নিকোলো প্যাগানিনির বেহালা বাজানো এতই ভালো ছিল যে, মানুষ মনে করত কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এমনভাবে বেহালা বাজানো সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এই প্রতিভা কেবল শয়তানের কাছ থেকে পাওয়া উপহার বৈ কিছু নয়। এই ব্যক্তি তার বেহালা বাজানোর অনন্য ক্ষমতার জন্য শ্রোতাদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দ্য ডেভিলস ভায়োলিনিস্ট’ নামে।
নিকোলো প্যাগানিনি, ২৭ অক্টোবর ১৭৮২ সালে, ইতালির জেনোভায় জন্মগ্রহণ করেন। একাধারে তিনি ছিলেন একজন বেহালাবাদক, গিটারবাদক এবং সুরকার। অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর এই সঙ্গীতশিল্পী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বেহালাবাদকদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত।
তার সময়ে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তিনি সঙ্গীতের একজন অত্যন্ত প্রতিভাসম্পন্ন প্রডিজি, আবার অনেকে ভেবেছিলেন যে তিনি শয়তানের সাথে চুক্তি থেকে আক্ষরিক অর্থে তার গুণাবলী পেয়েছেন। নিকোলো প্যাগানিনির প্রতিভা, অসাধারণ দক্ষতা তাকে প্রায় পৌরাণিক খ্যাতি দিয়েছে। কিন্তু তার এমন খ্যাতি ও প্রতিভার পেছনে আসল কাহিনী কী?
গুজব ও খ্যাতি
ফ্যাকাশে চামড়া, ডেবে যাওয়া গাল এবং পাতলা ঠোঁটের একজন ছিলেন পাগানিনি। তার আঙুলগুলো ছিল খুব লম্বা, চিকন। প্রায়ই তিনি কালো পোশাক পরতেন। লম্বা এবং ফ্যাকাশে চেহারার কারণে তাকে ‘রাবার ম্যান’ ডাকনামও দেওয়া হয়েছিল। তার সম্পর্কে গুজব ছিল অগণিত। এর মধ্যে বেশিরভাগ গুজবই সেই সময়ের অজ্ঞতার কারণে সৃষ্ট কুসংস্কারেরও ফল।
ভিয়েনায় একটি কনসার্ট থেকে প্রথমদিকে একটি গুজবে কিছু দর্শক বলেছিলেন যে, তারা শয়তানকে দেখেছে প্যাগানিনিকে বাজাতে সাহায্য করতে। শীঘ্রই কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তারা শিং এবং খুরওয়ালা প্যাগানিনির ডপেলগ্যাংগার বা তার মতো হুবহু দেখতে আরেক ব্যক্তিকে দেখেছিল। এই কথাও ছড়ায় যে, শয়তান একবার একটি পারফর্ম্যান্সের সময় প্যাগানিনির বেহালার ধনুকের শেষের দিকে বজ্রপাত করেছিল। এমনকি কেউ কেউ ভাবত, তিনি নিজেই শয়তান হতে পারেন। আবার অনেকে দাবি করতেন, তিনি নারীদের হত্যা করে তাদের আত্মাকে তার বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বন্দী করে রাখতেন!
একটি গুজব এমন ছিল যে, প্যাগানিনি একজন নারীকে হত্যা করে তার অন্ত্রকে বেহালার তার হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং যন্ত্রের মধ্যে তার আত্মাকে বন্দী করেছেন, আর মঞ্চে বাজানোর সময় তার বেহালা থেকে নাকি নারীদের আর্তনাদ শোনা যেত। এমনকি এই গুজবও ছিল যে, প্যাগানিনির মা তার আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করেছিলেন, যাতে তিনি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। সেসময় বেহালাকে কেউ কেউ শয়তানের যন্ত্র হিসেবে গণ্য করত, তাই সবমিলিয়ে, এটা আশ্চর্যজনক নয়। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে শয়তানের সাথে চুক্তি নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছুও ছিল না।
তার সম্পর্কে এসব অবিশ্বাসযোগ্য গুজব সত্য বা মিথ্যা, যা-ই হোক না কেন, এসবের কারণে তার খ্যাতি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং যেখানে সেখানে হয়রানিরও শিকার হন তিনি। তবে এখন ধারণা করা হয় যে, তার শারীরিক এরূপ গঠন হয়তো কিছু জেনেটিক ব্যাধির ফলাফল।
তার আঙুলের অস্বাভাবিক দৈর্ঘ্য, যা তাকে এক হাতে তিনটি অক্টেভ বাজাতে সক্ষম করেছিল, তা আসলে মারফান সিনড্রোমের কারণে হয়, যা একটি জিনগত ব্যাধি। আবার একইভাবে, অবিশ্বাস্য গতিতে তার বেহালা বাজানোর ক্ষমতা এহলার্স-ড্যানলোস সিনড্রোমের কারণে ঘটতে পারে। এই ব্যাধি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নমনীয়তা বৃদ্ধি এবং সমন্বয়ের অভাব সৃষ্টির জন্য দায়ী।
বেহালায় প্যাগানিনির দক্ষতা ছিল সত্যিই অতুলনীয়। তিনি প্রথম একক বেহালাবাদকদের মধ্যে একজন, যিনি শিট মিউজিক ছাড়াই, না দেখে সবকিছু মুখস্থ করে পারফর্ম করতেন এবং প্রতি সেকেন্ডে ১২টি পর্যন্ত নোট বাজাতে পারতেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তিনি যে সঙ্গীত রচনা এবং পরিবেশন করেছিলেন, তা বেহালার মাধ্যমে কী করা সম্ভব, সে সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তার অনন্য কৌশল, স্পেশাল ইফেক্ট এবং স্টেজে পারফর্মের শৈলী প্রায়ই তার শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে ফেলত।
একবার এক গির্জায় সন্ধ্যায় বাজানোর সময়, তার সঙ্গীতে বাইরের মানুষ এমন হৈচৈ সৃষ্টি করেছিল যে উপাসকরা গির্জার বাইরে জনতাকে শান্ত রাখতে ছুটে আসতে হয়। তবে তার এই প্রচণ্ড খ্যাতি তাকে আস্তে আস্তে চরম জুয়াড়ি, মদ্যপ এবং চরিত্রহীন ব্যক্তিতে পরিণত করে।
প্রাথমিক জীবন ও সঙ্গীতজীবন
প্যাগানিনির বাবা শিপিং ব্যবসায় ছিলেন, কিন্তু তিনি ম্যান্ডোলিনও বাজাতেন। ছোটবেলায় তিনি ছেলেকে বেহালা শেখান। মায়ের উচ্চাশা ছিল ছেলেকে কোনো একদিন বিখ্যাত বেহালাবাদক হিসেবে দেখবার।
প্যাগানিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ম্যান্ডোলিন বাজানো শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে বেহালা বাজানো শুরু করেন এবং ১১ বছর বয়সে জেনোভায় প্রথম জনপরিসরে বেহালা বাজান। ছোটবেলায় তার বাবার কাছে বেহালা শেখা ছাড়াও তিনি ওই সময়ের সেরা সঙ্গীত শিক্ষকদের কাছে শেখার সুযোগ পান। ১৩ বছর বয়সে প্যাগানিনিকে বিখ্যাত বেহালাবাদক ও শিক্ষক আলেসান্দ্রো রোলার কাছে অধ্যয়নের জন্য পাঠান হয়। রোলা তাড়াতাড়িই প্যাগানিনির প্রতিভা উপলব্ধি করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তাকে তার আর শেখানোর কিছু নেই। তাই তিনি প্যাগানিনিকে তার নিজের শিক্ষক ফার্দিনান্দো পেয়ারের কাছে পাঠান, যিনি আবার পরবর্তীতে তাকে তারও শিক্ষক গ্যাসপারো ঘিরেত্তির কাছে পাঠান।
প্যাগানিনি কঠোর প্রশিক্ষণের নিজস্ব সময়সূচীও নির্ধারণ করেছিলেন। কখনও কখনও দিনে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত তিনি অনুশীলন করতেন। তিনি তার নিজের কম্পোজিশনগুলো অনুশীলন করতেন, যা প্রায়ই বেশ জটিল ছিল, এমনকি তার নিজের জন্যও।
তরুণ প্যাগানিনি স্পষ্টতই একজন মিউজিক্যাল প্রডিজি ছিলেন। যখন তার বয়স ১৫ বছর, তখন থেকে তিনি একাকী ভ্রমণ শুরু করেন। কিন্তু এই অকাল স্বাধীনতায় তার জীবন আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। তখন তিনি একসময় শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং অতিরিক্ত মদ্যপান ও জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন।
তবে পরবর্তীতে তিনি লুকাতে ফিরে আসলে নেপোলিয়নের বোন রাজকুমারী এলিসা বাকিওচির অনুগ্রহ অর্জন করেন এবং রাজপ্রাসাদে বেহালাবাদকের অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু একসময় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন এবং ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করেন। তার বাজানোর তীব্রতা বা সংবেদনশীলতা দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতে শুরু করেন এবং বলা হয় যে, শ্রোতারা তার দুঃখের সংগীতে অনেক সময় কান্নায় ভেঙে পড়তেন। স্টেজে তার লোক টানার ক্ষমতা এবং শোম্যানশিপ ছিল অনবদ্য। তিনি একটি বা দুটি বেহালার স্ট্রিং কেটে বাকিগুলো দিয়ে বাজানোর মতো কৌশলও আয়ত্ত করেছিলেন।
১৮২৭ সালে পোপ দ্বাদশ লিও দ্বারা প্যাগানিনিকে ‘নাইট অফ গোল্ডেন স্পার’ উপাধি দেয়া হয়। এই উপাধি ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে যারা বিশেষ অবদান রাখে অথবা যারা গির্জার গৌরবের জন্য কাজ করে, তাদের প্রদান করা হয়।
পুরো ইতালির চারপাশে কনসার্ট করার পর প্যাগানিনির খ্যাতি দেশের বাইরেও ছড়াতে শুরু করে। ১৮২৮ সালের মধ্যে, তিনি পুরো ইউরোপ জুড়ে দুর্দান্ত সাফল্যের সাথে পারফর্ম করে বেড়ান। তাঁর নিজস্ব বেহালা বাজানোর কৌশল নজর কাড়ে অনেকের।
তবে জুয়া, মদ্যপানের আসক্তি এবং নারীঘটিত কেলেঙ্কারি তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। একসময় এসবের ফলে তার সম্পদ কমতে কমতে ঋণের বোঝায় তিনি জর্জরিত হয়ে পড়েন। এমনও সময় আসে, যখন তিনি ঋণের বোঝা মেটাতে বেহালা বন্ধক দিতে বাধ্য হন। একটি কনসার্ট পারফর্মের জন্য প্যাগানিনিকে তখন গুয়ার্নেরি নামক এক ধনী বণিক তার বেহালা ধার দেন, যেটি তিনি প্যাগানিনির বেহালা শোনার পর তাকে একেবারে দিয়ে দেন।
প্যাগানিনির বিখ্যাত কিছু কম্পোজিশন
প্যাগানিনির সর্বশ্রেষ্ঠ কম্পোজিশন বললে সবার আগে ক্যাপ্রিসি নং ২৪ ইন এ মাইনর (24 Caprices for Solo Violin) এর কথা উঠে আসে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ, ক্যাপ্রিসি নং ২৪ সম্ভবত ১৮০১ থেকে ১৮০৭ এর মধ্যে লেখা। এই কাজ বেহালা বাজানোর আধুনিক স্ট্রিং কৌশল, যেমন- বো বাউন্স, লেফট হ্যান্ড পিজিক্যাটো এবং হারমোনিক্সকে জনপ্রিয় করে তোলে।
এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য আরও কিছু কাজ হচ্ছে-
- ভায়োলিন কনসার্টো নং ১ (Violin Concerto No. 1,1818)
- মোজেস ফ্যান্টাসি (Moses Fantasy,1818)
- ভেরিয়েশনস অফ গড সেভ দ্য কিং (Variations on God Save the King, 1829)
- শেন্টোন ডি সোনেট, ভলিউম ১ (Centone di Sonate, Vol. 1, 1828-29)
- মোটো পার্পেচুয়ো (Moto perpetuo, 1835)
সিনেমায় প্যাগানিনি
২০১৩ সালে বার্নার্ড রোজ প্যাগানিনির জীবন নিয়ে ‘The Devil’s Violinist’ সিনেমা নির্মাণ করেন, যেখানে ১৮৩০ এর দিকে তার ক্যারিয়ারের শীর্ষের দিকের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। সিনেমাটি যদিও ক্রিটিকদের নিকট ততটা ইতিবাচক মূল্যায়ন পায়নি, তবুও এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে এর অভিনেতা। প্যাগানিনির চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেভিড গ্যারেট (David Garrett), যিনি বাস্তব জীবনেও একজন দুর্দান্ত বেহালাবাদক। বলা হতো, প্যাগানিনি প্রতি সেকেন্ডে ১২টি নোট বাজাতে পারতেন, আর এই কৃতিত্ব পরে তার চরিত্রে অভিনয় করা বেহালাবাদক ডেভিড গ্যারেট অর্জন করতে পেরেছিলেন!
জীবনের শেষাংশ
উজ্জ্বল-জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের শেষদিকে অসুস্থতায় জর্জরিত এক নীরব সমাপ্তি এই মহিমান্বিত সঙ্গীতজ্ঞের ভাগ্যে জোটে।
১৮২২ সালের দিকে প্যাগানিনির স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হতে শুরু করে এবং একসময় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সিফিলিস ধরা পড়লে তাকে পারদ এবং আফিম দিয়ে নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হিতে বিপরীত হয় এবং তার স্বাস্থ্য আরও খারাপের দিকে চলে যায়। ১৮৩৪ সালের দিকে যক্ষ্মাসহ আরও কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। অবশেষে দুর্বল হয়ে তিনি ৫৪ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন এবং ফ্রান্সের নিস নামক জায়গায় ভায়োলিন শেখানোর দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৮৪০ সালের ২৭ মে, ফ্রান্সের নিসে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই বিখ্যাত বেহালাবাদক মৃত্যুবরণ করেন।