কুতুব আল দীন মাহমুদ বিন জিয়া আল দীন মাসুদ বিন মোসলেহ সিরাজি, সংক্ষেপে কুতুব আল দীন আল সিরাজি নামে পরিচিত। ইরানের গৌরবোজ্জ্বল মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত তিনি। উঠতি সময়ে সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পরবর্তীতে নিজের ঝোঁকটা নিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের দিকে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, সঙ্গীতশাস্ত্র আর চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি তিনি সুফিবাদ আর দর্শন চর্চায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। তার ঘটনাবহুল জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল হাজার বছর আগের কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসেই। তাই তাকে স্মরণ করবার এটাই ভালো সময়।
কাজেরুন, ইরানের ফার্স অঙ্গরাজ্যের শিল্প ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি ছোট্ট শহর। এই শহরে প্রায় ৮০০ বছর আগে, ১২৩৬ সালের অক্টোবর মাসের কোনো এক দিনে একটি সুফি পরম্পরার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আল সিরাজি। তার বাবা জিয়া আল দীন পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। আর ধর্মীয় দিক দিয়ে কাজেরুনি ধারার একজন প্রভাবশালী সুফি ছিলেন। তিনি মধ্যযুগের আরেক বিখ্যাত সুফি, সাহাব আল দীন ওমর সুহরাওয়ার্দীর কাছে একটি খেরকা বা সুফি আলখেল্লা উপহার পেয়েছিলেন, যা ছিল অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার। সিরাজির যখন ১০ বছর পূর্ণ হয়, তখন তার বাবা তাকে এই আলখেল্লাটি আশীর্বাদস্বরূপ পরিয়ে দেন। অবশ্য, প্রাপ্তবয়স্ক সিরাজি নিজগুণেই সেকালের আরেকজন বিখ্যাত সুফি নজিব আল দীনের কাছে একটি খেরকা উপহার পেয়েছিলেন।
মুসলিম সমাজে তখন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী শৈশবেই কুরআন এবং হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন সিরাজি। প্রাথমিক পড়ালেখা শেষে বাবার কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করেন তিনি। তার বাবা জিয়া, কাজেরুনের পার্শ্ববর্তী শহর শিরাজের বিখ্যাত হাসপাতাল মুজাফ্ফারিতে ডাক্তারি করতেন। বাবার হাত ধরে এই হাসপাতালেই চলে আসতেন সিরাজি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা মৌলিক বিষয় শেখার জন্য। কিন্তু সিরাজি ১৪ বছরের সময় জিয়া পরলোকগমন করলে তার মুজাফ্ফারিতে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় তার শিক্ষাজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এই অধ্যায়ে তার শিক্ষার দায়িত্ব নেন তার ৩ চাচা কামাল আল দীন, সারাফ আল দীন এবং শামস আল দীন, যারা কিনা প্রত্যেকেই চিকিৎসক ছিলেন। চাচাদের কাছেই তিনি ইবনে সিনার বিখ্যাত চিকিৎসাশাস্ত্রের বই ‘আল কানুন’ এর শিক্ষালাভ করেন।
সিরাজির বাবা মুজাফ্ফারি হাসপাতালে একজন অপথ্যালমোলজিস্ট ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সিরাজি একই হাসপাতালের একই পদে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন! অবশ্য চাচাদের কাছে তার পড়ালেখা তখনো চলমান ছিল। ১৮ বছর বয়সে তার ডাক্তারি পড়ালেখার ইতি ঘটে। কিন্তু ডাক্তারি পেশায় তিনি বেশিদিন ছিলেন না। সারাজীবন যদি একটিই মাত্র পেশার সাথে লেগে থাকলাম, তাহলে জীবনের সার্থকতা কই? সিরাজির কাছে ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই ছিল। ২৪ বছর বয়সে তিনি ডাক্তারি পেশা চিরতরে ত্যাগ করেন। তখন তার মাথায় জ্ঞানের নতুন শাখায় আরোহনের চিন্তা, নতুন পথের পথিক হবার স্বপ্ন।
ডাক্তারি ছেড়ে হঠাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভূত চাপে সিরাজির মাথায়। তিনি সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত নাসির আল দীন আল তুসির শিষ্যত্ব লাভ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার জন্য। ১২৬০ সালে আল তুসি, মঙ্গোল শাসক হুলেগু খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় মারগেহ শহরে ‘মারাঘা’ অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। অবজারভেটরি সম্পর্কে সিরাজি এতটাই কৌতূহল অনুভব করেন যে তিনি শিরাজ ছেড়ে মারাগেহ চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১২৬২ সালে তিনি মারাগেহ পৌঁছেন এবং আল তুসির অধীনে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিত শিক্ষা শুরু করেন। এ সময়, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি ইবনে সিনার ‘ইশারাত’ গ্রন্থটির উপর দক্ষতা অর্জন করেন সিরাজি।
মারাগেহতে সম্ভবত ৩ বা ৪ বছর কাটান সিরাজি। এরপর শুরু হয় তার জ্ঞানানুসন্ধানের ভ্রমণ। ১২৬৬ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি খোরাসান, জোভিয়ান, ইস্ফাহান এবং বাগদাদ ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি নাজম আল দীন কাতেবি এবং মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর মতো বিখ্যাত পণ্ডিতের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান। তাছাড়া তার কিছু বিখ্যাত চিঠি খুঁজে পেয়েছেন ইতিহাসবিদগণ, যেগুলো তিনি বাগদাদ থাকাকালীন মিশরীয় মামলুক শাসকদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। ১২৮০ কিংবা ১২৮২ সালে, পড়ালেখা শেষ করে মিশর থেকে সিরিয়া পৌঁছেন সিরাজি। সেখানে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ইবনে সিনার দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৩১০ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘদিনের জন্য শয্যাশায়ী হন। মোটামুটি সুস্থ হতেই তিনি তৎকালীন পারস্যের (বর্তমান আজারবাইজানের অন্তর্গত) তাব্রীজ শহরে গমন করেন। সেখানেই ১৩১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন কুতুব আল দীন আল সিরাজি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে কুতুব আল দীন আল সিরাজির অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মধ্যযুগের অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতের মতো কোনো মৌলিক কাজ করেননি, তথাপি তার সংকলন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তাত্ত্বিক আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারেনি। আধুনিককালের অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে তার অনুপস্থিতির জন্যই এমন হয়েছে। কিন্তু, তার রচিত গ্রন্থগুলো তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মধ্যযুগীয় জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে। তার মৃত্যুর পর সেগুলো নিয়ে কাজ করেছেন আরবের অনেক বিজ্ঞানী। সেগুলো ইতিহাসের দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ইউরোপেও।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে সিরাজির শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘নেহায়াত আল এদরাক’ বা ‘দ্য লিমিট অব অ্যাকমপ্লিশম্যান্ট কনসার্নিং নলেজ অব দ্য হেভেনস’। এই গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের জ্যোতির্বিদগণের জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত কাজগুলোর যথার্থতা, সীমাবদ্ধতা, সীমাবদ্ধতার কারণ, বৈজ্ঞানিক ভুলসমূহ ইত্যাদি নির্মোহভাবে আলোচনা করেন। ১২৮১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, এখানে তিনি সমকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে গিয়ে ‘হেলিওসেন্ট্রিজম’ বা সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের সম্ভাব্যতা আলোচনা করেন। অবশ্য, তিনি নিজে ভূ-কেন্দ্রিক মডেলেই বিশ্বাস রাখতেন। ১২৮৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘দ্য রয়্যাল প্রেজেন্ট’, যেখানে টলেমির গ্রহসমূহের গতি সংক্রান্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। এছাড়া ‘এখতিয়ার আল মোজাফ্ফারি’, ‘ফি হারাকাত আল দাহরাজা’, ‘আল তুহফা আল সাহিয়া’ সহ আরো বেশ কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন সিরাজি, যেগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
‘রিসালা ফি হারকাত আল দারাজা’ গ্রন্থটি সিরাজির জীবনের একমাত্র গণিতের বই। এই বইটিও ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। তবে মধ্যযুগীয় অনেক ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিকের উদ্ধৃতি থেকে যত দূর জানা যায়, এই গ্রন্থে ত্রিকোণমিতি এবং বীজগণিত বিষয়ক আলোচনা করেছেন সিরাজি। তার চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইগুলো অবশ্য টিকে আছে বর্তমান সময় পর্যন্ত। ‘রিসালা ফি’ল বারা’, ‘রিসালা ফি বাইয়ান’, ‘আল তুহফাত আল সা’দিয়া’- সিরাজির চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক এই তিনটি গ্রন্থই মূলত ইবনে সিনার ‘আল কানুন আল তিব’ গ্রন্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এর মধ্যে, আল তুহফাত আল সা’দিয়া গ্রন্থটি প্রায় সম্পূর্ণটাই ইবনে সিনার চিকিৎসাশাস্ত্রীয় কাজের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা।
“আত্মিক পরিশুদ্ধি আর মানসিক প্রশান্তি পরস্পর সম্পূরক। এ দুয়ের একটি ছাড়া অপরটি অর্থহীন। সুফিবাদের মূল কথাও এ দুটি বিষয়।”- কুতুব আল দীন আল সিরাজি
মধ্যযুগীয় সুফিবাদে সিরাজি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। এ বিষয়ে তার ছিল অগাধ জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। সুফিবাদের উপর তিনি রচনা করেছেন অনেকগুলো বই, যেগুলো মধ্যযুগে বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেগুলোর মধ্যে ইতিহাসে উদ্ধৃত বইগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যাক।
- ‘ফাতহ আল মান্নান ফি তাফসির আল কুরআন’- ৪০ খণ্ডে রচিত এই মহাগ্রন্থটি হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ চমৎকার একটি গ্রন্থ। ‘তাফসির আল্লামি’ নামে পরিচিত এই গ্রন্থটি মুসলিম পণ্ডিতদের নিকট একটি নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থও বটে।
- শিরাজ শহরে থাকাকালীন তিনি সেখানকার শাসক মালেক’এজ্জ আল দীন এর সাথে একটি বই রচনা করেন। ‘আ বুক অন এথিকস অ্যান্ড পোয়েট্রি’ নামের বইটির কবিতার অংশটি সম্ভবত সিরাজি লিখেছিলেন।
- ‘সারহ মোকতার আল উসুল ইবনে হাজেব’ গ্রন্থটি সে সময়কার প্রচলিত একটি বিখ্যাত সুফি গ্রন্থের সমালোচনা।
- ‘হাসিয়া বার হেকমাত আল অয়ন’ গ্রন্থটি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মৌলিক রীতিনীতি সম্পর্কিত আলোচনা।
- ধর্মীয় বক্তৃতার উপর লেখা বই ‘মুসকিলাত আল তাফাসির’।
- আরবি ব্যাকরণ এবং ধর্মীয় বক্তৃতার উপর লেখা গ্রন্থ ‘মেফতাহ আল মেফতাহা’।
- ইরানের গিলান প্রদেশে বসবাসকালীন সেখানকার শাসক রুস্তম দাব্বাজকে উৎসর্গ করে তিনি রচনা করেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রের বই ‘দোর্রাত আল তাজ ফি গোর্রাত আল দাব্বাজ’ যা ‘পার্লে ক্রাউন’ নামে সুপরিচিত। এই গ্রন্থে তিনি ধর্মতত্ত্ব থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, জ্যোতিশশাস্ত্র, গণিত, নীতিশাস্ত্র, আইন, অলঙ্কারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, অতীন্দ্রিয়বাদ আলোচনা করেন।
তিনি হয়তো কোনো মৌলিক কাজ করে যাননি, কিংবা কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণও সম্পন্ন করেননি। তবুও তিনি যা করেছেন, তা তার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে হাজারো পণ্ডিত এবং জ্ঞান সাধককে অনুপ্রাণিত করেছে। জীবনের ২৫-৩০টি বছর তিনি ব্যয় করেছেন জ্ঞানচর্চা করে। সুফিবাদের বাইরেও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে তার কাজগুলো মানুষ ভুলতে বসেছিল। তবে সাম্প্রতিককালের তাত্ত্বিকগণ কুতুব আল দীন আল সিরাজির কাজগুলো নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেছেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদানের জন্য ইতিহাসে তার নাম চিরস্থায়ী হয়েই থাকবে।
ফিচার ছবি: pics-about-space.com