‘নীল পর্বতমালার পাদদেশে ছিল এক গহীন বন। সেখানে কাজ করতো এক লোক। কাজের চাপে বেচারার ছুটি মেলে না। তাই বৌকে চিঠি লিখলো যাতে বাচ্চাদেরকে নিয়ে এসে কয়েকদিন ঘুরে যায়। লোকটির স্ত্রী থাকতেন বহু দূরে, এক বিরাট শহরে। পৃথিবীতে অমন অসাধারণ শহর আর একটিও নেই। দিন-রাত সেখানকার সুউচ্চ টাওয়ারগুলোর মাথায় জ্বলজ্বল করে লাল রঙের তারকা। শহরটির নাম মস্কো’
ছোটবেলায় দু’পাতা সোভিয়েত সাহিত্য যারা পড়েছেন, তারা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন কিসের কথা হচ্ছে। গল্পটির নাম ‘চুক আর গেক’। দুরন্ত দুই ভাইয়ের কাহিনী। লিখেছেন আর্কাদি পেত্রোভিচ গোলিকভ। আর্কাদি গাইদার নামেই তিনি বেশি পরিচিত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তারা নিজেদের মতবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। এই চিন্তার সাথে একাত্মতা বোধ করতেন আরো অনেক লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা। আর্কাদি গাইদার ছিলেন এমনই এক মানুষ যিনি আমৃত্যু লিখে গিয়েছেন ছোটদের জন্য। তাদেরকে শেখাতে চেয়েছেন সমাজতন্ত্রের সুমহান শিক্ষা। আজ এই ক্ষণজন্মা লেখককে নিয়েই আলাপ হবে।
ডানপিটে কিশোর থেকে লাল বিপ্লবী
১৯০৪ সালের এক শীতে রুশ সাম্রাজ্যের লভোভ শহরে আর্কাদি গাইদারের জন্ম। মায়ের দিক থেকে তিনি বিখ্যাত রোমান্টিক কবি মিখাইল লেরমেন্তভের বংশধর। জন্মের কিছুদিন পরেই আর্কাদিসহ গোলিকভ পরিবার আর্জামাস নামের একটি ছোট্ট শহরে চলে আসেন। কর্মজীবনে শিক্ষক ছিলেন। রাজনৈতিক আদর্শে বলশেভিক বাবার সূত্রে, ছোটবেলা থেকেই রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনে ঝুঁকে পড়েন আর্কাদি। রাস্তায় লিফলেট বিতরণ করতেন, দেওয়ালে স্লোগান লিখতেন। বাবা যুদ্ধে চলে গেলে তিনিও পিছু নিয়েছিলেন। ৪ দিন পর বাসা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে ধরা পড়লে সে যাত্রা আর যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে করতেন সাংবাদিকতা। ১৯১৮ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হন।
রাশিয়ার পটভূমিটা একটু জানা প্রয়োজন। জারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে ১৯১৭ এর ফেব্রুয়ারিতে। সোশ্যালিস্ট রেভোল্যুশনারি পার্টি (এস আর) নেতা আলেক্সান্দর কেরেনস্কি ক্ষমতায়। তিনি যথারীতি ধনীদের তোয়াজ তুষ্টি করে চলতেন। এলো অক্টোবর বিপ্লব। বলশেভিকেরা ক্ষমতা দখল করলো। কিন্তু তাতে ঝামেলা বাড়লো বৈ কমলো না। বহির্শক্তির প্ররোচনা ও প্রণোদনায় রাশিয়ার এস আর, জারপন্থী সেনাদল, ধনী চাষী (কুলাক) আর স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতার দল ব্যাপক হাঙ্গামা শুরু করে দিলো ক্ষমতা দখলের জন্য। এই বিদ্রোহী জোটটি শ্বেতরক্ষী নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে নেস্তর মাখনোর নৈরাজ্যবাদী কালো ফৌজের সাথেও যুদ্ধ বাঁধে সমাজতান্ত্রিক লাল ফৌজের।
আর্কাদি এই যুদ্ধে অংশ নিলেন। বয়স গোপন করে সেনাদলে যোগ দিলেন আর মাত্র ১৬ বছর বয়সে হয়ে গেলেন কোম্পানী কমান্ডার। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি যুদ্ধ করেছেন ইউক্রেন, পোল্যান্ড, ককেশাস আর মঙ্গোলিয়ার সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলে। পরে যুদ্ধ থামলেও মস্তিষ্কের পুরনো একটি চোটে আর্কাদি গাইদার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে তাকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
যোদ্ধা থেকে লেখক, তারপর আবার যোদ্ধা
আর্কাদি গাইদার লাল ফৌজে থাকতে না পারার দুঃখ জানিয়ে কয়েক ছত্র চিঠি লেখেন মিখাইল ফ্রুঞ্জকে। মিখাইল ফ্রুঞ্জ ছিলেন বলশেভিকদের মধ্যে খুবই উচুঁদরের এক নেতা। তিনি গাইদারের সাহিত্য প্রতিভায় মুক্ত হয়ে চিঠির প্রেরকের সাথে দেখা করেন ও তাকে আরো লিখতে প্রেরণা যোগান। শুরু হয়ে যায় সাহিত্যক্ষেত্রে আর্কাদি গাইদারের পথচলা।
গাইদার লেখালেখি করে কাটিয়েছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগপর্যন্ত। ১৯৪১ সালে জার্মানী সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করলে আর্কাদি গাইদার আর বসে থাকতে পারলেন না। যোগ দিলেন ফ্রন্টলাইনের বহু পেছনে পার্টিজান নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ গেরিলা দলগুলোর একটিতে। পার্টিজান বাহিনী তখন সমগ্র ইউক্রেন, বেলারুশসহ অন্যান্য শত্রু অধিকৃত অঞ্চলে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এখান থেকে মস্কোতে তিনি প্রতিবেদন লিখতেন। বহুবার কর্তারা তাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন কিন্তু দেশের প্রতি কর্তব্যে অবিচল গাইদার নিজের পার্টিজান বাহিনী ছেড়ে যাননি।
১৯৪১ এর হেমন্তকালে, নিপার নদীর তীরে একটি রেল জংশনের কাছে আর্কাদি গাইদার আর তার পার্টিজান বাহিনীর সাথে বড়সড় একটা জার্মান বাহিনীর দেখা হয়ে যায়। লেখক যোদ্ধা গাইদার অস্ত্র হাতে বীরের মতো মৃ্ত্যু বরণ করেন। স্থানীয় লোকেরা তাকে সাধারণ সৈন্য ভেবে গোর দেন। পরে পার্টিজানদের সূত্রে, আশেপাশের সবাই জানতে পারে কী অসাধারণ এক মানুষ শুয়ে আছেন সেখানে।
যুদ্ধ শেষ হলে সোভিয়েত সরকার আর্কাদি গাইদারের মৃতদেহ সরিয়ে এনে নীপারের তীরের এক উচুঁ টিলায় স্থাপন করে। সেখানে স্থাপন করা আছে গাইদারের একটা ব্রোঞ্জের আবক্ষমূর্তি। বহু দূর থেকে দেখা যায় এই সমাধিক্ষেত্র।
আর্কাদি পেত্রোভিচ গোলিকভ কিভাবে আর্কাদি গাইদার হয়ে গেলেন? সামরিক বাহিনীতে গাইদার ও তার দলবল মূলত পথপ্রদর্শক তথা গাইড হিসেবে কাজ করতেন। শত্রু চলাচল বিঘ্নিত করবার পাশাপাশি গোপনে নজরদারি করতেন শত্রু অবস্থানের ওপরে, তথ্য পাঠাতেন বড় লাল ফৌজগুলোতে। গাইডের খাকাস অনুবাদ হচ্ছে গাইদার; অর্থ যে পথ দেখায় বা সামনে থাকে। কেন যে সাইবেরীয় অঞ্চলে প্রচলিত এই ভাষাটি থেকে তিনি শব্দ ধার নিলেন তা অবশ্য জানা যায় না। আর এভাবেই আর্কাদি গাইদার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি, লিখতেনও এই নামেই।
গাইদারের সাহিত্যকর্ম
গাইদার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন কিশোর বয়সে। কিশোরের চোখ দিয়েই দেখেছেন যুদ্ধটাকে। সহকর্মীর মৃত্যু, মারণাস্ত্রের আঘাত, জয়ের আনন্দ, পরাজয়ের বেদনা সবই সয়েছেন তিনি। শারীরিক কারণে তার বিচ্ছেদ ঘটেছিলো পরিবারতুল্য সেনাদলের সাথে। কিন্তু যুদ্ধের সবকিছুই তাকে লেখালেখির প্রেরণা দিয়েছিলো। প্রায়শই তাতে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে শিশু কিশোর-কিশোরীরাই থাকতো।
খুব বেশি লেখালেখি করবার সুযোগ আর্কাদি গাইদার পাননি। তবে লিখে গিয়েছেন বেশ কিছু ছোটগল্প এবং উপন্যাস। গাইদারের লেখা নীল পেয়ালা খুব বিখ্যাত গল্প। ছোট একটি মেয়ের চোখে আশেপাশের পৃথিবীকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তার সব থেকে সাড়া জাগানো উপন্যাস সম্ভবত ‘তিমুর আর তার দলবল।’ নিজের ছেলে তিমুরের নামে নামকরণ করেছিলেন প্রধান চরিত্রের। উপন্যাসে তিমুর এবং তার বন্ধুবান্ধব মিলে গোপনে, রাতের বেলায় সাহায্য করতো সেই সব দুঃস্থ পরিবারকে, যাদের বাবা, স্বামী বা ছেলে যুদ্ধে চলে যাওয়ার কারণে বেজায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
১৯৪০ সালে লেখা গাইদারের এই উপন্যাস তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গোটা দেশে। তিমুর মুভমেন্ট নামের একধরনের আন্দোলনই শুরু হয়ে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা এই মুভমেন্টে অংশ নিতো, সাহায্য করতো পাড়া প্রতিবেশীদেরকে, সেই সাথে রাস্তাঘাট পরিষ্কারসহ নানা জনহিতকর কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিত। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল সোভিয়েত ইউনিয়নে তিমুর মুভমেন্টের সাথে যুক্ত শিশু-কিশোরদের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষে পৌঁছেছে।
গাইদারের আরেকটি তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস হচ্ছে ইশকুল। আত্মজীবনীমূলক ঢং এ লেখা বইটিতে চিত্রায়ণ করেছেন বরিস গোরিকভ নামের এক কিশোরের, যার বাবাকে হত্যা করে সরকারি বাহিনী। বরিস বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ফ্রন্টে যান, যোগ দেন এক দুর্ধর্ষ পার্টিজান বাহিনীর সাথে। পরিচয় হয় ফেদিয়া সিরোতসভ, চুবুক, কমরেড শেবালভ, সুখারেভ, বাচ্চা বেদে, শমাকভের মত রোমাঞ্চকর সব দুঃসাহসী চরিত্রের সাথে। নিজে যেহেতু কিশোর বয়সে সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন। তাই তার বড় শখ ছিলো ফ্রন্টের জীবনটা কেমন তা নিজের ভাষায় তুলে ধরবেন।
এর বাইরেও গাইদার লিখেছেন সামরিক গুপ্ততথ্য, আর ভি এস, বনে ধোঁয়া, চুক আর গেক, দূরদেশ, চার নাম্বার ডাগ আউট এর মতো চমৎকার সব সাহিত্য। তার লেখা সোভিয়েত ইউনিয়ন তো বটেই, সারা বিশ্বে বিশেষ করে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট দেশগুলোতে সাগ্রহে পড়া হতো। আমাদের দেশেও অনেকেই এই বইগুলো পড়েছেন। যে পটভূমিতেই লিখুন না কেন, তার লেখায় সব সময়ে শৃংখলা, দেশ ও জনগণের প্রতি কর্তব্য এবং বীরত্বের অনুপ্রেরণায় একটি আদর্শ কিশোর সমাজ গড়বার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
আর্কাদি গাইদারের পুত্র, তিমুর গাইদার; ‘তিমুর আর তার দলবল এর নায়ক’ সোভিয়েত নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। নাতি ইগর গাইদার সোভিয়েত পরবর্তী শাসক বরিস ইয়েলতসিনের আমলে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সোভিয়েত আমলে আর্কাদি গাইদারকে নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে।
ফিচার ইমেজঃ Youtube