আপনার মতে রক সঙ্গীতের সর্বকালের সেরা গায়ক কে? উত্তরে অধিকাংশই একজনের নাম বলবেন, ফ্রেডি মার্কারি। সত্তর ও আশির দশকের দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড ‘কুইন’ এর ভোকাল ফ্রেডি তার অসাধারণ গানের গলা ও মঞ্চে অনন্যসাধারণ উপস্থিতি দিয়ে মোহাবিষ্ট করেছিলেন দুনিয়ার কোটি ভক্তকে। মৃত্যুর দুই যুগের বেশি সময় পরও তার গাওয়া গান বিশ্বে সর্বজন নন্দিত। ফ্রেডির লেখা ও গাওয়া ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’ সর্বকালের সেরা গানের বিভিন্ন তালিকায় প্রায়ই স্থান পায়।
জানেন কি, একুশ শতকের অন্যতম এই কালচারাল আইকনের শৈশব কেটেছিল আমাদেরই প্রতিবেশী দেশ ভারতে? ফ্রেডি মার্কারি নামে জনপ্রিয়তা পেলেও তার জন্মগত নাম ছিল ভিন্ন। পারস্যের ধর্ম জরথুস্ত্র এর অনুসারী পরিবারে জন্ম নেওয়া ফারুখ বুলসারা নামের ছোট্ট বালকটির ফ্রেডি মার্কারি নামক এক কিংবদন্তী হয়ে উঠার গল্পই থাকছে এই লেখায়।
ভারতে শুরু
১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বৃটিশ অধ্যুষিত জানজিবার (বর্তমান তানজানিয়া) এলাকার স্টোন টাউন নামক শহরে এক পার্সি দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নিলো এক শিশু। জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারী বোমি ও জের বুলসারা তাদের নবজাতক সন্তানের নাম রাখলেন ফারুখ বুলসারা। আদি নিবাস ভারতের গুজরাটে হলেও ফারুখ এর বাবা বোমি চাকরির সুবাদে জানজিবারে বসবাস করতেন। কিন্তু উন্নত শিক্ষার উদ্দেশ্যে তারা ফারুখকে পাঠালেন বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) এর এক বোর্ডিং স্কুলে।
আট বছর বয়সে ফারুখ বোম্বাই থেকে কিছু দূরে পাঁচগনি এলাকায় অবস্থিত সেন্ট পিটার্স বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। বৃটিশ ঘরানার এই স্কুলেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তার। খেলাধুলায়ও তিনি ছিলেন ওস্তাদ। দশ বছর বয়সেই স্কুলের টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান ফারুখ।
অবসর সময়ে সংগ্রহে থাকা ভারতীয় ও পশ্চিমা গানের রেকর্ড শুনতেন এবং গানগুলো গাওয়ার চেষ্টা করতেন। গানের প্রতি ফারুখের এই অনুরাগ দেখে প্রধান শিক্ষক স্কুলের পিয়ানো ক্লাসে ফারুখকে ভর্তি করবার আশা প্রকাশ করে তার বাড়িতে চিঠি পাঠান। শুরু হলো পিয়ানো শেখা। কে জানতো এই ছেলেই একদিন বোহেমিয়ান র্যাপসোডির পিয়ানোর সুর দিয়ে তাবৎ বিশ্বের সঙ্গীত পিপাসুদের হৃদয় জয় করবেন?
১২ বছর বয়সে ফারুখ ও তার আরো চার স্কুলবন্ধু ডেরিক ব্র্যাঞ্চ, ব্রুস মারে, ফারাং ইরানি এবং ভিক্টরি রানা মোট ৫ জন মিলে গঠন করেন ‘The Hectics‘ ব্যান্ড। এর মাধ্যমেই ওয়েস্টার্ন রক মিউজিকের আনুষ্ঠানিক চর্চা শুরু করেন ফারুখ। নিজের নামের প্রথম অংশ পরিবর্তন করে নতুন নাম নেন ‘ফ্রেডি’। ১৯৬২ সালে স্কুলের পাট চুকিয়ে জানজিবারে পরিবারের কাছে ফিরে যান ফ্রেডি। এর মধ্যে গানের প্রতি তার ভালোবাসা আরো বিস্তৃত হয়েছে। এলাকার রাস্তায়, অলিতে গলিতে, চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে গান জুড়ে দিতেন কিশোর ফ্রেডি। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন জানজিবারে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অন্যান্য বহু বৃটিশ এবং ইন্ডিয়ান পরিবারের মতো ফ্রেডির পরিবারও পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। তার নতুন বাসস্থান হয় ইংল্যান্ডের মিডলসেক্স।
ইংল্যান্ডে এসে তরুণ ফ্রেডি ভর্তি হন ইয়েলিং আর্ট কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি পেটের তাগিদে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হন তিনি। ফ্যাক্টরির মালপত্র উঠানো নামানো থেকে শুরু করে হিথ্রো বিমানবন্দরে প্যাকেজ হ্যান্ডেলিংয়ের কাজও তিনি করেছেন। ছোট থেকেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ফ্রেডিকে দেখে অনেকেই বলতো, তোমাকে এই কাজে মানায় না। তিনি উত্তর দিতেন,
আমি আসলে একজন সঙ্গীতশিল্পী। অপেক্ষা করছি সঠিক সময়ের জন্য। এইসব কাজ আমার কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়!
রক দুনিয়ায় প্রবেশ
ফ্রেডি যখন পড়াশোনা ও কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত, সেসময় জিমি হেনড্রিক্স নামক আরেক কিংবদন্তী গিটারিস্ট বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ফ্রেডি শুরু থেকেই তার বিশাল ভক্ত ছিলেন। ঘরময় সাঁটানো ছিল তার পোস্টার। পড়াশোনার ফাঁকে গিটার বাজানোটাও শিখে ফেলেছেন এর মধ্যে। হেনড্রিক্সের গিটারের সুরে বুঁদ হয়ে থাকা ফ্রেডির সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ দেখে তার কলেজ বন্ধু টিম স্টাফেল ফ্রেডিকে আমন্ত্রণ জানালেন তার ব্যান্ড ‘স্মাইল’ এ। ব্যান্ড এর তৎকালীন লিড গিটারিস্ট ছিলেন ব্রায়ান মে, ড্রামার ছিলেন রজার টেয়লর।
শুরু থেকেই স্মাইল এর সঙ্গীতচর্চার ধরন ফ্রেডিকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। ইংল্যান্ডে আসবার পর এই প্রথম ফ্রেডি পুনরায় গানের জগতে প্রবেশ করেন। সরাসরি ব্যান্ডে যুক্ত না হলেও টিম স্টাফেল এর সাথে গানের চর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে ফাইন আর্টস এর উপর ডিগ্রি নিয়ে কলেজ পাশ করেন ফ্রেডি। এর পরপরই তিনি স্মাইল ব্যান্ডের ড্রামার রজার টেয়লরের ফ্ল্যাটে একসাথে বসবাস করা শুরু করেন।
দুজনে মিলে নিজেদের আঁকা বিভিন্ন ছবি, পোস্টার বিক্রি করেন জীবিকার তাগিদে। শুরু করেন সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাকের ব্যাবসা। একই বছর ফ্রেডির পরিচয় হয় লিভারপুলের ব্যান্ড আইবেক্স (Ibex) এর সাথে। গানের প্রতি ফ্রেডির অত্যুৎসাহ ও তার গানের গলা শুনে আইবেক্স তাদের পরবর্তী কনসার্টে ফ্রেডিকে কিছুটা সময় স্টেজ পারফর্ম করবার সুযোগ দেয়।
১৯৬৯ সালের ২৩ অক্টোবর ইংল্যান্ডের বোল্টন শহরে প্রথমবারের মতো মঞ্চ মাতান ফ্রেডি। নবাগত ফ্রেডির গান গাওয়ার ধরন, মঞ্চে নিজের উপস্থিতি দিয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করবার ক্ষমতা দেখে আইবেক্স ফ্রেডিকে তাদের ব্যান্ডে পাকাপোক্ত করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু ব্যান্ডের নামকরণ নিয়ে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কিছু ঝামেলার কারণে শেষমেশ আর আইবেক্সে যোগ দেওয়া হয় না তার। এরপর ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে Sour Milk Sea নামক অন্য একটি ব্যান্ডের লিড ভোকাল হিসেবে সঙ্গীত দুনিয়ায় পা রাখেন ফ্রেডি।
কুইন এর সৃষ্টি ও একজন কিংবদন্তীর আগমন
পেশাদার সঙ্গীত জগতে একটু একটু করে ঢুকছেন ফ্রেডি। এমন সময় খবর পেলেন কলেজ জীবনে পরিচয় হওয়া স্মাইল ব্যান্ডের ভোকাল, একসময়ের বন্ধু টিম স্টাফেল ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেছেন। সুযোগ হাতছাড়া করলেন না ফ্রেডি। ব্যান্ডের বাকি দুই সদস্য ব্রায়ান মে ও রজার টেয়লরের সাথে তো পরিচয় ছিল আগে থেকেই। ১৯৭০ সালের এপ্রিলে ফ্রেডি স্মাইল ব্যান্ডের ভোকাল হিসেবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ব্যান্ড এর নাম পরিবর্তন করবেন। নতুন নাম হলো ‘কুইন’। নিজের ফ্রেডি নামের শেষেও যোগ করলেন ‘মার্কারি’। এর কিছুদিন পরই ব্যান্ডে যোগদান করেন বেজ গিটারিস্ট জন ডিকন। সম্পূর্ণ হয় কুইন এর লাইনআপ।
কুইন প্রতিষ্ঠার পর ফ্রেডিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে সৃষ্টি হয় বোহেমিয়ান র্যাপসোডি, ডোন্ট স্টপ মি নাউ, কিলার কুইন, উই আর দ্য চ্যাম্পিয়নস ও উই উইল রক ইউ এর মতো কালজয়ী গান। তার গলায় চড়ে কুইনও পায় জগতজোড়া খ্যাতি। লাইভ কনসার্টে কুইনের পারফরম্যান্স ছিল এক ও অদ্বিতীয়। আর ইতিহাসের অন্যতম সফল এই রক ব্যান্ডটির মূল চালিকা শক্তিই ছিলেন ফ্রেডি।
ফ্রেডির অনন্য গলার স্বর নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার গলার স্বর ছিল চতুর্থ অক্টেভ রেঞ্জ এর। সাধারণ মানুষের ভোকাল কর্ড সাধারণত ৫.৪ হার্জ থেকে ৬.৯ হার্জ এর মধ্যে ওঠানামা করে, সেখানে ফ্রেডির ভোকাল কর্ডের রেঞ্জ ছিল ৭.৯ হার্জ পর্যন্ত।
স্বাভাবিক আর দশটা মানুষ যেসব শব্দ গলা থেকে সৃষ্টিই করতে পারেন না, ফ্রেডি সেগুলো অনায়াসে গেয়ে যেতেন। স্টেজে ফ্রেডি মার্কারি ছিলেন অনবদ্য। হাতের আঙ্গুলের ইশারায় পুরো স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। ১৯৮৫ সালের ১৩ জুলাই ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে লাইভ এইড কনসার্টে ফ্রেডি মার্কারি ও তার ব্যান্ড কুইন এর করা ২৫ মিনিটের পারফরম্যান্সকে আখ্যায়িত করা হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা লাইভ পারফরম্যান্স হিসেবে।
এ তো গেল পর্দার সামনের ফ্রেডি মার্কারির গল্প। মঞ্চ কাঁপানো এই লোকটি পর্দার আড়ালে ছিলেন পুরো ভিন্ন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রচার বিমুখ। সাক্ষাৎকার খুব কমই দিতে চাইতেন। সাংবাদিকদের তীক্ষ্ণ সব প্রশ্নে বিরক্ত হতেন। জীবনযাপনও ছিল বেশ উশৃঙ্খল। অতি প্রতিভাবান মানুষেরা নাকি কিছুটা অস্বাভাবিক হন- এই প্রবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন এই ফ্রেডি।
১৯৭০ সালে ফ্রেডির জীবনে আগমন ঘটে ম্যারি অস্টিন নামক এক রমণীর। অসম্ভব ভালোবাসতেন ম্যারিকে। সাত বছর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে নিজের সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবার কথা ম্যারিকে জানাবার পরও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুজন গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সহায় সম্পত্তির সিংহভাগই ম্যারিকে উইল করে দিয়ে যান ফ্রেডি, যার তৎকালীন মূল্য ছিল ৩০ মিলিয়ন ডলার। নিজে হন ম্যারির সন্তানের গডফাদার। নিজের ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ ম্যারিকে নিয়ে গান লেখেন ফ্রেডি।‘লাভ অব মাই লাইফ’ নামের সে গান আজও শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ব্যক্তি মার্কারির রহস্যময় জীবন এবং এর পরিসমাপ্তি
সত্তর এবং আশির দশকে ফ্রেডি যখন মঞ্চ মাতাচ্ছেন, পুরো দুনিয়ার রক ভক্তদের রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন, তিনি নিজেও কি তখন জানতেন আর খুব বেশি সময় হাতে নেই তার? ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন তিনি এইচআইভি পজিটিভ। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া These are the days of our lives গানের ভিডিওতে ভঙ্গুর ও অসুস্থ ফ্রেডি মার্কারিকে দেখে ভক্তদের হৃদয় কেঁদে ওঠে।
তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন তিনি। তিনি না থাকলেও তার ব্যান্ড কুইন যেন থেমে না থাকে, সে ব্যাপারে বলে গেছেন মৃত্যুর কিছুদিন আগে গাওয়া ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’ গানে। জন্ম থেকেই ফ্রেডির চোয়ালে চারটি অতিরিক্ত দাঁত থাকায় সামনের দাঁতগুলো বেশ খানিকটা উঁচু ছিল। অপারেশন করে দাঁত ঠিক করালে গলার স্বরে এর প্রভাব পড়তে পারে, এই ভেবে তিনি সারাজীবন এভাবেই গান গেয়েছেন। মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া ফ্রেডি মার্কারি যাওয়ার আগে নিজের উঁচু দাঁতের সরল হাসি হেসে ভক্তদের বলে গেছেন,
I’ll face it with a grin, I’m never giving in. On with the show!
১৯৯১ সালের ২৪ নভেম্বর কেনসিংটনের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী। এইডস থেকে সৃষ্ট ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মূলত মৃত্যু হয় তার। পারস্যের অগ্নি সাধক বাবা-মায়ের সন্তান ফ্রেডির মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে সৎকার করা হয়। তার নির্দেশমতোই মৃতদেহের ভস্ম হস্তান্তর করা হয় ফ্রেডির জীবনের একমাত্র প্রেম, ম্যারি অস্টিনের কাছে। নিজের প্রাসাদতুল্য বাড়িটিও তিনি লিখে যান ম্যারির নামে।
চলে গেলেন ফ্রেডি মার্কারি। কিন্তু যাওয়ার আগে তৈরি করে গেলেন এমন এক ইতিহাস, যার পুনরাবৃত্তি করবার দুঃসাহস বা প্রতিভা কোনোটিই হয়তো ভবিষ্যতে কারো হবে না। ব্যক্তিগত জীবনে ফ্রেডি সুখী হতে পারেননি। কিন্তু একজন রকস্টার হিসেবে তিনি সঙ্গীতকে যা দিয়ে গেছেন, তার জন্য বিশ্বের তাবৎ সঙ্গীতপ্রেমীরা হাজার বছর পরও তাকে ধন্যবাদ জানাবে।