সেলমান ওয়েকসমান: যক্ষ্মার অভিশাপ মোচনকারী

কলেজের গবেষণায় একবার টিস্যু কালচার নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন সেলমান ওয়েকসমান। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার অংশ হিসেবে একটি পাত্রে অনেক দিনের চেষ্টায় কিছু একটা জন্মেছিলেন তিনি, কিন্তু সমস্যা হলো সেটা কী তা ধরতে পারছিলেন না! পরীক্ষার দিন যখন শিক্ষক নাম জিজ্ঞেস করলেন, তখন থেমে থেমে ওয়েকসমান উত্তর দিলেন, “ব্যাকটেরিয়া…, না ছত্রাক…, সম্ভবত ব্যাকটেরিয়া!” শিক্ষকের বুঝতে বাকি রইলো না যে ওয়েকসমানের সঠিক উত্তরটি জানা নেই। ফলে পরীক্ষায় ফেল করলেন তিনি। আর তাতেই মনে জেদ চেপে বসলো। টানা মাসখানেক পড়ালেখা আর পর্যবেক্ষণ করে তিনি বের করলেন যে, সেটি হচ্ছে অ্যাক্টিনোমাইসেটালস বর্গের অ্যাক্টিনোমাইসিটিস ব্যাকটেরিয়া। পরীক্ষায় ফেলের দগদগে ক্ষতকে পুঁজি করেই সিদ্ধান্ত নিলেন, অণুজীববিজ্ঞানই হবে তার জীবনের গতিপথ।

image source: alamy.com

সেলমান আব্রাহাম ওয়েকসমান বিশ্বখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী। অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল থেকে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ শব্দটি তারই সৃষ্টি। এর ধারাবাহিকতায়ই ফ্লেমিং অ্যান্টিডট আবিষ্কার করেছিলেন। অন্যদিকে যক্ষ্মার মতো প্রাণঘাতী রোগে যখন বিশ্বজুড়ে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন প্রশমন নিয়ে এসেছিলেন ওয়েকসমানই।

নোবেল বিজয়ী এ বিজ্ঞানী ১৮৮৮ সালের ২২ নভেম্বর রাশিয়ার (বর্তমান ইউক্রেন) নোভা প্রাইলুকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্রাহাম ওয়েকসমান উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির কল্যাণে জমিদার বনে যান। ফলে বিপুল বিত্তবৈভবের মাঝে জন্ম নিয়ে একমাত্র সন্তান হিসেবে সেলমানের শৈশব ছিল প্রাচুর্যে ভরপুর।

সেলমানের মা-বাবা উভয়েই ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলতেন। নিজ এলাকায় ইহুদি ধর্মের বিকাশ ঘটাতেও কাজ করেছেন তারা। নিজেদের এই ধর্মভীরুতা তারা সেলমানের মধ্যেও আরোপ করেছিলেন। শিশু সেলমানকে ডুবিয়ে রাখা হতো কেবলই ধর্মীয় বইপত্রের মাঝে। সেলমানও সেগুলো পড়তে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১০ বছর বয়সেই হিব্রু ভাষায় সম্পূর্ণ বাইবেল মুখস্ত করে ফেলেন। ধর্মশিক্ষায় ছেলের উৎসাহ দেখে বইপত্রের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল হলেন ওয়েকসমান দম্পতি। ছেলেকে পড়তে দিলেন জুল ভার্নের সায়েন্স ফিকশন। আর এখান থেকেই শুরু সেলমানের বদলে যাওয়া। সায়েন্স ফিকশন পড়েই তার অন্যান্য সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ জাগলো। তিনি দস্তয়ভস্কি, তলস্তয় আর শেক্সপিয়ারের মতো লেখকদের লেখা পড়তে শুরু করলেন। আর একইসাথে তার মাঝে দুটি পরিবর্তন চলতে থাকলো। একটি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠা। অপরটি, ক্রমাগত ধর্মশিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া।

ধর্মশিক্ষা থেকে মন উঠে গেলেও বাবা-মায়ের প্রতি সেলমানের ছিল অগাধ ভরসা। তাদের পরামর্শে তিনি শহর থেকে দূরের স্কুলে ভর্তি হননি। যদিও তারা বলেছিলেন দূরত্বই প্রধান সমস্যা, তথাপি তাদের ভয় ছিল অন্য জায়গায়। সেক্যুলার স্কুলে পড়ালেখা করে পাছে তাদের ছেলে না আবার সেক্যুলার হয়ে ওঠে, সে ভাবনা থেকে তার সেলমানের জন্য অধিক টাকা খরচায় গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। কিন্তু তাতে আসলে লাভ কিছুই হয়নি। ‘ম্যাট্রিকুলেশন ডিপ্লোমা’ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যোগ্যতা লাভ করার পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হলেন। পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, সমন্বয়ের অভাবের সাথে আরো একটি কারণ ছিল তার ফেল করার পেছনে। সেটি হলো সরকারের ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব।

রুটজারস কলেজ বর্তমানে রুটজারস বিশ্ববিদ্যালয়; iamge source: city-data.com

সেলমান পরের বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন ঠিকই, তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন না। কারণ সেবছরই রাশিয়ান সরকার ইহুদিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উপর কঠোর কোটা আরোপ করে, যার বাঁধা পেরিয়ে খুব কম সংখ্যক ইহুদি শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতো। হতাশায়, ক্ষোভে দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেলমান। চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। এই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা ৩০ বছর পরে হলেও প্রমাণিত হয়, যখন নাৎসি বাহিনী রাশিয়া আক্রমণের সময় নোভা প্রাইলুকা শহরটি ধ্বংস করে দেয় এবং সর্বশেষ ইহুদি নাগরিকটিকেও হত্যা করে। যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পান সেলমান। কিন্তু সে সময় তার পরিচয় হয় রুটজারস কলেজের ডিন লিপম্যানের সাথে, যিনি কি না সেলমানের মতো একজন দেশত্যাগী ইহুদি রাশিয়ান নাগরিক ছিলেন। উভয়ের মানসিক অবস্থা যখন একসূত্রে গেঁথে গেল, তখন একত্রে থাকাটাও ঠিক হয়ে গেল সহজে। লিপম্যানের অনুরোধে কলাম্বিয়া ছেড়ে রুটজার কলেজেই ভর্তি হয়ে গেলেন সেলমান।

অ্যাক্টিনোমাইসিটিস ব্যাকটেরিয়া; image source: city-data.com

কলেজে পড়াকালে একবার ব্যবহারিকে ফেল করে অণুজীববিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নেন সেলমান। ‘সয়েল ব্যাকটেরিওলজি’তে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি লিপম্যানের গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকটিনোমাইসেটালস নিয়ে গবেষণা করে বায়োকেমিস্ট্রিতে পি.এইচডি লাভ করেন। তারপর রুটজারসে ফিরে এসে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেখানে অ্যাক্টিনোমাইসিটিস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং বিস্ময়কর সাফল্য পান, যদিও ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কারের পূর্বে তার গুরুত্ব বোঝা যায়নি। তিনি গবেষণা করে দেখতে পান যে, অ্যাক্টিনোমাইসিটিসের কলোনি অনেক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করে। তার এই পর্যবেক্ষণেরও ৫ বছর পর ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন।

পেনিসিলিয়াম ছত্রাক; image source: coggle.it

এর পরের সময়টাতে সেলমানের সাফল্য অনেকটা সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো এগোতে লাগলো। তার গবেষণা গ্রন্থ ‘প্রিন্সিপালস অব সয়েল মাইক্রোবায়োলজি’ বিশ্বজুড়ে মাইক্রোবায়োলজির পাঠ্যবইয়ে পরিণত হলো। অ্যাক্টিনোমাইসিনসহ আরো বেশ কিছু মাইক্রোঅর্গানিজম একধরনের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট উৎপন্ন করে, যা ব্যাকটেরিয়া রোধক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। সেলমান এসব ব্যাকটেরিয়া রোধক ওষুধের নামকরণ করেন ‘অ্যান্টিবায়োটিক’। তিনি অ্যাক্টিনোমাইসিন, ক্যালভাসিন, ফিউমিগাসিন এবং স্ট্রেপ্টোথ্রাইসিন নামক চারটি ব্যাকটেরিয়ারোধক কেমিক্যাল তৈরি করেন। তবে প্রতিটিই ছিল প্রাণীদেহের জন্য বিষাক্ত। তাই সেগুলো ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তবে এসময় তার পি.এইচডি শিক্ষার্থী আলবার্ট শাটজের সাথে একপ্রকার নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এজেন্ট উৎপাদনকারী একপ্রকার নতুন ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পান। তারা এর নাম দেন স্ট্রেপটোমাইসিন।

এই স্ট্রেপটোমাইসিন নিয়ে শুরু হলো নতুন গবেষণা। ‘মায়ো ক্লিনিক’ নামে একটি ক্লিনিকে গিনিপিগের দেহে স্ট্রেপটোমাইসিনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল যে সেটি প্রাণীদেহের জন্য বিষাক্ত নয়। সেলমান একটি টিউবারকুলোসিস আক্রান্ত গিনিপিগের দেহে স্ট্রেপটোমাইসিন প্রয়োগ করলেন এবং সেটি সফলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করলো। এতে উৎসাহী হয়ে টিবি আক্রান্ত মানবদেহেও পরীক্ষা চালানো হলো এবং সাফল্য আসলো। আর তাতেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমর এক অধ্যায় রচিত হলো। কারণ তখনো পর্যন্ত যক্ষ্মার কোনো চিকিৎসা ছিল না। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর হাজারো মানুষ মৃত্যুবরণ করতো। বার্নহার্ড রেইম্যান, ব্লেইজ প্যাসকেল, উইলিয়াম ক্লিফোর্ড, অগাস্টিন ফ্রেজনেলের মতো প্রতিভাবধর অনেক বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন।

শাটজের সাথে স্ট্রেপটোমাইসিন নিয়ে গবেষণা করছেন সেলমান; image source: de.wikipedia.org

এই যুগান্তকারী সাফল্যে বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির চূড়ায় উঠে বসেন সেলমান। আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মার্ক তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়। টিবির পাশাপাশি কলেরা, বিউবোনিক প্লেগ, টাইফয়েড জ্বরের মতো কিছু রোগ যেগুলো পেনিসিলিনে প্রশমিত হয় না, সেগুলোর ক্ষেত্রেও স্ট্রেপটোমাইসিন ছিল কার্যকর। মার্ক কোম্পানি ভার্জিনিয়ায় আলাদা একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করলো শুধুমাত্র স্ট্রেপটোমাইসিন উৎপাদনের জন্য। আর পরের বছর ১৯৫২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন সেলমান ওয়েকসমান। স্ট্রেপটোমাইসিনের অধ্যায় এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি শাটজের জন্য। সেলমানের পি.এইচডি শিক্ষার্থী শাটজ অভিযোগ করলেন যে সেলমান অন্যায্যভাবে স্ট্রেপটোমাইসিনের অধিকাংশ কৃতিত্ব নিয়ে নিয়েছেন!

শুরু হলো স্ট্রেপটোমাইসিনের দ্বিতীয় অধ্যায়, যেখানে সেলমান বরাবরই ঠাণ্ডা মাথার পরিচয় দেন। নোবেল পুরস্কার পাবার আগপর্যন্ত ৮টি অ্যান্টিবায়োটিকের পেটেন্ট করান সেলমান, যার জন্য তিনি নগদ অর্থ লাভ করেন। শাটজ এ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি এবং মামলা করে বসেন। তবে, মামলা আদালতে যাবার আগেই সেলমান তার সমাধান করেন। তিনি শাটজকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্রেপটোমাইসিনের একজন উদ্ভাবক হিসেবে ঘোষণা করেন এবং পেটেন্টের প্রাপ্ত অর্থ গবেষণা সহযোগীদেরও দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সাময়িকভাবে শাটজ শান্ত হলেও নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর তিনি পুনরায় মামলা করেন এই মর্মে যে নোবেল পুরস্কার তার সাথে ভাগাভাগি করা উচিৎ সেলমানের। তবে নোবেল কমিটি সাফ জানিয়ে দেয় তারা সেলমানকে এককভাবেই নোবেল প্রদান করবে। তাই আদালতেও এই মামলা বেশি দূর আগায়নি। আর এসব ঘটনায় শাটজের প্রতি বিজ্ঞানীসমাজ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়।

সেলমান ওয়েকসমান (১৮৮৮-১৯৭৩ সাল); image source: thefamouspeople.com

কিছুকাল পরই স্ট্রেপটোমাইসিনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়। এখানে এসে স্ট্রেপটোমাইসিনের অকার্যকারিতা সামনে আসতে শুরু করে। অনেক রোগীই সুস্থ হবার পর পুনরায় টিবি আক্রান্ত হন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেল টিবি রোগ সারাতে পারছে না। উপকার পাওয়া রোগীর সংখ্যা ১০ বছরেই অর্ধেকে নেমে এলো। তবে স্ট্রেপটোমাইসিন পরিত্যক্ত হলো না। কারণ, টিউবারকুলোসিস মেনিনজাইটিসের জন্য এটি বেশ কার্যকর ওষুধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। বর্তমানে বিশ্বে লক্ষাধিক স্ট্রেপটোমাইসিন রোধক টিউবারকুলোসিসের উদাহরণ পাওয়া যায়, যেগুলো রোধে নতুন ওষুধের খোঁজ করছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানী হিসেবে সাফল্যের জন্য অসংখ্য ব্যক্তিগত পুরস্কার লাভ করা সেলমান ওয়েকসমান রাশিয়ান বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হলেও, ১৯১৬ থেকেই তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেই বছরই দেশত্যাগী রাশিয়ান নাগরিক দেবোরাহ মিটনিককে বিয়ে করেন। ৭০ বছর বয়সে তিনি অধ্যাপনা থেকে অবসর নেন। তবে লেখালেখি এবং বক্তৃতা চালিয়ে যান মৃত্যুর আগপর্যন্ত। তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল একটি সংকলন গ্রন্থ। ১৯৭৩ সালের ১৬ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ম্যাসাচুসেটসের ক্রাউয়েল সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।

ফিচার ছবি: youtube.com

Related Articles

Exit mobile version