(পর্ব ৩ এর পর থেকে)
১৯৩৯ সালের ৩১ আগস্ট নাগাদ কমকর গিওর্গি ঝুকভ পরিণত হন সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন জাতীয় বীরে। খালখিন গোলের যুদ্ধে জাপানিদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে তিনি কেবল মঙ্গোলিয়াকে জাপানি আগ্রাসন থেকেই রক্ষা করেননি, একই সঙ্গে কার্যত পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তিনি যখন মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাতোরে সপরিবারে এই বিজয় উদযাপন করছিলেন এবং পরাজিত জাপানিদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মঙ্গোলীয়–মাঞ্চুকুয়োয়ান সীমান্ত চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত করার জন্য আলোচনা করছিলেন, সেই সময়েই ইউরোপের বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠেছিল।
বস্তুত ১৯৩৯ সাল নাগাদ ইউরোপের সকল বৃহৎ শক্তিই অনুধাবন করতে পারছিল যে, জার্মানির ক্রমাগত আগ্রাসী ভূমিকার কারণে এবং জার্মানি ও পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন একটি যুদ্ধ সুনিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি জার্মানবিরোধী জোট গঠনের জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ ও ফরাসিরা এ রকম কোনো জোট গঠনে বিশেষ আগ্রহী ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সেটি হতো তাদের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে অনুকূল।
এই পরিস্থিতিতে খালখিন গোল যুদ্ধ চলাকালেই ২৩ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির সঙ্গে একটি পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে নিজেকে মুক্ত করে। বিশ্বকে হতভম্ব করে দেয়া ‘মলোতভ–রিব্বেনট্রপ চুক্তি’ নামক এই চুক্তির গোপন শর্ত অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি পূর্ব ইউরোপকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়, এবং পোল্যান্ডের পূর্বাংশ, মেমেল (বর্তমান ক্লাইপেদা) বন্দর বাদে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো, ফিনল্যান্ড এবং রুমানীয়–নিয়ন্ত্রিত বেসারাবিয়াকে জার্মানি সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড অভিযান: ঝুকভের অনুপস্থিতি
১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং প্রত্যুত্তরে ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ব্রিটিশ ও ফরাসিরা পোল্যান্ডকে কার্যত কোনো সহায়তা করেনি এবং মাসখানেকের মধ্যেই জার্মান ‘ব্লিটজক্রিগে’র সম্মুখে পোল্যান্ডের প্রতিরোধ তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে।
এদিকে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে খালখিন গোলে সোভিয়েত–জাপানি যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ১৭ সেপ্টেম্বর লাল ফৌজ পূর্ব দিক থেকে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। পোলিশরা কার্যত সোভিয়েতদের বাধা প্রদান করেনি বললেই চলে এবং সোভিয়েতরা পোল্যান্ডের কাছ থেকে পশ্চিম ইউক্রেন ও পশ্চিম বেলোরুশিয়া (বর্তমান বেলারুশ) পুনর্দখল করে নেয়। উল্লেখ্য, ১৯১৯–১৯২১ সালের সোভিয়েত–পোলিশ যুদ্ধের সময় পোল্যান্ড এই অঞ্চল দুইটি বলশেভিকদের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল।
পোল্যান্ডে সাফল্য অর্জনের পর ১৯৩৯ সালের নভেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফিনল্যান্ডকে একটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা কিংবা সেটি সম্ভব না হলে অন্তত সোভিয়েত–ফিনিশ সীমান্তবর্তী লেনিনগ্রাদ (বর্তমানে সেইন্ট পিটার্সবার্গ) শহরের নিরাপত্তা রক্ষার্থে ফিনল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখল করে নেয়া। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও লাল ফৌজের অকর্মণ্যতার কারণে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরিচালিত সোভিয়েত আক্রমণাভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং লাল ফৌজের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। সোভিয়েত–জার্মান মিত্রতার প্রেক্ষাপটে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করে এবং জাতিপুঞ্জ (League of Nations) থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাল ফৌজ ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরেকটি আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে। এটি সফল হয় এবং সোভিয়েত সৈন্যরা ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি অধিকারের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার আশঙ্কা করছিল যে, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ফিনল্যান্ডের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। এজন্য তারা ফিনল্যান্ডের শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ১৯৪০ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত ‘মস্কো শান্তি চুক্তি’র মধ্য দিয়ে সোভিয়েত–ফিনিশ যুদ্ধের অবসান ঘটে।
এই যুদ্ধে ৪৮,৭৪৫ জন সোভিয়েত সৈন্য এবং ২৫,৯০৪ জন ফিনিশ সৈন্য নিহত বা নিখোঁজ হয়, যদিও সোভিয়েতদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে ফিনল্যান্ড উপসাগরের দ্বীপগুলো, কারেলিয়ান ইস্থমাস, লাদোগা কারেলিয়া, সাল্লা ও রিবাচি উপদ্বীপ (ফিনল্যান্ডের প্রায় ১০% ভূখণ্ড) সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তগত হয়, এবং ফিনল্যান্ড হাঙ্কো বন্দরকে সোভিয়েতদের কাছে ইজারা প্রদান করার পাশাপাশি তাদের লাদোগা নৌবহরও সোভিয়েতদের কাছে সমর্পণ করে।
ইউরোপে যখন এতকিছু ঘটে যাচ্ছিল, তখন ঝুকভ ঘটনার কেন্দ্রস্থল থেকে বহু দূরে মঙ্গোলিয়ায় অবস্থান করছিলেন। স্বভাবগতভাবেই তিনি যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে থাকতে বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু এ সময় যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে থাকা তার জন্য ছিল ‘মিশ্র আশীর্বাদ’ (mixed blessing) স্বরূপ। পোল্যান্ড অভিযান ছিল রুশ গৃহযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পরিচালিত সর্ববৃহৎ সামরিক অভিযান এবং এই অভিযানে অংশগ্রহণ করতে না পারাটা ছিল ঝুকভের জন্য আফসোসের ব্যাপার। কিন্তু ফিনল্যান্ড অভিযানে সোভিয়েতরা যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তার ফলে অভিযানটির সঙ্গে জড়িত সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তাদের দক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ঝুকভ যেহেতু এই অভিযানে জড়িত ছিলেন না, সেহেতু এ ধরনের অবমাননা থেকে তিনি বেঁচে যান।
কমকর থেকে জেনারেল এবং কিয়েভ সামরিক জেলার কমান্ডার
এদিকে সোভিয়েত–ফিনিশ যুদ্ধের সমাপ্তির পরপরই জার্মানি পশ্চিম ইউরোপে ঝটিকা আক্রমণ চালায় এবং ১৯৪০ সালের জুনের মধ্যে ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স জার্মানির পদানত হয়। ইতালি জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। একমাত্র ব্রিটেন তখনো জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। এমতাবস্থায় সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ড অভিযান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং পশ্চিম ইউরোপে জার্মানদের পরিচালিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে লাল ফৌজের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন শুরু করে। ফিনল্যান্ড অভিযানের পর নিযুক্ত নতুন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল সেমিয়ন তিমোশেঙ্কোর নামানুসারে এই সংস্কার কর্মসূচি ‘তিমোশেঙ্কো সংস্কার’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। এই পরিস্থিতিতে ঝুকভকে মঙ্গোলিয়া থেকে ডেকে পাঠানো হয়।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগে তিমোশেঙ্কো ছিলেন কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিয়েভ সামরিক জেলার কমান্ডার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত এই সামরিক জেলাটির দায়িত্ব ছিল পশ্চিম দিক থেকে যেকোনো আগ্রাসন প্রতিহত করা এবং সেখান থেকে শত্রুপক্ষের ভূমিতে প্রতিআক্রমণ চালানো। তিমোশেঙ্কো প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর উক্ত সামরিক জেলাটির কমান্ডারের পদ ফাঁকা ছিল, যেটি পূরণের জন্য ঝুকভকে নির্বাচিত করা হয়। ঝুকভ ছিলেন একজন সদ্য যুদ্ধবিজয়ী সমরনায়ক, সুতরাং এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তাকেই উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
মঙ্গোলিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৪০ সালের ২ জুন ঝুকভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব (এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক) জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এটি ছিল স্তালিনের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি স্তালিনের নিকট মঙ্গোলীয়–মাঞ্চুকুয়োয়ান সীমান্তের সামগ্রিক পরিস্থিতি, এতদঞ্চলে জাপানিদের শক্তিসামর্থ্য ও সোভিয়েত সৈন্যদলের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন পেশ করেন। ঝুকভের আত্মজীবনী অনুযায়ী, স্তালিনের আচরণ ছিল নম্র এবং সামরিক বিষয়াবলি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল প্রখর। ঝুকভের আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত অংশ অনুযায়ী, স্তালিনের নম্র আচরণ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন, কারণ তার মনে হয়েছিল, স্তালিনের আচরণ আসলেই এ রকম হলে সবাই তাকে এত ভয় পায় কেন? বস্তুত স্তালিনের ব্যক্তিত্ব ঝুকভকে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীতে স্তালিনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ঝুকভ বুঝতে পেরেছিলেন, স্তালিন প্রয়োজন অনুসারে নম্র এবং নিষ্ঠুর দুইই হতে পারেন।
স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাতের তিন দিন পর ১৯৪০ সালের ৫ জুন ঝুকভকে ‘জেনারেল অফ দ্য আর্মি’ পদ প্রদান করা হয় এবং তিনি তার দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে কিয়েভে পৌঁছান। ঝুকভের মতে, তিনি এই দায়িত্ব পেয়ে খুশি ছিলেন এবং এটিকে ‘খুবই সম্মানজনক’ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু কর্মস্থলে পৌঁছে সেখানকার সামগ্রিক চিত্র দেখে ঝুকভ সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
কিয়েভ সামরিক জেলা সেসময় নানান সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল– সৈন্যদের মধ্যে মনোবল, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার অভাব, ব্যাপক হারে দলত্যাগের প্রবণতা, ত্রুটিযুক্ত সামরিক ও অন্যান্য সরঞ্জাম, বাসস্থান সমস্যা এবং ভালো অফিসারের অপ্রতুলতা। সামরিক জেলাটির শ্রেষ্ঠ ডিভিশন ও ইউনিটগুলোকে ফিনল্যান্ড অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। তদুপরি, পশ্চিম ইউক্রেন অধিকারের পর সেই অঞ্চলটিও কিয়েভ সামরিক জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং এর ফলে সেখানে আরো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল।
রুমানিয়া অভিযান: বিনা যুদ্ধে বিজয়
এই পরিস্থিতির মধ্যেই ঝুকভকে রুমানিয়া আক্রমণের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯১৮ সালে রুশ গৃহযুদ্ধ চলাকালে রুমানিয়া বলশেভিকদের পরাজিত করে বেসারাবিয়া (বর্তমানে মলদোভার অংশ) দখল করে নিয়েছিল। রুমানিয়া ছিল জার্মানির মিত্র, কিন্তু মলোতভ–রিব্বেনট্রপ চুক্তির গোপন ধারা অনুযায়ী জার্মানরা অঞ্চলটিকে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই মোতাবেক ১৯৪০ সালের ২৬ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন রুমানিয়াকে একটি চরমপত্র প্রদান করে এবং বেসারাবিয়া ও উত্তর বুকোভিনা সোভিয়েতদের কাছে হস্তান্তর করার দাবি জানায়। উল্লেখ্য, জাতিগত ইউক্রেনীয়–অধ্যুষিত উত্তর বুকোভিনা মলোতভ–রিব্বেনট্রপ চুক্তির আওতাভুক্ত ছিল না এবং জার্মানি এই ব্যাপারে খুশি ছিল না। কিন্তু তারা রুমানিয়াকে সোভিয়েতদের দাবি মেনে নেয়ার পরামর্শ দেয় এবং ২৮ জুন রুমানিয়া সোভিয়েতদের কাছে অঞ্চল দুইটি হস্তান্তর করতে সম্মত হয়।
২৮ জুন ঝুকভের অধীনস্থ কিয়েভ সামরিক জেলার সৈন্যরা বেসারাবিয়া ও উত্তর বুকোভিনায় প্রবেশ করে এবং অঞ্চলদ্বয়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। কিন্তু এই অভিযানের সময় তাদের মান ও দক্ষতা নিয়ে ঝুকভ মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। ১৭ জুলাইয়ে প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, রুমানিয়া অভিযানের সময় কিয়েভ সামরিক জেলার সৈন্যদলের বেশকিছু গুরুতর সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত রণপ্রস্তুতির অভাব, ইউনিটগুলোর অসংগঠিত অবস্থা ও সেগুলোর ওপর কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণের অভাব, নিম্নমানের গোয়েন্দা কার্যক্রম, শৃঙ্খলার অভাব এবং স্থানীয় জনসাধারণের প্রতি দুর্ব্যবহার।
স্বভাবতই ঝুকভ তার সৈন্যদের বিস্তৃত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন এবং সংগঠন কাঠামোর সংস্কার সাধনে মনোযোগী হন। অকর্মণ্যতার দায়ে তিনি বেশ কয়েকজন কমান্ডারকে বরখাস্ত করেন এবং একজন কমান্ডারকে সামরিক আদালতের মুখোমুখি করেন। ঐ কমান্ডারের ডিভিশনের সৈন্যরা বেসারাবিয়ায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল।
রণপরিকল্পনা ও যুদ্ধক্রীড়া: জার্মানির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি
ইতোমধ্যে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিরেকে সমগ্র ইউরোপের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিল এবং সোভিয়েত–জার্মান সম্পর্কে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েতরা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নানা ধরনের পরিকল্পনা তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় ঝুকভ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লাল ফৌজের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুইটি সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধ সম্পর্কে তার নিজস্ব পরিকল্পনা পেশ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ সময় লাল ফৌজের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, জার্মানি যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়, সেক্ষেত্রে তাদের মূল আক্রমণ দক্ষিণ দিকে কেন্দ্রীভূত হবে এবং ইউক্রেনের শস্যভাণ্ডার ও ককেশাসের তেলভাণ্ডার দখলের হবে তাদের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য তারা লাল ফৌজের তদানীন্তন তিনটি বিশেষ সামরিক জেলার মধ্যে কিয়েভ সামরিক জেলায় সবচেয়ে বেশি সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করার পক্ষপাতী ছিলেন। বাকি দুইটি সামরিক জেলায় (মিনস্কভিত্তিক পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক জেলা এবং রিগাভিত্তিক বাল্টিক সামরিক জেলা) জার্মান আক্রমণ তুলনামূলকভাবে সীমিত হবে বলে তারা মনে করতেন। ঝুকভও এই বিশ্বাস পোষণ করতেন এবং এজন্য কিয়েভ সামরিক জেলার শক্তিবৃদ্ধির জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালান।
১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে লাল ফৌজ সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত দুইটি যুদ্ধক্রীড়ার (war game) আয়োজন করে। এদের মধ্যে প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয় ২ থেকে ৬ জানুয়ারির মধ্যে। এই মহড়ায় দেখানো হয় যে, জার্মান সৈন্যরা পূর্ব প্রাশিয়া থেকে বেলোরুশিয়া ও বাল্টিক অঞ্চলে আক্রমণ চালাচ্ছে। এই মহড়ায় ঝুকভ ছিলেন কল্পিত জার্মান আক্রমণকারী বাহিনীর কমান্ডার, আর জেনারেল দিমিত্রি পাভলভ ছিলেন কল্পিত সোভিয়েত প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার। এ সময় পাভলভ সীমান্তে শত্রুপক্ষের অনুপ্রবেশ সীমিত করতে সক্ষম হন এবং ঝুকভের বাহিনীর বাম বাহুর ওপর তীব্র প্রতিআক্রমণ চালান, যেটির উদ্দেশ্য ছিল ঝুকভের বাহিনীকে পিছন থেকে ঘিরে ফেলা। জবাবে ঝুকভ পাভলভের বাহিনীকে তার শক্তিশালী বাম বাহুর ওপর আক্রমণ চালানোর সুযোগ দিয়ে তাদেরকে প্রলম্বিত যুদ্ধে লিপ্ত রাখেন এবং এই সুযোগে পাভলভের বাহিনীর বাম বাহুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে রিগার দিকে অগ্রসর হন।
দ্বিতীয় যুদ্ধক্রীড়াটি অনুষ্ঠিত হয় ৮ থেকে ১১ জানুয়ারির মধ্যে। এই মহড়ায় দেখানো হয় যে, সোভিয়েত সৈন্যরা ইউক্রেন থেকে জার্মান–অধিকৃত পোল্যান্ড এবং জার্মান মিত্র রুমানিয়া ও হাঙ্গেরির ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এই মহড়ায় ঝুকভ ছিলেন কল্পিত সোভিয়েত আক্রমণকারী বাহিনীর কমান্ডার, আর পাভলভ ছিলেন কল্পিত জার্মান প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার। এবারও ঝুকভ দক্ষতার সঙ্গে এমনভাবে সৈন্য পরিচালনা করেন যে তারা পাভলভের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে পোল্যান্ডের গভীরে পৌঁছাতে এবং বহু সংখ্যক শত্রু ডিভিশন (কল্পিতভাবে) ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
দুইটি যুদ্ধক্রীড়ার কোনোটিই পুরোপুরি শেষ করতে দেয়া হয়নি, কিন্তু দুইটিতে ঝুকভ অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। এই যুদ্ধক্রীড়ার মধ্য দিয়ে লাল ফৌজের রণনীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লাল ফৌজের কমান্ডারদের ধারণা ছিল, জার্মানি যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবে না। লাল ফৌজ প্রথমে সোভিয়েত সীমান্ত অঞ্চলে জার্মানদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করবে এবং এরপর জার্মান–নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে পাল্টা আক্রমণ চালাবে।
বস্তুত প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই লাল ফৌজ ছিল একটি আক্রমণমুখী বাহিনী এবং তাদের জন্য ‘আক্রমণই ছিল শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। এর ফলে তারা আক্রমণের জন্য যতটা প্রস্তুত ছিল, দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিরক্ষার জন্য ততটা প্রস্তুত ছিল না। এই নীতির কারণে পরবর্তীতে তাদেরকে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
জেনারেল স্টাফের প্রধান এবং উপ–প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে ঝুকভ
যুদ্ধক্রীড়া দুইটি শেষ হওয়ার পর ১৯৪১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঝুকভকে লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ঝুকভ কখনো জেনারেল স্টাফ অ্যাকাডেমিতে শিক্ষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু খালখিন গোল যুদ্ধে তার কৃতিত্বের কারণে তাকে এই পদে নিযুক্ত করা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি তিনি মস্কোয় পৌঁছান এবং দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ প্রদান করা হয় এবং সামরিক যোগাযোগ, জ্বালানি সরবরাহ, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও জেনারেল স্টাফ অ্যাকাডেমি পরিচালনার দায়িত্বও তার ওপর অর্পণ করা হয়। একই সঙ্গে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রার্থী সদস্যও নির্বাচিত হন। মস্কোর গ্রানোভস্কি সরণিতে অবস্থিত একটি অ্যাপার্টমেন্টে ঝুকভ ও তার পরিবার বাস করতে থাকে এবং পরবর্তী ২০ বছর এটিই ছিল তাদের আবাসস্থল।
ঝুকভ জেনারেল স্টাফের প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর প্রথম যে নথিগুলোতে স্বাক্ষর করেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সৈন্যসমাবেশ পরিকল্পনা – ১৯৪১’। বস্তুত এই পর্যায়ে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কা করছিল এবং এজন্য তাদের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা ছিল তারই অংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪১ সালের শেষ নাগাদ লাল ফৌজের সদস্য সংখ্যা ৪০ লক্ষ থেকে ৮০ লক্ষে উন্নীত করা এবং এদের মধ্যে ৬৫ লক্ষ সৈন্যকে পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি বিশেষ সামরিক জেলায় মোতায়েনের কথা ছিল। কিন্তু সোভিয়েতদের জন্য দুর্ভাগ্যবশত এই পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
বস্তুত সোভিয়েতরা জানত যে, তাদের সঙ্গে জার্মানদের যুদ্ধ বাঁধবেই এবং এই উদ্দেশ্যে তারা সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ঠিক কখন জার্মানরা আক্রমণ চালাবে, এই বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল না। স্তালিন ছিলেন একজন কঠোর বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ এবং তিনি বাস্তবতার নিরিখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ব্রিটেনের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালাবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি একই সঙ্গে পূর্বে রাশিয়া এবং পশ্চিমে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। একই সঙ্গে দুই রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের মূল কারণ।
সুতরাং, স্বাভাবিক যুক্তির ভিত্তিতে স্তালিন অনুমান করেছিলেন যে, এবারের যুদ্ধে জার্মানি বিগত যুদ্ধের মতো ভুল করবে না। এজন্য জার্মানি ১৯৪১ সালের জুনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে, সোভিয়েত গুপ্তচর বিভিন্ন দলের কাছ থেকে এই মর্মে তথ্য পাওয়ার পরেও তিনি সেগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। অনুরূপভাবে, ঝুকভ এবং অন্য শীর্ষ সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তারাও প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, যদিও ঝুকভের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অংশত বিপদের আভাস দিচ্ছিল বলেই তিনি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪১ সালের ২২ জুন ভোরে জার্মানি ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকে এবং দুই বছর আগে স্বাক্ষরিত অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ৩৮ লক্ষ সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত ইতিহাসের বৃহত্তম আক্রমণকারী সৈন্যদল যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলে মোতায়েনকৃত লাল ফৌজের সৈন্যদলগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই। আসন্ন দিনগুলো হবে লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের প্রধান জেনারেল গিওর্গি ঝুকভের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়!
(এরপর দেখুন ৫ম পর্বে)