শাবানা: বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী এক নায়িকার গল্প

ছোটবেলায় যখন গ্রামে ছিলাম, তখন প্রতি শুক্রবার দুপুরে বাংলা সিনেমা দেখার ধুম পড়ে যেত। তখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন ছিল না। গ্রামে সচ্ছল ৩-৪টি পরিবারে কিংবা বাজারে কোনো খানদানী চায়ের দোকানে টেলিভিশন থাকতো, যা দিয়ে গ্রামের মানুষের বিনোদনের চাহিদা মিটতো। আর চ্যানেল বলতে ছিলো বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। শুক্রবার দুপুরে বাংলা সিনেমা নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখতাম, উত্তেজনা যতটা না সিনেমার কাহিনী নিয়ে, তার চেয়ে বেশি সিনেমায় কে কে অভিনয় করছেন। বিশেষত শাবানা যে সিনামায় আছেন, সে সিনেমা বাঙ্গালী দর্শকদের দেখতেই হবে। শাবানার বিপরীতে আলমগীর, জসীম, রাজ্জাক, খসরু যে-ই থাকুন না কেন, সিনেমাটা শাবানার।

আফরোজা সুলতানা রত্না ( শাবানা)

বাঙ্গালী নারীর শাশ্বত রূপ তুলে ধরেছিলেন এই অভিনেত্রী। একের পর এক ব্যবসা সফল এবং দর্শকের মন জয় করা সিনেমা করেছেন তিনি। শাবানা মানেই এক মমতাময়ী মা, অন্যায়ের প্রতিবাদী এক নারী, ব্যক্তিত্ববান স্ত্রী, কখনোবা মমতাময়ী ভাবী। তার চোখের পানিতে টলটল করতো আমার মা বোনদের চোখ, সিনেমায় আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখলে ক্ষেপে উঠতো দর্শকের দল, কখনোবা সিনেমা দেখতে দেখতে কেউ কেউ চিৎকার করে উঠতেন “মার শালাকে, মার!

এমনই মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছিলেন শাবানা। তার জায়গা আজও কেউ নিতে পারেননি। এখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক ভালো ভালো প্রযুক্তির ব্যবহার হয়, কিন্তু সেই সাদা কালো যুগের শাবানাকে কেউ পেছনে ফেলতে পারেননি।

১৯৫২ সালের ১৫ই জুন ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ফজিলাতুন্নেসা এবং ফয়েজ চৌধুরীর ঘর আলো করে আফরোজা সুলাতানা রত্না নামের এক শিশুর জন্ম হয়। ফয়েজ সাহেবের পৈত্রিক ভিটা চট্টগ্রামের রাউজানে। তিনি পেশায় টাইপিস্ট। নিজের স্বল্প আয়ে কোনো রকমে দিন কেটে যাচ্ছিল। আদরের রত্নাকে ভর্তি করালেন গেন্ডারিয়া হাই স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনায় একদমই মন নেই রত্নার। তাই খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হলো। পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও ছোট্ট রত্নার অভিনয়ে খুব আগ্রহ।

Image Credit: bdaffairs.com

মাত্র ১০ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে প্রথম অভিনয় করেন ‘নতুন সুর’ সিনেমায়। ছোট মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। খুব বেশি বড় কোনো চরিত্র না হলেও এই সিনেমা তার মাঝে অভিনয় ক্ষুধা জাগায়। পরবর্তীতে বাবার হাত ধরে ১৯৬৩ সালে উর্দু ‘তালাশ’ সিনেমায় নাচের দৃশ্যে অংশগ্রহণ করেন। ‘আবার বনবাসে রূপবান’ এবং ‘ডাক বাবু’ সিনেমাতে তিনি সহ-নায়িকার কাজ পান।

চলচ্চিত্রে শাবানার অভিষেক আজিজুর রহমানের হাত ধরে হলেও শাবানাকে রত্না থেকে শাবানা করে তুলেছেন পরিচালক এহতেশাম। এহতেশাম সম্পর্কে হালকা বলে নিচ্ছি। বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিষেক হয়েছে তার হাত ধরেই। শুধু তা-ই নয়, বাংলা সিনেমাকে শিল্প এবং ব্যবসা সফল করে তোলার পেছনে ‘ক্যাপ্টেন’ এহতেশামের ভূমিকা মুখে বললেই শেষ হবে না। অভিনয় শিল্পীদের বিভিন্ন নামও তিনিই দিয়েছেন। যেমন- তার আবিষ্কার করা নায়িকাদের নামের শুরুতে ‘শাব’ শব্দটি যুক্ত করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় রত্না থেকে শাবানা, কাজী শারমিন নাহিদ নূপুর থেকে শাবনূর নাম তিনি রেখেছেন। ফরিদা আখতার পপি হয়ে গেলেন ববিতা।

এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরী’ সিনেমায় নাদিমের বিপরীতে শাবানা।

১৯৬৭ সালে এহতেশামের ‘চকোরী’ সিনেমায় নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে অভিনয় জগতে নিজের স্থান পোক্ত করে নিতে শুরু করলেন শাবানা। যে সময়ে রাজ্জাক-কবরী জুটি বেঁধে অভিনয় করতেন, সেসময়ে শাবানা বিভিন্ন নায়কের সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, তিনি কারো সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করার জন্য আসেন নি, তিনি নিজের অভিনয় গুণ দিয়ে যেকোনো অভিনেতার সাথে কাজ করতে পারেন। আশির দশকের শেষ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যখন তার সময়ের অভিনেত্রীরা মূল চরিত্রে অভিনয় দূরে থাক, অভিনয় থেকে ইস্তফা নিয়েছেন, তখনও শাবানা দাপটের সাথে একের পর এক ব্যবসা সফল সিনেমায় অভিনয় করে গিয়েছেন।

শাবানা, এক চিরসৌন্দর্যের নাম

শাবানার অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। শাবানা শুধু একজন সফল অভিনেত্রীই ছিলেন না, একজন সফল প্রযোজকও ছিলেন। স্বামী সাদিক ওয়াহিদের সাথে নিজস্ব প্রযোজনা এস এস প্রোডাকশন তৈরি করেছিলেন। চলুন শাবানার অভিনীত কিছু বিখ্যাত সিনেমার কাহিনী সম্পর্কে জেনে নেই।

ভাত দে

‘ভাত দে’ সিনেমার একটি পোস্টার।

আমজাদ হোসেনের পরিচালনা এবং শাবানার অভিনীত ‘ভাত দে‘ সিনেমাটি প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছিল। ছবিটির স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে আমজাদ হোসেনের এক মাস সময় লেগেছিল। একটি গরীব বাউল পরিবারের নিদারুণ কষ্টের ছবি তুলে ধরেছেন আমজাদ হোসেন। গরীব বাউলের মেয়ে জরি, ছোটবেলায় অভাবের কারণে মা মারা যায়, তারপর বাবাও দু’মুঠো অন্নের অভাবে মারা গেলে জরিকে পড়তে হয় অকূল সমুদ্রে। নানা অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জরির জীবন কাটে।

সমাজের কিছু হায়েনাদের অর্থলোলুপতা এবং স্বার্থসিদ্ধির চাল কতটা নির্মম হতে পারে তা এই সিনেমার গল্প এবং অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় না দেখলে বুঝতে বেশ কষ্ট হয়। ছবিটিতে শাবানা, আলমগীর এবং রাজীব অভিনয় করেছেন। এখানে জরির চরিত্রে শাবানা অভিনয় করেছেন। এক্ষেত্রে একজন পরিচালক হিসেবে আমজাদ হোসেন তার শিল্পী নির্বাচনের দক্ষতা দেখিয়েছেন। কারণ চরিত্রটিতে শাবানা ছাড়া যে অন্য কাউকে মানাতো না, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। পুরো সিনেমাটিতে শাবানা দর্শককে একবারের জন্যও অন্যমনস্ক হতে দেন নি। জরির অর্থাৎ শাবানার চোখের জলে ভেসেছে গোটা দর্শকশ্রেণী। এই সিনেমা দেখে খুব কম মানুষই তাদের চোখে পানি আঁটকে রাখতে পেরেছেন। সিনেমাটির গানগুলোও বেশ জীবনবাদী হওয়ায় তা দর্শকদের স্পর্শ করে।

Image Credit: somewhereinblog.net

রজনীগন্ধা

এই সিনেমাটিও দুইটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করে। এতে অভিনয় করেছেন শাবানা, রাজ্জাক এবং আলমগীর। এই সিনেমাটিতে স্বামীর অবহেলিত এবং ভালবাসা বঞ্চিত চিরায়ত বাঙ্গালী নারীর ভূমিকায় করেছেন শাবানা। বিলেত ফেরত শিক্ষিত আধুনিক কোটিপতির ছেলে তপনকে (রাজ্জাক) তার মা বিয়ে দেয় ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়ে সুধার (শাবানা) সাথে। সুধাকে তপনের তেমন পছন্দ নয়। সুধাকে তার শাশুড়ি আর ননদের পছন্দ হলেও তপন বারবার ছুটে যায় তার পূর্বতন প্রেমিকা টিনার কাছে। এদিকে সুধা নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে স্বামীকে ভালবাসেও স্বামীর মন পান না। তবুও স্বামীকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। নাট্যধর্মী এই সিনেমায় সুধা গান গেয়ে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতেন। এই ছবির বিখ্যাত গান সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া আলম খানের সুর করা গান ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, কালজয়ী একটি গান।

ওরা ১১ জন

‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার পোষ্টার

ওরা ১১ জন একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। বিখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটিই প্রথম ছবি। এতে অভিনয় করেন শাবানা-রাজ্জাক, খসরু, মুরাদ, নান্টু। ছবির নেপথ্যের কাহিনীটা জানলে আশা করি খুব ভালো লাগবে। চাষী নজরুল ইসলামের সরাসরি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যাক সেই কাহিনী।

‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার একটি দৃশ্য

‘জয়দেবপুরে শুটিং করা হবে। সে সময় দুজন পাকিস্তানি আর্মি পালিয়েছিল। খসরু ও মুরাদ দুজনকে ধরে এনে বলল, ছবির শুটিংয়ে এ দুজনকে ব্যবহার করা হবে এবং সরাসরি রাইফেলের বেয়নেট চার্জ করা হবে। ‘ক্যামেরাম্যান সামাদ ভাই খসরুর কথা শুনে আঁতকে উঠলেন। সামাদ ভাই বললেন, “চাষী, এটা কী করে হয়!” আমি আস্তে করে খসরুকে বুঝিয়ে বললাম, “খসরু, এটার মনে হয় দরকার নেই। আসলে এভাবে তো দৃশ্যটি করা যাবে না। তা ছাড়া আমরা যে দৃশ্যের কথা চিন্তা করেছি, সেটা এভাবে করা যাবে না।”

খসরু একটু ঠান্ডা হলো। মুরাদকে ইশারা করে সে বলল, “দুইডারে ফালায়া দে।” পাকিস্তানি আর্মি দুজন মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত। মুরাদ তাদের সরিয়ে নিল। পরে মুরাদ এসে বলল, “চাষী ভাই, দুইডারে লুকায়ে রাখছি।” আমি বললাম “ভালো করেছ, খসরুকে বলার দরকার নেই। তাদের আমরা প্রশাসনের হাতে তুলে দেব। পরে ওরা যুদ্ধবন্দী হিসেবে চলে যাবে।” ‘এ ঘটনা দেখে তো শাবানা ভয়ে কাঁপছিল। আর সে সময় খসরুর কাছে অস্ত্র থাকত। দেখা গেল, আমরা নারকেলগাছের তলায় শুটিং করছি, হঠাৎ খসরু বলল, “ম্যাডাম, ডাব খাবেন?” শাবানা হয়তো বলল, ডাব কই। অমনি খসরু ডাব লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। ডাব পড়তে শুরু করল। শাবানা তো আরও ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। এমনই অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ওরা ১১ জন ছবি শুটিং করা হয়েছে।’ বলছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম।

‘মা যখন বিচারক’ সিনেমার একটি দৃশ্য। সহঅভিনেতা জসীম এবং শাকিল খান।

এছাড়াও জননী, সখি তুমি কার, দুই পয়সার আলতা, অপেক্ষা, রাঙা ভাবী, সত্য মিথ্যা, মরণের পরে এবং অচেনা- এই সিনেমাগুলোতে শাবানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেছেন। দেশীয় পুরস্কারের পাশাপাশি শাবানা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতেও অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রুমানিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ আরো বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন।

১৯৯৭ সালে আজিজুর রহমানের পরিচালিত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে নিজের অভিনয় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান এককালের জনপ্রিয় এ নায়িকা। বর্তমানে পরিবারের সাথে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।

কালো বোরখা পরিহিত শাবানা। সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।

ইদানিং হিন্দি, ইংরেজি সিনেমার আড়ালে হারিয়ে গেছে বর্ণালী সেই সিনেমাগুলো। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে দর্শক পর্যন্ত সবাই পশ্চিমা ধাঁচের সিনেমা তৈরিতে এবং দেখতে ব্যস্ত। তবুও শাবানা, রাজ্জাক, আলমগীর, ববিতা এবং সালমান শাহ্‌দের যুগকে, বাংলা সিনেমার স্বর্ণালী সেই যুগকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, তাদের মতো তেমন ভালো অভিনেতা আমরা আরো পাব কিনা জানিনা।

Related Articles

Exit mobile version