শুরু হলে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয় এবং রাস্তাগুলো শুকিয়ে ব্যবহারোপযোগী হয়ে যায়। সুতরাং গ্রীষ্মকাল শুরু হলে লাল ফৌজ কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেটি নিয়ে স্তাভকা চিন্তিত ছিল।

ঝুকভ ৮ এপ্রিলেই কৌশলগত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ এবং জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনার কৌশল অবলম্বনের জন্য স্তালিনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঝুকভের প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্তালিন এই ব্যাপারে লাল ফৌজের ফ্রন্ট কমান্ডারদের মতামত যাচাই করেন। ফ্রন্ট কমান্ডাররা সকলেই ঝুকভের বিশ্লেষণকে সমর্থন করেন এবং কুরস্ক অঞ্চলে জার্মানরা আক্রমণ চালাবে বলে মন্তব্য করেন। কুরস্ক ছিল লাল ফৌজের কেন্দ্রীয় ও ভরোনেঝ ফ্রন্টদ্বয়ের সংযোগস্থলের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং জার্মানরা এই অঞ্চলটি অধিকার করতে পারলে তাদের প্রতিরক্ষা রেখা ১৫০ থেকে ২০০ মাইল হ্রাস পেত ও তাদের অন্তত ২০ ডিভিশন সৈন্য সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্য মুক্ত হতো। তদুপরি, স্তালিনগ্রাদের বিপর্যয়ের পর এরকম একটি বিজয় জার্মান সৈন্য ও জনসাধারণের মনোবল বৃদ্ধি করতে পারত।

এমতাবস্থায় ১৯৪৩ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি স্তালিন, ঝুকভ, ভাসিলেভস্কি ও স্তাভকার চিফ অফ অপারেশন্স (পরবর্তীতে স্তাভকার উপপ্রধান) জেনারেল আনাতোলি আন্তোনভের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, জার্মানরা নতুন করে কোনো আক্রমণ শুরু করার আগপর্যন্ত লাল ফৌজ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকবে। বস্তুত স্তালিন, ঝুকভ, ভাসিলেভস্কি ও আন্তোনভ ছিলেন সেই চারজন ব্যক্তিত্ব যাদের নেতৃত্বে ১৯৪৩–৪৪ সালে লাল ফৌজ পশ্চিম দিকে তাদের সফল অগ্রাভিযান পরিচালনা করে।

তামান উপদ্বীপে ঝুকভ: ব্যর্থতার বিনিময়ে পদোন্নতি?

এপ্রিলের আলোচনার পর ঝুকভকে নতুন একটি দায়িত্ব দিয়ে উত্তর ককেশাস অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। ঝুকভের দায়িত্ব ছিল তামান উপদ্বীপের কাছ থেকে জার্মান ১৭তম আর্মিকে অপসারণের জন্য পরিচালিত একটি অভিযান তত্ত্বাবধান করা। উল্লেখ্য, তামান উপদ্বীপের মাধ্যমে ক্রিমিয়া উত্তর ককেশাসের উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত। অপারেশন ইউরেনাস চলাকালে সোভিয়েতরা ট্রান্সককেশিয়া থেকে জার্মানদের বিতাড়িত করেছিল, কিন্তু জার্মানরা তামানে তাদের অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এর ফলে তারা ক্রিমিয়ায় তাদের অবস্থানকে নিরাপদ রাখতে এবং পশ্চাদ্ভাগ থেকে সোভিয়েতদের ওপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম ছিল। এজন্য তামান পুনর্দখল করা সোভিয়েতদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু ঝুকভের অভিযান সফল হয়নি এবং জার্মানরা তামান উপদ্বীপে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান বজায় রাখতে সমর্থ হয়। ১২ মে ঝুকভ মস্কোয় ফিরে যান, কিন্তু তার ব্যর্থতার জন্য স্তালিন তাকে কোনোপ্রকার শাস্তি প্রদান করেননি। উল্টো একই দিন স্তালিন নির্দেশনা জারি করেন যে, তিনি ছাড়া কেবল ঝুকভ আর ভাসিলেভস্কি লাল ফৌজের ফ্রন্ট কমান্ডারদের আদেশ দিতে পারবেন। এই আদেশ প্রদানের উদ্দেশ্য ছিল আর্টিলারি, বিমানবাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনীসহ লাল ফৌজের বিভিন্ন শাখার প্রধানরা যাতে ফ্রন্টের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করা।

কিন্তু শীঘ্রই জার্মানরা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় মাত্রার আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছিল। এই আক্রমণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য জার্মানদের সর্বশেষ বৃহদাকৃতির প্রচেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই ঝুকভের জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন সময়, কারণ যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফল এই লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করছিল। পরবর্তী দিনগুলো হবে ঝুকভের জন্য কঠোর অধ্যবসায়ের দিন।

(এরপর দেখুন ৮ম পর্বে)

Related Articles

Exit mobile version