রুশ বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট অনন্যসাধারণ সমরবিদদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। অভিষিক্ত হয়েছিলেন ‘মহা অন্তর্ঘাতক’, ‘ভিন্নমুখকরণের ঈশ্বর’, ‘মাইন যুদ্ধের জিনিয়াস’ এবং ‘সোভিয়েত স্পেৎসনাজের পিতামহ’ প্রভৃতি চমকপ্রদ অভিধায়। স্পেনীয় জাতীয়তাবাদী সৈন্যদল থেকে শুরু করে জার্মান ভের্মাখট জেনারেলদের জন্য তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার স্বয়ং তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিলেন, কিন্তু জার্মানরা তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। এই ব্যক্তিটি হলেন সোভিয়েত কর্নেল ইলিয়া স্তারিনভ।
সামরিক বিষয়াবলি নিয়ে যারা আগ্রহী, ‘স্পেৎসনাজ’ শব্দটি তাদের কাছে খুবই পরিচিত হওয়ার কথা। সাধারণভাবে, স্পেৎসনাজ বলতে রুশ/সোভিয়েত বিশেষ বাহিনীগুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে। ‘Войска спецального назначения’ (ভয়স্কা স্পেৎসালনোভো নাজনাচেনিয়া, যার ভাবার্থ ‘বিশেষ অভিযান বাহিনী’ বা ‘Special Operations Forces’) শব্দগুচ্ছের সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ‘Спецназ’ (স্পেৎসনাজ)। যুদ্ধক্ষেত্রে বা শত্রুপক্ষের মাটিতে নানাবিধ জটিল ও বিপজ্জনক অভিযান পরিচালনা করা স্পেৎসনাজের দায়িত্ব। আর কর্নেল ইলিয়া স্তারিনভ এই স্পেৎসনাজের ‘পিতামহ’ হিসেবে পরিচিত।
ইলিয়া গ্রিগোরেয়েভিচ স্তারিনভ ১৯০০ সালের ২ আগস্ট তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের ওরিয়োল প্রদেশের ভয়নোভো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় ১৭ বছর বয়সী স্তারিনভ ছিলেন ৎভের শহরের একটি কারখানার কর্মী। এসময় তিনি কারখানার শ্রমিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বলশেভিক সামরিক দলের সদস্য ছিলেন। তাদেরকে রাজধানী পেত্রোগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) অভিমুখে গমনরত সৈন্যদের থামানোর জন্য বলশেভিক নেতারা নির্দেশ দেয়। স্তারিনভের দলের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, কিন্তু তারা শহরটির রেলপথ অকার্যকর করে দেয় এবং এর মধ্য দিয়ে সৈন্যবাহী ট্রেনগুলোকে আটকে ফেলে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্তারিনভের স্পেৎসনাজ জীবনের সূচনা!
রুশ গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৮ সালের ১৮ জুন তিনি বলশেভিক ‘লাল ফৌজে’ যোগদান করেন এবং মাত্র এক মাসের প্রশিক্ষণের পর দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টে বলশেভিকবিরোধী আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন ‘শ্বেত ফৌজে’র বিরুদ্ধে লড়াই করেন। বর্তমান কুরস্ক প্রদেশে যুদ্ধ চলাকালে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় শ্বেত রুশদের হাতে বন্দি হন, কিন্তু বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে যান এবং সুস্থ হয়ে পুনরায় লাল ফৌজে যোগদান করেন। এসময় তিনি ক্রিমিয়া উপদ্বীপে শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ভরোনেঝ মিলিটারি রেলওয়ে টেকনিশিয়ান স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে এক বছর অধ্যয়নের পর ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে কিয়েভে অবস্থিত লাল ফৌজের ৪র্থ করোস্তেনস্কি রেড ব্যানার রেলওয়ে রেজিমেন্টের অন্তর্ঘাতক দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এর মধ্য দিয়ে স্তারিনভের ‘অন্তর্ঘাতক’ জীবনের সূচনা। উল্লেখ্য, শত্রুপক্ষের রসদপত্র সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি, যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, শত্রুপক্ষের কর্মকর্তা বা সৈনিকদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা চালানো, অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘ্নিত করা বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা ইত্যাদি কাজকে ‘অন্তর্ঘাত’ (sabotage) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯২৩ সালে স্তাতিনভ লেনিনগ্রাদ মিলিটারি রেলওয়ে টেকনিশিয়ান স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে বছরখানেক অধ্যয়নের পর ১৯২৪ সালে তাকে তার রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এসময় তিনি ওরশা–লেপেল রেলপথ নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের সদস্যপদ লাভ করেন, এবং ১৯২৫ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কিয়েভে অন্তর্ঘাতকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
১৯৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্তারিনভ ইউক্রেনীয় সামরিক জেলার সদর দপ্তরের ৪র্থ বিভাগে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি পার্টিজানদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরির কাজ করেন। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, ‘পার্টিজান’ বলতে সেসব যোদ্ধাকে বোঝানো হয়, যারা শত্রুপক্ষের অধিকৃত ভূমিতে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ১৯৩০–এর দশক জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘পার্টিজান যুদ্ধ’ পরিচালনার জন্য বহু মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, কারণ এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন চারদিকে শত্রুবেষ্টিত ছিল এবং যেকোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছিল।
১৯৩৩ সালের মার্চে স্তারিনভকে ইউক্রেন থেকে মস্কোয় বদলি করা হয় এবং সেখানে তিনি সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’র একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন এবং সেখানে ফ্রুঞ্জে মিলিটারি অ্যাকাডেমির মিলিটারি আর্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান কর্নেল মিখাইল সভেচনিকভের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সভেচনিকভ ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী সোভিয়েত সামরিক তাত্ত্বিক এবং সোভিয়েত ‘অপ্রচলিত যুদ্ধে’র (unconventional warfare) প্রবক্তা। তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্তারিনভের চিন্তাধারা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল এবং তাঁর কাছ থেকেই স্তারিনভ অপ্রচলিত যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা লাভ করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৩৮ সালে স্তালিনীয় শুদ্ধি অভিযানের চরম পর্যায়ে কর্নেল সভেচনিকভকে গ্রেপ্তার করা হয় ও বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
১৯৩৫ সালের মে মাসে স্তারিনভ মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং লেনিনগ্রাদ–মস্কোভস্কায়া স্টেশনে উপ–সামরিক কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। একই সময়ে তিনি মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট ইনস্টিটিউটে রোডব্লক প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।
১৯৩৬ সালে স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে স্পেনীয় সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই যুদ্ধটি কার্যত একটি ক্ষুদ্র ‘ইউরোপীয় গৃহযুদ্ধে’ পরিণত হয়, কারণ ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধকে নিজ নিজ সমরকৌশল ও সামরিক প্রযুক্তির পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুদ্ধে স্পেনীয় সরকারকে সমর্থন করে, অন্যদিকে জার্মানি ও ইতালি স্পেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সহায়তা করে। উভয় পক্ষই স্পেনে নিজ নিজ ‘প্রক্সি’কে সহায়তা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করে।
১৯৩৬ সালের নভেম্বরে স্তারিনভকে ‘বাণিজ্যিক কারণে’ স্পেনে প্রেরণ করা হয়। কার্যত স্তারিনভ সেখানে প্রথমে স্পেনীয় সরকারি বাহিনীর একটি অন্তর্ঘাতক দলের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এবং পরবর্তীতে প্রায় ৩,০০০ সদস্যবিশিষ্ট ১৪তম পার্টিজান কোরের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তিনি স্পেনীয় গেরিলাদের মাইন ও বিস্ফোরক ব্যবহার এবং অন্তর্ঘাত চালানো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি সারাগোসা, মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে বহু অন্তর্ঘাত পরিচালনা করেন। একই সময়ে স্পেনে কর্মরত একজন সোভিয়েত নারী অনুবাদকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
স্পেনে দায়িত্ব পালনকালে স্তারিনভের ছদ্মনাম ছিল ‘রোডোলফো’। স্পেনে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। একবার জাতীয়তাবাদী সৈন্যদর কাছ থেকে অধিকৃত একটি ফিল্ড কিচেনে স্তারিনভ বিস্ফোরক সংযুক্ত করেন এবং আলিকান্তে নদীর ওপরে অবস্থিত সেতুর মাঝখানে সেটি রেখে দেয়া হয়। জাতীয়তাবাদী সৈন্যদের একটি কলাম সেতুটি অতিক্রম করতে নিলে স্তারিনভ ও তার সহযোদ্ধারা সেতুটি উড়িয়ে দেন এবং এর ফলে জাতীয়তাবাদী কলামটি বিধ্বস্ত হয়। আরেকবার স্তারিনভ একটি মালিকানাহীন খচ্চরের ওপরে বিস্ফোরক বসিয়ে সেটিকে ছেড়ে দেন এবং জাতীয়তাবাদী সৈন্যরা সেটিকে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। এরপর স্তারিনভ বিস্ফোরণ ঘটান এবং জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সৃষ্ট গোলযোগের সুযোগে স্পেনীয় সরকারি সৈন্যরা ঘাঁটিটিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয়।
এর পাশাপাশি স্তারিনভ গ্রানাডায় একটি পানির পাইপ ও একটি সেতু উড়িয়ে দেন, কর্দোবার নিকটবর্তী একটি টানেলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটিকে পাঁচ দিনের জন্য অকার্যকর করে দেন, কর্দবার কাছে মরোক্কান সৈন্যদের বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেন, মাদ্রিদের কাছে একটি জঙ্গলে বহুসংখ্যক শত্রুসৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করেন, এবং কর্দোবার নিকটে ইতালীয় বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরকে বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেন।
১৯৩৭ সালের নভেম্বরে স্তারিনভকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে যে শুদ্ধি অভিযান চলছিল, তাতে স্তারিনভেরও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। স্পেনে স্তারিনভের তত্ত্বাবধায়ক ইয়ান বেরজিনকে এসময় বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। স্তারিনভেরও একই পরিণতি হতে পারত, কিন্তু সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্লিমেন্ত ভরোশিলভের হস্তক্ষেপে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গর্কোভস্কায়া স্টেশনের রেলওয়ে ট্রুপ্সের কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণকেন্দ্রের প্রধান নিযুক্ত হন। সোভিয়েত–ফিনিশ যুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৯ সালের নভেম্বরে তিনি কারেলিয়ান ইস্থমাস অঞ্চলকে মাইনমুক্ত করার কাজে নিযুক্ত দলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের আগস্টে তাকে লাল ফৌজের মূল সামরিক প্রকৌশল ডিরেক্টরেটের অন্তর্ভুক্ত মাইনিং ও বাঁধ অধিদপ্তরের প্রধান নিযুক্ত হন।
১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়, এবং এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় সোভিয়েত ‘দেশপ্রেমিক মহাযুদ্ধ’ (Great Patriotic War)। ২৮ জুন স্তারিনভকে পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের অপারেশনাল প্রতিবন্ধক দলের প্রধান নিযুক্ত করা হয়, এবং ১৩ জুলাই তার আগের দায়িত্বের পাশাপাশি তাকে পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের অপারেশনাল ট্রেইনিং সেন্টারের প্রধানও নিযুক্ত করা হয়। সেপ্টেম্বরে তিনি দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের অপারেশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এসময় তার অধীনে ৫টি ব্যাটালিয়ন ও ৫টি অপারেশনাল গ্রুপ ছিল, এবং তার নেতৃত্বে এগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নির্মাণ, রেলপথ ও সড়কপথে মাইন স্থাপন প্রভৃতি অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত ছিল।
১৯৪১ সালের অক্টোবরে জার্মান সৈন্যরা ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল এবং ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র খারকভ শহর জার্মানদের করতলগত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। এসময় স্তারিনভ শহরটিতে মাইন স্থাপনের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তার নেতৃত্বে সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে ৩০,০০০ অ্যান্টি–ট্যাঙ্ক ও অ্যান্টি–পার্সোনেল মাইন, ২,০০০ টাইমড মাইন এবং ৫,০০০ নকল মাইন পুঁতে রাখে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানদের অগ্রগতি শ্লথ করে দেয়া এবং তাদের যতদূর সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা।
একই সময়ে স্তারিনভের নির্দেশে খারকভ শহরের একটি ভবনে বিস্ফোরক স্থাপন করা হয়। স্তারিনভের ধারণা ছিল, জার্মানরা খারকভ দখলের পর এই ভবনটিতেই তাদের সদর সপ্তর স্থাপন করবে। এজন্য তিনি ভবনটির বয়লার রুমের মেঝের নিচে ৩৫০ কেজি রেডিও চার্জ স্থাপন করেন, এবং জার্মানদের বিভ্রান্ত করার জন্য কয়লার স্তূপে একটি ভুয়া বিস্ফোরক স্থাপন করেন। তার ধারণাকে সঠিক প্রমাণিত করে খারকভ দখলের পর জার্মান ৬৮ তম পদাতিক ডিভিশন ভবনটিকে তাদের সদর দপ্তরে পরিণত করে। জার্মানরা কয়লার স্তূপে রাখা নকল বিস্ফোরকটি খুঁজে পেয়ে ভবনটিকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৪ নভেম্বর খারকভ থেকে ৩০০ মিটার দূর হতে স্তারিনভ বেতারযোগে মূল বিস্ফোরকটিকে সক্রিয় করেন। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জার্মানদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তাদের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জর্জ বন ব্রাউনসহ বহুসংখ্যক জার্মান সৈন্য এই বিস্ফোরণে নিহত হয়।
এই ঘটনাটি জার্মানদের দারুণভাবে ক্ষিপ্ত করে। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জার্মানরা খারকভের ৫০ জন অধিবাসীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং ২০০ জন অধিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তা-ই নয়, এই ঘটনার খবর হিটলারের কানে পৌঁছালে তিনি যারপরনাই ক্ষিপ্ত হন এবং স্তারিনভের মাথার মূল্য দুই লক্ষ রাইখসমার্ক হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে জার্মানরা স্তারিনভকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নানা প্রচেষ্টা আরম্ভ করে। এদিকে ১৯৪১ সালের ১৭ নভেম্বর স্তারিনভ লাল ফৌজের ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রুপসের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ নিযুক্ত হন। এসময় তার তত্ত্বাবধানে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মান সৈন্যদের যাতায়াতকে কঠিন করে তোলার উদ্দেশ্যে অসংখ্য মাইন স্থাপন করে, রোডব্লক স্থাপন করে এবং বহুসংখ্যক রাস্তা ও সেতু ধ্বংস করে দেয়। ডিসেম্বরে তাকে দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টের অপারেশনাল–ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের প্রধান নিযুক্ত করা হয়, এবং তার নেতৃত্বাধীনে ৫ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রোস্তভ শহর ও তার আশেপাশে প্রতিবন্ধক সৃষ্টির কাজ করে।
১৯৪২ সালের এপ্রিলে স্তারিনভ কালিনিন ফ্রন্টের ৫ম পৃথক প্রকৌশল ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এসময় তাঁর তত্ত্বাবধানে ব্রিগেডটি রঝেভ থেকে সুরোঝ পর্যন্ত ৪০০ কি.মি. বিস্তৃত অঞ্চলে মাইন স্থাপন করে। আগস্টে তাকে পার্টিজানদের সদর দপ্তরের হাই অপারেশনাল স্কুলের প্রধান নিযুক্ত হন, এবং সেখানে তিনি সেরা বিশেষজ্ঞ ও কমান্ডারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযানের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নতুন অন্তর্ঘাত প্রযুক্তির পরীক্ষানিরীক্ষায় মনোনিবেশ করেন। সেপ্টেম্বরে তিনি ককেশাস, রোস্তভ ও নভোরোসিয়স্ক অঞ্চলে সফর করেন এবং অঞ্চলগুলোতে পার্টিজানদের অভিযান তত্ত্বাবধান করেন।
১৯৪৩ সালের মার্চে তিনি দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের সামরিক পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন, এবং মে মাসে পার্টিজানদের ইউক্রেনীয় সদর দপ্তরের উপপ্রধান নিযুক্ত হন। এসময় তিনি ইউক্রেনে পার্টিজানদের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন। তার সুযোগ্য পরিচালনায় ইউক্রেনীয় পার্টিজানরা ১৯৪৩ সালে সাড়ে তিন হাজারের বেশি জার্মান ট্রেন উড়িয়ে দেয়। কার্যত জার্মানবিরোধী যুদ্ধে সোভিয়েত পার্টিজানদের সাফল্যের পশ্চাতে স্তারিনভের সুযোগ্য নেতৃত্ব বহুলাংশে দায়ী ছিল।
১৯৪৪ সালের এপ্রিলে স্তারিনভকে পোলিশ পার্টিজান সদর দপ্তরের উপপ্রধান নিযুক্ত করা হয়। এসময় তিনি জার্মান–অধিকৃত পোল্যান্ডের অভ্যন্তরে পার্টিজান কার্যক্রম পরিচালনা এবং সোভিয়েত–পোলিশ সীমান্তে সোভিয়েত ও পোলিশ পার্টিজানদের কার্যক্রম সমন্বয়ের কাযে নিয়োজিত ছিলেন। একই সময়ে তার তত্ত্বাবধানে জার্মান–অধিকৃত পোল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া এবং জার্মান আশ্রিত রাষ্ট্র হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ায় পার্টিজান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইউক্রেনীয় পার্টিজানদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। জুনে তাকে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে অবস্থিত যুগোস্লাভিয়ায় নিযুক্ত সোভিয়েত মিশনের চিফ অফ স্টাফের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি লাল ফৌজ ও যুগোস্লাভ জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মধ্যে লিয়াজোঁ স্থাপন করেন এবং বেশ কয়েকবার যুগোস্লাভ নেতা জোসিপ টিটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্তারিনভকে জার্মানির সড়ক ও রেলপথ মাইনমুক্ত করার জন্য নিযুক্ত অপারেশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে তিনি লভোভে অবস্থিত সোভিয়েত সেনাবাহিনীর রেলওয়ে ট্রুপসের ২০ তম ডিরেক্টরেটের উপপ্রধান নিযুক্ত হন। এসময় তিনি ইউক্রেনের রেলপথ মাইনমুক্তকরণ এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ পরিচালনা করেন্ম একই সময়ে তিনি পশ্চিম ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে স্তারিনভ সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের লজিস্টিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান নিযুক্ত হন এবং প্রায় তিন বছর এই দায়িত্ব পালনের পর ১৯৪৯ সালে পার্টিজান যুদ্ধ বিষয়ক অপারেশনাল–ট্যাকটিকাল গ্রুপের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি ‘মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদ ইনস্টিটিউটে’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে ৬ খণ্ডবিশিষ্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত বই লেখায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’র অফিসার ইম্প্রুভমেন্ট কোর্সের অন্তর্ঘাত কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন, এবং ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কেজিবির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৪ সালে তাকে প্রফেসর উপাধি প্রদান করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্তারিনভ তার নিজের জীবন এবং সোভিয়েত অন্তর্ঘাতকদের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। স্তারিনভের যা পেশা ছিল, তাতে জীবিত থাকাই একটা বিশাল কৃতিত্ব। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার পতন ঘটেনি, কিংবা তিনি ৫০ বছরের বেশি বাঁঁচবেন না, ডাক্তাররা এরকম নিশ্চয়তা দেয়ার পরেও স্তারিনভ তার দ্বিগুণ সময় বেঁচে ছিলেন। ধারণা করা হয়, স্তারিনভের কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারাই (ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, নিয়মিত শরীরচর্চা প্রভৃতি) ছিল তার দীর্ঘ জীবনের রহস্য। ২০০০ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি ১০০ বছর বয়সে রাশিয়ার মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে মস্কোর ত্রোয়েকুরভ সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।
স্তারিনভকে নির্দ্বিধায় রুশ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অন্তর্ঘাতকদের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তার তত্ত্বাবধানে পার্টিজানরা ২৫৬টি সেতু ধ্বংস করে এবং ১২ হাজারের বেশি ট্রেন ধ্বংস করে। সুতরাং যখন স্তারিনভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ ‘ডেমোলিশন এক্সপার্ট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেটিকে অত্যুক্তি বলা চলে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্তারিনভকে পাঁচবার জেনারেল পদমর্যাদা প্রদানের জন্য এবং তিনবার ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ (সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক পদক) প্রদানের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কর্নেলই থেকে গেছেন, এবং নানা পদক লাভ করলেও বীরত্বসূচক সর্বোচ্চ পদক তার ভাগ্যে জোটেনি। স্তারিনভ স্পষ্টভাষী ছিলেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে ‘কটু’ সত্য বলতে দ্বিধা করতেন না, এজন্যই হয়তো এরকমটা ঘটেছে। অবশ্য সেটা নিয়ে স্তারিনভের বিশেষ কোনো আফসোস ছিল না, কারণ তার মতে, “মৃত মার্শাল হওয়ার চেয়ে জীবিত কর্নেল হওয়া অনেক বেশি ভালো!”