আপনি কি মনে করেন, পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন? অথবা এমন কোথাও গিয়ে নিজের বাকি জীবন কাটাতে চান, যেখানে নেই কোনো অর্থের লোভ, দুর্নীতি কিংবা নেশাজাতীয় দ্রব্য? তাহলে এ পৃথিবীতে এমন একটি জায়গা আছে, যেখানে খোদ যীশু আপনাকে পথ দেখাবেন।
এটি কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি নয়, ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা যীশুর ছবি। কী ভাবছেন? টাইম ট্র্যাভেল করে কেউ দু হাজার বছর আগে গিয়ে জীবন্ত যীশুর ছবি তুলে নিয়ে এসেছে? এসব কিছুই নয়। ছবিতে যীশু খ্রিস্টের মতো দেখতে মানুষটা আসল যীশু নন। কিন্তু তিনি এখনো জীবিত এবং নিজেকে পুনর্জন্ম নেওয়া যীশু দাবি করেন।
সবাই তাকে ডাকে ভিসারিয়ন বলে। প্রকৃত নাম সের্গেই আনাতোলিয়েভিচ টরোপ। ১৯৬১ সালের ১৪ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাস্নদার শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথম জীবনে কম্যুনিস্ট সরকারের রেড আর্মি এবং ট্র্যাফিক পুলিশ হিসেবে চাকরি করেন।
১৯৮৯ সালে চাকরি হারানোর কয়েকমাস পর, ১৯৯০ সালে ২৯ বছর বয়সে তিনি দাবি করেন যে, তার পুনর্জন্ম হয়েছে যীশু খ্রিস্ট হিসেবে। ১৯৯১ সালের ৮ আগস্ট, রাশিয়ার মিনুসিন্সক শহরে জনসম্মুখে নিজেকে ঈশ্বর নয়, বরং ঈশ্বরের বার্তাবাহক হিসেবে দাবি করেন। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই তার উত্থান ঘটে।
বুক অভ রেভেলিশনে ‘মিলেনিয়ালিজম’ নামে একটি ধারণা রয়েছে। এ ধারণা অনুযায়ী, কোনো এক হাজার বছরের সমাপ্তিতে মহাপ্রলয় আসবে এবং সকল জীবিত-মৃত মানুষের বিচার হবে। তবে ঠিক কত হাজার বছর পর এ দিন আসবে, তা সঠিক কেউই বলতে পারে না। অনেকে মনে করেন, পৃথিবী ধ্বংসের আগে কয়েকবার মহাপ্রলয় আসবে। যেমনটা হয়েছিল নোয়াহর সময়ে এবং একজন পয়গম্বর আসবেন, যিনি বিশ্বাসীদের পথ দেখাবেন। ঠিক এ ধারণা থেকেই ভিসারিয়ন দাবি করেন, মহাপ্রলয়ের আগে যীশু তার মধ্যে পুনর্জন্ম নিয়েছেন। তিনি বুক অভ দ্য লাস্ট টেস্টামেন্ট নামে ধর্মগ্রন্থও লিখেছেন এবং সাইবেরিয়ার পেট্রপাভ্লভকায় একটি চার্চ বানিয়েছেন, যার নাম চার্চ অভ দ্য লাস্ট টেস্টামেন্ট।
এখানে তিনি পুনর্জন্ম, নিরামিষবাদ এবং জগতের রহস্যের উদঘাটন শেখান। তার অনুসারীরা তাকে শিক্ষক বলে ডাকে। ১৯৯৪ সাল থেকে সাইবেরিয়ায় পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তার অনুসারীদের বসতি রয়েছে, যার কেন্দ্রে পাহাড়ে এই ধর্মের উপাসনালয় অবস্থিত। এ বসতিতে প্রায় চার হাজার মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করে। বর্তমানে আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম জুড়ে এই চার্চের প্রভাব রয়েছে। এছাড়া পৃথিবী জুড়ে প্রায় দশ হাজার অনুসারী রয়েছে তার।
ভিসারিয়নের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে খুব বেশি নতুনত্ব পাওয়া যায় না। তিনি তার ১১ খণ্ডের অসমাপ্ত গ্রন্থে ঈশ্বরের বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন, যে অনুযায়ী তার অনুসারী লোকেরা দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করে। তার ধর্মের আদর্শ বৌদ্ধধর্ম, রহস্যবাদ, সমষ্টিবাদ এবং বাস্তুজাগতিক মূল্যবোধ সহ রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের থেকে নেওয়া কিছু কিছু উপাদানের সমষ্টি। এই বিশ্বাস অনুযায়ী মহাবিশ্বের দুটি উৎস রয়েছে, একটি প্রকৃতি ও অপরটি আত্মা। এছাড়া ভিসারিয়ন মহাজাগতিক সত্ত্বায় বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, মানুষের আত্মা আছে কিন্তু এই মহাজাগতিক সত্ত্বাদের আত্মা নেই। তারা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে তাদের আর জৈবিক শরীরের প্রয়োজন হয় না।
রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকায় জন্মহার অনেক বেশি। ভিসারিয়ন মনে করেন, ঈশ্বর নারীকে পুরুষের অধীন করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ যেমন ঈশ্বরের উপাসনা করে, প্রত্যেক নারীর উচিত পুরুষের উপাসনা করা। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণকেও অনুৎসাহিত করেন। কয়েক বছর আগে তার এলাকায় নারী পুরুষের সংখ্যায় অসমতা দেখা দেয়। নারীর সংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষ কমতে থাকে। এর জন্য তিনি একটি উপায় বের করেন। তিনি বিবাহিত নারীদের বলেন যে, তাদের স্বামীর উপর শুধু তাদের একার অধিকার আছে এমন নয়, সম্প্রদায়ের অন্য নারীদেরও অধিকার রয়েছে। একজন পুরুষ একের অধিক বিবাহ করতে পারবেন।
তার অনুসারীরা এই বহুগামী অভিক্রিয়াকে ত্রিভুজ বলে থাকে। চার্চের কর্তৃপক্ষ মনে করে, ভিসারিয়নের একনিষ্ঠ অনুসারী এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই জন্ম নেবে। যদিও এই বহুবিবাহ নীতি ভিসারিয়নের নিজের জীবনেই কাজ করেনি। তার প্রথম স্ত্রী এটি মেনে নিতে পারেননি এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ভিসারিয়ন ১৯ বছর বয়সী এক পালিত কন্যাকে বিয়ে করেন।
ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য
ভিসারিয়ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, পৃথিবী খুব শীঘ্রই ধ্বংস হবে। পুরো পৃথিবী বা এর অংশবিশেষ পানির নিচে থাকবে। শুধু ভিসারিয়নের বসতি অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হবে না। এই অঞ্চলে তখন উপকূলীয় আবহাওয়া বিরাজ করবে। ভিসারিয়ন তার অনুসারীদের নিয়ে পরিশুদ্ধ, পাপ মুক্ত পৃথিবীতে বসবাস করবেন।
এই সম্প্রদায়ে সময়ানুবর্তিতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সবাইকে নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। প্রতিদিন সকালে ভিসারিয়নের প্রধান অনুসারী চেভাল্কভ সবাইকে নগর চত্বরে জড়ো করেন। সবাই হাত ধরে গোল হয়ে প্রার্থনা করে। এরপর চার্চের কর্ম পরিদর্শকগণ সবাইকে আট ঘণ্টার কাজ ভাগ করে দেন। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব অনুযায়ী কাঠ কাটে, বরফ পরিষ্কার করে, জমি চাষ করে, ফসলের পরিচর্যা করে, নতুন ঘর নির্মাণ করে। এখানে প্রত্যেকটি ঘর এই সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেরা তৈরি করেছেন। ঘরের নকশা ছবির মতো সুন্দর। পাহাড়ের উপরে চার্চের থেকে অদূরবর্তী জায়গায় ভিসারিয়ন তার ছয় পুত্র-কন্যা নিয়ে বসবাস করেন।
ভিসারিয়নের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, তার অনুসারীদের মধ্যে টাকা পয়সা, প্রসাধনী, বিলাসদ্রব্য, অস্ত্র, গাড়ি ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাইরে থেকে যে অর্থ অনুদান আসে, তা সম্পূর্ণটাই অনুসারী সম্প্রদায়ের বাজেটে জমা হয়। এখান থেকেই তাদের পরিমিত পুষ্টিকর আহারের ব্যবস্থা করা হয়। যদি কখনো বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে চাষকৃত শস্য এবং ফলমূল থেকে যাতে সহজেই সে ঘাটতি পূরণ করা যায়, তার জন্য প্রতি গ্রীষ্মে এখানে কৃষিজমিতে চাষ করা হয়।
এ সম্প্রদায়ের সবাই নিরামিষাশী। মাছ-মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জীব হত্যা মহাপাপ।
ভিসারিয়ন মনে করেন, পৃথিবীতে নারী ও পুরুষের আলাদা দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। তিনি ছেলেমেয়েদের অধিক মেলামেশা করতে বারণ করেন। এখানে স্কুল রয়েছে, তবে ছেলে-মেয়েরা আলাদা আলাদাভাবে স্কুলে যায়। ছেলেদের বাইরের বিভিন্ন কাজ সেখান হয় আর মেয়েদের ঘরের বিভিন্ন কাজ শেখানো হয়। তারা মনে করে, কোনো মেয়ে যদি এসব মেনে না নেয়, তবে ঈশ্বর তাকে বিভিন্ন মেয়েলি অসুখ দিয়ে শাস্তি দেবেন। মেয়েদের কুমারিত্বকে এই সমাজে পবিত্র হিসেবে দেখা হয়। প্রত্যেক মেয়ের বিয়ের আগপর্যন্ত কুমারী থাকা অবশ্য কর্তব্য।
এই এলাকায় প্রতি বছর ধর্মীয় জমায়েতের আয়োজন করা হয়, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে ভিসারিয়নের অনুসারীরা অংশ নেয়। এখানে তিনি চার্চের সামনে বাৎসরিক বক্তৃতা দেন এবং অনুসারীদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেন।
ভিসারিয়নের অনুসারীরা মহাজাগতিক সত্ত্বা বা এলিয়েনে বিশ্বাস করে। অনেকে এলিয়েন মহাকাশযান দেখেছে বলেও দাবি করে। যদিও এই দাবি সাইবেরিয়া অঞ্চলের অনেকেরই। তার এলাকায় কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষী নেই। দরকারও হয় না। এত বছরে এখানে কোন ঝুট-ঝামেলার খবর পাওয়া যায়নি। ভিসারিয়ন প্রকৃতি রক্ষায় সচেষ্ট। এখানে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় এবং প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন দ্রব্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ভিসারিয়নের উত্থান নিয়ে সমালোচনা
ভিসারিয়ন ঠিক এমন সময়ে তার পুনর্জন্মের ঘোষণা দেন যখন ধর্মহীন সোভিয়েত সরকারের পতন হয়। সোভিয়েত আমলে ধর্মচর্চার সুযোগ ছিল না। বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের জীবনের নানা সমস্যা, হতাশার সমাধান দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজছিলেন। সরকারের পতন হলে যখন উদার ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করা হয়, তখন পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে অনেক মানুষ নিজেকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের বার্তাবাহক দাবি করে। ১২ জন লোক নিজেকে স্বয়ং যীশু দাবী করে। এর মধ্যে ভিসারিয়নও ছিলেন। অনেকে মনে করে, ভিসারিয়ন তার যীশুর মতো চেহারার কারণেই এত অনুসারী পেয়েছে।
মূলধারার চার্চ তার এই পুনর্জন্মকে মেনেও নেয়নি। অনেকে মনে করে, তিনি ভণ্ড এবং সুযোগ সন্ধানী। তার মেয়েদের নিয়ে ধর্ম গ্রন্থে লেখা মতবাদ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। পুরো রাশিয়া জুড়ে এ ধরনের ধর্মীয় নেতা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আগের মতো সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই ধর্মীয় নেতারা নিজের এলাকায় নিজের আইন বানিয়ে মানুষকে পরিচালনা করে। ভিসারিয়ন তার ব্যতিক্রম নন।
ভিসারিয়নের অনুসারীরা সাদামাটা জীবনযাপন করলেও ভিসারিয়ন নিজে বিলাসবহুল জীবন কাটান। তার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বাড়ি রয়েছে। এছাড়া তিনি মাঝে মাঝেই দেশে বিদেশে ‘আধ্যাত্মিক’ দর্শনে বের হন। তার আয়-ব্যয়ের হিসাব একমাত্র তার কাছের অনুসারীরা জানেন তাই এ বিষয়ে তদন্ত করা সম্ভব হয় না।
আলোচনা সমালোচনা যাই থাকুক, ভিসারিয়ন দিন দিন শান্তিপ্রিয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুনাম অর্জন করছেন। রাশিয়ার অন্য ধর্মীয় ব্যক্তিদের তুলনায় ভিসারিয়ন কম সমালোচিত এবং তার অনুসারী এবং গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। তার সম্প্রদায়ের সুখী, নির্ঝঞ্ঝাট, মোহহীন জীবনযাত্রা অনেককেই আকর্ষিত করে। তার অনুসারীদের বিশ্বাসমতে, নিজের মনকে শুদ্ধ করতে এবং জীবনের মানে খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়ে ভিসারিয়নের কাছে গেলে তিনি কাউকে ফেরান না। চাইলে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। শেষ বেলায় হয়তো মহাপ্লাবন আসবে না বা ভিসারিয়নের জাহাজের যাত্রী আপনাকে হতে হবে না, তবে সাইবেরিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তির দেখা পেয়ে যেতেও পারেন।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/