গোলগাল চেহারার মায়াবী ছেলেটার বয়স কতই বা হবে তখন? বড়জোর দশ-বারো বছর। এতটুকুন ছেলেকে নাকি এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে! কথাটা বার বার মনে পড়তেই বালকের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। ডান হাতের তালু দিয়ে বার বার চোখের জল মুছে নিচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পরেই তার সামনে দিয়ে তার বাবাকে হাতকড়া পরিয়ে একজন পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গেলো। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। তার কাছে এই দৃশ্য অসহ্য লাগছে। একে একে মা, চাচাসহ পরিবারের বাকি সদস্যদেরও হাতে হাতকরা পরানো হলো। শুধু পরিবারের দ্বিতীয় ছেলে চার্লস এবং তার বোনকে রেহাই দেয়া হলো।
এই দুজনকে পেছনে ফেলে কারাগারের দিকে ছুটে গেলো পুলিশের প্রিজন ভ্যান। সেদিকে একপলক তাকিয়ে থাকলো চার্লস আর তার বোন ফ্রান্সিস। পুলিশের গাড়িগুলো দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই দুজন মিলে ঘরের ভেতর চলে আসলো। তারপর হঠাৎ নিজের কক্ষের দিকে ছুটে গেলো চার্লস। সেখানে বিছানার পাশে রাখা স্কুল ব্যাগের দিকে চোখ পড়লো তার। ক্রোধান্বিত চার্লস ব্যাগ থেকে একটি করে বই বের করে দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে থাকলো। আজ থেকে তার আর কোনো স্কুল নেই। তাই এসব বইয়ের প্রয়োজনও নেই।
সেদিন সারাদিন অভুক্ত থাকলো দুজন। কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অস্থির হয়ে পড়লো তারা। ক্ষিধের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। একটু কিছু মুখে না দিলে বুঝি মরেই যাবে। শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়ালো চার্লস। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পরিষ্কার হয়ে নিলো সে। বড়দিনে বাবার উপহার দেয়া ছোট কোটখানা গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো এবার। নোংরা লণ্ডনের পথে-ঘাটে ঘুরতে থাকলো সে। দোকানে দোকানে গিয়ে অসহায় চার্লস আবেদন করে, “জনাব, আমার একটি চাকরি দরকার। আপনি যা বলবেন,তা-ই করতে রাজি আছি আমি।” অনেকেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো তাকে। কিন্তু চার্লস হাল ছাড়লো না। তার হার মানলে চলবে না। কারণ, সে চার্লস ডিকেন্স। হার মানার জন্য তার জন্ম হয়নি।
ডিকেন্স পরিচিতি
ভিক্টোরিয়ান যুগে ইউরোপের সাহিত্যে এক নতুন বিপ্লবের নাম চার্লস ডিকেন্স। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, সচিত্র প্রতিবেদক এবং সমালোচক ছিলেন। তবে চার্লস ডিকেন্সকে ইতিহাস মনে রাখবে তার অসাধারণ লেখনীর জন্য। ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘অ্যা ক্রিস্টমাস ক্যারল’, ‘নিকোলাস নিকলবি’, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অ্যা টেল অফ টু সিটিস’ এবং ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন’- এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা ডিকেন্সকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
তার উপন্যাসের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজে খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ এবং সামাজিক অসঙ্গতির চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে সাধারণ বন্ধুত্ব কিংবা প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্বাসরুদ্ধ উপন্যাস উপহার দেয়ার জন্যও তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় সাহিত্যিক। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তিনি। এমনকি একবিংশ শতাব্দীর লাইব্রেরিগুলোতেও ডিকেন্সপ্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
বিখ্যাত সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের জন্ম ১৮১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ শহরে। বাবা জন ডিকেন্স এবং মা এলিজাবেথ বারো এর আট সন্তানের সংসারে চার্লস দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। ডিকেন্সরা পারিবারিক দিক থেকে অসচ্ছল ছিলেন। জন ডিকেন্স কঠোর পরিশ্রম করতেন পরিবারের ভাগ্য বদলানোর জন্য, কিন্তু কোনোভাবেই তাদের অবস্থার উন্নতি হলো না। জনের নিকট পোর্টসমাউথ শহরকেই অভিশপ্ত লাগতে থাকে। তাই ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সপরিবারে কেন্টের চাথাম শহরে গমন করলেন। নতুন শহরে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করলেন তারা। শহরের রাস্তায় মুক্তভাবে চলাফেরা করতেন তিনি। মাঝে মাঝে রোচেস্টারের প্রাচীন প্রাসাদে ঘুরতে যেতেন ভাইবোনদের সাথে। মনে হচ্ছিলো এবার বুঝি ভাগ্য ফিরলো ডিকেন্সদের। কিন্তু চাথামেও স্থায়ী হতে পারলেন না তারা। ফলে ১৮২২ সালে লণ্ডনে স্থানান্তরিত হন তারা। চার্লস ডিকেন্সের শৈশবটুকু লণ্ডনেই কাটে। কিন্তু নতুন শহরে আরো বড় ঝামেলায় ফেঁসে গেলেন জন ডিকেন্স। ফলে শৈশবের আনন্দে ইস্তফা দিয়ে জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন কিশোর চার্লস।
শৈশবের দুর্দিন
লণ্ডনের দরিদ্র পল্লীতে নতুন বসতি স্থাপন করেন জন ডিকেন্স। অর্থাভাবে নিরুপায় হয়ে তিনি প্রতিবেশীদের নিকট থেকে বেশ কিছু টাকা ঋণ করেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার পরেও তিনি অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হন। পাওনাদাররা রেগে গেলো। এভাবে আর কয়দিন? এবার তারা জনের নামে মামলা ঠুকে দিলো। মামলায় জন এবং তার পুরো পরিবারকে আসামী করা হলো। কয়দিন বাদে ডিকেন্সের বাড়ির সামনে পুলিশ এসে হাজির হলো। বেচারা ডিকেন্স অসহায় আত্মসমর্পণ করেন। ১৮২৪ সালে জন ডিকেন্স এবং তার পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
মা-বাবা বিহীন চার্লস জীবিকার তাগিদে চাকরি খুঁজতে থাকেন। শেষপর্যন্ত টেমস নদীর ধারে এক জুতার কালির কারখানায় কাজ জুটে যায়। সপ্তাহে ছয় শিলিং করে পেতেন তিনি। এই অর্থ দিয়ে কোনোমতে দু’বেলা খেয়ে দিন গুজরান করতে থাকেন তিনি। তার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন খুব ভোরে কাজে বেরিয়ে পড়তেন চার্লস। ফিরতেন বেশ বেলা করে। শৈশবের এই সংগ্রাম চার্লসের মনস্তাত্ত্বিক জগতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। চার্লস ডিকেন্স তার আত্মজীবনীতে তার শৈশব সম্পর্কে মন্তব্য করেন,
“এত কম বয়সে আমি কীভাবে লড়াই করতে পেরেছি, তা ভাবতেই অবাক লাগে। আমার মা-বাবা আমার অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলতেন। তারা সন্তুষ্ট ছিলেন বটে। কিন্তু আমার পুরো জগতটা তছনছ হয়ে গিয়েছিলো। সবাই কেমন যেন করুণার দৃষ্টিতে তাকাতো। এখন আমি খুব বিখ্যাত। জীবনটাও বেশ চলছে। আমি তো মাঝে মাঝে ভুলেও যাই যে আমার একজন স্ত্রী আছে, আমি একজন পারিবারিক মানুষ। হঠাৎ করে আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে, সেই দুর্বিষহ অতীতে!”
চার্লস ডিকেন্স প্রতি সপ্তাহে একবার কারাগারে মা-বাবাকে দেখতে যেতেন। সমাজে অবহেলিত চার্লস খুব দ্রুত সমাজের কঠিন বাস্তবতা এবং অসঙ্গতির সাথে পরিচিত হন। পরবর্তীতে তিনি এই অসঙ্গতিকে তার উপন্যাসে স্থান দেন। তার লেখনীর মাধ্যমে আমরা বারবার দরিদ্র নিপীড়িত সমাজব্যবস্থার মুখোমুখি হই।
রূপকথার গল্পের মতো চার্লসের দুঃসময়ের সমাপ্তি ঘটে। একদিন জন ডিকেন্স জানতে পারেন, তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রামের বাড়ি থেকে বেশ কিছু অর্থ লাভ করেছেন। সেই অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে মুক্তি লাভ করেন তিনি। চার্লসেরও কালির কারখানার কাজ ছেড়ে নতুন করে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ আসে। কিন্তু জন ডিকেন্স খুব দ্রুত সেই অর্থ খরচ করে ফেলেন। ফলে পুনরায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু চার্লস আরেকবার তার বাবাকে হারাতে চান না। ১৫ বছর বয়সে ডিকেন্স শিক্ষাজীবনে ইতি টানেন। নতুন করে অফিসের পিয়ন হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এখানে কর্মরত অবস্থায় ডিকেন্সের সাহিত্যিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে।
সাংবাদিক ডিকেন্স এবং লেখালেখির হাতেখড়ি
১৮৩২ সালে চার্লস ডিকেন্স পিয়নের কাজ ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন। লণ্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ছবি স্কেচ করা শুরু করেন তিনি। ফাঁকে ফাঁকে দু’চার পাতা লিখতেও থাকেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, চার্লস স্কেচের নিচে ছদ্মনামে স্বাক্ষর করতে থাকেন। তার সকল স্কেচের নিচে ‘বোজ’ বা ‘Boz’ নামে স্বাক্ষর করা থাকতো। ১৮৩৬ সালে চার্লস ডিকেন্স তার স্কেচগুলো একত্র করে বই আকারে প্রকাশ করেন ‘দ্য স্কেচেস বাই বোজ‘ নামে। বই বিক্রির মাধ্যমে চার্লস ডিকেন্স বেশ কিছু অর্থ লাভ করেন। তার আর্থিক অবস্থার সামান্য উন্নতি ঘটে।
চার্লস এবার সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন। ক্যাথেরিন হোগার্ট নামক এক নারীর প্রেমে পড়েন তিনি। তারা দ্রুত বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের পর যেন নতুন চার্লসের জন্ম হয়। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। তিনি এবার পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিলেন। লণ্ডনের একটি পত্রিকায় ছাপা হলো চার্লস ডিকেন্স রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস ‘The Posthumous Papers of the Pickwick Club’। গল্পের নাম দেখেই যেন পাঠকরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রথম পর্ব পড়ার পর পাঠকরা অভিভূত হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর খুব দ্রুত সবগুলো কপি বিক্রি হয়ে গেলো। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, সবাই চার্লস ডিকেন্সের গল্প পড়তে চায়। ডিকেন্সের মূলনীতি ছিল- “পাঠকদের হাসাও, পাঠকদের কাঁদাও এবং তাদের অপেক্ষা করাও।” ডিকেন্সের লেখার ধরন সাহিত্যে এক নতুন মাত্রার সৃষ্টি করলো। ১৮৩৭ সালে The Posthumous Papers of the Pickwick Club সর্বাধিক পঠিত ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে নির্বাচিত হয়।
চারদিক থেকে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন তিনি। ধারাবাহিকের সাফল্যে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন চার্লস ডিকেন্স। একটি পত্রিকার সম্পাদকের চাকরিও লাভ করেন। ‘Bentley’s Miscellany’ নামক পত্রিকায় সম্পাদক থাকাকালীন চার্লস ডিকেন্স নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস রচনা শুরু করেন। এক অনাহারী অনাথ বালককে নিয়ে রচিত সেই ধারাবাহিকের নাম দেন ‘অলিভার টুইস্ট’। ভিক্টোরিয়ান যুগে ইংরেজি উপন্যাসের ইতিহাসে এর পূর্বে কখনো কোনো বালককে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। ১৮৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অলিভার টুইস্টের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। কিশোর অলিভারের মাঝে চার্লসের শৈশবের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠে। প্রায় দু’বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসের খ্যাতি ইংল্যাণ্ডের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের পাঠক সমাজেও জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘অলিভার টুইস্ট’। ১৮৩৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি।
ধারাবাহিক উপন্যাসে সফলতার পর থেমে যাননি চার্লস। কারণ, তিনি আরো গল্প বলতে চান। সেই উদ্দেশ্যে নতুন করে লিখতে বসেন তিনি। একে একে রচনা করেন ‘নিকোলাস নিকলবি (১৮৩৮-৩৯)’, ‘দ্য ওল্ড কিউরিসিটি শপ (১৮৪০-৪১)’, ‘বারানাবি রিজ (১৮৪১)’ শিরোনামে তিনটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক উপন্যাস। লেখালেখির জগতে অভিষেকেই বাজিমাত করে ফেলা চার্লস ডিকেন্সের নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপ এবং আমেরিকায়। জীবনের পরবর্তী পর্বে চার্লসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা, যার নাম ‘যুক্তরাষ্ট্র’।
যুক্তরাষ্ট্রে অবকাশ যাপন
১৮৪২ সালে পাঁচ মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান চার্লস ডিকেন্স এবং তার স্ত্রী। সেদেশের পাঠক সমাজ তাকে বিশাল সংবর্ধনার মাধ্যমে বরণ করে নেয়। অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ করলেও চার্লস সেখানে বেশ কয়েকটি লেকচারের আয়োজন করেন। ভার্জিনিয়ায় থেকে শুরু করে মিসৌরি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কয়েকটি লেকচারে তিনি বার বার দাসপ্রথার বিরোধিতা করে সচেতনতার আহ্বান করেন। তার লেকচারে এত বিশাল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে যে, স্বয়ং আয়োজকদেরও লেকচার হলের বাইরে দাঁড়িয়ে লেকচার শুনতে হয়েছিলো। বিখ্যাত লেখক জে বি প্রিস্টলির মতে, “আমেরিকার ইতিহাসে অন্য কাউকে এত শ্রদ্ধার সাথে স্বাগতম জানানো হয়েছে কিনা আমার জানা নেই”।
ডিকেন্স নিজেও অভিভূত ছিলেন। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, “আমাকে তারা যেভাবে ঘিরে রেখেছিলেন, মনে হচ্ছিলো আমি কোনো তারকা।” যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন- ‘American Notes’ এবং ‘Martin Chuzzlewit’। দেশে ফিরে যেন চার্লস ডিকেন্স নতুনভাবে জ্বলে উঠলেন। নতুন দুটি গ্রন্থ রচনার পর তিনি একটি নতুন উপন্যাস রচনা করেন। ‘অ্যা ক্রিস্টমাস ক্যারল‘ শিরোনামের নতুন উপন্যাসটি ছিল সেবারের বড়দিনে পাঠকদের প্রতি ডিকেন্সের উপহারস্বরূপ। পরবর্তীতে চার্লস ইতালি ভ্রমণ করেন। দেশে ফিরে তিনি ধারাবাহিক উপন্যাসের বদলে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনার কাজ হাতে নেন।
উপন্যাসের জগতে বিপ্লব
চার্লস ডিকেন্স তার ধারাবাহিক উপন্যাসগুলোর জন্য হয়তো বড়জোর কয়েক যুগ পর্যন্ত পাঠকদের নিকট জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারতেন। চার্লস নিজেও তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই এবার তিনি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনায় নজর দেন। প্রথমেই বের করেন ‘Dealings with the Firm of Dombey and Son’ নামক উপন্যাস। তৎকালীন লণ্ডনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি সামাজিক গল্পকে শৈল্পিক স্পর্শের দ্বারা জীবন্ত উপাখ্যানে রূপ দেন চার্লস। পাঠক সমাজ এবারও তাকে হতাশ করেনি। দেশের বিখ্যাত বইমেলাগুলোতে তার বইয়ের লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়ে যায়।
পাঠকরা যখন নতুন উপন্যাস পড়ায় ব্যস্ত, তখন কিন্তু চার্লস বসে থাকেননি। তিনি একের পর এক উপন্যাস লেখতে থাকেন। পরবর্তী কয়েক বছরে তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘ব্লিক হাউস’, ‘হার্ড টাইমস’, ‘অ্যা টেল অফ টু সিটিস’ এবং ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন’- এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকদের মনে পাকাপাকিভাবে আসীন হন চার্লস। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেতে থাকে উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রে। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ উপন্যাসের ‘উইলকিনস মিকাওবার’ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি তার ঋণগ্রস্ত পিতার ছবি ফুটিয়ে তুলেন। হয়তো এই কারণেই ডেভিড কপারফিল্ডের প্রতি চার্লসের সামান্য দুর্বলতা ছিল। যদি চার্লসকে প্রশ্ন করা হতো,“আপনার লেখা সেরা উপন্যাস কোনটি?” তিনি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতেন, “অবশ্যই ডেভিড কপারফিল্ড।” যদিও সাহিত্য সমালোচকগণ তার সাথে একমত নন। তাদের দৃষ্টিতে ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন’ ছিল চার্লসের সেরা উপন্যাস। তিনি সর্বমোট পনেরটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
অন্যরকম চার্লস
সব লেখকের মতোই কাগজ-কলমের বাইরে চার্লস ডিকেন্সের ভিন্ন আরেকটি জগত আছে। তার সেই ব্যক্তিগত জগতের সাথে আমরা খুব বেশি একটা পরিচিত নই। সাধারণ মানুষের ন্যায় চার্লসেরও একটি সংসার ছিল। স্ত্রী আর দশ সন্তান নিয়ে জীবনযাপন করতেন তিনি। তবে শেষপর্যন্ত তাদের সংসারে ভাঙন ধরে। ১৮৫৮ সালে পারস্পরিক সম্মতিতে স্ত্রী ক্যাথেরিনকে তালাক প্রদান করেন চার্লস ডিকেন্স। বিচ্ছেদের পর পুনরায় নতুন করে প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। এলেন টারনান নামক এক অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি।
ডিকেন্স লেখক হিসেবে যতই সাহসী হন না কেন, তিনি কিন্তু বাস্তব জীবনে ভূতকে মারাত্মকভাবে ভয় পেতেন। তিনি ভূত-প্রেত নিয়েও কাজ করেছেন। ‘The Ghost Club‘ নামক একটি সংঘের নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি সম্মোহনবিদ্যাতে আগ্রহী ছিলেন। একবার নিজের অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সম্মোহনবিদ্যার প্রয়োগ করেছিলেন বলে জানা যায়। এদিক থেকে ডিকেন্স একজন মজার মানুষ ছিলেন। পাঠকরা হয়তো জানেন না, ডিকেন্স অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। একবার ড্যানিশ লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ডিকেন্সের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি ডিকেন্সের বাড়িতে পাঁচদিন অবস্থান করেন। পঞ্চমদিন তিনি বিদায় নেয়ার পর ডিকেন্স রসিকতা করে অতিথি কক্ষের আয়নায় বড় করে লিখেছিলেন, ‘এখানে হ্যান্স পুরো পাঁচদিন যাবৎ ছিলেন। যেটা আমার কাছে কয়েক জনমের মতো অসহ্য মনে হয়েছে।’ এমন মজার মানুষের বাড়িতে একবার অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ পাওয়া মন্দ নয়!
একসময়ের আঁকিয়ে ডিকেন্স লেখক জীবনে তার অঙ্কন প্রতিভাকে কাজে লাগান নিজের বাড়ির নকশা তৈরির পেছনে। ঘরের অভ্যন্তরীণ নকশার ব্যাপারেও বেশ মনোযোগী ছিলেন তিনি। প্রায়ই ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। প্রতি মাসেই একবার করে নতুনভাবে সাজাতেন সেগুলো। শোবার ঘরে সবসময় নিজের মাথা উত্তরমুখী করে ঘুমাতেন। তিনি শখের বশে একটি দাঁড়কাককেও পোষ মানিয়েছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি অভিনয়ের মঞ্চেও নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি ডিকেন্স। অগত্যা তিনি অভিনয় ছেড়ে লেখালেখিতে মনোযোগ দেন। ভাগ্যিস তিনি অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন! আপনারা জেনে অবাক হবেন, একবার ব্রিটিশ দশ পাউণ্ড নোটে চার্লস ডিকেন্সের ছবি ব্যবহৃত হয়েছিলো। চার্লসের প্রথম উপন্যাসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে স্মারক নোট হিসেবে তা বাজারে ছাড়া হয়েছিলো।
বিদায় চার্লস
১৮৬৫ সালে এক রেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন চার্লস ডিকেন্স। সেবার একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার পর আর কখনও সুস্থ হতে পারেননি ডিকেন্স। অসুস্থতার দরুন লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ডিকেন্স বেশিদিন লেখালেখি ছেড়ে বিশ্রাম নিতে পারেননি। পাঠকদের ভালোবাসায় তিনি অসুস্থ অবস্থাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যান। পাঠ করে শোনান তার উপন্যাসগুলো। এমনকি নতুন করে শুরু করেন উপন্যাস লেখা। কিন্তু ‘দ্য মিস্ট্রি অফ এডউইন ড্রুড’ নামক উপন্যাসটি শেষ করতে পারেননি তিনি। ১৮৭০ সালের ৯ জুন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন লেখক চার্লস ডিকেন্স।লেখকের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে বিভিন্ন বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাথে সম্মানের সহিত সমাধিত করা হয়। তার শেষকৃত্যে লাখো ভক্তের সমাগম হয়। তার মৃত্যু উপলক্ষ্যে ইংল্যাণ্ডে জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়।
প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা কিশোর চার্লস ডিকেন্স একদিন পৃথিবী জয় করেছিলেন। অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি কোটি পাঠকের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। হাজারো মানুষের নিকট চার্লস ডিকেন্স এক অনুপ্রেরণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি পার্থিব জগতে মৃত্যুবরণ করলেও, তার কর্মের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। অলিভার টুইস্টের সেই অনাথ অলিভারের পথচলাতে তিনি বারবার ফিরে আসবেন আমাদের নিকট।
ফিচার ইমেজ: The Big Issue