কোক স্টুডিওতে একজন পাকিস্তানি গায়ক বাংলা-উর্দুর মিশেলে ‘আমায় ভাসাইলি রে’ গাইছেন, অনেকের কাছে আলমগীর হকের পরিচিতি সেখান থেকেই। আর উপমহাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের একটু গভীর হালহাকিকত যারা জানেন, তারা আলমগীরকে চেনেন আরো আগে থেকেই। বাংলাদেশে জন্মে যেই লোকটি বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয়তা, তিনি আজ সেই দেশে ‘প্রাচ্যের এলভিস’ অভিধায় পূজিত হন। কিংবদন্তি এই গায়কের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়েই আজকের লেখা।
১৯৫৪ সালে ঢাকার শান্তিনগরে জন্মেছিলেন আলমগীর হক। বাবা ফরমুজাল হক ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য ও ভোলার দৌলতখানের সাংসদ। মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। এরপর দশ ভাই-বোনের সকলেই ক্রমান্বয়ে আমেরিকা-কানাডায় চলে যেতে থাকেন। ঢাকা থেকে যান আলমগীর। লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল ও পিএএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজে প্রাথমিক শিক্ষার পর আলমগীর ভর্তি হয়েছিলেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষাজীবন কাটালেও পড়ালেখায় খুব একটা মন কখনোই ছিলো না তার। মা তো এজন্য একবার ক্ষেপে গিয়ে তার গিটারটাই আছাড় মেরেছিলেন। দিনভর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রাফি, বিটলস, রোলিং স্টোন নিয়ে পড়ে থাকতেন তিনি। তবে তাকে সবচেয়ে বেশি টানতো এলভিস প্রিসলি। ঢাকায় বন্ধুদের নিয়ে চেয়েছিলেনও ব্যান্ড জাতীয় কিছু একটা করতে, কিন্তু ব্যাটে-বলে যেন হচ্ছিলো না কিছু!
সময় ১৯৬৯, গণঅভ্যুত্থানে জেরবার গোটা বাংলা। ওদিকে ১৫ বছর বয়সী কিশোর আলমগীরের মনে তখন পপ গায়ক হবার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন বুকে নিয়ে একদিন হুট করেই অতিরিক্ত একটা শার্ট, ছোট্ট টেপ রেকর্ডার আর গিটার নিয়েই বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন পশ্চিম মুলুকের করাচিতে, উঠলেন PECSH এলাকায়। খেয়ে-না খেয়ে তিন দিন পথে পথে ঘুরবার পর সেখানকার তারিক রোডের ‘গ্লোব হোটেল’-এ রোজ সন্ধ্যেবেলায় গান করবার কাজ পান তিনি। সম্মানী হিসেবে মুফতে জুটতো রাতের খাবার, সাথে মাস গেলে ৩৫০ রুপি। উল্লেখ্য, সেই হোটেলে আবার যাতায়াত ছিলো গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। তাদেরই কোনো একজনের সুনজরে পড়লেন আলমগীর। সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর সুবাদে তিনি জানতে পারেন পাকিস্তান টিভিতে ‘ফেরোজাঁ’ নামে একটি গানের প্রতিযোগিতার অডিশন চলছে। এরপরের কাহিনী তো আরো নাটকীয়।
সেখানে অডিশন দিয়ে আলমগীর শুরুতেই মন কেড়ে নেন অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক-পরিচালক খুশবখত আলিয়ার। কিন্তু আলমগীরের জায়গায় তিনি অন্য একজনকে সুযোগ দেবেন বলে ঠিক করেই রেখেছিলেন। বেচারা আলমগীর, মন খারাপ করে বেরোলেন টিভি স্টেশন থেকে। পেছন থেকে হুট করে এলো ডাক! ডেকে পাঠিয়েছেন অপর বিচারক সোহাইল রানা। খ্যাতিমান এই সঙ্গীত পরিচালক গায়কির জন্য নয়, আলমগীরকে নতুন সুযোগ দিলেন অনবদ্য গিটার প্রতিভার জন্য। ‘হাম হি হাম’ নামে শিশুতোষ একটি অনুষ্ঠানে গিটারিস্ট হিসেবে তিনি নিলেন আলমগীরকেই! বর্ণাঢ্য জয়যাত্রার সেই শুরু।
১৯৭১ সাল। যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশে। নিজের আত্মীয়স্বজন সবাই নিরাপদে উত্তর আমেরিকায় থাকার কারণেই হয়তো স্বপ্নের পিছে ছোটার একাগ্রতায় কোনো ছেদ পড়েনি আলমগীরের।
করাচির টিভি চ্যানেলে যখন আলমগীর পপ গাওয়া শুরু করলেন, উর্দু গানের জগতে পপ তখন অনেকটাই অপরিচিত-অপাঙক্তেয় জঁনরা। ওদিকে একই বছর ‘সানডে কে সানডে’ নামে একটি পপ গানের টিভি সিরিজ এলো চ্যানেলে। গুটিকয়েক উর্দু পপ শিল্পীর একজন হিসেবে আলমগীরকেও সে অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া করলেন প্রযোজক শায়ের সিদ্দিকি। ১৯৭২ সালে সে অনুষ্ঠানেই স্প্যানিশ গান ‘গুয়ান্তামেরা’ অবলম্বনে আলমগীরের গাওয়া উর্দু গান ‘আলবেলা রাহি’ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
করাচির ঝিল পার্ক এলাকার রাস্তায় লাল একটা চেয়ার পেতে রোজ সন্ধ্যায় গাইতে আসতেন আলমগীর। তরুণ-তরুণী মহলে সে সময় বিপুল চাহিদা তৈরি হলো তার, সেই সঙ্গে উর্দু পপেরও। ‘৭৩ সালে আলমগীরের যে দ্বিতীয় পপ গানটি বাজারে এলো, সেটিও ছিলো একটি বিদেশি গানের উর্দু সংস্করণ। ‘প্যায়ার হ্যায় জিন্দেগি কি গ্যাহনা’ নামের এই গানটিও যথারীতি বাজার কাঁপিয়ে দিলো। দরাজ কণ্ঠ, ব্যতিক্রমী গায়কি, মঞ্চে সাবলীল শরীরী নৈপুণ্য- সব মিলিয়ে আলমগীর দ্রুততম সময়েই পরিণত হলেন সমগ্র পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের আইকনে! ‘আয়না’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের সুবাদে ১৯৭৭ সালে সম্মানজক নিগার অ্যাওয়ার্ডও জিতে নেন তিনি। ‘দেখ না থা’, ‘ম্যানে তুমহারি গগরসে’, ‘শাম সে প্যাহলে আনা’, ‘মুঝে দিল সে না ভুলনা’, ‘সাব কা পাকিস্তান’ ইত্যাদি গান গেয়ে অমরত্বের সুধা একরকম পান করেই ফেলেন তিনি। গানের সাথে তার ঐতিহ্যবাহী কায়দায় প্রাণবন্ত নাচ প্রদর্শনের কারিশমায় মোহিত ছিলো পাকিস্তানী কয়েকটি প্রজন্ম।
আলমগীরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রবিন ঘোষ আর নিসার বাজমিও ছিলেন গায়ক-সঙ্গীতজ্ঞ। তারা সকলে মিলেই ‘৭০ থেকে ‘৯০ এর পুরোটা সময় কাঁপিয়েছেন লাহোর-করাচি তথা উর্দু মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। উল্লেখ্য, এই রবিন ঘোষের জীবনটাও আবার বেশ বর্ণিল। কিংবদন্তি গায়ক আহমদ রুশদির স্নেহধন্য রবিন ঘোষের জন্ম বাঙালি বাবা ও ইরাকি খ্রিস্টান মায়ের ঘরে। তিনিও জাতীয়তাবাদের ধার না ধেরে আলমগীরের মতোই ক্যারিয়ার গড়েছিলেন করাচিতে। তার স্ত্রী হলেন সে সময়ে পাকিস্তানের ডাকসাইটে চিত্রনায়িকা শবনম ওরফে ঝর্না বসাক, তিনিও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত।
যা-ই হোক, রবিন আর নিসার যখন ব্যক্তিগত কারণে করাচি ছাড়লেন, আলমগীর হয়ে পড়লেন একা। এমনিতেও তার সকল আত্মীয়ই ছিলো আমেরিকায়, মা-ও মৃত্যুশয্যায়। সালটা ১৯৯১। বিষণ্ণতায় ভোগা আলমগীর তখন দেশ ছেড়ে সপরিবারে পাড়ি জমালেন মার্কিন মুলুকে, আটলান্টার জর্জিয়ায়। ব্যক্তিগত কিছু অভিমান থেকে বেছে নিলেন নিভৃতের জীবন। তারপর তো গান একরকম ছেড়েই দিলেন।
ওদিকে সুস্থতাও যেন ছেড়ে পালালো তাঁর থেকে। ২০০৪ সালে আক্রান্ত হলেন কিডনি জটিলতায়। নিজের হেলথ ইন্স্যুরেন্সের অর্থ যথেষ্ট ছিলো না সে চিকিৎসায়। তবু টেনেটুনে ভক্তদের সাহায্য চলছিলো কোনোরকম চিকিৎসা। এরই ফাঁকে ২০০৬ সালে এআরওয়াই মিউজিক ফাংশনে গান করতে আসার মাধ্যমে গানের মৌনব্রত ভঙ্গ করেন তিনি। ভক্তরা ছেঁকে ধরলো তাকে, কোথায় ছিলেন এতদিন, কেন ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাদের না জানিয়ে! আবেগে-অনুতাপে আপ্লুত আলমগীর আবার ফিরলেন আপন ভুবনে। অসুস্থতার জন্য আরেক দফা বিরতি শেষে আলমগীরের আসল প্রত্যাবর্তন হয় ২০১১ সালে। আমেরিকা থেকেই ক্রিস্টি ইয়াং নামক এক কোরীয়-কানাডীয় গায়িকার সাথে বের করেন ‘কেহ দেনা’ নামে একটি মিউজিক ভিডিও। ততদিনে অবশ্য বার্ধক্য পেয়ে বসেছে তাকে, গলায়ও নেই আগের ধার। কিন্তু তাতে কী! ভক্তদের ভালোবাসায় তো কমতি আসেনি কিছু, শিল্পীর প্রত্যাবর্তনকে উষ্ণতায় বরণ করে নিলেন তাই তারা।
২০১২ সালে অনেকটা সময় পর পাকিস্তানে ফেরার পর তো প্রায়ই হাজির হতে লাগলেন টিভি অনুষ্ঠানসমূহে। ২০১৩ সালে এআরওয়াই টিভির রিয়েলিটি শো ‘মিউজিক আইকন’-এ আলি আজমত, শেহজাদ হাসানের সাথে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই বছর তো বাংলাদেশেও এসেছিলেন এক অনুষ্ঠানে। দরদভরা কণ্ঠে গেয়েছিলেন “আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে…”। দর্শকসারিতে বসে সে গান উপভোগ করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশির দশকে অবশ্য বিটিভিতে একাধিকবার গাইতে এসেছেন আলমগীর।
এই প্রত্যাবর্তনেরও বেশ আগেই দুটো কিডনিই অকেজো হয়ে গিয়েছিলো তার। সরকারের তরফে ৫০,০০০ ডলারের অনুদানও প্রস্তুত ছিলো, কেবল দাতার অভাবে পুনঃস্থাপন করা যাচ্ছিলো না। ২০১৫ সালে সফলভাবে সেই অস্ত্রোপচারও সম্পন্ন হয়।
পুরো সঙ্গীতজীবনে ২০টি অ্যালবাম বেরিয়েছে তার পাকিস্তানে, আর পাঁচটির মতো বেরিয়েছে বাংলাদেশে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনি ভূষিত হয়েছিলেন প্রাইড অব পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ডে। ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ২০টি ভাষায় আলমগীর গেয়েছেন চার শতাধিক গান। এই কিংবদন্তির জীবনী নিয়ে ২০১৭ সালে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানে। চলচ্চিত্রটির নাম ‘আলবেলা রাহি’, আলমগীরের প্রথম হিট গানের নামে নামকরণ যার। পরিচালক সুলতান আলশালি এবং নাম ভূমিকায় আছেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় গায়ক, মডেল ও বলিউডে বেশ নামকামানো অভিনেতা ফাওয়াদ আফজাল খান।
মুক্তিযুদ্ধ তাকে কেন টানেনি, শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকে হলেও কেন সেসময় কিংবা তার পরে বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন বর্বরতা নিয়ে মুখ খোলেননি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। এমনকি রবিন ঘোষ আর তার স্ত্রী শবনম নব্বইয়ের দশকে ফিরে আসেন নিজেদের জন্মভূমিতে। যদিও বলা হয়, জনপ্রিয়তার হালে জল শুকোবার পরেই দেশে ফিরেছিলেন রবিন ও শবনম। কিন্তু ফিরেছিলেন তো! আলমগীর সেটিও করেননি, হয়তো স্বজনহীন মাটিতে আর ফিরতে মন চায়নি!
বাংলাকে অবশ্য তিনি পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেননি আপন সত্তা থেকে। জাত্যাভিমানী পাঞ্জাবি, সিন্ধিদের কাছে বাংলার আব্বাস উদ্দীনকে তিনিই চিনিয়েছেন। পাকিস্তানে বসেই বহুবার গেয়েছেন ‘আমায় ভাসাইলি রে’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘আমার হাড় কালা’, ‘আমায় এত রাতে ক্যানে ডাক দিলি’-এর মতো কালজয়ী সব বাংলা গান!
পাকিস্তানি জাতীয়তা লালন করেও বাঙালি শেকড়ের প্রতি ‘কিঞ্চিত’ মমত্ববোধের আছে বলেই হয়ত এতটা দরদ নিয়ে তিনি গানগুলো গাইতে পারেন। এ কারণেই হয়ত খোদ পাকিস্তানেই কথায় কথায় উঠে আসে- আলমগীরের জন্মটা বাংলায়, আজকের বাংলাদেশে; অথচ কথায় কথায় পাকিস্তানে কেউ বলে না আতিফ আসলামের শেকড় পাঞ্জাবের বা আবিদা পারভীনের শেকড় সিন্ধের।
বর্তমানে পরিবার নিয়ে আটলান্টাতেই বাস এই শিল্পীর। সেখানে খুলেছেন নিজের একটি স্টুডিও-ও। গানের সূত্রে ঘুরে ফেলেছেন প্রায় অর্ধ শতাধিক দেশ। এখনো গান-কনসার্ট নিয়েই ছোটোছুটি করেন, তবে সেটা সীমিত হয়ে গেছে আমেরিকা, কানাডার মধ্যেই। মাঝেমধ্যে পাকিস্তানেও যান। দেশ-বিদেশে ভক্তদের ফরমায়েশে উর্দুর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বাংলা গানও করেন। বাংলাদেশ বাদ দিয়ে পাকিস্তানকে কেন বেছে নিলেন, বাঙালির এই অনুযোগ বা নিন্দাবোধ যৌক্তিকভাবেই আসে। কিন্তু স্থান-কালের ঊর্ধ্বে তো শিল্পী, সাহিত্যিকেরাই উঠেছেন, তাই কিছুটা ছাড় হয়তো তারা পেয়েই যান।
ফিচার ইমেজ: Youtube