শম্ভুনাথ দে জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের পহেলা ফেব্রুয়ারি হুগলী জেলার গরিবাটি গ্রামে। তার পিতা দাশুরথি দে ও মা চট্টেশ্বরী। দাশুরথি তার পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়ার ফলে পিতা অকালে মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথে শৈশবেই সংসারের সমস্ত ব্যয়ভার তার ওপর এসে পড়েছিল। এজন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে গ্রামের এক মুদি দোকানেই তিনি দোকান সহকারীর কাজ করা আরম্ভ করেছিলেন। পরবর্তীতে যদিও তিনি নিজে একটা ছোটখাট ব্যবসা আরম্ভ করেন। কিন্তু তাতে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এজন্য শম্ভুনাথের জন্মের পরেও তাকে এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটিতে বিভিন্ন অভাব অনটনের মধ্যে বড় হতে হয়েছিল। কিন্তু বংশের সবচেয়ে বড় সন্তান হওয়ায় সকলের আদর এবং মমতায় পরিপূর্ণ ছিল তার শৈশব।
অধ্যাপক শম্ভুনাথ দে (source: www.desh.co.in)
সেই সময় পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন তার কাকা। এ কাকাই তার ভেতরে প্রথম পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন। কাকার অনুপ্রেরণাতে মূলত শম্ভুনাথ স্কুলে ভর্তি হন। গরিবাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ডিস্টিংশন সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি হুগলী মহসিন কলেজে পড়বার জন্যে বৃত্তি পান। উচ্চ মাধ্যমিকেও তিনি তার কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন এবং ফলস্বরূপ কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়বার সুযোগ পান। পাশাপাশি তিনি ডি পি আই বৃত্তি লাভ করেন। ইতোমধ্যে তার কাকা, তার পড়াশোনায় অবিরাম অনুপ্রেরণা জোগানো মানুষটি, মৃত্যুবরণ করায় আর্থিক ও মানসিক প্রতিকূলতা তাকে গ্রাস করে।
এই সময়ে সেই সময়কার কলকাতার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কে সি শেঠ এগিয়ে আসলেন তার পাশে। মূলত তার আর্থিক সাহায্যেই শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হন। পাশাপাশি নিজের বাসভবনেরই একটা অংশে তিনি শম্ভুনাথের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম থেকেই মেধাবী ও স্থিতধী শম্ভুনাথ শিক্ষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। সেই সময় প্যাথলজি বিভাগে ব্যাকটেরিওলজির অধ্যাপক ও শিক্ষক মণীন্দ্রনাথ দে’র বিশেষ স্নেহের পাত্রে পরিণত হন তিনি। তাই দুই পরিবারের মধ্যে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও কন্যা তরুবালার সাথে তিনি শম্ভুনাথের বিয়ে দেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে শম্ভুনাথ এম বি এবং ১৯৪২ সালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিকিৎসাবিদ্যায় (Tropical Medicine) ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
১৯৪২ সালেই তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে প্রদর্শক পদে নিযুক্ত হন। এই সময় অধ্যাপক বি পি ত্রিবেদীর অধীনে তিনি তার গবেষণা কার্য চালাতে থাকেন। সমসাময়িক সময়ে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবা প্রদানও অব্যাহত রাখতে হয়। কারণ এছাড়া তার গ্রামে থাকা একান্নবর্তী পরিবারের ব্যয়ভার সংকুলান তার দ্বারা সম্ভব ছিল না। অধ্যাপক বি পি ত্রিবেদীর অধীনে গবেষণাকালে তারা যুগ্মভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
মণীন্দ্রনাথ দে শম্ভুনাথের জীবনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি অধ্যাপক জি আর ক্যামেরন ( যিনি পরবর্তীতে নাইটহুড উপাধিও পেয়েছিলেন) এর অধীনে হাইড্রোসেফালাস রোগের দ্বারা মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন হয় সেই সম্পর্কিত গবেষণার জন্য শম্ভুনাথকে ১৯৪৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে প্রেরণ করেন। হাইড্রোসেফালাস একধরনের স্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত রোগ, যেখানে মস্তিষ্কে সেরেব্রো স্পাইনাল রস (CSF) এসে জমা হওয়ার ফলে বিভিন্ন উপসর্গের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
গবেষণা করতে গিয়ে শম্ভুনাথ একটি অন্যরকম বাধার সম্মুখীন হন। তিনি দেখেন যে, ইঁদুরটি নিয়েই তিনি গবেষণা করতে যাচ্ছেন সেটিই দুর্ভাগ্যজনকভাবে পালমোনারী রক্তসঞ্চালনে বাধার কারণে ফুসফুস স্ফীত হয়ে মারা যাচ্ছে। এই বিষয়টি তাকে হাইড্রোসেফালাস ও পালমোনারী রক্তসঞ্চালন এর মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় নিয়ে গবেষণা করতে উৎসাহী করে তোলে। তিনি “Pulmonary edema and experimental hydrocephalus” বিষয়ে তার অভিসন্দর্ভ রচনা করেন এবং ১৯৪৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। এরপরে তিনি কলকাতায় ফিরে আসলেও অধ্যাপক ক্যামেরনের সাথে তার আমৃত্যু যোগাযোগ ছিল।
কলকাতায় ফিরে তিনি সম্পূর্ণ নতুন বিষয়ের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন। কলেরা রোগের সংক্রমণ নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করলেন। এই সময়ে তিনি যোগ দিলেন নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজে। রবার্ট কখ একসময় একটা কথা বলেছিলেন-
“কলেরা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের দেশে কলেরা নেই বললেই চলে। অথচ ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রচুর কলেরা রোগী সেখানে কলেরা নিয়ে তেমন কেউই গবেষণা করেন না।”
তাই শম্ভুনাথ দে যখন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে ছিলেন তখনই কলেরা নিয়ে গবেষণা করবার কথা তার মাথায় আসে। এজন্য যখন তিনি দেশে ফিরে নীলরতন মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন তখন তিনি গবেষণার প্রধান বিষয় হিসেবে কলেরা রোগ এবং এর জীবাণুর সংক্রমণকে বেছে নেন। শম্ভুনাথের কলেরা নিয়ে গবেষণার বহু আগে ১৮৮৩ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট কখ কলেরা জীবাণু নিয়ে কাজ করতে কলকাতাতে আসেন। কারণ কলেরা রোগটির মূল প্রাদুর্ভাব ক্ষেত্র ছিল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলো। বিশেষত এই বাঙলায় কলেরা রোগের সংক্রমণ এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করত যে পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে কলেরার মহামারীতে গ্রামের পর গ্রাম খুব অল্প দিনেই উজাড় হয়ে যেত- এমন নজিরও ছিল। কলকাতাতে এসে কখ কলেরার জীবাণুকে আলাদা করতে পারলেন এবং ১৮৮৪ সালে এই বিষয়ে তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। কিন্তু এই জীবাণুটিকে কলেরা রোগের জন্যে দায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই কখ তার নিজের তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ালেন।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে, সংক্রমণ অণুজীববিদ্যার ভিত্তি হিসেবে কখ কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন, যার মাধ্যমে কোনো রোগাক্রান্ত জীবের শরীরে থাকা অনেক জীবাণুর মধ্যে কোন জীবাণুটিই যে ঐ রোগের জন্যে দায়ী সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যেত।
প্রথমত, রোগাক্রান্ত জীবের শরীর থেকে সেই জীবাণুটিকে পৃথক করে জীবাণুটিকে আলাদাভাবে বাড়তে দিয়ে তার বিশুদ্ধ সমষ্টি সংগ্রহ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, কোনো সুস্থ প্রাণীর শরীরে সেই বিশুদ্ধ জীবাণু সমষ্টি কোনোভাবে প্রবেশ করিয়ে দেখতে হবে সেই শরীরেও একই রোগ দেখা দিচ্ছে কিনা।
তৃতীয়ত, এই প্রাণীটির শরীর থেকে রোগের জীবাণু সংগ্রহ করে আগের মতোই আরেকটি সুস্থ প্রাণীর দেহে তা প্রবেশ করিয়ে দেখতে হবে রোগ সৃষ্টি করা যায় কিনা।
এই ধাপগুলোর শেষে যদি সবক’টি ক্ষেত্রেই রোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় তবে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে ওই জীবাণুটিই সেই নির্দিষ্ট রোগের কারণ।
কখ কলেরা রোগের জীবাণুটি পৃথক করলেন (Vibrio cholerae)। জীবাণুর বিশুদ্ধ সমষ্টিও তৈরি করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই এই জীবাণু দিয়ে অন্য কোনো সুস্থ প্রাণীর দেহে কলেরা রোগ সৃষ্টি করতে পারলেন না। তারপরেও কলেরা রোগ সৃষ্টিতে এই জীবাণুটির ভূমিকা সম্বন্ধে কখ এতখানিই নিশ্চিত ছিলেন যে, তিনি এই জীবাণুর সংক্রমণের ব্যাপারটিকে তার তত্ত্বের একটি ব্যতিক্রম হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং বললেন এই জীবাণুই কলেরা রোগের জন্য দায়ী।
কখ জীবাণুটিকে নির্ভুলভাবে শনাক্ত ও পৃথক করেছিলেন- এ কথা অবশ্যই সত্য। কিন্তু কখের তত্ত্বানুযায়ী এই জীবাণু কীভাবে তার সংক্রমণ ঘটাচ্ছে এবং তার বিষক্রিয়ার মাধ্যমে কিভাবে মৃত্যু ঘটাচ্ছে সে সম্বন্ধে কোনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। কখের কথা অনুযায়ী, এই জীবাণুটি দ্বারা নিঃসৃত বিষ হলো একধরনের এন্ডোটক্সিন, যা কিনা ব্যাকটেরিয়াটির কোষপ্রাচীরের সাথে যুক্ত থাকে এবং এটি কোষকে পুরোপুরি মেরে ফেলে। অথচ এই প্রক্রিয়ারও কোনো সঠিক বর্ণনা দিতে তিনি ব্যর্থ হন।
এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৯০৫ সালে কখ যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রে তার অনবদ্য অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান আর কখের কথাই কলেরা রোগের সংক্রমণের ক্ষেত্রে ধ্রুব সত্য মেনে নিয়ে এই বিষয়ে মানুষের আগ্রহও কমতে থাকে। এরপরে যদিও কলেরা রোগের আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছু টিকা বা স্যালাইন ইনজেকশন চালু হয়, তবুও আসলে তেমন কার্যকরী ছিল না। কারণ যে জীবাণুর সংক্রমণক্রিয়াই ভালভাবে জানা যায় নি, সেই জীবাণুর সংক্রমণক্রিয়া ঠিকমতো প্রতিরোধ করাটা খানিকটা “আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া”র মতো ছিল। শম্ভুনাথ তাই এই সংক্রমণক্রিয়া নিয়ে কখের মতবাদ অনুসারে চলতে থাকা পুরনো ধ্যান ধারণার উপরেই কুঠারাঘাত করলেন।
যেখানে সবাই মনে করতেন কলেরার ফলে অন্ত্রের দেওয়ালের উপর যে পিচ্ছিল পদার্থ দ্বারা আবৃত আবরণী আছে তা নষ্ট করে কলেরা জীবাণু সবখানে ছড়িয়ে পড়াটা একটি গৌণ উপসর্গ, শম্ভুনাথ দেখালেন এটিই আসলে জীবাণুর সংক্রমণের মূল মারণ প্রভাব। তার মতে, বিষটি এন্ডোটক্সিন নয়, এক্সোটক্সিন। বছরের পর বছর চলতে থাকা এই মূল ধারণাটিই শম্ভুনাথ পাল্টে দিয়েছিলেন।
এই মত প্রমাণের জন্যে শম্ভুনাথ বেছে নিয়েছিলেন, “বিচ্ছিন্ন আন্ত্রিক ফাঁস পরীক্ষণ (Ligated Intestinal Loop Experiment)”। অন্ত্রের উপর কলেরা জীবাণুর নিঃসৃত বিষের প্রভাব দেখার জন্যে খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের একটা অংশ নিয়ে তার একটা ছোট দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট করে প্রথমে দু’মাথা আটকে দেওয়া হল। এতে ছোট নলের মতো যে প্রকোষ্ঠ তৈরি হলো সেখানে নেওয়া হলো কেবল জীবাণুর নির্যাস (কোষপ্রাচীর ব্যতীত, কারণ কখের ধারণা মতে জীবাণুটির বিষ নিঃসৃত হয় কোষ প্রাচীর থেকে। তাই শম্ভুনাথ কোষপ্রাচীর পৃথক করে ফেলেছিলেন।) এভাবে পরীক্ষা সাজিয়ে রেখে দেওয়া হলো।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল অন্ত্রের ওই অংশটিতে এসে জমতে থাকল দেহনিঃসৃত তরল। এমনিতে দেহ থেকে অন্ত্রের মধ্যে দেহরসের প্রবেশ অসম্ভব। কিন্তু ওই নির্যাসে থাকা বিষ অন্ত্রের দেওয়ালে এমনভাবে পরিবর্তন ঘটায় যে তা দেহরসের কাছে ভেদ্যরূপে পরিণত হয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের ওই অংশে বিচ্ছিন্ন বাধা না দেওয়া হলে তা অন্ত্র থেকে বের হয়ে পায়ুপথ দিয়ে দেহের বাইরে নির্গমণ হত, যেটি আসলে পাতলা পায়খানা হিসেবে বেরিয়ে আসত, যা কলেরার অন্যতম উপসর্গ ছিল। এভাবেই শরীর থেকে প্রয়োজনীয় জল নিঃশেষিত হবার মাধ্যমে রোগী আস্তে আস্তে দুর্বল ও পরিশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে বহুদিন ধরে চলে আসা একটি ত্রুটিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণাকে যে অধ্যাপক শম্ভুনাথ দে পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন শুধু তা-ই নয়। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি কলেরা গবেষণায় খরগোশকে সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। ১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত “নেচার” গবেষণা পত্রিকায় অধ্যাপক দে’র এই পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ‘Enterotoxicity of bacteria-free culture-filtrate of Vibrio cholerae’ শিরোনামে গবেষণাপত্র বের হয়। কিন্তু তার এই আবিষ্কার সেই সময় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রচার পায়নি। অবহেলায়, বিনা স্বীকৃতিতে তার এই কাজ রয়ে গেছে এক বিরাট সময় পর্যন্ত। স্বীকৃতির অভাবে তার পরবর্তী গবেষণায় সাহায্যও মেলেনি। এভাবেই তার বহু গবেষণার কাজ অসম্পূর্ণ হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯৬৬ সালে তার গবেষণা জগতের পথপ্রদর্শক ও গুণগ্রাহী অধ্যাপক ক্যামেরনের মৃত্যু তাকে মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত দেয়। তিনি বলেছিলেন,
“His death put the last nail on my struggle against all these odds.”
১৯৭৩ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবন থেকে অবসরে যান। কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি না পাওয়া, গবেষণা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়া- সব মিলিয়ে তিনি হতাশ ছিলেন ভীষণভাবে। অবশেষে ১৯৭৮ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন তাকে কলেরা ও ডায়রিয়ার উপর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানালে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা শক্তি ফিরে পান। সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
“I have been dead since the early 1960’s, I have been exhumed by the Nobel Symposium Committee and these two days with you make me feel that I am coming to life again.”
এরপরে তিনি গবেষণায় আবার মনোনিবেশ করেন। অবশিষ্ট জীবন তিনি গবেষণাতেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তার উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রগুলো হলো-
- De, S. N., Sarkar, J. K., Tribedi, B. P. An experimental study of the action of cholera toxin. J. Pathol. Bacteriol. 63: 707–717, 1951.
- De, S. N. Cholera: its pathology and pathogenesis, Published by Oliver and Boyd, London, 1961.
- De, S. N. and Chatterje, D. N. An experimental study of the mechanism of action of Vibrio cholerae on the intestinal mucous membrane. J. Pathol. Bacteriol. 66: 559–562, 1953.
- De, S. N., Bhattacharya, K., Sarkar, J. K. A study of the pathogenicity of strains of Bacterium coli from acute and chronic enteritis. J. Pathol. Bacteriol. 71: 201–209, 1956.
- De, S. N. Enterotoxicity of bacteria-free culture-filtrate of Vibrio cholerae. Nature 183: 1533–1534, 1959.
- Garfield, E. Mapping cholera research and the impact of Shambu Nath De of Calcutta. Current Contents 14: 3–11, 1986. Reproduced in Essays of an information scientist, Vol:9, p.103-111, 1986; www.garfield.library.upenn.edu/essays/v9p103y1986.pdf.
- De S N, Ghose M L & Sen A. Activities of bacteria-free preparations from Vibrio cholerae. J. Patho/. Bacferiol. 79:373-80, 1960.
পাশ্চাত্যের বিদগ্ধ সমাজ তাকে সর্বদা শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও সেই সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই তাকে সম্মাননা বা স্বীকৃতি কিছুই জানায়নি। কেবলমাত্র ১৯৫৭ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ তাকে কোটেশ পদক প্রদান করে। আরেক নোবেল বিজয়ী জোশুয়া লেডারবার্গ নোবেল পুরস্কারের জন্যে নোবেল কমিটিতে তার নাম উত্থাপন করেছেন বারংবার। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি নোবেল পাননি। অথচ শম্ভুনাথের আবিষ্কারের আগে কেবলমাত্র জীবাণুর মারণপ্রকৃতি সঠিকরূপে না বোঝবার দরুণ প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। লেডারবার্গ তার জীবনে বিভিন্ন সময়ে শম্ভুনাথের প্রশংসা করতে দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে শম্ভুনাথ দে’কে “Oral Rehydration Therapy” এর জনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
যে রোগ এককালে মহামারী আকারে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম নিমেষে মহাশ্মশানে পরিণত করত, যে কারণে ইউরোপ, মিশর কিংবা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে আন্ত্রিক রোগে মারা যেত অসংখ্য মানুষ, সেই রোগের গতি-প্রকৃতি বুঝতে মূল সূত্রটিই এই মানুষটির হাত ধরে বিশ্ববাসী অবগত হয়েছিল। তার এই আবিষ্কারের সূত্র ধরেই আস্তে আস্তে কলেরা রোগের বিরুদ্ধে ওরস্যালাইনের মতো সহজ সরল বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছে। জীবনে স্বীকৃতি না পেয়ে অবহেলায় গবেষণার কাজ ঠিকমত চালাতে না পেরেও এই মানুষটি দমে যাননি, জ্ঞানচর্চা করে গেছেন অবলীলায়। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক শম্ভুনাথ দে মৃত্যুবরণ করেন।
সহায়ক তথ্যপঞ্জি
- Special issue on S N De and cholera enterotoxin. Current Science, 59: 623–714, 1990.
- Dutta S, Das S, Nandy A K, Dutta SK. Tribute: Dr. Sambhu Nath De: One of the Greatest Indian Scientists. Indian J Pathol Microbiol 2015;58:134-6
- Nair GB, Narain JP. From endotoxin to exotoxin: De’s rich legacy to cholera. Bull World Health Organ. 2010;88:237–40
- Garfield E. Mapping cholera research and the impact of Sambhu Nath De of Calcutta. Curr Contents. 1986;14:3–11
- Koley, S., & Sen, B. K. (2014). Biobibliometric study on Dr. Sambhu Nath De-A pioneer in cholera research. Library Herald, 52(1), 28.
ফিচার ইমেজ: nobelprizeseries.in