হিটলার-স্ট্যালিন রাজনৈতিক চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ে এবং জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। স্ট্যালিনের গ্রেট পার্জের মাধ্যমে রেড আর্মির অনেক দক্ষ ও তুখোড় সামরিক নেতাদের হত্যা করায়, হিটলার রেড আর্মিকে একটি ভঙ্গুর ও দুর্বল সেনাবাহিনী বলে ভাবতে থাকেন। হিটলার ভেবেছিলেন দুর্বল সোভিয়েত রেড আর্মি, মহান শক্তিশালী নাৎসি বাহিনীর কাছে পাত্তাই পাবে না। দ্য গ্রেট পার্জ হিটলারকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণে প্ররোচিত করে।
মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির বাইশ মাসের মাথায়, ১৯৪১ সালের ২২ জুন সাম্রাজ্যবাদী নেশায় মত্ত হিটলার তার জীবনের বৃহত্তম ভুলটি করে বসেন। সেদিন হিটলারের নির্দেশে জার্মানরা অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বারবারোসা’ পরিচালনা করে।
হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল, ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করে দেওয়া। এই আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্ট্যালিন একে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে অভিহিত করেন এবং সোভিয়েত-জার্মান মিত্রতা, শত্রুতায় পরিণত হয়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তিতে যোগদান করে এবং শুরু হয় সোভিয়েত জনগণের ‘গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়ার’।
নাৎসিদের আক্রমণে সোভিয়েত বাহিনী নাস্তানাবুদ হতে থাকে। কয়েক মাসের মধ্যে নাৎসিরা পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত অঞ্চলগুলো দখল করে নেয়। নাৎসি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে রাশিয়ার অভ্যন্তরেও ঢুকে পড়ে। এক মাসের মধ্যে নাৎসিরা এতটা এগিয়ে যায় যে, জার্মান বিমানগুলো প্রায়ই মস্কোতে বোমা হামলা করত।
এমন শোচনীয় অবস্থায় সোভিয়েত সরকারকে কুইবশেভে (বর্তমান সামারা) সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু স্ট্যালিন কুইবশেভে না গিয়ে, মস্কোতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। স্ট্যালিন ভেবেছিলেন মস্কো থেকে তিনি সরে গেলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। তাই স্ট্যালিন ক্রেমলিনে থেকেই যুদ্ধের নির্দেশনা দিতে থাকেন।
নাৎসিদের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের প্রেক্ষিতে ১৯৪১ সালের ৩ জুলাই স্ট্যালিন জাতির উদ্দেশ্যে এক রেডিও ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি ইতিহাসের কোনো বাহিনীই অপরাজেয় নয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে অদম্য মনে করা হতো, তবুও এটি যেমন রাশিয়ানদের কাছে পরাজিত হয়েছিল, কায়জার ভিলহেলমের জার্মান সেনাবাহিনীকেও অপরাজেয় বলে মনে করা হতো, এটাও যেমন রাশিয়ান বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল, তেমনি হিটলারের বর্তমান ফ্যাসিস্ট জার্মান সেনাবাহিনীর একই অবস্থা হবে। তিনি হিটলার ও রিবেনট্রপকে দানব এবং নরখাদক বলে অভিহিত করেন।
স্ট্যালিন আরো বলেন, “রেড আর্মি, রেড নেভি, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল নাগরিককে সোভিয়েত ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে হবে, রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই রেড আর্মির জন্য বিশাল সমর্থন সংগঠিত করতে হবে, সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত শক্তি প্রদান করতে হবে, সমস্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে, সৈন্য পরিবহনের দ্রুত অগ্রগতি করতে হবে, যুদ্ধের সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হবে এবং যুদ্ধে আহতদের ব্যাপক যত্ন নিতে হবে।” এছাড়া এই রেডিও বার্তায় আরো অনেক দিকনির্দেশনা দেন স্ট্যালিন। বলা বাহুল্য, তার এই ভাষণ সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও জনগণকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে।
নাৎসিদের সাথে কোনোভাবেই পেরে উঠছিল না রেড আর্মি। এমতাবস্থায়, সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত আর্মি ‘স্কর্চড আর্থ পলিসি’ গ্রহণ করে। এই নীতি অনুযায়ী, সোভিয়েত আর্মি যখন পিছু হটতে থাকে তখন সেখানকার সব রসদ ধ্বংস করে দিয়ে আসে। শত্রুদের ব্যবহারযোগ্য, যা থেকে শত্রুরা সুবিধা নিতে পারে, এমন সবকিছুই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তেলক্ষেত্রগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, যন্ত্রপাতি নষ্ট করে দেওয়া হয়, খাবারদাবার, রাস্তাঘাট সবকিছুই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
জার্মান বাহিনীর দ্রুত এগিয়ে আসার প্রেক্ষিতে স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মধ্য রাশিয়ায় স্থানান্তর করা হয় এবং এর কার্যক্রম অধিকতর জোরদার করা হয়। যুদ্ধকালীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় পুরোপুরি সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করে।
১৯৪১ সালের অক্টোবরের মধ্যে জার্মান বাহিনী মস্কোর উপকণ্ঠে চলে আসে। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় ‘ব্যাটল অফ মস্কো’। প্রথমদিকে সোভিয়েত বাহিনী পর্যুদস্ত হতে থাকে, কিন্তু দুই মাস পর ডিসেম্বরে জার্মান বাহিনীর দুর্দিন শুরু হয়। ডিসেম্বরের শুরুতে সোভিয়েত বাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। কয়েকদিন পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে হাজির হয় জেনারেল উইন্টার! সেই জেনারেল উইন্টার, যিনি বারবার রাশিয়ানদের বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করেছেন। সেই উইন্টার বা শীতকাল আবারও সোভিয়েতদের রক্ষার জন্য উপস্থিত হয়। শীত ও বরফের প্রকোপে জার্মান বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
পাল্টা আক্রমণে সোভিয়েত বাহিনী একের পর এক এলাকা পুনরুদ্ধার করতে থাকে। ১৯৪২ সালের জানুয়ারির শুরুতে জার্মান বাহিনী পিছু হটতে থাকে। প্রথমবারের মতো সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের থামিয়ে দেয় এবং তাদের বিতাড়িত করে। এরই সঙ্গে শেষ হয় অপারেশন বারবারোসা এবং শুরু হয় সোভিয়েত বাহিনীর প্রতিআক্রমণ। এর ফলে আত্মবিশ্বাসী স্ট্যালিন জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৪২ সালের ৫ জানুয়ারি, ক্রেমলিনে একটি বৈঠকের সময় স্ট্যালিন মস্কো, লেনিনগ্রাদ এবং ক্রিমিয়ায় একযোগে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেন। এ সময় তিনি জার্মান বাহিনীকে মস্কোর কাছেই আটকে ধ্বংস করে দিতে আদেশ দেন। ঝুকভ এবং অন্যান্য জেনারেলদের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে স্ট্যালিন এবার রক্ষণাত্মক থেকে আক্রমণাত্মক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জার্মানিকে আরো চাপে ফেলতে স্ট্যালিন ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিম ইউরোপে সেকেন্ড ফ্রন্ট খুলতে আহ্বান জানান। তার পরিকল্পনা ছিল, সেকেন্ড ফ্রন্টের মাধ্যমে যদি পশ্চিমদিকে জার্মানদের আঘাত করা যায় তবে হিটলার বিচলিত হয়ে পড়বে এবং পূর্বে সোভিয়েত আর্মির পক্ষে জার্মানদের পরাজিত করা সহজ হবে। কিন্তু ব্রিটেন উত্তর আফ্রিকায় মনোযোগ দিতে বেশি আগ্রহী ছিল। যুদ্ধের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন মস্কোর ক্রেমলিনে বৈঠকে বসেন। ১৯৪২ সালের ১২-১৭ আগস্ট পর্যন্ত মস্কো সম্মেলন চলে।
মস্কোর যুদ্ধে হারার পর হিটলার দক্ষিণে মনোনিবেশ করেন। সোভিয়েত সেনাবাহিনীও হিটলারের দক্ষিণে অভিযানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে যায়। স্ট্যালিনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে স্ট্যালিনগ্রাদ শহর জার্মানদের হামলার লক্ষ্যবস্তু। স্ট্যালিন রেড আর্মিকে যেকোনো মূল্যে স্ট্যালিনগ্রাদ শহর রক্ষার নির্দেশ দেন।
১৯৪২ সালের জুন মাসে জার্মান বাহিনী স্ট্যালিনগ্রাদ আক্রমণ করে। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ ‘ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদ’ শুরু হয়। স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত বাহিনী স্ট্যালিনগ্রাদে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সোভিয়েত বাহিনীর আক্রমণে জার্মান বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, স্ট্যালিনগ্রাদ আক্রমণকারী জার্মান সেনারা আত্মসমর্পণ করে। স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।
নাৎসিদের প্রতিরোধ করায় মিত্রশক্তির দেশগুলোতে স্ট্যালিন বেশ জনপ্রিয় মুখে পরিণত হন। এসময় স্ট্যালিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকের সাথে সাক্ষাৎকার দেন। মার্কিন সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ১৯৪২ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করে।
স্ট্যালিন সৈন্যদের শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে লড়াই করতে করতে মরে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং শত্রুর হাতে বন্দীদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন। এছাড়া তিনি সৈন্যদের অননুমোদিত পশ্চাদপসরণ না করতে নির্দেশ দেন। তার বড় ছেলে ইয়াকভ একজন লেফটেনান্ট হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এক যুদ্ধে ইয়াকভকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে নিয়ে যায় জার্মানরা। তিনি ইয়াকভের বন্দী হওয়ার খবর শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করেন, কারণ ইয়াকভ জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করেনি।
১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধে জার্মান ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডরিখ পলাস আত্মসমর্পণ করলে, জার্মানরা তার বিনিময়ে ইয়াকভকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। স্ট্যালিন একজন লেফটেনান্টের জন্য একজন ফিল্ড মার্শালকে বিনিময় করতে রাজি হননি। ইয়াকভকে মুক্ত না করার ব্যাপারে পরবর্তীতে স্ট্যালিন বলেন, “একটু ভেবে দেখুন কত ছেলেরা ক্যাম্পে মারা গিয়েছে! পলাসের বিনিময়ে কে তাদের মুক্ত করবে? তারা কি ইয়াকভের চেয়ে খারাপ ছিল?” ইয়াকভ পরবর্তীতে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আত্মহত্যা করে। স্ট্যালিন দেশের জন্য কতটা নিবেদিত আর নিরপেক্ষ ছিলেন তার এই মনোভাব থেকে সহজেই অনুমেয়।
স্ট্যালিন হিটলারের সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের প্রচার চালান। তার নির্দেশে প্যান-স্লাভ জাতীয়তাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৩ সালে স্ট্যালিন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্নকে বিলুপ্ত করে দেন। তিনি বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের প্রচার চালানোর নির্দেশ দেন।
১৯৪৩ সালের জুলাইয়ে জার্মান বাহিনী কুর্স্কে আক্রমণ করে। কুর্স্কের যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম ট্যাংক যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুর্স্কের যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী জার্মান বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে। স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত বাহিনী তাদের হারানো অঞ্চল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করে। ১৯৪৩ সালের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের কাছে হারানো অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক পুনরুদ্ধার করে।
ইস্টার্ন ফ্রন্টে সোভিয়েত বাহিনীর জয়রথ এগিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় মিত্রশক্তির প্রধান তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের নেতারা আলোচনার জন্য একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে স্ট্যালিনের পছন্দের জায়গা তেহরানে মিলিত হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ও সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন। মিত্রশক্তির এই তিন নেতা একত্রে ‘বিগ থ্রি’ নামে পরিচিত।
তেহরানে এই তিন নেতা জার্মানিকে পরাজিত করার পরিকল্পনা এবং যুদ্ধোত্তর ইউরোপের রূপরেখা কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন। স্ট্যালিন দাবি করেন যুদ্ধ শেষে জার্মানির নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব প্রুশিয়ার কনিগসবার্গ অঞ্চল সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিতে হবে। রুজভেল্ট এবং চার্চিলও স্ট্যালিনের এই দাবি মেনে নেন।
স্ট্যালিন আরো দাবি করেন, যুদ্ধ শেষে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি অনুযায়ী পোল্যান্ডের একটি অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীন আসা উচিত, তবে চার্চিল স্ট্যালিনের এই দাবির বিরোধিতা করেন। সম্মেলনে স্ট্যালিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে পশ্চিমা ফ্রন্ট খোলার জন্য চাপ দেন, ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন উত্তর ফ্রান্সে আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইউরোপে জার্মানিকে পরাজিত করার পর প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে নীতিগতভাবে সম্মত হন স্ট্যালিন।
১৯৪৪ সালের মাঝামাঝিতে পশ্চিমা ফ্রন্ট খোলা হয়। দুই দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে জার্মান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। জার্মানি তার অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চল দ্রুত হারাতে শুরু করে। স্ট্যালিন বুঝতে পারেন জার্মানি পরাজয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তার উদ্দেশ্য ছিল, জার্মানির একটা অংশসহ সমগ্র পূর্ব ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়ে আসা। এজন্য তিনি যত দ্রুত সম্ভব বার্লিন দখল করতে চেয়েছিলেন। তিনি রেড আর্মিকে আক্রমণ জোরদার করার নির্দেশ দেন। রেড আর্মির প্রচণ্ড আক্রমণে জার্মানরা সংকুচিত হতে থাকে এবং একের পর এক অঞ্চল সোভিয়েত আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। স্ট্যালিনের নির্দেশে রেড আর্মি ক্রমেই জার্মানির মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে যায়।
যুদ্ধ শেষে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে কে কতটুকু অধিকার করবে তা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে মস্কোতে চার্চিল ও স্ট্যালিনের মধ্যে আবারো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বলকান অঞ্চলে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তি ও প্রভাবের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব ছিলেন স্ট্যালিন। চার্চিলের প্রধান দৃষ্টি ছিল গ্রিসের দিকে। তিনি গ্রিসকে সম্পূর্ণভাবে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।
বৈঠকে চার্চিল মিত্রশক্তির মধ্যে রোমানিয়া, গ্রীস, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়াকে ভাগ করে একটি কাগজের টুকরোতে বিস্তারিত লিখেন। চার্চিলের লেখা যে যে বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে সেগুলো সেখানে লিখে দেন স্ট্যালিন। চার্চিল ও স্ট্যালিনের মধ্যে আলোচনায় রোমানিয়ার ৯০ শতাংশ, বুলগেরিয়ার ৭৫ শতাংশ, যুগোস্লাভিয়ার অর্ধেক, হাঙ্গেরির অর্ধেক এবং গ্রিসের ১০ শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ইউরোপে বিজয় যখন সন্নিকটে, নাৎসি বাহিনী যখন ধুঁকছে, তখন বিগ থ্রি আবারও একত্রিত হওয়ার কথা ভাবলেন। রুজভেল্ট ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী কোনো এক স্থানে সম্মেলনে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ট্যালিনের ডাক্তাররা তাকে লম্বা ভ্রমণের ব্যাপারে নিষেধ করেন। এছাড়া তার বিমানে চড়ায় ভয় ছিল। ফলে, স্ট্যালিনের প্রস্তাবে সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হলো কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ক্রিমিয়ান শহর ইয়াল্টায়। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়াল্টা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
‘বিগ থ্রি’ নেতারা যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি ও বাকি ইউরোপের পরিণতি, জাপানের বিরুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরে চলমান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবেশ এবং জাতিসংঘ গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করেন। অতীতে জার্মানি অনেকবার পোল্যান্ডের মাধ্যমে রাশিয়াকে আক্রমণ করেছে। এজন্য স্ট্যালিন যেকোনো মূল্যে পোল্যান্ডকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চান। চার্চিল স্ট্যালিনের এই দাবির বিরোধিতা করেন। স্ট্যালিন ঘোষণা করেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডের যে অঞ্চলটি দখল করেছিল তা ফেরত দেবে না এবং লন্ডনে অবস্থিত পোলিশ নির্বাসিত সরকারের দাবিও পূরণ করবে না।