ব্রহ্মপুত্র নদ প্রেমে পড়েছে। সে প্রেমে পড়েছে সুন্দরী নদী গঙ্গার। গঙ্গার রূপের গল্প শুনে সে অস্থির হয়ে পড়েছে। যে করেই হোক, গঙ্গাকে তার চাই। ব্রহ্মপুত্র সিদ্ধান্ত নিলো সে গঙ্গাকে বিয়ে করবে। যে-ই ভাবা সেই কাজ। গঙ্গাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে প্রবাহিত হতে থাকলো সে। ওদিকে গঙ্গাও ব্রহ্মপুত্রকে পছন্দ করেছে। কিন্তু পছন্দ করলেই তো হবে না। ব্রহ্মপুত্র কি সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে, সেটা যাচাই করে দেখাও চাই। তাই গঙ্গা এক অভিনব বুদ্ধি বের করলো। সে তার রূপবতী আবয়বে বৃদ্ধার সাঁজ নিলো। বৃদ্ধা অর্থাৎ, বুড়িগঙ্গা এবার এগিয়ে গেলো ব্রহ্মপুত্রের দিকে।
ওদিকে ব্রহ্মপুত্র তার দীর্ঘ যাত্রা শেষে গঙ্গার নিকট চলে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সে গঙ্গাকে চিনতেই পারলো না। চিনবেই বা কেমন করে, গঙ্গা তখন ছদ্মবেশী বুড়িগঙ্গা। তাই কৌতূহল নিয়ে ব্রহ্মপুত্র শুধালো, “মা, গঙ্গা কোথায়?” বুড়িগঙ্গা এই প্রশ্নে ক্রোধান্বিত হয়ে গেলেন। তাকে চিনতে না পারার মাশুল গুনতে হলো ব্রহ্মপুত্রকে। গঙ্গা তাকে ফিরিয়ে দিলেন। ব্রহ্মপুত্র তারপর দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেলো। আর গঙ্গা ফিরে গিয়ে যমুনার সাথে মিলিত হলো।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ে এরকম শত শত উপকথা প্রচলিত রয়েছে। তিব্বতের সাংপো, উত্তর ভারতের লৌহিত্য এবং বাংলাদেশের এই ব্রহ্মপুত্র নদটি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই নদকে ঘিরে রয়েছে সুবিস্তৃত ইতিহাস। পৌরাণিক শাস্ত্র থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, ভৌগোলিক অবস্থান এবং কোটি মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত এই নদের গল্প নিয়ে আপনাদের নিকট পরিবেশন করছি আমাদের আজকের আয়োজন।
একনজরে ব্রহ্মপুত্র নদ
সারাবিশ্বে নদ-নদীর তালিকায় পানি নিষ্কাশনের দিক থেকে নবম এবং দৈর্ঘ্যের হিসাবে পৃথিবীর ১৫ তম বৃহত্তম এই ব্রহ্মপুত্র নদ। হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গ থেকে জন্ম নেওয়া এই নদ তিব্বতের বুকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপত্যকা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতের আসাম হয়ে পরবর্তীতে বাংলাদেশে পদ্মা (যমুনা নদী হিসেবে) এবং মেঘনা নদীর সাথে মিশে শেষমেশ বিসর্জিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকে। অঞ্চলভেদে সাংপো (তিব্বত), ইয়ারলুং জাংবো (চীন), লৌহিত্য, লোহিত, দিহাং (আসাম), পুরাতন ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশ) হিসেবে পরিচিত এই আন্তর্জাতিক নদটিকে সাধারণত ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে ডাকা হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। বাংলাপিডিয়া মতে, এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৮৫০ কিলোমিটার। তবে সম্প্রতি চীনা জরিপে দেখা গেছে, এই নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,৮৪৮ কিলোমিটার।
ব্রহ্মপুত্র নদ তার যাত্রাকালে বেশকিছু উপনদীর জন্ম দিয়েছে। এদের মধ্যে মানাস, রেইডাক, সঙ্কোশ, ভারেলি, তিস্তা, দিবাং এবং লুহিত প্রধান উপনদী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এই নদের যাত্রাপথে অসংখ্য চর এবং দ্বীপের জন্ম হয়েছে। এই নদের মাজুলি দ্বীপকে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী-দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নদ বাংলাদেশ এবং ভারতের অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকে অন্যতম প্রধান নদ হিসেবে পরিচিত।
হিন্দু পুরাণে ব্রহ্মপুত্রের উৎস
ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস নিয়ে তিব্বতি এবং ভারতীয় পুরাণে বেশ কিছু কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। তিব্বতিরা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর বুকে মানুষের বসতি শুরু হওয়ার বহু বছর আগে চাং টান নামক একটি মালভূমিতে এক সুবিশাল হ্রদের অস্তিত্ব ছিল। তখন বোধিসত্ত্ব নামক এক স্বর্গীয় অস্তিত্ব এই অঞ্চলে আসন্ন সকল মানুষের জন্য এই পানির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে হিমালয়ে দিয়ে এই পানি নির্গমনের একটি পথ তৈরি করে দেন। সেই পথ দিয়ে হ্রদের পানি প্রবল স্রোতে সাংপো নদী হয়ে ভূমিতে প্রবাহিত হতে থাকে। তারা এই নদীর পানিকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। অপরদিকে হিন্দু পুরাণ মতে, ঋষি শান্তনুর স্ত্রী অমোঘার গর্ভে স্রষ্টা ব্রহ্মার একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। সেই পুত্র একটি জলপিণ্ড হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। ঋষি শান্তনু এই পুত্রকে কৈলাস, গন্ধমাদনা, জারুধি, সম্বর্তক নামক চারটি পর্বতের মাঝে রেখে আসেন। সেখানে এই জলপিণ্ড ‘ব্রহ্মকুণ্ড’ নামক হ্রদে পরিণত হয়। ওদিকে ত্রেতা যুগে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের জন্ম হয়। পিতা মুণি জমদগ্নির নির্দেশে তিনি তার মাকে হত্যা করেছিলেন। মাতৃহত্যার মতো গুরুপাপের কারণে তার হাতে মারণাস্ত্র কুঠারটি আঠার মতো লেগে যায়। কোনোভাবেই সেই কুঠারকে হাত থেকে ছাড়াতে না পেরে পিতার কাছে যান তিনি। পিতা তাকে জানান মাতৃহত্যার মতো পাপের কারণে এই কুঠার তার হাত ছাড়ছে না। জমদগ্নি মুণি পরশুরামকে তীর্থযাত্রা করতে বলেন।
পাপমোচনের লক্ষ্যে তিনি তীর্থযাত্রা করেন। একপর্যায়ে তিনি হিমালয়ের সেই ব্রহ্মকুণ্ড হ্রদে স্নান করেন। এর ফলে তার পাপমুক্তি হয় এবং কুঠার হাত থেকে নেমে আসে। এই ঘটনায় তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এরপর চিন্তা করলেন, এমন স্বর্গীয় পানি সকলের জন্য সহজলভ্য করা প্রয়োজন। তিনি কুঠার দিয়ে পাহাড়ের একপাশ ভেঙে দেন। এর ফলে হ্রদের পানি হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এরপর তিনি লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে সেই জলধারাকে প্রবাহিত হওয়ার পথ গড়ে দিতে থাকেন।
সুদূর হিমালয় থেকে হাল টানতে টানতে ক্লান্ত পরশুরাম বিশ্রাম করার জন্য লাঙ্গল থামান বর্তমান নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ অঞ্চলে। মূলত, এই কারণেই অঞ্চলটির নাম ‘লাঙ্গলবন্দ’ রাখা হয়েছে। সেই থেকে ব্রহ্মপুত্রের ধারা হিমালয় থেকে লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই জলধারা পরবর্তীতে মেঘনার সাথে মিশে যায়। সনাতন ধর্মানুসারীদের নিকট এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের পানি অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য হয়। প্রতিবছর লাঙ্গলবন্দ ঘাটে বিভিন্ন দেশ থেকে হিন্দুরা এসে স্নান করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হন। ব্রহ্মার সন্তান থেকে এই নদের জলধারা এসেছে বলে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র নদ।
তিব্বত থেকে ভারতে ব্রহ্মপুত্রের যাত্রাপথ
ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গের জিমা ইয়ংজং হিমবাহ। এই হিমবাহের অবস্থান তিব্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। এখান থেকে জন্ম নেওয়া নদের জলধারা শৃঙ্গ থেকে নেমে প্রায় ১,১০০ কিলোমিটার পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। তিব্বতের রাজধানী লাসা পেড়িয়ে এই প্রবাহ চুশুর অঞ্চলে সাংপো নদী হিসেবে প্রবাহিত হয়। তিব্বত পেরিয়ে এই নদীর গতিপথ পূর্ব থেকে উত্তর দিকে বদলে যায়। নামচা বারওয়া নামক পাহাড়ি অঞ্চলে আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণে প্রবাহিত হতে থাকে। তিব্বতি সাংপো নদী এবার উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করে। এখানে সাংপো নদীর নাম বদলে যায় দিহাং বা সিয়াং নদীতে। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বের হয়ে এই নদী আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে। দিহাং নদী অরুণাচল প্রদেশ থেকে বের হয়ে আসামের নিচু অববাহিকায় প্রবেশ করে। আসামের সাদিয়া শহরের পশ্চিমে নদীর গতিপথ ফের বদলে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হয়ে যায়। এখানে দিবাং এবং লোহিত নামক দুটি পাহাড়ি নদীর সাথে মিলিত হয় দিহাং। এই মিলনস্থল থেকে দিহাং নদী বদলে যায় ব্রহ্মপুত্র নদে।
আসামের সমতল ভূমিতে ব্রহ্মপুত্র বেশ বিশাল এবং খরস্রোতা নদ। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও নদের প্রশস্ততা গড়ে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়। নদের বুকে বেশ কিছু চর এবং মৌসুমি দ্বীপের দেখা মেলে। আসামের বুকে নদের গতিপথ প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। আসাম পেড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে আগমন এবং গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ গঠন
আসামের উপত্যকায় ৭২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই নদ গারো পাহাড়কে ঘিরে প্রবাহিত হয়। এরপর ভবানীপুর এলাকায় কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ অন্যান্য দেশের তুলনায় সংক্ষিপ্ত। এদেশে একে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে ডাকা হয়। চিলমারী অতিক্রম করে এই নদ তিস্তা নদীর সাথে মিলিত হয়। এরপর দক্ষিণে এটি যমুনা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের নিকটে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। আর ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা জামালপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই ধারা ভৈরব বাজারে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। চাঁদপুর জেলায় মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্রের ধারার সাথে মিলিত হয় পদ্মা। এরপর মেঘনা নদী হিসেবে তা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
২০০ বছর পূর্বে ১৭৮৫ সালে রেনেলের তৈরি মানচিত্রে ময়মনসিংহের উপর দিয়ে নদের গতিপথ চিহ্নিত হয়েছে। তখন এটিই ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিপথ ছিল। ১৭৮২-৮৭ সময়কালের মধ্যে সঙ্ঘটিত ভূমিকম্প এবং ভয়াবহ বন্যার ফলে এর গতিধারা বদলে যায়। ব্রহ্মপুত্রের পানি তখনকার জোনাই খালের সাথে মিলিত হয়ে গঠিত হয় যমুনা নদী। গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ কয়েকটি নদী নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিস্তৃত ৩৫৫ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে গঠিত হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ।
ব্রহ্মপুত্র নদ না নদী?
নদ এবং নদীর মধ্যে পার্থক্য জিজ্ঞাসা করা হলে প্রায়ই যে উত্তর পাওয়া যায় তা হচ্ছে, নদীর শাখা আছে কিন্তু নদের নেই। বহুল প্রচলিত হলেও এই উত্তর সঠিক নয়। যেমন ধরা যাক ব্রহ্মপুত্রেরই কথা। নদ হিসেবে পরিচিত এই ব্রহ্মপুত্র থেকে যমুনা, শীতলক্ষ্যা, বানার, সাতিয়া নামক শাখা নদীর উৎপত্তি হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী কিন্তু ব্রহ্মপুত্রকে নদী বলতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা একে নদ বলি। নদ এবং নদীর মধ্যকার লিঙ্গ বিভাজন সম্ভবত পৃথিবীর এই অঞ্চল ব্যতীত অন্য কোথাও নেই। আর এই বিভাজনের কারণ শাখায় নয়, ব্যাকরণে। পুরুষবাচক নামের ক্ষেত্রের জলধারাকে আমরা নদ হিসেবে ডাকছি। আর নারীবাচক নামের জলধারাকে নদী। সেজন্য ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ হলো নদ, কিন্তু পদ্মা, মেঘনা যমুনা হচ্ছে নদী। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন, আড়িয়াল খাঁ একটি পুরুষবাচক শব্দ হলেও এটি একটি নদীর নাম।
প্রাণের আশ্রয়
তিব্বত থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রবাহিত সুদীর্ঘ ব্রহ্মপুত্রের বুকে প্রাণের বিজয়কেতন বহন করছে শত প্রজাতির মাছ। এদের মধ্যে ভারতে প্রায় ১২৬ প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে।1 বাংলাদেশে পরিচালিত এক জরিপে প্রায় ৬৭ প্রজাতির মাছ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাছ হচ্ছে পাবদা, চিতল, মৃগেল, মিরর কার্প, চীনা পুঁটি, সিলভার কার্প ইত্যাদি। ব্রহ্মপুত্রের সমৃদ্ধ্য মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিচিত্র জেলে সমাজ। একসময় শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে জেলেরা জনপ্রতি দৈনিক ৫০ কেজির মতো মাছ ধরতে পারতো। তবে নদের পানি দূষিত হয়ে যাওয়ায় এখন তা ১৫-২০ কেজিতে নেমে এসেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নদের বুক থেকে প্রায় ২৮২.৭ হাজার টন মাছ ধরা হয়েছিল। মাছ ছাড়াও বহু প্রজাতির পাখি, সাপ, কচ্ছপ এবং ডলফিনের দেখা মিলেছে ব্রহ্মপুত্রের বুকে। এককালে এখানে কুমির এবং ঘড়িয়াল (মেছো কুমির) পাওয়া যেত বলে জানা গেছে।2
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বহু হাতি, বেঙ্গল বাঘ, চিতা বাঘ, বন্য মহিষ, হরিণের মতো প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরা বেঁচে থাকার জন্য ব্রহ্মপুত্রের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আসামের দিকে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এক-খড়গ বিশিষ্ট গণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যেত। বর্তমানে এদের সংখ্যা অনেক কম। আসাম ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে এই প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নাব্যতা
তিব্বতের অভ্যন্তরে সাংপো নদীতে প্রায় ৬৪০ কিলোমিটারের মতো নদীপথে নাব্যতা রয়েছে। এই অঞ্চলে তিব্বতিরা বিভিন্ন বাঁশের তৈরি নৌযান থেকে শুরু করে বিশাল ফেরি করে নদী পাড়ি দিয়ে থাকেন। এখানে নদীর উপর বেশ কিছু ঝুলন্ত সেতুর দেখাও মিলে। তবে ব্রহ্মপুত্র তার শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হয়েছে ভারতের আসাম এবং বাংলাদেশের বুকে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ভরা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র অত্যন্ত খরস্রোতা এবং প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সমতল ভূমিতে ব্রহ্মপুত্রের পুরো অঞ্চলই (প্রায় ১১০০ কিলোমিটার) নৌ পরিবহণের চলাচলের জন্য উপযোগী।
বাংলাদেশ এবং আসামে স্থানীয় নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলারে করে মানুষ নদীপথে যাতায়াত করে। এছাড়া বিভিন্ন ভারী কাঁচামাল বোঝাই বাণিজ্যিক নৌযানও ব্রহ্মপুত্র দিয়ে যাতায়াত করে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতে ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। আসামে কপিলি হাইড্রো প্রকল্প, অরুণাচলে রাঙ্গানদী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তিব্বতে সাংপো নদীর উপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৫ সালে তিব্বতে চালু হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত।
১৯৬২ সালে ব্রহ্মপুত্রের উপর সর্বপ্রথম সেতু (সরাইঘাট) নির্মাণ করা হয় আসামের গৌহাটি অঞ্চলে। এই সেতু দিয়ে একসাথে রেল এবং সড়ক পরিবহণ যাতায়াত করতে পারে। ভারতে ব্রহ্মপুত্রের উপর কলিয়াভোমরা সেতু, ভূপেন হাজারিকা সেতু, সতী সাধ্বিনী সেতু এবং নারানারায়ণ সেতু নির্মিত হয়েছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল এবং বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ফেরী যাতায়াত ব্যবস্থাকে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে কুড়িগ্রাম, রৌমারী, চিলমারি, বাহাদুরাবাদ ঘাট, সরিষাবাড়ি, জগন্নাথ ঘাট, নাগরবাড়ি, গোয়ালন্দ ঘাট প্রভৃতি ব্রহ্মপুত্রের বুকে গুরুত্বপূর্ণ ফেরী চলাচল কেন্দ্র।
ব্রহ্মপুত্রের প্রলয়ংকারী বন্যা
ব্রহ্মপুত্র নদ যেমন একদিক দিয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম, তেমনি এর প্রলয়ংকারী বন্যায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের আসাম রাজ্য। আসামে প্রতিবছর বর্ষাকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দুই কূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ২৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবছর গড়ে ৪৭ জন বন্যায় প্রাণ হারায়, প্রায় ১০ হাজার গবাদি পশু মারা যায় এবং বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৮ কোটি রুপি।
ব্রহ্মপুত্রের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯২৭, ১৯৩৪ এবং ১৯৫০ এর বন্যা উল্লেখযোগ্য। বন্যার ফলে আসামের প্রায় ৪০ শতাংশ ভূমি পানির নিচে নিমজ্জিত হয়ে যায়। বাস্তুহারা মানুষকে তখন ভেলায় চড়ে ভাসমান জীবনযাপন করতে দেখা যায়। মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দেখা দেয় পানিবাহিত রোগের মহামারি। গ্রীষ্মকালে হিমালয়ের পর্বতের গায়ে জমে থাকা তুষার গলে পানিতে রূপান্তরিত হয়ে সমতলে নেমে আসে। এই পানি ব্রহ্মপুত্রের বুকে গিয়ে মিলিত হয়। তার উপর, বর্ষাকালে ব্রহ্মপুত্র অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০ ইঞ্চি। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং বন্যার সৃষ্টি হয়।3
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ব্রহ্মপুত্রের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ৬০ বছরে ব্রহ্মপুত্রের উপর বেড়িবাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি রুপি। কিন্তু বন্যাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা নদীর উপর তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় বিপুল পরিমাণ পানি অপসারিত হয়। এই পানির সাথে প্রচুর পরিমাণ পলিমাটি বাহিত হয়। বন্যাশেষে এসব পলিমাটির সাহায্যে কৃষি জমির উর্বরতা বেড়ে যায়। প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ৭২৫ মিলিয়ন টন পলি বাহিত হয়।
ব্রহ্মপুত্রের সর্বনাশ
মরা ব্রহ্মপুত্র নদে আজ আমার অস্তিত্ব শুয়ে
যেন এক চিতলের শঙ্খশাদা হাড়– (পহেলা বৈশাখ, সৈয়দ শামসুল হক)
এককালের প্রাণবন্ত, খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ আজ মৃতপ্রায়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে দখলদারি এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে প্রশস্ত নদ আজ মৃতপ্রায় খালের ন্যায় টিকে আছে। এর ফলে নদ হারিয়েছে নাব্যতা, হুমকির মুখে আছে নদের উপর নির্ভরশীল প্রাণিসম্পদ। কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার কারণে আড়াইহাজার অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুমে নদের পানি বাড়লেও শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচরে ছেয়ে যায় নদের দুই পাড়। বিশেষজ্ঞ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ভাটির দিকে পলি জমে নদের বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের সাথে যমুনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতি দ্রুত এখানে খনন না করলে পরবর্তীতে নদকে বাঁচানো যাবে না।
তবে শুধু নদ খনন করলেই সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে দূষিত পানি থেকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক নকশা প্রণয়ন করে এসব শিল্প-কারখানায় উন্নতমানের নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। ব্রহ্মপুত্রের সর্বনাশ মানে বাংলাদেশের সর্বনাশ। এই নদ ধ্বংস হলে আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক ভূমি। শত শত ছোট-বড় নদীর সমাহারে এই বাংলা এক প্রাণবন্ত অববাহিকা। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্নার সাথে জড়িয়ে আছে এই নদ-নদীর গল্পগাথা। ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের বুক দিয়ে বয়ে চলা দীর্ঘতম নদ। হিমালয়ের সন্তান এই নদ আমাদের দেশের ভৌগোলিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের অন্যতম প্রভাবক। ব্রহ্মপুত্রের প্রাণবন্ত রূপ যেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। তাই আমাদের সকলের উচিত এই নদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা। কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাসাধ্য অবদানের মাধ্যমে এই নদকে বাঁচিয়ে রাখা।
আরো জানতে পড়ুন- ‘ব্রহ্মপুত্র নদ’ বইটি