বড় চকের টুকরোটা সোজা ছুটে এসে একদম পেছনের বেঞ্চে বসা ছেলেটার কপালে গিয়ে আঘাত করলো। কপাল দু’হাতে চেপে আর্তনাদ করে উঠলো ছেলেটি। হঠাৎ করে ক্লাসরুমের বাকি ছাত্ররা ভয়ে চুপ হয়ে গেলো। ক্লাসের সামনে দাঁড়ানো শিক্ষক রাগে গজ গজ করতে লাগলেন। হুংকার দিয়ে ডাকলেন ছেলেটাকে। তাকে আদেশ করলেন চকের টুকরোটা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে। বহু কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলো ছেলেটি। এরপর মেঝে থেকে চকের টুকরোটি কুড়িয়ে নিয়ে শিক্ষকের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। তার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
শিক্ষক কড়া গলায় আদেশ দিলেন বোর্ডে নিজের নাম লেখার জন্য। গুটি গুটি অক্ষরে ছেলেটি নিজের নাম লেখলো। এরপর গম্ভীর গলায় শিক্ষক নাম উচ্চারণ করতে বললেন। এবার ছেলেটি মাথা নিচু করে ফেললো। শিক্ষক আবার ধমক দিয়ে উঠলেন। ভয় পেয়ে গেল ছেলেটি। এরপর খুব নিচুস্বরে নিজের নাম উচ্চারণ করলো। কিন্তু ক্লাসের কেউই বুঝতে পারলো না। শিক্ষক বললেন আরো উঁচুস্বরে নাম উচ্চারণ করতে। ছেলেটি কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় থাকার পর স্পষ্ট গলায় বলে উঠলো, “F-A-R-A-D-A-Y, ফাওয়াডে”। পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো। শিক্ষক তার মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। “নিজের নামটাও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারিস না? এ কেমন ছাত্র তুই!” হাতের বেত দিয়ে প্রহারের মাধ্যমে জখম করে ফেললেন ছেলেটিকে। ব্যথার তীব্রতায় মাটি থেকে উঠে বসতেও পারছিলো না ছেলেটি।
Neil deGrasse Tyson-এর বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘Cosmos: A Spacetime Odyssey‘-এর দশম পর্বে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের গল্পের শুরুটা ঠিক এভাবেই চিত্রায়িত হয়েছিলো। সেদিনের ক্লাসরুমের সেরা ছাত্রকে ডেকে যদি কেউ বলতো, ক্লাসের নির্বোধ ফ্যারাডে একদিন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হবে, তাহলে নিশ্চিত তার কথা সবাই হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে কালের আবর্তে সেই নির্বোধ শিশু ফ্যারাডেই একদিন হয়ে উঠলেন বিশ্বজয়ী বিজ্ঞানী। আজকে আমাদের গল্প সেই ফ্যারাডেকে নিয়ে।
জন্ম এবং শৈশব
১৭৯১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের নিউইংটন বাটস অঞ্চলে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। কামার পিতা এবং গৃহিণী মাতার চার সন্তানের সংসারে ফ্যারাডের অবস্থান তৃতীয়। জন্মের পর থেকেই অভাবের সাথে যুদ্ধ শুরু হয় ফ্যারাডের। প্রায়ই তাকে অনাহারে দিন পার করতে হতো। তার পিতা শারীরিকভাবে মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। দিনের পুরোটা সময়ই তার মেজাজ থাকতো তিরিক্ষি। কিন্তু ফ্যারাডের মা সবসময় তাকে সঙ্গ দিতেন। মাঝে মাঝে সামান্য একটি রুটি দিয়ে পুরো সপ্তাহ পার করতে হতো ফ্যারাডের।
একটু বড় হওয়ার পর ফ্যারাডেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ফ্যারাডে পড়াশোনায় দুর্বল ছিলেন। এমনকি তিনি সঠিকভাবে ইংরেজি ‘R’ উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাকে নিয়ে স্কুলে প্রায়ই বন্ধুরা হাসি-তামাশা করতো। তবুও মায়ের উৎসাহে স্কুল যাওয়া বন্ধ করেননি ফ্যারাডে। মায়ের স্বপ্ন তার ছেলে শিক্ষিত হয়ে পরিবারের অভাব দূর করবে।
কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হলো না। ফ্যারাডের বয়স তখন ১৩। শুকনো রুটি পানিতে ভিজিয়ে নরম করে নাস্তা করছিলেন ফ্যারাডে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। ঠিক তখন মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন। সন্তানের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে জানালেন, আজ থেকে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। অভাবের তাড়নায় চাকরি খুঁজতে হবে ফ্যারাডেকেও। ভদ্র ছেলের মতো স্কুলের পোশাক খুলে ফেলেন ফ্যারাডে। এরপর ময়লা একটা জামা পরে রওয়ানা দেন কাজের সন্ধানে। খুব দ্রুত তার চাকরি হয়ে যায় স্থানীয় এক বইয়ের দোকানে।
বইয়ের সাথে পরিচয়
প্রথমদিকে ফ্যারাডে বুক ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মালিক তাকে বুক বাইণ্ডারের পদে উন্নীত করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরাতন বই নেড়েচেড়ে দেখতেন তিনি। একদিন তার কাছে বেশ বড় বড় কিছু বই বাঁধাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেগুলো ছিল ‘Encylcopedia Britannica‘ এর তৃতীয় সংস্করণ। ফ্যারাডে একটি বই হাতে নিয়ে মাঝখান থেকে পড়া শুরু করলেন। এই বই পড়েই তিনি বিদ্যুৎ সম্পর্কে জানতে পারেন। ব্যাপারটা তার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হলো। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী Jane Marcet রচিত ‘Conversations on Chemistry‘ বইটি পড়েন তিনি।
তিনি সারাদিন কাজ করতেন আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে বই নিয়ে বসতেন। সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর ভাবতেন। একদিন ঠিক করলেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো খতিয়ে দেখবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। হাতের কাছে যা পেতেন তা দিয়েই বিভিন্ন পরীক্ষা করতেন। ফ্যারাডের বিজ্ঞানী হওয়ার যাত্রার শুরুটা এখান থেকেই।
এর কিছুদিন পর ফ্যারাডে শহরে যান। সেখানে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন, সামনের সপ্তাহে বিজ্ঞানী জন টেটাম পদার্থবিজ্ঞানের উপর একটি লেকচারের আয়োজন করবেন। টিকিটের মূল্য মাত্র ১ শিলিং। কিন্তু ফ্যারাডের পক্ষে ১ শিলিং খরচ করার মতো সামর্থ্য ছিল না। সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকলেন তিনি। রাতে তার বড় ভাইয়ের কাছে সবকিছু খুলে বলেন। তিনি ফ্যারাডেকে অনেক স্নেহ করতেন। নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে ফ্যারাডেকে একটি শিলিং প্রদান করলেন। জন টেটামের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে ফ্যারাডের মাথায় বিজ্ঞানী হওয়ার নেশা চেপে বসলো।
হামফ্রে ডেভির সাথে পরিচয়
বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি ছিলেন তৎকালীন অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তিনি রয়্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষণা করতেন। ফ্যারাডের দোকানের একজন নিয়মিত খদ্দের ছিলেন উইলিয়াম ড্যান্স নামক এক ব্যবসায়ী। তিনি ফ্যারাডের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে হামফ্রের লেকচারের টিকিট উপহার দেন।
ফ্যারাডে এই সুযোগ লুফে নেন। হামফ্রে ডেভির চারটি লেকচারে অংশ নেন তিনি। হামফ্রে ডেভির লেকচারের বিষয়বস্তু ছিল ‘অম্লতা’ নিয়ে। এর কিছুদিন আগে ডেভি অক্সিজেনের সাথে অম্লতার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্যারাডে মনোযোগ দিয়ে তার বক্তৃতা শুনতেন আর খাতায় লিখতেন।
ফ্যারাডে বইয়ের দোকানের পেছনে একটি ছোট গবেষণাগার গড়ে তুলেন। ডেভির তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। নির্বোধ ফ্যারাডের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। কয়েক মাসের ভেতর তিনি প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্র তৈরি করে ফেলেন। সেগুলো সুন্দর করে বাঁধাই করে ডেভির নিকট প্রেরণ করেন তিনি। তখন ফ্যারাডে এবং ডেভি দুজনের জীবনেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এই দুর্ঘটনাই দুজনকে একত্রিত করে।
ফ্যারাডের দোকানের মালিকানা বদল হয়। নতুন মালিক ফ্যারাডের সাথে অত্যন্ত রুক্ষ ব্যবহার করতেন। তার কাজের চাপ বেড়ে যায়। ফ্যারাডে বুঝতে পারলেন তার পক্ষে আর এখানে কাজ করা সম্ভব নয়।
অপরদিকে ডেভির গবেষণাগারে গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। তার হাতের বেশ কয়েক জায়গা পুড়ে যায়। ডাক্তার তাকে লেখালেখি করতে বারণ করে দেন। বিপাকে পড়ে যান ডেভি। তিনি তার গবেষণাপত্র লেখার কাজে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন। ফ্যারাডে দেরি না করে এই পদে আবেদন করেন। এর আগে ফ্যারাডের গবেষণাপত্র দেখে ডেভি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ফ্যারাডেকে তার লেখক হিসেবে চাকরি দেন।
পরবর্তীতে ফ্যারাডে ডেভির ল্যাব সহকারী হিসেবে চাকরি লাভ করেন। বই বাঁধাইয়ের সুঁই-সুতা ফেলে ফ্যারাডে চলে আসলেন রয়্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে।
গবেষণাগারে ফ্যারাডে
১৮১৩ সালের ১ মার্চ ফ্যারাডে রয়্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে যোগ দেন। অবাক চোখে ফ্যারাডে গবেষণাগারের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ধরে দেখতে লাগলেন। নতুন কিছু জানার নেশায় তার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। নতুন কর্মস্থলে ফ্যারাডের বেতন ছিল পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। ফ্যারাডের জীবন থেকে দারিদ্রের অভিশাপ শেষপর্যন্ত পিছু ছাড়লো।
ডেভির সাথে হাতেকলমে কাজ শিখতে লাগলেন ফ্যারাডে। ফ্যারাডে সারাদিন ব্যয় করতেন গবেষণাগারের কাজে। তিনি একবার দুর্ঘটনায় পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তার পরেও দমে যাননি তিনি। চাকরিতে যোগদান করার সাত মাসের মাথায় ডেভি ফ্যারাডেকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল তার নতুন ‘Theory of Volcanic Movement’-এর সত্যতা যাচাই করা।
এই ভ্রমণকে ফ্যারাডের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ভ্রমণে ফ্যারাডে প্রত্যক্ষভাবে অনেক নামকরা বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করেন। এই প্রথম খুব কাছ থেকে তিনি বিজ্ঞানকে অবলোকন করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞান আর গণিতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত হন। ভ্রমণ শেষে যুক্তরাজ্যের মাটিতে পা দেয়া ফ্যারাডে যেন এক নতুন মানুষ। তিনি তখন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
ফ্যারাডে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে থাকেন। তার সবকিছু ঠিক চলছিলো, শুধু একটা ব্যাপার বাদে। ডেভির স্ত্রী তার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতেন। ডেভি ফ্যারাডেকে গবেষণার কাজে উৎসাহ প্রদান না করলেও তিনি ছিলেন একজন চমৎকার শিক্ষক। প্রায় সাত বছর ডেভির সাথে কাজ করেন ফ্যারাডে। ১৮২০ সালে ডেভির সাথে তার কাজ করার চুক্তি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ল্যাব সহকারী ফ্যারাডে ততদিনে একজন পরিপূর্ণ বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। তিনি ঠিক করলেন, এবার নিজের আবিষ্কারের কথা পৃথিবীকে জানাবেন।
বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে
পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন দুই বিষয়ের সমান আগ্রহী এবং পণ্ডিত ছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে। কিন্তু তার বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ হয় রসায়নবিদ হিসেবে। ১৮২০ সালে তিনি কার্বন এবং ক্লোরিনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ প্রস্তুত করেন। এর মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানমহলে নিজের আগমনের জানান দেন। চারিদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর তিনি সারাহ বার্নাড নামক এক নারীর প্রেমে পড়েন। সে বছরই তারা বিয়ে করেন এবং রয়্যাল ইনস্টিটিউটে স্থায়ীভাবে বাস করা শুরু করেন।
বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেডের মতে বিদ্যুতায়িত তারের আশেপাশে চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, বিদ্যুতায়িত তার চুম্বকের মতো আচরণ করে। মাইকেল ফ্যারাডে এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক মোটর আবিষ্কার করেন।
তিনি এখানেই থেমে যাননি। ১৮২৩ সালে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্লোরিন এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস তরলে রূপান্তর করতে সক্ষম হন তিনি। তার এই আবিষ্কার স্রেফ পেটেন্ট অফিসের দলিলেই আটকে থাকেনি। ১৮৬২ সালে ফার্দিনান্দ ক্যারে নামক এক বিজ্ঞানী এর সাহায্যে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক বরফকল তৈরি করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে আরও কয়েক ধাপ সংস্করণের মাধ্যমে তা রেফ্রিজারেটর হিসেবে আমাদের আবাসস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন ধরনের রেফ্রিজারেটর আবিষ্কৃত হলেও তা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের উপযোগী ছিল না।
লন্ডনে তখন আলোকসজ্জার জন্য বিভিন্ন তেলের বাতি ব্যবহৃত হতো। ফ্যারাডে কৌতূহলবশত সেই তেল নিয়ে গবেষণা করতেন। ১৮২৫ সালে ফ্যারাডে সেই তেলের ভেতর এক গুপ্তধনের সন্ধান লাভ করেন। সেই গুপ্তধনের নাম ছিল ‘Benzene’ (বেনজিন)। রসায়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যৌগের তালিকায় বেনজিনেজ র নাম প্রথমদিকে থাকবে সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এরপর ফ্যারাডে তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় ‘বিদ্যুৎ’ এবং ‘চুম্বক’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি চুম্বকের বলরেখা আবিষ্কার করেন। এরপর তিনি একটি বৈদ্যুতিক তারের উপর একটি চুম্বকের প্রভাব নিয়ে কাজ শুরু করেন। একদিন তিনি একটি কুণ্ডলাকৃতির তারের সাথে ব্যাটারির সংযোগ দিলেন। পুরো বর্তনীর সাথে একটি গ্যালভানোমিটার যুক্ত করে দিলেন। এরপর কুণ্ডলীর ভেতর একটি চুম্বক প্রবেশ করান। সাথে সাথে গ্যালভানোমিটারের কাঁটা কেঁপে উঠে। তিনি ফের চুম্বকটি বাইরে বের করে আনার সময় কাঁটা বিপরীত দিকে কেঁপে উঠলো। তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি এই ধর্মের নাম দিলেন তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ (Electromagnetic induction)।
কিন্তু ফ্যারাডে তখনও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু প্রথমদিকে বার বার ব্যর্থ হতে থাকেন। তবুও হার মানলেন না। রাতদিন এর পেছনে সময় দিতে থাকেন। একদিন হঠাৎ করে তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসলো। তিনি তামার তৈরি চাকতি দিয়ে একটি অদ্ভুত যন্ত্র তৈরি করলেন। এরপর চাকতিটি অবিরাম ঘুরানোর পর সেই যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হলো। আনন্দে ফ্যারাডে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছেন। আর সেই বিপ্লবের নাম ‘ডায়নামো’। এর কল্যাণে আজ আমরা সর্বত্র বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছি।
বিদ্যুৎ নিয়ে ফ্যারাডের তেলেসমাতি এখানেই থেমে যায়নি। তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়ের জন্ম দেন। বিষয়টির নাম ‘Electrochemistry’ বা তড়িৎ রসায়ন। তিনি ‘Anode’, ‘Cathode’, ‘Ion’, ‘Electrode’, ‘Electrolysis’ সহ বহু বৈজ্ঞানিক শব্দের জন্ম দেন। বর্তমানে আমাদের নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন ধাতব বস্তুর উপর চাকচিক্যপূর্ণ আরেকটি ধাতুর প্রলেপ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বস্তুটির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। দেখতেও সুন্দর লাগে। এসবই কিন্তু ফ্যারাডের অবদান।
১৮৩৬ সালে ফ্যারাডে আরেকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে হাজির হন। তার সে আবিষ্কারের নাম ‘Faraday’s Cage’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ফ্যারাডের খাঁচা’। ফ্যারাডে গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে পারেন, যখন কোনো বস্তু চার্জিত হয়ে যায়, তখন চার্জ বস্তুর দেহের বাইরের দিকে অবস্থান করে। বস্তুর ভেতরের ফাঁকা স্থানে এর কোনো প্রভাব নেই। তাই তিনি ধাতুর তৈরি একটি খাঁচা প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে এর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করেন এবং প্রমাণ করেন খাঁচার ভেতরের শূন্যস্থানে বিদ্যুতের কোনো প্রভাব নেই। তার এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে শত শত নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। এর ফলে বিদ্যুৎ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিপদজনক পরীক্ষা নিরাপদে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
এছাড়াও মাইকেল ফ্যারাডে পদার্থের ডায়াম্যাগনেটিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন। ১৮৫০ সালে তিনি তড়িৎ চুম্বকের সাথে সাধারণ চুম্বকের মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ফুরিয়ে যাচ্ছেন। তার উপর বার্ধক্য নেমে এসেছে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
মাইকেল ফ্যারাডের জীবনও আমাদের বাকি সবার মতো বিভিন্ন ঘটনায় ভরপুর ছিল। বিভিন্ন বই ঘেঁটে পাওয়া উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো-
- ১৮২৪ সালে মাইকেল ফ্যারাডে একটি খেলনা আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে খেলনাটি শিশুদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে খেলনার নাম ‘বেলুন’।
- আলবার্ট আইনস্টাইন তার নিজের অফিসরুমে তিনজন বিজ্ঞানীর ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন। তারা হলেন- আইজ্যাক নিউটন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এবং মাইকেল ফ্যারাডে।
- ব্রিটিশ সরকার মাইকেল ফ্যারাডেকে রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
- তিনি সম্মানজনক ‘নাইটহুড’ উপাধি গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
- মাইকেল ফ্যারাডের বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে রয়্যাল ইনস্টিটিউটের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ফ্যারাডে এই প্রস্তাবনাও প্রত্যাখ্যান করেন।
- মৃত্যুশয্যায় অসুস্থ ফ্যারাডেকে তার মৃত্যুর পর তাকে বিখ্যাত ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ করার প্রস্তাব প্রদান করা হলে তিনি তা নাকচ করে দেন।
- ফ্যারাডের সম্মানে বৈদ্যুতিক ক্যাপাসিট্যান্সের এককের নাম দেয়া হয় ‘ফ্যারাড‘।
তার জীবদ্দশায় তিনি প্রায় সকল লোভনীয় প্রস্তাব এবং সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি পুরষ্কারের লোভে বিজ্ঞানী হননি। তিনি বিজ্ঞানকে ভালোবাসতেন। এর মাধ্যমে কোনো সম্মান লাভের আশা তার ছিল না।
শেষ জীবন
১৮৫৫ সালে মাইকেল ফ্যারাডে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি এরপর আর কখনো গবেষণাগারে কাজ করতে পারেননি। দীর্ঘ একযুগ ধরে তিনি শয্যাশায়ী থাকেন। ১৮৬৭ সালের ২৫ আগস্ট তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি কোনো সন্তান রেখে যেতে পারেননি। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সাধারণ মানুষের সাথে লন্ডনের হাইগেটে সমাধিস্থ করা হয়।
মাইকেল ফ্যারাডের মতো অসাধারণ বিজ্ঞানীর মৃত্যুর মাধ্যমে পদার্থবিদ্যার জগতে এক বিপ্লবের অবসান ঘটে। তিনি ছিলেন অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, জ্ঞানী এবং সবকিছুর উপরে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি সবকিছু পেছনে ফেলে তিনি বিজ্ঞানকে ভালোবেসে গেছেন আজীবন। হাজার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি হয়েছেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। এমনকি মৃত্যুর পরের ঠিকানাটুকু পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষদের মাঝে খুঁজে নিতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি জীবনের এক মহামূল্যবান দর্শন শিক্ষা দিয়ে গেলেন। তার সম্পর্কে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড বলেছেন,
“The more we study the work of Faraday with the perspective of time, the more we are impressed by his unrivaled genius as an experimenter and natural philosopher”
বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইকেল ফ্যারাডের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল।