১৯৭১ সালের ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবল দল মিলওয়াকি বাকস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র তৃতীয় বছরের মাথায় জাতীয় বাস্কেটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা এনবিএ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে। এটি ছিল তাদের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র শিরোপা। মিলওয়াকির এই বিজয়গাথার নায়ক ছিলেন তৎকালীন উদীয়মান এনবিএ তারকা লুই আলসিন্দর। তিনি একইসাথে ঐ বছরের সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রহকারী ছিলেন। কিন্তু এ অর্জনের কিছুদিন পর সবাইকে অবাক করে লুই আলসিন্দর হঠাৎই নিজের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা জনসম্মুখে ঘোষণা করেন। ভবিষ্যৎ জীবনে অসংখ্য রেকর্ডের জন্ম দিতে যাওয়া এই তরুণ তুর্কি ধর্মান্তরিত হওয়ার পর খ্যাতি অর্জন করেন কারিম আব্দুল-জব্বার নামে।
তবে কারিম ইসলাম গ্রহণ করেন আরো তিন বছর আগে। তার ইসলাম গ্রহণের প্রধান কারণ প্রচলিত বর্ণবাদের প্রতি ঘৃণা এবং তার আফ্রিকান-আমেরিকান শেকড়ের প্রতি আগ্রহ। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি অনেকের কাছ থেকে বিরূপ আচরণের শিকার হন। অন্যদিকে বর্ণবাদের শিকার হওয়া তো তার কালো চামড়ার অদৃষ্ট। তারপরও তিনি এগিয়ে গেছেন। অধিকাংশ পরিসংখ্যান কারিম আব্দুল-জব্বারকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবেই সাক্ষ্য দেয়। যদিও তিনি নিজেকে শুধু বাস্কেটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বর্তমানে ৭৩ বছরের এই কিংবদন্তি একাধারে একজন লেখক, কলামিস্ট, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, মানবাধিকার কর্মী ও বর্ণবাদবিরোধী যোদ্ধা।
কারিম আজীবন তার ক্লাসে সবচেয়ে লম্বা ছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতায় পৌঁছে যান। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার উচ্চতা দাঁড়ায় ৭ ফুট ২ ইঞ্চিতে। তার উচ্চতা বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের গড় উচ্চতা থেকেও বেশি। কলেজ পর্যায়ের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় লুই আলসিন্দর তথা কারিম আব্দুল জব্বার ছিলেন এক ত্রাসের নাম। একাধারে তার উচ্চতা ও দক্ষতা তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল। তার কলেজ ইউসিএলএ (ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলস) তার সময় পর পর তিনবার (১৯৬৭-৬৯) দেশসেরার পুরস্কার লাভ করে।
সে সময় আমেরিকার বাস্কেটবল খেলার ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে। কলেজ পর্যায়ের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনসিএএ বাস্কেটবলে প্রচলিত পয়েন্ট সংগ্রহ পদ্ধতি ‘ডানকিং’ নিষিদ্ধ করে। ডানকিং হলো লাফ দিয়ে কোনোপ্রকার দূরত্ব বজায় না রেখে হাত দিয়ে বল বাস্কেটবল রিংয়ে প্রবেশ করানো। লম্বা খেলোয়াড়দের জন্য ডানকিং করা তুলনামূলকভাবে সহজ। অন্যদিকে তিন মিটার (প্রায় ১০ ফুট) উঁচুতে থাকা বাস্কেটবল রিংটিকে খেলোয়াড়রা সহজেই স্পর্শ করতে পারে।
১৯৬৭ সালের কলেজ পর্যায়ের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় কারিম ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আর পরবর্তী বছর সকলেই ভয়ে ছিল যে, কলেজ পর্যায়ের এ প্রতিযোগিতায় তিনি পয়েন্টের বন্যা বইয়ে দেবেন। কারণ, তিনি প্রথম তার অভিষেক ম্যাচেই অবিশ্বাস্যভাবে ৫৬ পয়েন্ট সংগ্রহ করেন। তবে এনসিএএ সরাসরি কখনোই তার কথা উল্লেখ করেনি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, এই নিষেধাজ্ঞা জারি তার কারণেই। এমনকি গণমাধ্যম একে ‘লুই আলসিন্দর রুল’ (কারিমের তৎকালীন নামানুসারে) নামে অভিহিত করে। এ নিষেধাজ্ঞা তাকে আরও পরিণত খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলে। সে সময়ে পয়েন্ট সংগ্রহের জন্য তিনি ব্যবহার করা শুরু করেন স্কাইহুক শটের। তার কলেজজীবন থেকে শুরু করে, তিনি পুরো পেশাদার জীবনে এর ব্যবহার করে গেছেন।
বাস্কেটবল কোর্টে স্কাইহুক শট প্রতিরোধ করা আদৌ কোনোভাবে সম্ভব নয়। এর ব্যবহার আজ পর্যন্ত কারিম ব্যতীত আর কেউ পূর্ণ দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা সাথে করতে পারেনি। তবে তিনি একদিনেই এ শট আয়ত্ত করেননি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম। ১০ ফুট উঁচু বাস্কেটবল রিংয়ের ভেতর বল প্রবেশ করানোর জন্য, তিনি লাফ দিয়ে আরো এক ফুট উঁচু থেকে বল ছুঁড়ে মারতেন। উড়ন্ত বলের গতিপথ দেখে মনে হতো, যেন সেটি সরাসরি আকাশ থেকে নেমে এসে রিংয়ের ভেতর পড়ছে। এ কারণেই একে নাম দেওয়া হয় স্কাইহুক- অর্থাৎ আকাশে ঝুলন্ত। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, তিনি এই শট ব্যবহার শুরু করেন পঞ্চম গ্রেডে থাকাকালে। অনেকেই মনে করেন, এটি যেন তার ট্রেডমার্ক শট।
২০ বছরের দীর্ঘ পেশাদার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তার অর্জিত পয়েন্টসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮,৩৮৭। সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জনকারীদের তালিকায় তার উপরে কেউ নেই। পেশাদার জীবন মিলওয়াকি বাকস দিয়ে শুরু করলেও, জীবনের অধিকাংশ সাফল্য আসে লস এঞ্জেলেস লেকার্সের হয়ে খেলার সময়ে। সফল পেশাদার জীবনে তিনি এখন পর্যন্ত ইতিহাসে সর্বোচ্চ মোট ছয়বার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান খেলোয়াড়ের খেতাব অর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি ছয়বার এনবিএ চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছেন, যার একটি আসে মিলওয়াকির হয়ে এবং অন্য পাঁচটি আসে লস এঞ্জেলসের হয়ে। উভয় দলই তার অবসরের পর তার ব্যবহৃত ৩৩ নং জার্সির অবসর ঘোষণা করে।
বর্ণবৈষম্যে জর্জরিত তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় আত্ম-প্রশান্তির জন্য কারিম ধর্মান্তরিত হন। ইসলাম গ্রহণে তার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী নেতা ম্যালকম এক্স। তিনি বলেন, “১৯৬৬ সালে ইউসিএলএ-তে একজন নবীন শিক্ষানবিশ থাকাকালীন আমি ম্যালকম এক্সের আত্মজীবনী পড়েছিলাম। যখন আমি শেষ পৃষ্ঠাটি পড়া শেষ করি, তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার জীবন চিরতরে ভিন্ন ধারায় নিপতিত হয়েছে। বিশেষত একটি অনুচ্ছেদ আমাকে অভিভূত করেছিল। তা হলো:
আমার মনে আছে একদিন এক গ্লাস ময়লা পানি টেবিলের উপর রাখা ছিল। জনাব মোহাম্মদ আরেক গ্লাস পরিষ্কার পানি তার পাশে রাখলেন। তিনি বললেন, “যদি কোনো ব্যক্তির কাছে ময়লা পানিযুক্ত গ্লাস থাকে, তবে তাকে নিন্দা করো না। বরং তুমি তাকে তোমার কাছে থাকা পরিষ্কার পানিযুক্ত গ্লাসটি দেখাও। তখন সে এমনিতেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, তোমারটা তার থেকে বেশি ভালো।” আমার বয়স তখন ১৯ বছর ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, সারাজীবন আমি ওই ময়লা গ্লাস থেকেই পানি পান করছি।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে বর্ণবাদের শিকার কারিম কিশোর বয়সেই হারলেমের বর্ণবাদবিরোধী যুব সংগঠনে যোগদান করেন। এ সংগঠনের বদৌলতে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ পান।
কারিম ম্যালকম এক্সের অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। আজ পর্যন্ত অনেকেই ম্যালকম এক্সকে একজন আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে জানে। তবে তার এই আগ্রাসী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে হজযাত্রার মাধ্যমে। সৌদি আরব থেকে ম্যালকম হারলেমে অবস্থানরত বন্ধুদের উদ্দেশে চিঠিতে লিখেছিলেন,
“তোমরা হয়তোবা আমার কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হবে। কিন্তু এই হজযাত্রায় আমি যা দেখেছি এবং যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তা আমার পূর্ববর্তী অধিকাংশ ধারণাকে পুনর্গঠন কিংবা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। যদি সাদা আমেরিকানরা প্রভুর একত্ববাদে বিশ্বাস করে, তবে সম্ভবত তারা সকল মানুষের অভিন্নতার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে। তখন তারা রংয়ের ভিত্তিতে কোনো মানুষকে বিচার করা কিংবা ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে।”
তিনি সেই হজে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দেখে মুগ্ধ হন। এর ফলে তার সামনে বর্ণবাদের সমাধানে ভিন্ন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। তিনি তার শ্বেতাঙ্গ-বিদ্বেষী নীতি পরিত্যাগ করেন। কারিম এই সৌহার্দ্যের চিন্তাধারার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। তিনি জীবনব্যাপী ইসলামের এই সহমর্মিতা ও সহাবস্থানের নীতিকে লালন করে যাচ্ছেন।
কারিমের সফল পেশাদার জীবনের অন্যতম কারিগর তার প্রিয় কোচ জন উডেন। তবে জন শুধু কলেজ পর্যায়ের বাস্কেটবলেই তার সরাসরি কোচের দায়িত্ব পালন করেন। তারপরও তিনি আজীবন তাকে গুরুর আসনে সমাসীন রেখেছেন। এমনকি তাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের সম্পর্ককে স্মরণ করে কারিম ‘কোচ উডেন অ্যান্ড মি: আওয়ার ফিফটি ইয়ার ফ্রেন্ডশিপ অন এন্ড অভ দ্য কোর্ট’ নামে একটি বইও লিখেছেন। বইটিতে তিনি তার জীবনে জন উডেনের নানা ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন।
একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে কারিম বর্ণবাদের বিপক্ষে ছিলেন বজ্রকণ্ঠের অধিকারী। মোহাম্মদ আলীর মতো তারকারা, যারা বিংশ শতাব্দীতে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি আমেরিকার বাস্কেটবল দলের হয়ে অলিম্পিকে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তার এই অলিম্পিক বর্জনের কারণ ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান ও অন্যান্য বর্ণের জনগণের উপর প্রচলিত অবিচারের প্রতিবাদ। এছাড়া সে বছর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রও গুপ্তহত্যার শিকার হন। তিনি তার অন্যতম আদর্শের হত্যার বিচারের চেয়ে অলিম্পিককে বড় করে দেখেননি। এমনকি বর্তমানেও যদি কোনো খেলোয়াড় বর্ণবাদের শিকার হয়ে থাকলেও তিনি তার পক্ষে কথা বলেছেন।
আল-জাজিরায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কারিম বলেন, তিনি যদি পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়াড় না হতেন, তাহলে তিনি একজন লেখক হতে পারতেন। লেখক হিসেবে তিনি মোটেও পাঠকদের নিরাশ করেননি। তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘বিকামিং কারিম’ নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। এছাড়া তিনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও টাইম ম্যাগাজিনে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। ফিকশন এবং নন-ফিকশন উভয় ধরনের গ্রন্থ মিলিয়ে তার রচিত মোট বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। যখন তাকে বলা হয়েছিল সাত শব্দে নিজেকে উপস্থাপন করতে, তখন তিনি বলেছিলেন,
“Use to skyhook, now just write books.” অর্থাৎ, “বাস্কেটবলে স্কাইহুকের ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন শুধু বই লিখি।”
লেখালেখির ভুবন ছাড়াও চলচ্চিত্র জগতেও কারিমের পদচারণা রয়েছে। হলিউড থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে এয়ারপ্লেন সুপরিচিত। তিনি ব্রুসলির মতো বিখ্যাত হলিউড তারকার সাথে অভিনয় করেছিলেন। তবে ব্রুসলির সাথে তার পরিচয় চলচ্চিত্রজগতে নয়। তাদের পরিচয় ঘটে মার্শাল আর্টের বদৌলতে। মার্শাল আর্টে অভিজ্ঞ ব্রুসলি তাকে নানা ধরনের কসরত শিখিয়েছিলেন। সেসকল কসরত পরবর্তী সময়ে তাকে আরও পরিণত খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলে এবং তার পেশাদার জীবন দীর্ঘায়িত করে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই কিংবদন্তি সম্প্রতি হিস্টোরি চ্যানেলের সহযোগিতায় ‘ব্ল্যাক প্যাট্রিয়টস: হিরোস অফ রিভলিউশনারি ওয়ার’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেছেন। এই ডকুমেন্টারির মাধ্যমে তিনি আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গদের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন,
“আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম শহীদ একজন আফ্রিকান-আমেরিকান।”
আমেরিকা শুধু সাদাদের দেশ নয়। বরাবরই আমেরিকার ইতিহাসে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের ভূমিকা জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ভিন্ন অন্য যে কারোর ভূমিকার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। এই অবজ্ঞা ও অস্বীকৃতিই বর্ণবাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। কারিম এই প্রচলিত কুপ্রথার নিরসনকল্পে ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করছেন। তিনি চেয়েছেন, সাদা আমেরিকানরা যেন কালোদের অবজ্ঞার চোখে না দেখে। আর তারা একে অপরের সম্পর্কে যত বেশি জানবে, একে অপরের প্রতি সম্মান তত বেশি বৃদ্ধি পাবে।
কারিম আব্দুল জব্বার ১৬ এপ্রিল, ১৯৪৭ তারিখে নিউ ইয়র্কের হারলেমে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই তার শরীর ছিল বৃহদাকায়। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ১২.১০ পাউন্ড (৫.৪ কেজি) এবং তিনি তখন লম্বায় ছিলেন প্রায় ২২ ইঞ্চি। তার বাবা পেশায় ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। বাবা ফার্দিনান্দ লুইস আলসিন্দরের নামেই তার নামকরণ করা হয়। কারিমের বেড়ে ওঠা হারলেমেই। সেখানকার বাস্কেটবল কোর্টে তার খেলার হাতেখড়ি। সেখানে বেড়ে ওঠার দরুন তিনি হারলেম রেনেসাঁর অনেক সহিংস ঘটনা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন। সেসকল ঘটনা তার রাজনৈতিক মতাদর্শ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তাকে ভর্তি করানো হয় নিউ ইয়র্কের পাওয়ার মেমোরিয়াল স্কুলে, যেটি ছিল একটি ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত স্কুল। এ স্কুলের হয়েই তিনি প্রতিযোগিতামূলক বাস্কেটবল খেলা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তার হাই স্কুল জীবন শেষ হয়। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৬৬ সালে ইউসিএলএ-তে ভর্তি হন। মূলত সেখান থেকেই তিনি দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন শুরু করেন।
কারিমের জীবনে অন্যতম বড় বিপত্তি ছিল ব্লাড ক্যান্সার। একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে সুস্থ জীবনযাপনের এত প্রচেষ্টার পরেও ২০০৮ সালে তার শরীরে লিউকেমিয়া ধরা পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে ২০১১ সালে তিনি ক্যান্সার থেকে রেহাই পান। এ বিষয়ে তিনি বলেন,
ভেবেছিলাম, আমি বোধহয় কয়েকমাসের মধ্যে মারা যাব। আমি আমার বন্ধুকে (অভিনেতা ব্রুনো কিরবি) লিউকেমিয়া ধরা পড়ার মাত্র একমাসের মধ্যে মারা যেতে দেখেছি। আমি আসলেই বুঝতে পারছিলাম না, সামনে কী অপেক্ষা করছে।
ক্যান্সার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত কারিম বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় তহবিল সংগ্রহের প্রচারণায় আত্মনিয়োগ করেছেন। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত স্কাইহুক ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে চলেছে। এ ফাউন্ডেশন উক্ত শিশুদের নিয়ে প্রতি বছর ক্যাম্প স্কাইহুকের আয়োজন করে। এ ক্যাম্পে তাদেরকে সুযোগ করে দেয়া হয় প্রকৃতির কাছ থেকে শেখার জন্য। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার কারণে কারিম ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম অর্জন করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাস্কেটবলের প্রচার-প্রসার খুবই কম। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই বাস্কেটবল কিংবদন্তি হিসেবে কারিম আব্দুল-জব্বার আমাদের কাছে তেমন মানে না-ও রাখতে পারেন। এটি হওয়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়। তারপরও তার পরিচয় তো শুধু বাস্কেটবল কিংবদন্তি নয়। তার অন্যান্য পরিচয়ের জন্যও মানুষ তাকে স্মরণ রাখবে। বর্ণবাদে জর্জরিত আমেরিকান সমাজে তার জীবনসংগ্রাম সহজ ছিল না। এমনকি পেশাদার জীবনে গণমাধ্যমের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল না। তবে তিনি মাথা নিচু করেননি। তার শারীরিক উচ্চতার মতোই তিনি নিজের সামাজিক মর্যাদাকে উঁচুতে নিয়ে গেছেন।
কারিম আব্দুল জব্বার এমন একজন মানুষ, যিনি জীবনভর বর্ণবাদকে ঘৃণা করে গেছেন। অলিম্পিক বয়কট থেকে শুরু করে আরো অনেক ঘটনা তার এই ঘৃণার প্রতিফলন। তিনি আমেরিকার ইতিহাসে আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রাপ্য অবস্থান পাইয়ে দিতে চেয়েছেন। জীবনের এতগুলো বছর কাটানোর পরও তিনি জীবন থেকে অবসর নেননি। ছুটে চলেছেন আপন গতিতে। এখনও তিনি দেশব্যাপী ভ্রমণ করেন তার বই সম্পর্কে কথা বলতে, যে বইগুলোতে তিনি নিজের অব্যক্ত কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি সে সকল মানুষদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের কর্ম তাদের আয়ুকে পেছনে ফেলেছে।