তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি?
তুমি কি আমায় বন্ধু, কাল ভালোবাসোনি?
খুবই প্রচলিত ও পরিচিত একটি গান। কিন্তু কয়জন গানটির গীতিকার বা সুরকারের নামটি জানে? তিনি আর কেউ নন। বাংলার শচীন দেব বর্মন। ছোট করে সবাই বলে এসডি বর্মন। অনেক বাঙালিই হয়তো জানে না, এসডি বর্মন এই বাংলাদেশেরই সন্তান। ত্রিপুরার বিখ্যাত চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজবংশে তাঁর জন্ম। পিতার নাম নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর।
ত্রিপুরার রাজবংশ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। রাজা-মহারাজাদের জীবনাচরণ নিয়েও আছে অনেক আখ্যান-উপাখ্যান। এসব কাহিনী নিয়ে মানে রাজবংশের ইতিহাসকে আশ্রয় করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়। পদ্যে রচিত গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। পরবর্তীতে গ্রন্থটির তথ্য হালনাগাদ করা হতে থাকে। সেই সময় ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট এবং কুমিল্লা। তাই এই বইতে এসব অঞ্চলের ইতিহাসও উঠে এসেছে।
‘রাজমালা’ ছয়টি লহর বা খণ্ডে বিভক্ত। এই খন্ডগুলোর যুগে যুগে আধুনিকীকরণ হয়েছে। রাজবংশেরই একজন কর্মচারী ১৮৯৬ সালে ত্রিপুরার ইতিহাস নিয়ে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটির নামও দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ। বইটি রচনা করা হয় মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমলে। কৈলাসচন্দ্রের বাবা ও ঠাকুরদা ছিলেন মানিক্য পরিবারের সেরেস্তাদার ও মোক্তার। তাই তার ‘রাজমালা’য় ত্রিপুরার ব্যাপারে অনেক অজানা ও মূল্যবান তথ্য উঠে এসেছে।
বীরচন্দ্র মানিক্য রাজা হওয়ার আগে সিংহাসনের আরেকজন শক্ত-পোক্ত উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি শচীন দেব বর্মনের বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর; বীরচন্দ্রের সৎভাই। সিংহাসনের অধিকার পাওয়ার লোভ বীরচন্দ্রকে হিংস্র ও নির্দয় করে তোলে। তিনি কয়েকবার নবদ্বীপচন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে নবদ্বীপচন্দ্র রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী কৈলাসচন্দ্র সিংহের পরামর্শে কুমিল্লায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। রাজসিংহাসনের দাবি ত্যাগ করার পর কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে চর্থা এলাকায় নবদ্বীপচন্দ্রকে বীরচন্দ্র ৬০ একর জমি দান করেন। এখানে নবদ্বীপচন্দ্র একটি দালান নির্মাণ করেন। এই দালানেই শচীন দেব বর্মনের জন্ম হয়।
ছোটবেলা থেকেই একটি সংগীতময় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন শচীন দেব বর্মন। বাবা ছিলেন একজন সেতারবাদক ও ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী। বাবার কাছেই গ্রহণ করেন সংগীতের প্রথম তালিম। এরপর সংগীত শিক্ষা করেন ওস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।
শচীন দেব বর্মনের সংগীত শিক্ষার জন্য অনেকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে আছে কানাকেষ্ট, ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আব্দুল করিম খাঁ প্রমুখ। নবদ্বীপচন্দ্রের কুমিল্লার বসতভিটার বিপরীত দিকে ছিল আরেক জমিদারবাড়ি। সবাই ডাকত মুন্সিবাড়ি। সেই বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুন্সিবাড়ির ছেলে মর্তুজ মিয়া আর শচীন দেব ছিলেন বাল্যবন্ধু। কৈশোরে একদিন রাতের বেলা শচীন দেব আর মর্তুজ মিয়া মুন্সিবাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। শচীন দেব এর মধ্যে গুনগুনিয়ে গান গাওয়া শুরু করে দেন। শচীন দেবের গান অন্দরের ভেতর থেকে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন জমিদার নাবালক মিয়া। তিনি চাকর সফর আলীকে সাথে সাথে পাঠিয়ে দেন রাস্তায় কে গান গাইছে তাকে নিয়ে আসার জন্য।
সফর আলী শচীন দেবের কাছে এসে বলেন, “শচীনকর্তা, হুজুর আপনাকে ডাকছে।” শচীন দেব এতে খুব ভয় পেয়ে যান। কাঁপতে কাঁপতে হাজির হন নাবালক মিয়ার সামনে। জমিদার তাকে বলেন, “কিরে, তোর তো গানের গলা খুব ভালো। কোনো বাদ্যযন্ত্র আছে কি তোর?” শচীন দেব না-বোধক উত্তর দিলে নাবালক মিয়া তাকে হারমোনিয়াম, তবলা, পিয়ানোসহ কয়েকপ্রকার বাদ্যযন্ত্র কিনে দেন। কানাকেষ্ট নামক এক তবলচিকেও রেখে দেন।
এভাবে সুখেই কাটছিল তার বাল্যকাল। ম্যাট্রিক, আইএ ও বিএ কুমিল্লা থেকে পাশ করে ১৯২৪ এ মাত্র ১৮ বছর বয়সে শচীন দেব কলকাতায় যান এম এ পড়ার জন্য। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। কুমিল্লাতে পড়ে থাকে তার স্মৃতি আর পরিবারের সহযোগিতায় গড়া সংগঠনগুলো। ত্রিপুরার মহারাজাগণের অনুগ্রহে সেকালেই কুমিল্লাতে গড়ে উঠেছিল নাট্যশালা, লাইব্রেরি, টাউনহল, সাংস্কৃতিক সংঘ ইত্যাদি। ১৯১০ থেকে ১৯২০ মাত্র দশ বছরের মধ্যেই কুমিল্লাতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। দ্য গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি ও ইয়ংমেন্স ক্লাব ইংরেজ সাহেবগণের দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছিল। এর ফলে এখানে কবি-সাহিত্যিক-সুধীজনদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। কাজী নজরুল ইসলামও এখানকার প্রেমে পড়ে যান। কবি এখানে আসলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটি ঘরে। এখান থেকেই কবি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছড়া– বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে। শচীন দেব আর নজরুল ইসলাম ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
শচীন দেব বর্মন “সরগমের নিখাদ” নামে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করেন। সেখানে তিনি তাঁর জীবনের উত্থান-সংগ্রাম-ব্যর্থতার কথা লিখেছেন। শচীন দেবের বয়স যখন পঁচিশ তখন তাঁর বাবা কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। পিতার মৃত্যুর পরে শচীন দেবের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন,
পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তা-ই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।
১৯৩৪ এ সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলনে গান গেয়ে শচীন দেব স্বর্ণপদক জয় করেন। পরের বছর বেঙ্গল সংগীত সম্মেলনে ঠুমরি পেশ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-কে মুগ্ধ করেন। ১৯৩৭ শচীন দেবের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর তিনি তাঁর পরবর্তী সংগীত জীবনের প্রেরণা শ্রীমতি মীরা দাশগুপ্তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার নাম পাল্টে রাখা হয় মীরা দেব বর্মন। মীরা দেব বর্মন ছিলেন তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনী।
মীরা আর শচীন দেবের বিয়ে নিয়েও অনেক কথা শোনা যায়। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শচীন দেব ও মীরা দেব বর্মন দুজনেই তালিম নিতেন। একসাথে সংগীতের পাঠ নিতে নিতে একসময় তাঁরা প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন যা গুরু ভীষ্মদেব ভালো চোখে দেখেননি। এরপর ভীষ্মদেবের সাথে শচীন দেবের সম্পর্ক শিথিল হওয়া শুরু করে এবং শেষে ভীষ্মদেব সব ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরির দিকে রওনা হন। তারপর মীরা দেব বর্মন শচীন কর্তার কাছে সংগীতের দীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। একই বছর তাদের বিয়েও হয়। স্বামীর মতো তিনিও ছিলেন সংগীতের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং সফল ব্যক্তিত্ব। বিয়ের দু’বছর বাদে তাদের একটি সন্তান হয়। সে-ও পরবর্তীতে বাবার মতো সুরজগতের প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ। রাহুল দেব বর্মনের কথাই বলা হচ্ছে।
শচীন কর্তার প্রাপ্তির ঝুলি বেশ ভারী। সেই ’৩৪ এ গোল্ডমেডেল দিয়ে শুরু। তারপর এক এক করে ফিল্মফেয়ার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ডসহ কত কী! ১৯৬৯ এ শচীন দেবকে দেওয়া হয় ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতার পদ্মশ্রী। পরের বছর শক্তি সামন্তের আরাধনা ছবির সফল হোগি তেরি আরাধনা গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক পুরস্কার পান শচীন দেব। চারবছর পর জিন্দেগী জিন্দেগী ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক। উনসত্তরটি বসন্ত পার করে শচীনকর্তা ’৭৫ সালে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
সারাটি জীবন সংগীতের সাধনায় রত থেকেছেন। দেশ-বিদেশের বড় বড় শিল্পী-সংগীতকারদের সাথে সংগীত চর্চা করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাভ করেছেন সীমাহীন সন্মান ও ভালোবাসা। তবুও একটি বারের জন্য ভোলেননি বাংলা মায়ের কোল; নিঃসঙ্কোচে গেয়েছেন,
কই সে হাসি, কই সে খেলা, কই সে বুনোরোল
আমি সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল…