প্রাচীনকালে মানুষ কী ধারণা করতো? পৃথিবী রয়েছে একটি বিশাল কচ্ছপের উপর, কিংবা কোনো ষাঁড়ের শিংয়ের মধ্যে! এই ধারণা থেকে প্রথম বেরিয়ে এসেছিলেন যে ব্যক্তি, তার নাম অ্যানাক্সিমেন্ডার। হ্যাঁ, প্রাচীন গ্রীসের এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রায় ২,৬০০ বছর আগে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে দাবি করেন যে, পৃথিবী একটি স্বাধীন একক হিসেবে বিদ্যমান এবং কারো উপর ভর করে নেই মানবজাতির বসবাসের এই গ্রহ। প্রাচীন এই জোতির্বিজ্ঞানী পৃথিবীর মানচিত্র প্রস্তুতকারীদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকের একজন। এমনকি মহাবিশ্বের প্রসারণ ও ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে প্রথম কথা বলা মানুষও তিনি! সম্ভবত বিবর্তন তত্ত্বেরও তিনিই প্রথম প্রবর্তনকারী। তার বিবর্তন তত্ত্বের দাবি এই যে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে মাছ থেকে!
শুরুটা প্রাচীন গ্রীসের মিলেটাস নগরে, যা বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত। এই শহরে ৬১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্যারাক্সিয়াডেস নামক এক ব্যক্তির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন অ্যানাক্সিমেন্ডার। তার মায়ের নাম জানা যায় নি। সক্রেটিস আর অ্যারিস্টটলদেরও পূর্বেকার সময়ে যতজন প্রভাবশালী বিজ্ঞানী এসেছিলেন পৃথিবীতে, অ্যানাক্সিমেন্ডার তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সম্ভবত মিলেটাস শহরে জন্মই এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। কেননা, অ্যানাক্সিমেন্ডারের সময়ে মিলেটাস জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বলা হতো, এই শহরে জন্মগ্রহণ করা শিশু হয় ব্যবসায়ী হবে, নয়তো বিজ্ঞানী! আর এই ধারার শুরু হয় তার জন্মের ঠিক ১৪ বছর আগে প্রাচীন গ্রীসের আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ থেলিসের আবির্ভাবের মাধ্যমে। পাঠক জেনে থাকবেন যে, থেলিসই হচ্ছেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম স্বীকৃত বিজ্ঞানী। তর্কসাপেক্ষে অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করে থাকেন যে অ্যানাক্সিমেন্ডার ছিলেন থেলিসের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়।
প্রাচীন গ্রীসে বিজ্ঞান চর্চা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে বিদ্যালয়, তার নাম হচ্ছে মাইলেসিয়ান বিদ্যালয়। অধিকাংশেরই একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, এই মাইলেসিয়ান স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আর্কিমিডিস। এটা সত্য যে মাইলেসিয়ানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন আর্কিমিডিস, কিন্তু মাইলেসিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন থেলিস। থেলিস প্রাচীন মিশর আর ব্যবিলনে ভ্রমণ করেন এবং গণিতে দক্ষতা অর্জন করেন। এই দক্ষতাকে তিনি স্বীয় চেষ্টায় প্রজ্ঞায় রূপ দিয়েছিলেন। মিলেটাসে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মাইলেসিয়ান স্কুল। সেই স্কুলে পড়ানো শুরু করেন বিজ্ঞান। আর মাইলেসিয়ানে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে নাম লেখান অ্যানাক্সিমেন্ডার। কত প্রথমের সাথেই না তার নাম জড়িত!
মাইলেসিয়ান তথা থেলিসই অ্যানাক্সিমেন্ডারের মধ্যে জ্ঞানস্পৃহা জাগ্রত করে এবং তার সুপ্ত প্রতিভাকে বাইরের জগতে নিয়ে আসে। তখনো মানুষের মাঝে প্রাচীন গ্রীক দেব-দেবী সম্পর্কিত নানান ভীতিকর বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। থেলিস সেগুলো ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দেন। তিনি তার শিষ্য অ্যানাক্সিমেন্ডারকে বিশ্বজগতের সবকিছু যুক্তি, তর্ক এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা বিচার করার শিক্ষা দেন। গুরুর কাছে লাভ করা শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগই করেছিলেন অ্যানাক্সিমেন্ডার। তিনি শুধু পৃথিবী না, পুরো মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করার পরিকল্পনা করেন!
থেলিসের কাছে অনেক অদ্ভুত জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কীয় জ্ঞান লাভ করেছিলেন অ্যানাক্সিমেন্ডার। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পৃথিবীর অবস্থান সম্বন্ধীয় থেলিসের তত্ত্ব। থেলিসের তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবী হচ্ছে একটি বিশাল গোলাকার চাকতি বিশেষ, যা এক মহাসমুদ্রে ভেসে আছে! এই উদ্ভট চিন্তার পেছনে অবশ্য যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন থেলিস। প্রথমত, দিগন্ত যতদূর দেখা যায় তা অবারিত, তার মানে পৃথিবী গোলাকার। দ্বিতীয়ত, রাতের আকাশেও অসংখ্য অনুরূপ চাকতি (তারা!) দেখা যায়। কিন্তু তার শিষ্য অ্যানাক্সিমেন্ডার তার থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে যান এবং তার তত্ত্বের শুদ্ধিকরণ করেন। তিনি সমুদ্র তত্ত্বকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সমকালীন বিজ্ঞানের তুলনায় এক অবিশ্বাস্য তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। তার মতে, পৃথিবী কোনো সমুদ্রের উপর ভেসে নেই কিংবা সমাজের প্রচলিত তত্ত্বের মতো কোনো কচ্ছপের পিঠেও অবস্থান করছে না। বরং পৃথিবী অসীমের কেন্দ্রে ভেসে আছে। এই অসীম দিয়ে তিনি মহাবিশ্বকেই বুঝিয়েছেন। তার মতে পৃথিবী মহাবিশ্বের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
“আমার মতে, পুরো মানব ইতিহাসে অ্যানাক্সিমেন্ডারের তত্ত্ব ছিল সবচেয়ে সাহসী, বৈপ্লবিক এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক!”- বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার।
মূলত আজকের বিশ্বে বসে অ্যানাক্সিমেন্ডারের তত্ত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করা প্রায় অসম্ভব। যখন মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রায় কিছুই জানে না, বিজ্ঞান যখন কেবল অঙ্কুরিত হচ্ছে, তখনকার সময়ে মানুষ যে ভূমিতে বসবাস করছে তা কোনো কিছুর উপর নেই বরং ভেসে আছে শূন্যে, এরকম ভাবনা ভাবতে কতটা প্রজ্ঞা আর সাহসের প্রয়োজন হতে পারে ভেবেছেন কি? তিনি এরকম অন্তর্দৃষ্টির উদাহরণ সৃষ্টি না করলে কে জানে মানবজাতি আরো কতকাল বিশ্বাস করে যেত যে পৃথিবী সমুদ্রে ভেসে থাকে কিংবা কচ্ছপের পিঠের উপর রয়েছে! অ্যানাক্সিমেন্ডার তার নিজের সময়ের তুলনায় হাজার বছর অগ্রসর হয়ে ভাবতে পেরেছিলেন বলেই তো পরবর্তীতে অ্যারিস্টার্কাস এবং আরো অনেক পরে কোপার্নিকাসের মতো বিজ্ঞানীরা জোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান তাই অ্যানাক্সিমেন্ডারের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে চিরকাল তাতে সন্দেহ নেই।
মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হচ্ছে এই তত্ত্ব কেবল ১৯২৯ সালে দিয়ে গেছেন এডুইন হাবল। তার মাত্র দু’বছর আগেই বেলজিয়ান পদার্থবিদ জি. লেমেইটার মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। অথচ জেনে বিস্মিত হবেন যে, এই ধারণাগুলো সম্পর্কে তাদের ২,৫০০ বছর আগেই কথা বলে গেছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার! অথচ অ্যানাক্সিমেন্ডারের সময়ে বিজ্ঞান বলতে কিছুই ছিল না। তখন বিশ্বাস করা হতো, আকাশ হচ্ছে একটি শক্ত কঠিন গোলক যা পৃথিবীকে ঘিরে আছে এবং যা ছাতার মতো নিয়ন্ত্রণ করছেন গ্রীক দেবতা অ্যাটলাস। আজকের দিনে সুদৃশ্য ছাতাগুলোর নাম অ্যাটলাস কেন, বোঝা যাচ্ছে তাহলে! সে যা-ই হোক, অ্যানাক্সিমেন্ডার এই বিষয়গুলো মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি বলেন যে মহাবিশ্ব সর্বদা বিরাজমান ছিল না। বরং অ্যাপেরিয়ন নামক একটি ক্ষুদ্র বীজই ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে মহাবিশ্বের আকার লাভ করেছে এবং তা আরো প্রসারিত হবে! মিল খুঁজে পেয়েছেন তো? মহাবিস্ফোরণের ক্ষুদ্র কণিকা এবং হাবলের বেলুন দ্বারা ব্যাখ্যা করা প্রসারণ তত্ত্ব তো ২,৫০০ বছর আগে জানিয়ে গেছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার!
অ্যানাক্সিমেন্ডার পৃথিবীর চারদিকে একপ্রকার অদৃশ্য আগুনের রিং বা চক্র কল্পনা করেছিলেন। তার সৌরজগতের মডেল খুবই সরল। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একাধিক আগুনের রিং রয়েছে যেগুলোর প্রথমটির মধ্য দিয়ে চন্দ্র, দ্বিতীয়টির মধ্য দিয়ে সূর্য এবং পরেরগুলোর মধ্য দিয়ে তারকারা ঘোরে। এই আগুনের রিংগুলোর মধ্যে ছিদ্র রয়েছে, যা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে আলো আসে। আবার সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলে যে রিঙের সে ছিদ্রগুলো কখনোবা বন্ধও হয়ে যেতে পারে, তখন স্বল্প সময়ের জন্য আলো পৃথিবীতে আসতে পারে না। অন্যদিকে ছিদ্রগুলোর আকৃতিও পরিবর্তনশীল যার জন্য চাঁদের আকার বদলায়! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সূর্য যে রিংয়ের ভেতর দিয়ে ঘোরে তার আগুন অধিক উত্তপ্ত তাই দিনের বেলা গরম লাগে এবং চাঁদের রিংটি অপেক্ষাকৃত কম উত্তপ্ত হওয়ায় রাত হয় শীতল! আজগুবি হলেও এই তত্ত্বে কিছু জিনিস তিনি সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। প্রথমত চাঁদ পৃথিবীর নিকটতম। দ্বিতীয়ত, গ্রহ-নক্ষত্রগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে (আগুনের রিং!) ঘুরে বেড়ায়।
অ্যানাক্সিমেন্ডার পৃথিবীর আকৃতি সম্বন্ধে ব্যাপক কৌতূহলী ছিলেন। তিনি গ্রীসের বাইরে থেকে ভ্রমণ করে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করেন পৃথিবীর মানচিত্র, যা সমসাময়িকভাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানচিত্রটি বর্তমানে পাওয়া না গেলেও অ্যানাক্সিমেন্ডারের ১০০ বছর পর জন্মলাভ করা ইতিহাসের জনক খ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন বর্তমানকালের পণ্ডিতগণ। থেলিসের সমুদ্রতত্ত্ব বর্জন করলেও অ্যানাক্সিমেন্ডার ঠিকই বিশ্বাস করেছিলেন যে পৃথিবী একটি বৃহৎ চাকতি যার উপরে মানবাজাতি বসবাস করে। নিচের পৃষ্ঠে কী আছে, তা জানবার জন্য অ্যানাক্সিমেন্ডারের আগ্রহেরও কমতি ছিল না! তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের গভীরতা এর ব্যাসের তিনভাগের একভাগ।
পানিচক্র সম্বন্ধে অ্যানাক্সিমেন্ডার বেশ চিন্তিত ছিলেন। পৃথিবীতে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা সমুদ্র থেকে বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যাওয়া পানির কারণেই হয়, সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ ছিল না বরং ছিল ভয়। তিনি মনে করতেন যে বৃষ্টি পর্যাপ্ত নয় এবং একদিন পৃথিবীর সকল পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে ও পৃথিবী পানিশূন্য হয়ে পড়বে! ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে তখনকার মানুষ বিশ্বাস করতো যে দেবতারা রাগান্বিত হলে ভূমিকম্প হয়। কিন্তু অ্যানাক্সিমেন্ডার এর কারণ হিসেবে বায়ুপ্রবাহের বিঘ্ন ঘটাকে দায়ী করেন। অন্যদিকে আকাশে বিজলী চমকায়ও প্রবল বাতাসের কারণে। তবে বজ্রপাতের কারণ হিসেবে তিনি সঠিকভাবে মেঘের ঘর্ষণের কথাই উল্লেখ করেছেন।
জীববিজ্ঞানের তখন কোনো সুনির্দিষ্ট ধারা ছিল না জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। তবে প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে অ্যানাক্সিমেন্ডারের ছিল ব্যাপক কৌতূহল। তিনি নিজের আশেপাশের প্রাণীজগৎ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রাণের শুরু হয় জলে এবং ধীরে ধীরে তা ডাঙায় বা শুষ্ক স্থানে বিস্তার লাভ করে। তার মতে, পৃথিবীর সকল প্রাণীই অন্য কোনো জীব থেকে এসেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। তিনি মানুষের ব্যাপারটি এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, একটি মানবশিশুর জন্মের পর বহুদিন লালন-পালনের প্রয়োজন হয়। অন্যান্য প্রাণীর তা প্রয়োজন হয় না। তাই যদি পৃথিবীতে মানুষ সরাসরি মানুষের আকৃতিতেই এসে থাকে, তবে পৃথিবীর প্রথম মানবশিশুটিকে লালন পালন করে বড় করেছিল কে? এক্ষেত্রে অ্যানাক্সিমেন্ডার বিশ্বাস করতেন যে মানুষ হচ্ছে একপ্রকার মাছ জাতীয় প্রাণীর বিবর্তিত রূপ।
সম্ভবত ৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে ৬৪ বছর বয়সে জন্মস্থান মিলেটাস শহরেই মৃত্যুবরণ করেন অ্যানাক্সিমেন্ডার। মৃত্যুর পর তার সকল কাজই হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। তবে তার সম্পর্কে আমরা আজ যা কিছু জানি, তা অ্যারিস্টটল এবং হেরোডোটাসের অবদান।