ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে কজন বাঙালি বিপ্লবী সাড়া জাগিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ তিতুমীরের অবস্থান সামনের কাতারে। সমরশক্তি ছাড়া শুধুমাত্র মানসিক পরাক্রম দ্বারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার সাহসিকতার স্ফুলিঙ্গ তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। নিজের জীবনের বিনিময়েও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি কখনো। ছিলেন ধর্মপ্রাণ, কিন্তু অত্যাচার করেননি অন্য কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে। প্রতিদানও পেয়েছেন হাতে-নাতে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছিলেন সকলের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার পাত্র। চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করবার। পথ হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন সশস্ত্র বিপ্লব। শেষ পর্যন্ত দেশের পক্ষে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন, তবুও ইংরেজদের হাতে ধরা দেননি। স্বাধীন করতে পারেননি দেশকে, তবে দেখিয়ে গেছেন সাহসিকতার নমুনা; তাকে দেখে আগ্রহী হয়েছে মুক্তিকামী আরো হাজার তরুণ।
বিদ্রোহ পূর্ববর্তী জীবন
তিতুমীরের নাম কীভাবে ‘তিতুমীর’ হলো তা বেশ চমকপ্রদ। যে তেতো ওষুধ খেতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই অনীহা প্রকাশ করে সে ওষুধ অনায়াসে খেতে পারতেন তিনি। সেখানে থেকে তার নাম হলো তিতু আর মূল নাম থেকে মীর ধার করে হয়ে গেল তিতুমীর। সৈয়দ মীর নিসার আলী থেকে ধীরে ধীরে পরিচিতি পেলেন তিতুমীর হিসেবে।
১৭৮২ সালের জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার চাঁদপুরে জন্ম নেন তিতুমীর। তাদের পরিবারের দাবী তারা হযরত আলী (র)-এর বংশধর। পরিবারের এ দাবীর সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা যায় না। সময়ের সাথে সাথে তিতুমীর ধীরে ধীরে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও সুঠাম দেহের অধিকারী হয়ে উঠতে লাগলেন। চার বছর বয়সে পড়াশুনায় হাতেখড়ি হবার পর একে একে শিখতে থাকেন বাংলা, উর্দু, আরবি, ফারসি ও গণিত। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখার পূর্বেই আয়ত্ত করেন অসি চালনা, তীর চালনা, মুষ্টিযুদ্ধ ও লাঠি খেলা। পূর্ণ যুবক অবস্থায় তিনি ছিলেন সেখানকার নামকরা কুস্তিগীর।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি কোরআনের হাফেজ হন। পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন সে সময়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিজেকে ঝালাই করে নিতেন প্রায়শ। কলকাতার এক কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। তারপর তার নাম ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র কলকাতা। এর সুবাদে কলকাতার এক জমিদারের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। সেখান থেকে শিখেন যুদ্ধ জয়ের সামরিক কৌশল। পরবর্তীতে আরো নানান জায়গায় ঘুরে আরো নানাবিধ বিষয় রপ্ত করেন তিনি।
জীবন বদলে দেয়া সফর
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কা নগরীতে গমন করেন। মক্কা গমন তার জীবনের গতিপথই পরিবর্তন করে দেয়। মক্কায় হজব্রত পালনের পর তিনি মদিনা ভ্রমণ করেন। সেখানে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সাথে সাক্ষাত হয় তিতুমীরের। তার সংস্পর্শে এসে তিনি বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। সম্পূর্ণরূপে ইসলামি চিন্তাধারায় বিশ্বাসী এবং ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ হিসেবে তিনি ইসলাম প্রচারে নিজের সর্বস্ব নিয়োজিত করার অঙ্গিকার নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন।
১৮২৭ সালে তিনি চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় পুরোদস্তুর ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এবং একইসাথে ব্রিটিশবিরোধী প্রচারও করতে থাকেন। তিনি জানতেন যে অধিকাংশ জমিদাররা ব্রিটিশদের ছায়াতলে থেকে বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাই অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা খুব দ্রুতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং এক সময় প্রায় ৪০০ জনের একটি দল তিনি গড়ে তুলতে সমর্থ হন।
বিদ্রোহী তিতুমীর
তিতুমীরের জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে তা অত্যাচারী জমিদারদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিতুমীরকে রুখতে স্থানীয় জমিদাররা এক জঘন্য পন্থা অবলম্বন করে। তারা মুসলিমদের দাড়ি ও মসজিদের ওপর খাজনা আরোপ করে। এমনকি কারো ইসলামি নাম রাখতে চাইলেও খাজনা দাবী করে তারা। যেন খাজনার ভয়ে কেউ তিতুমীরের সাথে যোগ না দেয়। তিতুমীর স্বভাবসুলভ উপায়ে এসবের বিরোধিতা করলে জামিদারদের সাথে তার প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমেই তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।
জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে মিসকিন শাহ্ ও তার দলবল তিতুমীরের সাথে যোগ দেয়। পরবর্তীতে গোবরাগোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়, নাগপুরের গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী, তারাকান্দির রাজনারায়ণ, গোবরডাঙ্গার কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সাথে তিতুমীরের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। প্রত্যেকেই সম্মুখ যুদ্ধে তিতুমীরের কাছে পরাজিত হয়। ফলে তিতুমীর তার সমস্ত এলাকা জুড়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে এবং হিন্দু-মুসলিম উভয়েই তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তার দলে যোগ দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে নদীয়া, চব্বিশ পরগনা ও ফরিদপুরের কিছু অংশ তার দখলে চলে আসলে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং উক্ত অঞ্চল মিলিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এটিই বারাসাত বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত। সে রাষ্ট্র জমিদার তথা ব্রিটিশদের খাজনা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় এবং সব ধরনের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। বিদ্রোহ দমন করতে এলে গোবরাগোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় নিহত হন।
ইতোমধ্যে তিতুমীরের খবর ব্রিটিশদের কানে পৌঁছে যায় এবং তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গনে ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ মিত্র হিসেবে গোবরডাঙ্গা ও নদীয়া অঞ্চলের জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। তিন বাহিনীর সম্মিলিত শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তাদের পরাজিত করে বীর তিতুমীর। পরবর্তীতে সরফরাজপুরের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় জুম্মার নামাজের সময় মুসলিমদের ওপর হামলা করলে দু জন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নিহত হন। তখন তিতুমীর তার বাহিনী নিয়ে নারকেলবাড়িয়া চলে আসেন।
নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা
১৮৩১ সালের ২৭ অক্টোবর সরফরাজপুর থেকে নারকেলবাড়িয়ায় গমনের পর তিতুমীর নিজেদের আত্মরক্ষার স্বার্থে বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। সেখানেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ চলতে থাকে। তবে কৃষ্ণদেব রায় এদিকে আবার তিতুমীরের ওপর হামলার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ২৯ অক্টোবর তিনি নারকেলবাড়িয়ায় হামলা করে বসেন এবং অতর্কিত এ হামলায় তিতুমীর বাহিনীর অনেকেই আহত হয়। এ ঘটনায় তিতুমীরের ভাগনে শেখ গোলাম মাসুম প্রায় ৫০০ জনের একটি সৈনিক দল নিয়ে তিতুমীরের সাথে যোগদান করে এবং পরবর্তীতে গোলাম মাসুমকে যোদ্ধা দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
৬ নভেম্বর কৃষ্ণদেব পুনরায় নারকেলবাড়িয়া হামলা করলে অনেকেই হতাহত হয়। ফিরে গিয়ে কৃষ্ণ দেব এবারও হামলার পরিকল্পনা সাজায়। তবে এবার তা ছিল ব্রিটিশদের সহায়তায়। ব্রিটিশ নীলকুঠি ম্যানেজার ডেভিস বিভিন্ন ভারি অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে নারকেল বাড়িয়ায় হামলা করে। তীব্রযুদ্ধে পরাজয় সুনিশ্চিত জানতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে যায় ডেভিস। জয়ধ্বনি ওঠে নারকেলবাড়িয়ায়। পরবর্তী দুই তিন দিনের মধ্যে জমিদার দেবনাথ হামলা করে নারকেলবাড়িয়ায়। তিতুমীর বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে দেবনাথ পরাজিত ও নিহত হন।
বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে আরেক দফা আক্রমণ হয় সে বছরেরই ১৩ই নভেম্বর। বন্দুক নিয়েও সে যাত্রায় জিততে পারেনি ব্রিটিশ এই ম্যাজিস্ট্রেট। উভয়ের পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষতক জান নিয়ে পালিয়ে যান আলেকজান্ডার। তিতুমীরের হাতে বন্দী হয় এক দারোগা ও জমাদ্দার।
তিতুমীরের শেষ যুদ্ধ
এতো চেষ্টা করেও তিতুমীরকে দমন করতে না পেরে সবশেষে ব্রিটিশরা তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। ১৯ নভেম্বর সমগ্র ভারতের গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক হামলার পরিকল্পনা করেন। হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য এবং বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ নিয়ে কর্নেল স্টুয়ার্ট হামলা করেন বাঁশের কেল্লায়। প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ রক্ষা হয়নি তিতুমীরের। চাইলেই আত্মসমর্পণ করা যেত, জীবন ভিক্ষা চাওয়া যেত। কিন্তু বীর সর্বদাই বীর, হোক তা জীবিত অথবা মৃত অবস্থায়।
যুদ্ধের এক পর্যায় ব্রিটিশ গোলার আঘাতে নিহত হন তিতুমীর। আরো প্রায় ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েক জনকে দেয়া হয় ফাঁসি, বাকিদের দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের সাজা। আর এতেই সমাপ্তি ঘটে বারাসাত বিদ্রোহীদের জীবনযুদ্ধ।
অনেকের দৃষ্টিতে তিতুমীর শুধুমাত্র একজন ধর্মযোদ্ধা ছিলেন। তাদের মতে তিনি শুধুমাত্র নিজের ধর্মের স্বার্থেই যুদ্ধ করেছিলেন। ধর্মযুদ্ধ কিংবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যা-ই তিনি করেন না কেন, সেটা ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই। তার আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে অল্প কিছুদিনের জন্যে হলেও উপমহাদেশের কিছু অংশ ছিল স্বাধীন। এ তথ্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই, এ স্বাধীনতাই পরবর্তী সময়ের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল।
তিতুমীরের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বাংলাদেশের একটি কলেজের নাম রাখা হয় তার নামানুসারে। এছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণও করা হয়েছে তিতুমীরের নামের স্মরণে। বিদ্রহী তিতুমীরের স্মৃতি আমাদের সকলের মনে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র: শত বিপ্লবীর কথা, সম্পাদনা: শেখ রফিক, পৃষ্ঠা ৩২-৩৭, প্রকাশকাল: ২০১৪
ফিচার ইমেজ- ইউটিউব